জাতীয় নির্বাচন- আইনি বাধা নেই তফসিল পুনর্বিন্যাসে by এম সাখাওয়াত হোসেন
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল মোতাবেক আগামী দশম সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ হচ্ছে ৫ জানুয়ারি ২০১৪।
তফসিল
ঘোষণার মাত্র এক দিন আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, প্রধান বিরোধী
দলকে আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে সরকার যে
প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল, তারই পরিপ্রেক্ষিতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করে তফসিল
ঘোষিত হবে। সমগ্র জাতির চোখ ছিল তখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, আওয়ামী
লীগের সাধারণ সম্পাদকের গোপন আলোচনা নাটকে।
দেশবাসী ধরে নিয়েছিলেন, হয়তো দুই বছর ধরে দুই প্রধান জোটের মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তার সুরাহা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু ছেদ পড়ল নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার সিদ্ধান্তে। যদিও বর্তমান সংবিধান মোতাবেক ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ সালের মধ্যেই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৩(ক) মোতাবেক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
তফসিল মোতাবেক মাত্র সাত দিনের সময় দেওয়া হয়েছিল মনোনয়নপত্র দাখিলের এবং প্রায় ১১ দিন দেওয়া হয়েছে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য। তার মানে এখনো দুই দিন সময় রয়েছে। ১৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হবে প্রচার-প্রচারণা। প্রচার-প্রচারণার সময় দেওয়া হয়েছে প্রায় তিন সপ্তাহ। আইন মোতাবেক ন্যূনতম ১৫ দিন সময় দেওয়া যেতে পারে।
বিরোধী জোট পূর্ব ঘোষণা মোতাবেক তাদের দাবি ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের পুনর্বহাল না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার যে প্রত্যয় নিয়েছে, সেখান থেকে এখনো সরে আসেনি। নির্বাচনের তফসিল বাতিলের দাবিতে তারা আন্দোলন চালাচ্ছে। এই আন্দোলনের সহিংসতায় বহু প্রাণনাশ, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারি দল নির্বাচনে একলা চলো নীতিতে এখনো অটল। এমতাবস্থায় নির্বাচন নিয়ে গভীর সংকটে রয়েছে দেশ।
অন্যদিকে অব্যাহত রয়েছে সরকারি দল ও জোটের সংশোধিত সংবিধানের ধারা ১২৩(৩) এবং ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনের প্রস্তুতি। ইতিমধ্যেই মনোনয়ন বাছাইয়ের পর সাতজন প্রার্থীকে, যাঁদের মধ্যে বর্তমান মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীই বেশি, একক মনোনয়নদাতা হিসেবে রিটার্নিং কর্মকর্তারা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ১৯(১) অনুযায়ী বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেছে। তথ্যে প্রকাশ, আরও ৩৩ জন প্রার্থী কমিশনের আপিল শুনানির পর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত বলে বিবেচিত হতে পারে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
ইতিমধ্যেই জাতীয় পার্টি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা এবং প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণার পর সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। জাতীয় পার্টি যদি দলীয় প্রার্থীদের প্রত্যাহার করে নেয়, তবে সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ এবং জোটভুক্ত কয়েকটি ছোট দল ছাড়া নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলসহ সিংহভাগ দল অংশগ্রহণ করছে না। নির্বাচন হবে একতরফা।
এরই আবর্তে সৃষ্ট গভীর সংকট নিরসনে দেশ-বিদেশের যত তৎপরতা। এমন তৎপরতা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। নির্বাচন নিয়ে এত বড় ধরনের সংকট ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। এমনকি ২০০৬ সালের সংকট থেকেও জটিল। এমতাবস্থায় দুই প্রধান জোটের মধ্যে সমঝোতার মধ্যস্থতায় বেশ কয়েক মাস ধরে গৃহীত দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। অবশেষে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিতে তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশ সফরে রয়েছেন। উভয় জোট, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, সুশীল সমাজ এবং নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে তিনি একাধিকবার বৈঠক করেছেন সমাধানের খোঁজে।
অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের একপর্যায়ে নির্বাচন পেছানোর অনুরোধ জানালে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত বলে মন্তব্য করেন। তদনুযায়ী মি. তারানকো প্রধান নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এ বিষয়ে একাধিকবার আলোচনাও করেন। তথ্যমতে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছেন, সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলে কিছু জটিলতা থাকলেও বিষয়টি সম্ভব হতে পারে, তবে তা এমনভাবে করতে হবে যাতে ২৪ জানুয়ারি ২০১৪-এর মধ্যেই হতে হবে। ইতিপূর্বে জাতীয় পার্টিও মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিন তফসিল ১০ দিন পেছানোর অনুরোধ রাখলেও নির্বাচন কমিশন গুরুত্ব দেয়নি। সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে না বলে জানিয়েছেন এইচ এম এরশাদ।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নির্বাচনের তফসিলে রদবদলই এখন মুখ্য আলোচ্য বিষয়। অবশ্য এই রদবদলেও প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনমুখী হবে কি না, তা নিশ্চিত নয়। বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে, এ পর্যায়ে নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনে তফসিল পরিবর্তন করতে পারে কি না? দ্বিতীয় প্রশ্ন উঠেছে, যদি সব দল অংশগ্রহণে রাজি হয় এবং তফসিল পুনর্নির্ধারিত হয়, তবে যাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এখনই নির্বাচিত বলে ঘোষিত হয়েছেন, তাঁদের আইনগত অবস্থান কী হতে পারে? আর যদি এ ধরনের সমঝোতা ১৩ ডিসেম্বরের পরে হয় এবং তত দিনে জাতীয় পার্টির অবস্থানে পরিবর্তন না আনলে হয়তো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতের সংখ্যা দুই গুণ বা ততোধিক বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে এত বেশিসংখ্যক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের আইনি অবস্থান কী হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর নির্বাচন কমিশনের দেওয়ার কথা, যদিও সেখানেও দ্বিমত রয়েছে বলে খবরে প্রকাশ।
যা-ই হোক, অভিজ্ঞতার এবং বিদ্যমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর আওতায় আমি এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি। প্রথমত, নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ বা আরপিও ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ১১(১) অনুযায়ী ৩০০ আসনে একই দিনে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। ওই অনুচ্ছেদ বা আরপিও ১৯৭২-এর অন্য কোথাও ঘোষিত তফসিল পুনর্নির্ধারণকরণ বারিত করা হয়নি। এরই আলোকে তফসিল, সংগত কারণে পুনর্নির্ধারণ করার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। তবে পুনঃ তফসিলে ভোট গ্রহণের
দিন সংবিধানে উল্লেখ্য সময়ের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হতে হবে, যদি না পরিস্থিতি অন্য কোনো দিকে মোড় নেয়। যেমন ১১ জানুয়ারি ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাধ্যমে ২২ জানুয়ারি ২০০৭ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন রহিত করা হয়েছিল। ওই নির্বাচন প্রায় দুই বছর পর পুনঃ তফসিলের আওতায় অনুষ্ঠিত হয় ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে।
২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগেও বর্তমান বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তিনবার তফসিল পুনর্নির্ধারণ করতে হয়েছিল। ওই সময় জরুরি অবস্থার প্রেক্ষাপটে সংবিধানে নির্ধারিত নির্বাচনের সময়ের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও তৎকালীন নির্বাচন কমিশন ঘোষিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত ও গৃহীত সময়সীমা ৩১ ডিসেম্বর ২০০৮ সালের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার একধরনের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে ছিল। ওই সময় ২ নভেম্বর ২০০৮ সালে প্রথমবার তফসিল ঘোষণা করে প্রথমে ১৮ ডিসেম্বর, পরে দুবার পিছিয়ে ২৪ ডিসেম্বর ও ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮-এ ভোট গ্রহণের দিন পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে এসব পরিবর্তন মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময়ের মধ্যেই করা হয়েছিল বলে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। অনস্বীকার্য যে বর্তমান পরিস্থিতি আরও জটিল, তবে সমাধান নির্বাচন কমিশন ও আইনের আওতাতেই রয়েছে। ২০০৮ সালের আগেও নির্বাচনী তফসিলে কয়েকবার পরিবর্তন আনার নজির রয়েছে।
দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি অনেকেই উত্থাপন করেছেন বলে প্রকাশ তা হলো, ইতিমধ্যে যাঁদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে, তাঁদের অবস্থান তফসিল পুনর্নির্ধারিত হলে কী হবে? যেমনটা আগেই বলেছি, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৩ সালের পরে জাতীয় পার্টির বর্তমান অবস্থান অপরিবর্তিত থাকলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতের সংখ্যা অতীত রেকর্ড ছাড়াবে। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমাধান সাপেক্ষে তফসিল পুনর্নির্ধারিত হলে আইনি জটিলতা হবে কি না? এর সোজাসাপটা উত্তর হলো, ওই অবস্থায় পুনঃ তফসিল হলে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় থেকে ভোট গ্রহণের দিন পর্যন্ত পরিবর্তন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাঁরা বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন বা হবেন, তাঁদের পক্ষে জারি করা গণবিজ্ঞপ্তিও কার্যকারিতা হারাবে। এখানে উল্লেখ্য, আরপিওর অনুচ্ছেদ ৩৯(৪) অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গেজেট প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত একজন সংসদ সদস্য সরকারিভাবে নির্বাচিত বলে বিবেচিত হবেন না।
উল্লেখ্য, সরকারি গেজেট প্রকাশের পর সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৮(২)(ক) অনুযায়ী তিন দিনের মধ্যে নবনির্বাচিত সদস্যদের শপথপাঠের মধ্য দিয়েই পূর্ণাঙ্গ সংসদ সদস্য হিসেবে বিবেচিত হবেন। কাজেই গেজেট প্রকাশনা এবং শপথের বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় থাকে। আরও উল্লেখ্য, ৫ জানুয়ারি ২০১৩ সালে এককভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হলেও উল্লিখিত সংবিধানের ধারার বাধ্যবাধকতার কারণে ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ সালের পর সরকারি গেজেট প্রকাশ করতে হবে। একজন সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর কত দিনের মধ্যে গেজেট প্রকাশ করতে হবে, তেমন বাধ্যবাধকতা আইনের দ্বারা নির্বাচন কমিশনের ওপর অর্পিত নেই। এমনই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি বাতিল হয়ে যাওয়া নির্বাচনকালেও। ওই সময় ১৭ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হলেও পুরো নির্বাচন সম্পন্ন না হওয়ায় আইনগত কারণে গেজেট করা হয়নি, যা পরে তফসিল বাতিলের মাধ্যমে ওই সব সদস্যপদের বেসরকারি ঘোষণাও বাতিল করা হয়েছিল।
যা-ই হোক, ওপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান যে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলে এবং সংবিধানের ১২৩(৩)(ক)-এর অনুচ্ছেদের আওতায় পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সংবিধানে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন হলেও তফসিল পুনর্নির্ধারণ করার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে। সম্ভাব্য সমঝোতার প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত ক্ষেত্রে যদি ১২৩(৩)(খ) অনুচ্ছেদের আওতায় সর্বদলীয় নির্বাচন হয়, সে ক্ষেত্রে বর্তমান তফসিল বাতিল করে পুনঃ তফসিল ঘোষণা করতে হবে। ওই পরিস্থিতিতে মনোনয়নপত্র নতুনভাবে দাখিল করতে হবে। এর প্রধান কারণ হবে, সংসদ বিলুপ্ত হলে বর্তমান সাংসদদের সদস্যপদের মেয়াদও উত্তীর্ণ হবে। অন্যদিকে বর্তমান তফসিল বহাল রেখে শুধু পুনঃ তফসিল হলে বাছাইয়ে উত্তীর্ণ হওয়া প্রার্থীর প্রার্থিতা বহাল থাকতে পারে, যদি না সম্ভাব্য প্রার্থীর দল পরিবর্তন আনতে ইচ্ছা প্রকাশ করে।
সংগত কারণে বর্তমান তফসিলের পরিবর্তন এবং ওই তফসিলে এখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোর পুনর্বিবেচনার এখতিয়ার সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের বিবেচ্য বিষয় এবং কমিশনের সিদ্ধান্তে সংবিধান ও আইনের আওতায় সিদ্ধ বলে বিবেচিত হবে।
এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.): অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।
hhintlbd@yahoo.com
দেশবাসী ধরে নিয়েছিলেন, হয়তো দুই বছর ধরে দুই প্রধান জোটের মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তার সুরাহা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু ছেদ পড়ল নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার সিদ্ধান্তে। যদিও বর্তমান সংবিধান মোতাবেক ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ সালের মধ্যেই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৩(ক) মোতাবেক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
তফসিল মোতাবেক মাত্র সাত দিনের সময় দেওয়া হয়েছিল মনোনয়নপত্র দাখিলের এবং প্রায় ১১ দিন দেওয়া হয়েছে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য। তার মানে এখনো দুই দিন সময় রয়েছে। ১৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হবে প্রচার-প্রচারণা। প্রচার-প্রচারণার সময় দেওয়া হয়েছে প্রায় তিন সপ্তাহ। আইন মোতাবেক ন্যূনতম ১৫ দিন সময় দেওয়া যেতে পারে।
বিরোধী জোট পূর্ব ঘোষণা মোতাবেক তাদের দাবি ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের পুনর্বহাল না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার যে প্রত্যয় নিয়েছে, সেখান থেকে এখনো সরে আসেনি। নির্বাচনের তফসিল বাতিলের দাবিতে তারা আন্দোলন চালাচ্ছে। এই আন্দোলনের সহিংসতায় বহু প্রাণনাশ, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারি দল নির্বাচনে একলা চলো নীতিতে এখনো অটল। এমতাবস্থায় নির্বাচন নিয়ে গভীর সংকটে রয়েছে দেশ।
অন্যদিকে অব্যাহত রয়েছে সরকারি দল ও জোটের সংশোধিত সংবিধানের ধারা ১২৩(৩) এবং ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনের প্রস্তুতি। ইতিমধ্যেই মনোনয়ন বাছাইয়ের পর সাতজন প্রার্থীকে, যাঁদের মধ্যে বর্তমান মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীই বেশি, একক মনোনয়নদাতা হিসেবে রিটার্নিং কর্মকর্তারা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ১৯(১) অনুযায়ী বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেছে। তথ্যে প্রকাশ, আরও ৩৩ জন প্রার্থী কমিশনের আপিল শুনানির পর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত বলে বিবেচিত হতে পারে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
ইতিমধ্যেই জাতীয় পার্টি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা এবং প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণার পর সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। জাতীয় পার্টি যদি দলীয় প্রার্থীদের প্রত্যাহার করে নেয়, তবে সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ এবং জোটভুক্ত কয়েকটি ছোট দল ছাড়া নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলসহ সিংহভাগ দল অংশগ্রহণ করছে না। নির্বাচন হবে একতরফা।
এরই আবর্তে সৃষ্ট গভীর সংকট নিরসনে দেশ-বিদেশের যত তৎপরতা। এমন তৎপরতা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। নির্বাচন নিয়ে এত বড় ধরনের সংকট ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। এমনকি ২০০৬ সালের সংকট থেকেও জটিল। এমতাবস্থায় দুই প্রধান জোটের মধ্যে সমঝোতার মধ্যস্থতায় বেশ কয়েক মাস ধরে গৃহীত দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। অবশেষে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিতে তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশ সফরে রয়েছেন। উভয় জোট, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, সুশীল সমাজ এবং নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে তিনি একাধিকবার বৈঠক করেছেন সমাধানের খোঁজে।
অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের একপর্যায়ে নির্বাচন পেছানোর অনুরোধ জানালে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত বলে মন্তব্য করেন। তদনুযায়ী মি. তারানকো প্রধান নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এ বিষয়ে একাধিকবার আলোচনাও করেন। তথ্যমতে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছেন, সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলে কিছু জটিলতা থাকলেও বিষয়টি সম্ভব হতে পারে, তবে তা এমনভাবে করতে হবে যাতে ২৪ জানুয়ারি ২০১৪-এর মধ্যেই হতে হবে। ইতিপূর্বে জাতীয় পার্টিও মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিন তফসিল ১০ দিন পেছানোর অনুরোধ রাখলেও নির্বাচন কমিশন গুরুত্ব দেয়নি। সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে না বলে জানিয়েছেন এইচ এম এরশাদ।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নির্বাচনের তফসিলে রদবদলই এখন মুখ্য আলোচ্য বিষয়। অবশ্য এই রদবদলেও প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনমুখী হবে কি না, তা নিশ্চিত নয়। বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে, এ পর্যায়ে নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনে তফসিল পরিবর্তন করতে পারে কি না? দ্বিতীয় প্রশ্ন উঠেছে, যদি সব দল অংশগ্রহণে রাজি হয় এবং তফসিল পুনর্নির্ধারিত হয়, তবে যাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এখনই নির্বাচিত বলে ঘোষিত হয়েছেন, তাঁদের আইনগত অবস্থান কী হতে পারে? আর যদি এ ধরনের সমঝোতা ১৩ ডিসেম্বরের পরে হয় এবং তত দিনে জাতীয় পার্টির অবস্থানে পরিবর্তন না আনলে হয়তো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতের সংখ্যা দুই গুণ বা ততোধিক বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে এত বেশিসংখ্যক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের আইনি অবস্থান কী হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর নির্বাচন কমিশনের দেওয়ার কথা, যদিও সেখানেও দ্বিমত রয়েছে বলে খবরে প্রকাশ।
যা-ই হোক, অভিজ্ঞতার এবং বিদ্যমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর আওতায় আমি এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি। প্রথমত, নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ বা আরপিও ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ১১(১) অনুযায়ী ৩০০ আসনে একই দিনে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। ওই অনুচ্ছেদ বা আরপিও ১৯৭২-এর অন্য কোথাও ঘোষিত তফসিল পুনর্নির্ধারণকরণ বারিত করা হয়নি। এরই আলোকে তফসিল, সংগত কারণে পুনর্নির্ধারণ করার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। তবে পুনঃ তফসিলে ভোট গ্রহণের
দিন সংবিধানে উল্লেখ্য সময়ের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হতে হবে, যদি না পরিস্থিতি অন্য কোনো দিকে মোড় নেয়। যেমন ১১ জানুয়ারি ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাধ্যমে ২২ জানুয়ারি ২০০৭ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন রহিত করা হয়েছিল। ওই নির্বাচন প্রায় দুই বছর পর পুনঃ তফসিলের আওতায় অনুষ্ঠিত হয় ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে।
২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগেও বর্তমান বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তিনবার তফসিল পুনর্নির্ধারণ করতে হয়েছিল। ওই সময় জরুরি অবস্থার প্রেক্ষাপটে সংবিধানে নির্ধারিত নির্বাচনের সময়ের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও তৎকালীন নির্বাচন কমিশন ঘোষিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত ও গৃহীত সময়সীমা ৩১ ডিসেম্বর ২০০৮ সালের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার একধরনের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে ছিল। ওই সময় ২ নভেম্বর ২০০৮ সালে প্রথমবার তফসিল ঘোষণা করে প্রথমে ১৮ ডিসেম্বর, পরে দুবার পিছিয়ে ২৪ ডিসেম্বর ও ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮-এ ভোট গ্রহণের দিন পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে এসব পরিবর্তন মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময়ের মধ্যেই করা হয়েছিল বলে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। অনস্বীকার্য যে বর্তমান পরিস্থিতি আরও জটিল, তবে সমাধান নির্বাচন কমিশন ও আইনের আওতাতেই রয়েছে। ২০০৮ সালের আগেও নির্বাচনী তফসিলে কয়েকবার পরিবর্তন আনার নজির রয়েছে।
দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি অনেকেই উত্থাপন করেছেন বলে প্রকাশ তা হলো, ইতিমধ্যে যাঁদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে, তাঁদের অবস্থান তফসিল পুনর্নির্ধারিত হলে কী হবে? যেমনটা আগেই বলেছি, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৩ সালের পরে জাতীয় পার্টির বর্তমান অবস্থান অপরিবর্তিত থাকলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতের সংখ্যা অতীত রেকর্ড ছাড়াবে। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমাধান সাপেক্ষে তফসিল পুনর্নির্ধারিত হলে আইনি জটিলতা হবে কি না? এর সোজাসাপটা উত্তর হলো, ওই অবস্থায় পুনঃ তফসিল হলে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় থেকে ভোট গ্রহণের দিন পর্যন্ত পরিবর্তন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাঁরা বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন বা হবেন, তাঁদের পক্ষে জারি করা গণবিজ্ঞপ্তিও কার্যকারিতা হারাবে। এখানে উল্লেখ্য, আরপিওর অনুচ্ছেদ ৩৯(৪) অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গেজেট প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত একজন সংসদ সদস্য সরকারিভাবে নির্বাচিত বলে বিবেচিত হবেন না।
উল্লেখ্য, সরকারি গেজেট প্রকাশের পর সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৮(২)(ক) অনুযায়ী তিন দিনের মধ্যে নবনির্বাচিত সদস্যদের শপথপাঠের মধ্য দিয়েই পূর্ণাঙ্গ সংসদ সদস্য হিসেবে বিবেচিত হবেন। কাজেই গেজেট প্রকাশনা এবং শপথের বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় থাকে। আরও উল্লেখ্য, ৫ জানুয়ারি ২০১৩ সালে এককভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হলেও উল্লিখিত সংবিধানের ধারার বাধ্যবাধকতার কারণে ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ সালের পর সরকারি গেজেট প্রকাশ করতে হবে। একজন সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর কত দিনের মধ্যে গেজেট প্রকাশ করতে হবে, তেমন বাধ্যবাধকতা আইনের দ্বারা নির্বাচন কমিশনের ওপর অর্পিত নেই। এমনই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি বাতিল হয়ে যাওয়া নির্বাচনকালেও। ওই সময় ১৭ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হলেও পুরো নির্বাচন সম্পন্ন না হওয়ায় আইনগত কারণে গেজেট করা হয়নি, যা পরে তফসিল বাতিলের মাধ্যমে ওই সব সদস্যপদের বেসরকারি ঘোষণাও বাতিল করা হয়েছিল।
যা-ই হোক, ওপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান যে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলে এবং সংবিধানের ১২৩(৩)(ক)-এর অনুচ্ছেদের আওতায় পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সংবিধানে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন হলেও তফসিল পুনর্নির্ধারণ করার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে। সম্ভাব্য সমঝোতার প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত ক্ষেত্রে যদি ১২৩(৩)(খ) অনুচ্ছেদের আওতায় সর্বদলীয় নির্বাচন হয়, সে ক্ষেত্রে বর্তমান তফসিল বাতিল করে পুনঃ তফসিল ঘোষণা করতে হবে। ওই পরিস্থিতিতে মনোনয়নপত্র নতুনভাবে দাখিল করতে হবে। এর প্রধান কারণ হবে, সংসদ বিলুপ্ত হলে বর্তমান সাংসদদের সদস্যপদের মেয়াদও উত্তীর্ণ হবে। অন্যদিকে বর্তমান তফসিল বহাল রেখে শুধু পুনঃ তফসিল হলে বাছাইয়ে উত্তীর্ণ হওয়া প্রার্থীর প্রার্থিতা বহাল থাকতে পারে, যদি না সম্ভাব্য প্রার্থীর দল পরিবর্তন আনতে ইচ্ছা প্রকাশ করে।
সংগত কারণে বর্তমান তফসিলের পরিবর্তন এবং ওই তফসিলে এখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোর পুনর্বিবেচনার এখতিয়ার সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের বিবেচ্য বিষয় এবং কমিশনের সিদ্ধান্তে সংবিধান ও আইনের আওতায় সিদ্ধ বলে বিবেচিত হবে।
এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.): অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।
hhintlbd@yahoo.com
No comments