আমি আজ চোর বটে!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার কথা অনেকেরই মনে আছে। মনে আছে, মিথ্যা দেনার দায়ে জমিদার ডিক্রি করে উপেনের দুই বিঘা জমি হাতিয়ে নেন। সেই জমির কথা ভুলতে না পেরে ১৫ থেকে ১৬ বছর পরে উপেন ফিরে আসেন তাঁর হারানো বাড়িতে। প্রাচীরসংলগ্ন পুরোনো আমগাছটির নিচে কুড়িয়ে পান দুটি পাকা আম। এ কারণে জমিদার তাঁকে আম চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। এমনই প্রেক্ষাপটে উপেন আফসোসের সুরে বলেন: ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।’ আমাদের সমাজে ‘ভিকটিমকে’ দোষ দেওয়ার মতো ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে, বিশেষ করে ক্ষমতাধরেরা তা সচরাচরই করে আসছেন।
সম্প্রতি এমন একটি দুঃখজনক অভিজ্ঞতার শিকার আমাকেও হতে হয়েছে। গত কয়েকটি সিটি করপোরেশন ও সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে উপেনের মতো করুণ অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছরের ১৫ জুন বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের প্রাক্কালে অতীতের মতো আমরা ‘সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর উদ্যোগে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের হলফনামার মাধ্যমে এবং তাঁদের আয়কর বিবরণীতে প্রদত্ত তথ্য ভোটারদের অবগতির জন্য প্রকাশ করি। একই সঙ্গে আমরা ‘ভোটার-প্রার্থী মুখোমুখি’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। প্রসঙ্গত, প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৫ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্টের প্রদত্ত আবদুল মোমেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ মামলার রায়ে। রায়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের হলফনামার মাধ্যমে নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, মামলার বিবরণী এবং নিজেদের ও নির্ভরশীলদের আয়-ব্যয়, সম্পদ এবং দায়-দেনার তথ্য মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। পরবর্তী সময়ে অবশ্য সম্পূর্ণ গোপন ও অকল্পনীয় জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে একটি স্বার্থান্বেষী মহল আবু সাফা বলে এক কাল্পনিক ব্যক্তির নামে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। সুজনের অনুসন্ধানী প্রচেষ্টায় এ জালিয়াতির তথ্য উদ্ঘাটিত হয় এবং বহু নাটকীয়তার পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন।
(সর্বোচ্চ আদালতের সম্পৃক্ততায় ঘটিত এ জালিয়াতির ইতিহাস জানতে হলে দেখুন ‘ভূমিকা’, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০৮: অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের তথ্যাবলি প্রথমা প্রকাশন, ২০১০)। প্রসঙ্গত, সুজনের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফলে এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এসব তথ্য প্রদানের ও প্রকাশের বাধ্যবাধকতার উদ্দেশ্য হলো ভোটারদের তথ্য দিয়ে ক্ষমতায়িত করা, যাতে তাঁরা জেনে-শুনে-বুঝে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। উল্লেখ্য, প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য। পিইউসিএল বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া [(২০০৩)৪এসসিসি] মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন যে ‘এ কথা সত্য যে, রাজনৈতিক দলগুলোই নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তবে নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হবে, যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে ভোটাররা না জানে। তাদের ‘এ’ কিংবা ‘বি’-এর পক্ষে ভোট দেওয়ার কোনো ভিত্তি থাকবে না। এ ধরনের নির্বাচন সুষ্ঠুও হবে না, নিরপেক্ষও না।’ আদালত আরও বলেন, ‘গণতন্ত্র যাতে গুন্ডাতন্ত্র (mobocracy) এবং উপহাসে (mockery) বা প্রহসনে (farce) পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ভোটাদের তথ্য পাওয়া জরুরি।’ আমাদের আদালতের রায়েও প্রায় একই ধরনের যুক্তি উত্থাপন করা হয়। চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে যে ১২ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, তাঁদের আটজন ২০০৮ সালের নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে সাতজন ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী, চার বিদায়ী মেয়র যার অন্যতম।
২০০৮ সালের নির্বাচনেও এসব প্রার্থীকে তাঁদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামার মাধ্যমে তথ্য প্রদান করতে হয়েছিল। আমরা সুজনের পক্ষ থেকে সাতজন গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীর ২০০৮ ও ২০১৩ সালে দাখিল করা হলফনামায় অন্তর্ভুক্ত আয় ও সম্পদের তথ্যের তুলনামূলক চিত্র সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করি। প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যায় যে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে চারজন বিদায়ী মেয়রের, যাঁরা সবাই ছিলেন সরকারদলীয়, গড়ে আয় বেড়েছে ৬৭৪৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। অন্যদিকে বাকি তিনজন গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী, যাঁরা বিরোধী দলের এবং এবার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের গড়ে আয় কমেছে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। একই ধরনের প্রবণতা দেখা যায় সম্পদের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ ক্ষমতার সঙ্গে যে জাদুর কাঠি জড়িত, তা প্রকাশিত তথ্য থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়। আমাদের সংবাদ সম্মেলনের পর সরকারদলীয় চার বিদায়ী মেয়রের পক্ষ থেকে সুজন এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করা হয় যে আমরা তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছি। প্রসঙ্গত, সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশিত সব তথ্যই ছিল প্রার্থীদের হলফনামা থেকে নেওয়া এবং এগুলো সম্পূর্ণ সঠিক। এগুলো প্রকাশ করা হয়েছিল প্রার্থীদের সততা-অসততা সম্পর্কে কোনোরূপ মন্তব্য ছাড়াই। অর্থাৎ প্রার্থীদের নিজেদের প্রদত্ত তথ্য প্রকাশ করে আমরা ‘চোর’ বনে গেলাম! সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়েও আমাদের একই ধরনের দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হয়েছে। নির্বাচনের আগে, অতীতের মতো, আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের হলফনামা ও আয়কর বিবরণীতে প্রদত্ত তথ্য সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করি।
এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, ডেপুটি স্পিকার প্রমুখের ২০০৮ ও ২০১৩ সালের হলফনামা ও আয়কর বিবরণীতে প্রদত্ত তথ্যের তুলনামূলক চিত্র আমরা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করি। প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যায়, এসব ক্ষমতাধরের অনেকেরই আয় ও সম্পদ গত পাঁচ বছরে আকাশচুম্বী হয়েছে। উল্লেখ্য, এবারও প্রার্থীদের প্রদত্ত তথ্য তাঁদের সততা-অসততা সম্পর্কে কোনোরূপ মন্তব্য ছাড়াই প্রকাশ করা হয়। প্রসঙ্গত, দাবি করা হয় যে সম্পদের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ গয়না ও জায়গা-জমির মূল্যবৃদ্ধি। এ দাবি সঠিক নয়। কারণ, হলফনামায় গয়না ও জায়গা-জমির ক্ষেত্রে অর্জিত মূল্যই দেখানো হয়। আবার অনেকে এসবের কোনো মূল্যই দেখাননি। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পদ বৃদ্ধির হার অহেতুকভাবে কমে যায়। এ ছাড়া এটি জানা কথা যে অনেকেই তাঁদের হলফনামায় সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। তাই প্রার্থীদের হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রকাশিত সম্পদ বৃদ্ধির হার প্রকৃত সম্পদ বৃদ্ধির হার থেকে কম হতে বাধ্য। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনের পর থেকে আমরা বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছি। বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নিগ্রহের হুমকি ছাড়াও আমরা আইনি লড়াইয়ের মুখোমুখি হচ্ছি। এ পর্যন্ত আমরা একাধিক ‘উকিল নোটিশ’ পেয়েছি, যেগুলোর পেছনে কোনোরূপ যৌক্তিক কারণ নেই। যেমন, আমাদের ক্যালকুলেশন অনুযায়ী, একজন অতি সম্মানিত ব্যক্তির গত পাঁচ বছরে আয় ও সম্পদ বেড়েছে যথাক্রমে ৪,৪৩৫ শতাংশ ও ২৩৮ শতাংশ।
তাঁর উকিল নোটিশে আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির হার সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি। অর্থাৎ আমাদের ক্যালকুলেশনে কোনো ভুল নেই, তবু তিনি আমাদের বিরুদ্ধে তাঁর মানহানি হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। আমরা শুনেছি যে আমাদের এসব তথ্য প্রকাশ এবং গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কিছু বিতর্কিত ব্যক্তি মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন এবং কারও কারও বিরুদ্ধে দুদক ব্যবস্থা নিচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তবে দেশকে সত্যিকারার্থে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে দুদককে শক্তিশালী এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনা করতে হবে। দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সরকারের উচ্চ পদ থেকে সব বিতর্কিতকেও বাদ দিতে হবে। পরিশেষে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কার্যকারিতার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান ও যথার্থ ‘সিস্টেম’ বা পদ্ধতি আবশ্যক। কিন্তু সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিরা এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা না করলে গণতন্ত্র অকার্যকর ও সাধারণ জনগণের জন্য অকল্যাণকর হতে বাধ্য। এ জন্যই সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার এবং নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি করা আবশ্যক। সুজনের প্রচেষ্টায় এবং আদালতের নির্দেশে প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগানোর লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এবং গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের সক্রিয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতাধরদের পক্ষ থেকে রক্তচক্ষু প্রদর্শন ও হয়রানির অবসানের, যা নাগরিক সক্রিয়তার জন্য অপরিহার্য। আমাদের রাজনীতিকে পরিচ্ছন্ন করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে একাধিক উদ্যোগ নিতে হবে। প্রথমত, কমিশনকে হলফনামার ছকটিতে পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন, ছকটিতে প্রার্থীদের ‘প্রাইভেন্ট ইন্টারেস্ট’ ও আয়ের বিস্তারিত উৎস প্রদর্শনের বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিরুদ্ধ হলফনামা প্রদানের বিধান সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তৃতীয়ত, হলফনামার তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে এবং মিথ্যা তথ্য প্রদানকারী ও তথ্য গোপনকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুততার সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রসঙ্গত, হলফ করে মিথ্যা তথ্য দেওয়া ফৌজদারি অপরাধও বটে। চতুর্থত, সাম্প্রতিক নির্বাচনে কিছু ব্যক্তি নির্বাচিত হয়েছেন, যাঁরা সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে নির্বাচিত হওয়ার এবং সাংসদ থাকার অযোগ্য। তাঁদের সাংসদ পদ বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। পঞ্চমত, হলফনামাসহ মনোনয়নপত্র ‘ইলেকট্রনিক ফাইলিং’-এর বিধান করা জরুরি, যাতে তথ্যগুলো দ্রুততার সঙ্গে ভোটারদের কাছে পৌঁছানো যায়।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments