সপ্তাহের হালচাল- তারানকোর সফরের পর কী by আব্দুল কাইয়ুম

জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সমঝোতা চেষ্টা কতটা সফল, তা আজ জানা যাবে। তবে স্বীকার করতেই হবে, তিনি একটি ভালো দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছেন।
কীভাবে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সরকার ও বিরোধীপক্ষের সঙ্গে বারবার দেখা করে ধৈর্য ধরে আলোচনা চালিয়ে যেতে হয়, এটা শেখার বিষয়। শেষ পর্যন্ত কী হয় তা না দেখে তিনি সাংবাদিকদের কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এমনকি দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও তাদের সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে কোনো কথা বলছে না। তারানকোর অনুরোধেই এযাবৎ সব পক্ষ নিশ্চুপ ছিল। এতে অন্তত সমঝোতা আলোচনার প্রতি একধরনের দায়িত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায়।

সরকার ও বিরোধী দল এক অশুভ প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কে কাকে হারাবে। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে না দাঁড়ালে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। আর প্রধানমন্ত্রী তাঁর পদ ছাড়বেন না। সংবিধানের বাইরে যাবেন না। যাঁর যাঁর অবস্থানে অনড় থাকায় কোনো সমঝোতা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। মনে হয় শেষ দেখা দেখে ছাড়বে, এ রকম ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছে দুই পক্ষ।

ওদিকে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রতিদিনই মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। গত ২৬ নভেম্বর থেকে শুরু করে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই সপ্তাহের অবরোধ-হরতালে অন্তত ৬০ জন নিহত হয়েছেন। অনেকে ককটেল ও আগুনে পুড়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁদের মধ্যে হয়তো আরও অনেকে মৃত্যুবরণ করবেন। এঁদের বেশির ভাগই নিরীহ মানুষ। শিশুদের কথা ভাবুন। তাদের কী অপরাধ? জীবনের শুরুতেই তারা নিভে গেল।

নির্বাচন নিয়ে এমন রক্তক্ষয়ী হানাহানি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। নির্বাচন করার জন্যই রাজনৈতিক দল। নির্বাচন না করার জন্য নয়। কিন্তু আমাদের দেশে প্রতি পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা-না করা নিয়ে দেশজুড়ে যে সহিংসতা শুরু হয়, তা দেশবাসী চিরকাল মেনে নেবে না। এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। একদিন সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক হিংসা-হানাহানির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। সেটা হবে ভিন্নমাত্রার আন্দোলন।
এই মুহূর্তে আগুনে পোড়ানো, হত্যা, সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। একটানা অবরোধ, থেমে থেমে হরতালের কর্মসূচির খেলা থামাতে হবে। আর একই সঙ্গে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন, জেল-জুলুম, পুলিশি অভিযানও থামাতে হবে। একটি সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য এটা প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে।

অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে কোনো সমঝোতায় আসা খুব কঠিন। এটা বোধগম্য। কারণ, শেখ হাসিনা যদি বলেন তিনি বিএনপির দাবি মেনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা তাঁদের বিজয় হয়েছে দাবি করে মিছিল বের করবেন। সেখানে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা কম নয়। আওয়ামী লীগ নৈতিক মনোবল হারিয়ে পথে বসবে। নির্বাচনে তাদের জায়গা থাকবে না।
বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া যদি আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী শেখ হাসিনাকেই প্রধানমন্ত্রী পদে রেখে ক্ষমতায় ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা বা অন্য কোনো ফর্মুলায় নির্বাচনে যাওয়ার কথা বলেন, তাহলেও দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতা-কর্মীরা বিজয় ঝান্ডা নিয়ে দেশজুড়ে মাতম শুরু করে দেবেন। বিএনপি নৈতিক মনোবল হারিয়ে বসে পড়বে। নির্বাচনের আগেই পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে কোনো দলের পক্ষে নির্বাচন করা সম্ভব নয়।

সুতরাং দুই দিকেই সমস্যা। যদি এর যেকোনো একটি ফর্মুলা শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া অন্তত ছয়-সাত মাস আগেই মেনে নিতেন, তাহলে এ রকম সমস্যা হতো না। সমঝোতার মাধ্যমে খুব ভালো নির্বাচন হতে পারত। কিন্তু বাংলাদেশ সেই সুযোগ হারিয়েছে। এ জন্য কে দায়ী, আওয়ামী লীগ না বিএনপি, তা নিয়ে বাদানুবাদ হতে পারে। কিন্তু মূল কথা হলো, গণতন্ত্র বিপন্ন। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যতটুকু অর্জন হয়েছিল, তার প্রায় সবটুকুই আজ আমরা হারাতে বসেছি।

কিন্তু তার পরও আমরা আশা ছাড়ব না। নির্বাচন কমিশন বলেছে সমঝোতা হলে তফসিল পরিবর্তন করা সম্ভব। যেহেতু মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয়ে গেছে এবং বেশ কয়েকজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পথে, তাই এই সময় তফসিল পরিবর্তন কঠিন, সন্দেহ নেই, কিন্তু অসাধ্যও নয়। এ জন্য প্রথমে আগের ঘোষিত তফসিলের কার্যকারিতা বাতিল করতে হবে। ২০০৭ সালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজের সময় এভাবেই তফসিল বাতিল করা হয়েছিল। তবে সে সময় জরুরি আইনের সুযোগ নিয়ে এটা করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন তার দরকার নেই। যদি দুই দল ও জোট একমত হয়, তাহলে নতুনভাবে তফসিল ঘোষণা সম্ভব।

কিন্তু তার আগে দরকার সমঝোতা। তারানকো সংবিধানের আওতার মধ্যে থেকেই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কিছুটা খর্ব করে সমঝোতায় পৌঁছানোর প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। এখানেই হয়তো সমাধানসূত্র রয়েছে। যেহেতু কোনো দলের পক্ষেই এককভাবে অপরের দাবি মেনে নিয়ে নির্বাচনে যাওয়া প্রায় অসম্ভব, তাই মাঝামাঝি একটা পথ বের করতে হবে, যেন দুই পক্ষই তাদের অবস্থানে থেকে নির্বাচনে যেতে পারে।
মনে হয় এ রকম সমাধান অসম্ভব। কিন্তু আমাদের সামনেই রয়েছে অনেক উদাহরণ। সমঝোতা ছাড়া ১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর তিন জোটের ঐতিহাসিক রূপরেখা রচিত হতো না। আর সেটা না হলে এরশাদবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানও হতো না। এরপর ১৯৯১ সালে সংসদেই বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ঐতিহাসিক সমঝোতার ভিত্তিতে সংবিধানের একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী গৃহীত হয়। যার ফলে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে। সুতরাং সমঝোতা কোনো অলীক বস্তু নয়।
সরকার যদি একতরফা নির্বাচন করার জন্য অগ্রসর হতে থাকে, তাহলে এর ফল আওয়ামী লীগ বা দেশের জন্য মোটেও ভালো কিছু এনে দিতে পারবে না। অবরোধ-হরতাল চলতেই থাকবে। দেশে অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে। অরাজকতা-বিশৃঙ্খলা দূর করা সরকারের একটি অন্যতম দায়িত্ব। একতরফা নির্বাচন করতে গিয়ে যদি সরকারই দেশকে সেদিকে ঠেলে দেয়, তাহলে তাদের দায় এড়ানো কঠিন হবে।

অন্যদিকে শুধু একতরফা নির্বাচন বন্ধের জন্য একের পর এক হরতাল-অবরোধের পথে অবিচল থাকলে একসময় বিএনপিও জনরোষের মুখে পড়বে। সরকারের ওপর রাগ তো থাকবেই, কিন্তু বিরোধী দলও অবিবেচনাপ্রসূত ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য নিন্দিত ও ঘৃণিত হবে।
বিএনপি যদি ভেবে থাকে যে অবরোধ-হরতাল দিয়ে সরকারকে ফেলে দেবে, তাহলে ভুল করবে। বাংলাদেশের ৪২ বছরের ইতিহাসে শুধু একবার, ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানেই সরকারের পতন হয়েছিল। সেটা সম্ভব হয়েছিল সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সারা দেশের মানুষ ও সব রাজনৈতিক দলের ঐক্যের ফলে। এখন সে অবস্থা নেই। তাই অবরোধের জোরে সরকার ফেলে দেওয়া কঠিন। সে রকম চেষ্টা থেকে বিরত থাকাই ভালো।
অন্যদিকে সরকারকে বুঝতে হবে, এ পর্যন্ত একতরফা নির্বাচন করে কোনো দলই ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। ১৯৮৮ সালে এরশাদ করেছিলেন, দুই বছরও টেকেনি। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে ন্যক্কারজনক পরাজয় মেনে নিয়ে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়েছেন।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া একতরফা নির্বাচন করেছিলেন, দেড় মাসও টেকেনি। নতিস্বীকার করে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়েছে। আজ যদি আওয়ামী লীগ একই চেষ্টা করে, একই করুণ পরিণতি মেনে নিতে হবে। এ দেশের মাটি ও মানুষ একতরফা নির্বাচন চায় না। এ কথা অন্তত আওয়ামী লীগের বুঝতে ভুল হওয়ার কথা নয়। তাদের রয়েছে দীর্ঘ প্রায় ৬৫ বছরের অভিজ্ঞতা। তারা গণতন্ত্রের যে ঐতিহ্য বহন করছে, সেই পথ থেকে বিচ্যুত না হওয়াই ভালো।
তারানকোর সমঝোতা-চেষ্টা সফল হোক আমরা চাই। কিন্তু যদি তা না হয়, তাহলে তিনি যেখানে রেখে যাবেন, সেখান থেকে দুই দলের সমঝোতার উদ্যোগ শুরু করতে হবে। এ জন্য দুই দল একটা যুগপৎ ঘোষণা আজই জারি করুক। সরকার জেল-জুলুম বন্ধ করবে, রাজনৈতিক নেতাদের নিঃশর্ত মুক্তি দেবে আর একই সঙ্গে বিরোধী দল অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহার করবে। আগুন দিয়ে মানুষ মারা বন্ধ করবে। এই যুগপৎ ঘোষণাই হবে সমঝোতার প্রথম পদক্ষেপ।

আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.