কাজী শাহেদ আহমেদের জীবনের মোড়ক উন্মোচন by ড. রফিকুল ইসলাম
কাজী
শাহেদ আহমেদের আত্মকথা ‘জীবনের শিলালিপি’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবের
আমন্ত্রণপত্রের শুরুতে তিনি লিখেছেন, ‘জেনে খুশি হবেন যে, অবশেষে আমার
জীবনীর মোড়ক উন্মোচন হচ্ছে।’ ‘জীবনের শিলালিপি’ গ্রন্থের আর ‘জীবনীর মোড়ক’
উন্মোচন কথার অর্থ অভিন্ন না হলেও দুটির মধ্যে নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে। কাজী
শাহেদ আহমেদ গত তিন দশকের ওপর সময়কাল ধরে নিজেকে যেভাবে
সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মরূপে প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা করেছেন এবং তা লিপিবদ্ধ করার
প্রয়াস পেয়েছেন তার সবটুকু না হলেও অনেকটাই ‘জীবনের শিলালিপি’ গ্রন্থে
খোদাই করে দিয়েছেন। কাজটা সহজ ছিল না। কারণ যখন একজন কর্মবীর তার জীবনের
অভিজ্ঞতা সমাজের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেন বস্তুতপক্ষে তখন তিনি তার
পরিচিত পরিবেশের কাঠগড়ায় নিজেকে দাঁড় করান এবং অলিখিত সব প্রশ্নের জবাব
দিতে থাকেন।
একজন মানুষ পৃথিবীতে জন্ম নেন এবং স্বাভাবিক জীবনে তিনি শৈশব, কৈশোর, যৌবন এবং বার্ধক্যকে অতিক্রম করে যান বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। সেই দীর্ঘ জীবনের স্মৃতি থেকে গ্রহণ বর্জনের মধ্য দিয়ে একজন তার জীবন কথা তুলে ধরেন। এ কাজে জীবনের কোন অভিজ্ঞতাকে তিনি তুলে ধরবেন, কতটা বাদ দেবেন সেটা নির্ভর করে জীবনস্মৃতি রচয়িতা মানুষটির শিক্ষাদীক্ষা, রুচি ও সাহসের ওপর। পাশ্চাত্যে একজন শিল্পী, সাহিত্যিক বা দার্শনিক অবলীলায় তার জীবনের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরতে পারেন, যা পাঠক সহজভাবে গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রাচ্যে বিশেষত আমাদের দেশের সমাজ মানুষের জীবনের অনেক অভিজ্ঞতাকেই প্রকাশ্যে গ্রহণ করতে পারে না। এমন একটা অবস্থায় কাজী শাহেদ আহমেদ তার জীবন স্মৃতিতে শুধু জীবনীর মোড়ক উন্মোচন করেননি, জীবনের আবরণকেও পাঠকের কাছে অনেকটা অপসারণ করেছেন। বিশ শতকের চল্লিশ দশক থেকে শুরু করে একুশ শতকে সূচনাকাল পর্যন্ত ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে যাপিত জীবনের যে চিত্র কাজী শাহেদ আহমেদ এ গ্রন্থে চলচ্চিত্রের মতো তুলে ধরেছেন তা কেবল একজন ব্যক্তির কথাই নয়, একটি পরিবর্তনশীল সময়ের কথাও বটে। এ ক্রান্তিকালের ব্যক্তি ও সমষ্টিগত অভিজ্ঞতাকে কাজী শাহেদ আহমেদ অকপটে বর্ণনা করে গেছেন। বর্ণিত হয়েছে তার পূর্বপুরুষ, শৈশব, শিক্ষাজীবন, সামরিক জীবন বিশেষত একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানে বাঙালি সামরিক অফিসারদের ভয়াবহ দিনগুলোর কথা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের বন্দি শিবিরে আটক যুদ্ধবন্দিদের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তাদের ভাগ্যে যা জুটেছিল সেটাও ছিল অনাকাক্সিক্ষত। সামরিক বাহিনী ছেড়ে দেওয়ার পর কাজী শাহেদ আহমেদের স্বাধীন কর্মজীবন বিশেষত নির্মাণ ও ব্যবসা প্রয়াসের পাশাপাশি সাংবাদিক ও রাজনৈতিক জীবন এবং শিল্পপতিরূপে আত্মপ্রকাশ চমকপ্রদ বললে অত্যুক্তি করা হবে না। কাজী শাহেদ আহমেদের এই দ্বিতীয় জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতাকে তিনি সহজ ও সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন।
পারিবারিক জীবনে কাজী শাহেদ আহমেদ স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ এবং নাতি-নাতনিদের নিয়ে এক অনাবিল আনন্দময় জীবনযাপন করেছেন। যেমনটি তিনি করেছিলেন তার পিতামাতা ও ভাইবোনদের সঙ্গে। এ নিবিড় পারিবারিক বন্ধন তাকে সর্বদা অনুপ্রেরণা ও শক্তি জুগিয়েছে। আর তিনি এক প্রয়াসে এক সফল কর্মময় জীবন গড়ে তুলেছেন, তবে তার উদ্ভাবনী শক্তি এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবিকই বিস্ময়কর। স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নে এমন কিছু সংযোজন করেছেন যা অভিনব। উদাহরণস্বরূপ বিদ্যুতের কংক্রিট পোল, জৈবিক চা বাগান এবং সংবাদপত্র জগতে দৈনিক ‘আজকের কাগজ’ আর আধুনিক উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে ইউনিভার্সিটি আর লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উল্লেখ যথেষ্ট।
কাজী শাহেদ আহমেদের মতো একজন সফল ব্যক্তি যখন তার কর্মময় জীবনের কথা সহজ-সরলভাবে তুলে ধরেন কিংবা পরিণত বয়সে একজন উপন্যাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তখন তার জীবনের রহস্য সমাজের কাছে পরিস্ফুট হয়ে ওঠাটা জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। সেই প্রয়োজন মিটিয়েছে কাজী শাহেদ আহমেদ নিজেই তার ‘জীবনের শিলালিপি’ গ্রন্থের মাধ্যমে। এ গ্রন্থটি প্রকাশের আগে লেখক তার ঘনিষ্ঠ চারজনকে দিয়ে পরিশীলিত করে নিয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু যারা কাজী শাহেদ আহমেদের ‘জীবনের শিলালিপি’ প্রকাশনার আগে পরীক্ষা করে তাদের সতর্ক রায় দিয়েছেন তারা যে কাজী শাহেদ আহমেদের চেয়ে সাহসী নন সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তবুও ওই পরীক্ষকদের সেন্সরশিপ মেনে নিয়ে কাজী শাহেদ আহমেদ যেভাবে নিজেকে প্রকাশ করেছেন তার তুলনা এ সময় আমাদের সমাজেও বিশেষ পাওয়া যাবে না। ‘জীবনের শিলালিপি’ শুধু কাজী শাহেদ আহমেদের নয়, আমাদের দেশের মানুষের জীবনের এক অস্থির সময়ের প্রতিলিপিও বটে।
জীবনের শিলালিপী ।। লেখক কাজী শাহেদ আহমেদ ।। প্রচ্ছদ এ.জি আরিফ ।। প্রকাশক আগামী প্রকাশনী
একজন মানুষ পৃথিবীতে জন্ম নেন এবং স্বাভাবিক জীবনে তিনি শৈশব, কৈশোর, যৌবন এবং বার্ধক্যকে অতিক্রম করে যান বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। সেই দীর্ঘ জীবনের স্মৃতি থেকে গ্রহণ বর্জনের মধ্য দিয়ে একজন তার জীবন কথা তুলে ধরেন। এ কাজে জীবনের কোন অভিজ্ঞতাকে তিনি তুলে ধরবেন, কতটা বাদ দেবেন সেটা নির্ভর করে জীবনস্মৃতি রচয়িতা মানুষটির শিক্ষাদীক্ষা, রুচি ও সাহসের ওপর। পাশ্চাত্যে একজন শিল্পী, সাহিত্যিক বা দার্শনিক অবলীলায় তার জীবনের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরতে পারেন, যা পাঠক সহজভাবে গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রাচ্যে বিশেষত আমাদের দেশের সমাজ মানুষের জীবনের অনেক অভিজ্ঞতাকেই প্রকাশ্যে গ্রহণ করতে পারে না। এমন একটা অবস্থায় কাজী শাহেদ আহমেদ তার জীবন স্মৃতিতে শুধু জীবনীর মোড়ক উন্মোচন করেননি, জীবনের আবরণকেও পাঠকের কাছে অনেকটা অপসারণ করেছেন। বিশ শতকের চল্লিশ দশক থেকে শুরু করে একুশ শতকে সূচনাকাল পর্যন্ত ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে যাপিত জীবনের যে চিত্র কাজী শাহেদ আহমেদ এ গ্রন্থে চলচ্চিত্রের মতো তুলে ধরেছেন তা কেবল একজন ব্যক্তির কথাই নয়, একটি পরিবর্তনশীল সময়ের কথাও বটে। এ ক্রান্তিকালের ব্যক্তি ও সমষ্টিগত অভিজ্ঞতাকে কাজী শাহেদ আহমেদ অকপটে বর্ণনা করে গেছেন। বর্ণিত হয়েছে তার পূর্বপুরুষ, শৈশব, শিক্ষাজীবন, সামরিক জীবন বিশেষত একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানে বাঙালি সামরিক অফিসারদের ভয়াবহ দিনগুলোর কথা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের বন্দি শিবিরে আটক যুদ্ধবন্দিদের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তাদের ভাগ্যে যা জুটেছিল সেটাও ছিল অনাকাক্সিক্ষত। সামরিক বাহিনী ছেড়ে দেওয়ার পর কাজী শাহেদ আহমেদের স্বাধীন কর্মজীবন বিশেষত নির্মাণ ও ব্যবসা প্রয়াসের পাশাপাশি সাংবাদিক ও রাজনৈতিক জীবন এবং শিল্পপতিরূপে আত্মপ্রকাশ চমকপ্রদ বললে অত্যুক্তি করা হবে না। কাজী শাহেদ আহমেদের এই দ্বিতীয় জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতাকে তিনি সহজ ও সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন।
পারিবারিক জীবনে কাজী শাহেদ আহমেদ স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ এবং নাতি-নাতনিদের নিয়ে এক অনাবিল আনন্দময় জীবনযাপন করেছেন। যেমনটি তিনি করেছিলেন তার পিতামাতা ও ভাইবোনদের সঙ্গে। এ নিবিড় পারিবারিক বন্ধন তাকে সর্বদা অনুপ্রেরণা ও শক্তি জুগিয়েছে। আর তিনি এক প্রয়াসে এক সফল কর্মময় জীবন গড়ে তুলেছেন, তবে তার উদ্ভাবনী শক্তি এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবিকই বিস্ময়কর। স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নে এমন কিছু সংযোজন করেছেন যা অভিনব। উদাহরণস্বরূপ বিদ্যুতের কংক্রিট পোল, জৈবিক চা বাগান এবং সংবাদপত্র জগতে দৈনিক ‘আজকের কাগজ’ আর আধুনিক উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে ইউনিভার্সিটি আর লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উল্লেখ যথেষ্ট।
কাজী শাহেদ আহমেদের মতো একজন সফল ব্যক্তি যখন তার কর্মময় জীবনের কথা সহজ-সরলভাবে তুলে ধরেন কিংবা পরিণত বয়সে একজন উপন্যাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তখন তার জীবনের রহস্য সমাজের কাছে পরিস্ফুট হয়ে ওঠাটা জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। সেই প্রয়োজন মিটিয়েছে কাজী শাহেদ আহমেদ নিজেই তার ‘জীবনের শিলালিপি’ গ্রন্থের মাধ্যমে। এ গ্রন্থটি প্রকাশের আগে লেখক তার ঘনিষ্ঠ চারজনকে দিয়ে পরিশীলিত করে নিয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু যারা কাজী শাহেদ আহমেদের ‘জীবনের শিলালিপি’ প্রকাশনার আগে পরীক্ষা করে তাদের সতর্ক রায় দিয়েছেন তারা যে কাজী শাহেদ আহমেদের চেয়ে সাহসী নন সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তবুও ওই পরীক্ষকদের সেন্সরশিপ মেনে নিয়ে কাজী শাহেদ আহমেদ যেভাবে নিজেকে প্রকাশ করেছেন তার তুলনা এ সময় আমাদের সমাজেও বিশেষ পাওয়া যাবে না। ‘জীবনের শিলালিপি’ শুধু কাজী শাহেদ আহমেদের নয়, আমাদের দেশের মানুষের জীবনের এক অস্থির সময়ের প্রতিলিপিও বটে।
জীবনের শিলালিপী ।। লেখক কাজী শাহেদ আহমেদ ।। প্রচ্ছদ এ.জি আরিফ ।। প্রকাশক আগামী প্রকাশনী
No comments