শুভবুদ্ধির উদয় হোক by সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক
বিরাজমান উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে
সামনে কী হবে বা হতে পারে, তা নিয়ে গভীর উৎকণ্ঠায় রয়েছে পুরো দেশ।
পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত সংবাদ ও কলাম পড়ছি। টেলিভিশনের টকশোগুলোতে বিভিন্ন
আলোচনা শুনছি। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়েই আলোচনা হচ্ছে বেশি। সাধারণ
মানুষের ভাষ্য হচ্ছে, তারা এই অস্থিরতা থেকে পরিত্রাণ চায়। কিন্তু
পরিত্রাণের কোনো পথ মানুষ দেখছে না। সরকার ও বিরোধী পক্ষের অনেকেই বলছেন,
বর্তমান রাজনৈতিক সহিংসতার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দমন করতে হবে। সাধারণ
নাগরিকরা সর্বদাই বলছেন, সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। বর্তমানে যে রাজনৈতিক
সহিংসতা চলছে তার দুটি দিক রয়েছে। ১. সরকার পক্ষ বলছে, যুদ্ধাপরাধীদের
বিচার প্রক্রিয়া বানচাল করার জন্য বিরোধী দল এবং তাদের সহযোগীরা এই সহিংসতা
চালাচ্ছে। সরকারি দলের বাইরে যারা আছেন কিন্তু বিরোধী শিবিরেও প্রকাশ্যে
নেই, তারা বলছেন, সরকারি ও বিরোধী শিবিরের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই নিয়ে সহিংসতা
বাড়ছে। ২. সরকার নিজেদের বাহিনী ও রাজনৈতিক ক্যাডারদের দিয়ে দমনপীড়ন
চালানোর মাধ্যমে সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে। বহু ক্ষেত্রেই সরকারি বাহিনী বা
সরকারি দলের লোকেরা সহিংসতা ঘটিয়ে বিরোধী শিবিরের ওপর বদনাম চাপিয়ে দিচ্ছে।
এরূপ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে পর্যবেক্ষকদের মত হল, সরকার এটা পরিকল্পিতভাবেই চেয়েছিল। কারণ সরকার ভেবেছিল, যুদ্ধাপরাধের বিচার ও অরাজক পরিস্থিতির বিষয়টি সামনে এনে জনগণের খুব কাছে যেতে পারবে এবং এমন পরিস্থিতি নির্বাচনের জন্য তাদের সহায়ক হবে। ক্ষমতাসীন দল তিন বছর আগে থেকেই তাদের এ পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। তিন বছর আগে তারা যখন রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত ছিল, তখন তারা ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের বা ২০১৪ সালের জানুয়ারির কথা মাথায় রেখেই কৌশল নির্ধারণ ও পরিকল্পনা করেছিল। তাদের মূল্যায়নে প্রধান বিষয় ছিল, আবার ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কী কী বাধা আসতে পারে এবং সেগুলো থেকে কিভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়। ক্ষমতাসীন দল আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিল, ভারতপ্রীতি ও মন্ত্রীদের প্রশ্নাতীত দুর্নীতির কারণে তাদের জনসমর্থন কমবে। সুতরাং সে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের বিষয়টি মাথায় রেখেই তারা সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দেন। সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করলে রাজনৈতিক অঙ্গন অস্থির হয়ে উঠবে, এটাও তারা ভালো করেই জানতেন। সুতরাং পরিকল্পনা করেই ও প্রস্তুতি নিয়েই তারা মাঠে নেমেছেন। অথচ সংবিধান সংশোধনের আগে ক্ষমতাসীন দল বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও আলাপচারিতায় তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির পক্ষে বক্তব্য দিয়ে গেছে। এটা যে জনসমর্থন পাওয়ার জন্য তা বেশ স্পষ্ট এবং পরবর্তী সময়ে সেটি বাতিল করলে পানি ঘোলা হবে, সেই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা সহজ হবে, এটাও তারা জানতেন। আর জেনেশুনেই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের মাধ্যমে প্রদত্ত একটি মৌখিক রায়ের উসিলায় তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিকে সংবিধান থেকে মুছে দেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গটি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ ছিল, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিলের বিষয়টির উল্লেখ ছিল না। ২০১১ সালের মাঝামাঝিতে পাস করা পঞ্চদশ সংশোধনী দ্বারা শুধু তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিই বাতিল করা হয়নি, সংবিধানের আরও অনেক মৌলিক বিষয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ পরিবর্তনগুলোও অস্থিরতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
সরকার জনগণকে; মিডিয়াকর্মী, পত্রিকার কলাম লেখক ও টকশোয় অংশগ্রহণকারীদের ব্যস্ত রাখার জন্য এমন কিছু বিষয়ের অবতারণা করতে থাকে, যাতে সবাই মূল বিষয় থেকে দূরে থাকে। কারণ নির্বাচনের আগে মানুষ সরকারের কর্মকাণ্ডগুলোর মূল্যায়ন করবে। সরকারের দুর্নীতি ও ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করবে। এতে করে স্বাভাবিকভাবেই সরকারের জনসমর্থন কমবে। তাই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল পরিকল্পনা করে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টি করাল যাতে করে ওগুলো নিয়ে মানুষ ব্যস্ত থাকে। এর কিছুদিন পর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামকে মহাসমাবেশ করার অনুমতি দেয় এবং নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ এনে র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সমন্বয়ে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। এ ঘটনাটিও সরকার ঘটিয়েছে যাতে করে হেফাজতে ইসলাম নিয়ে বেশ কিছুদিন মানুষ ব্যস্ত থাকে। সুতরাং অফিস-আদালতে, পথেঘাটে, চায়ের দোকানে আলোচনার বিষয়বস্তু পাল্টে গেছে। গত পাঁচ-ছয় মাস যাবত কোথাও পদ্মা সেতুর দুর্নীতি, হলমার্ক-ডেসটিনি কেলেংকারি, বিসমিল্লাহ গ্র“পের ঋণ জালিয়াতি, শেয়ার মার্কেটের মহাদুর্নীতি এবং রেলমন্ত্রীর কালো বিড়াল নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। মিডিয়া থেকেও এসব বিষয় প্রায় উধাও হয়ে গেছে। সরকারপন্থী মিডিয়াগুলো সরকারের এরূপ পরিকল্পনায় প্রভূত সহযোগিতা করে। ২০১৩ সালের শেষাংশে যেরূপ পরিস্থিতি আমরা দেখছি, সেরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এমনটি সরকার আগেই কল্পনা করে নিয়েছিল। রাজনৈতিক যুদ্ধে মিডিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য, এটা স্বীকার করেই সরকার তাদের অনুগত কিছু ব্যক্তিকে টেলিভিশন লাইসেন্স প্রদান করেছিল। সেই টেলিভিশনগুলো নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন ও মূল্যায়ন করতে চেষ্টা করলেও সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার কারণে যথার্থ নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত পাঁচ-ছয় মাস যাবত অব্যাহতভাবে বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং বিরোধী দলের উদ্দেশে বেশিরভাগ সময় আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা বলছেন, যার কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একটি শোভনীয় বা সহনশীল আবহ সৃষ্টি হয়নি। সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে বিরোধের মূল জায়গাটি জনগণের কাছে অস্পষ্ট রাখার বিষয়ে সরকার দক্ষতা দেখিয়েছে। সরকার চাচ্ছে, তাদের দলীয় সরকারের অধীনে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরই অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিরোধী দল চাচ্ছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরূপ পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষকে কাছাকাছি আনার জন্য প্রায় সমগ্র বিশ্ব চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে কোনো ফল মেলেনি।
এবার একটু ব্যতিক্রমী প্রসঙ্গে আসি। গত প্রায় দশ দিন ধরে বিভিন্ন দৈনিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা তাদের হলফনামায় নিজেদের সম্পর্কে যে বিবরণ দিয়েছেন, সে বিবরণ দেখে মানুষের চক্ষু প্রায় চড়কগাছ! আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সম্পদের বিবরণ দেখে এটা বেশ সহজেই অনুমেয় তারা কী পরিমাণ দুর্নীতি করছেন। অনেকে মন্তব্য করেছেন, আমরা প্রার্থীদের সম্পদ গড়ার দুর্নীতির যে বিবরণ পাচ্ছি, সেটি একটি সামান্য অংশ মাত্র। কারণ হলফনামায় কেউই তার দুর্নীতির পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করবে না। অতএব সেই প্রকাশিত ক্ষুদ্র অংশটিই যদি এত মারাত্মক ও ভয়ংকর হয়, তাহলে পূর্ণ অংশটি কত ভয়ংকর ও মারাত্মক হতে পারে? বিষয়টি খুব সহজেই অনুমেয়। মহাজোট সরকারকে অনেকেই এখন মহাদুর্নীতিবাজ সরকার বলে সম্বোধন করছেন। আরও আশ্চর্যের বিষয়, প্রার্থীদের হলফনামাগুলো যেন জনসমক্ষে প্রকাশ করা না হয় সেজন্য ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করেছে। কেননা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের দুর্নীতির চিত্র জনসমক্ষে প্রকাশ পেয়ে গেলে সাজানো নির্বাচনের সাজানো হাওয়ার দিক বদলে যেতে পারে। অনেকে রসিকতা করে বলছেন, এতদিন একটি কালো বিড়ালের গল্প জানতাম, আওয়ামী লীগে যে এত কালো বিড়ালের জন্ম হয়েছে, আমরা সেটা জানতাম না! স্বাধীন চেতনাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে, দায়িত্ববোধকে বিসর্জন দিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের অনুরোধ রক্ষা করেছে এবং দুর্নীতির চিত্রগুলো তাদের ওয়েবসাইট থেকে গায়েব করে ফেলেছে। অর্থাৎ এভাবে তারা দুর্নীতিবাজদের সহায়তা করছেন। জনগণের জানার অধিকারকে খর্ব করছেন।
যাই হোক, ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলকে দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে এতটাই কোণঠাসা করে রেখেছে যে, তারা রাজপথে আন্দোলন করার কোনো সুযোগই পাচ্ছেন না, যা গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের নামান্তর বললে কম বলা হবে। আজ ২৯ ডিসেম্বর মার্চ ফর ডেমোক্রেসির সমাবেশের ওপর সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সরকার কোনো আইন-কানুন, রেওয়াজের তোয়াক্কা না করে আইন-শৃংখলা বাহিনী দিয়ে যেসব কাজ করিয়েছে, তা দেখে মানুষ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা ভুলে গেছে। সহিংসতার কারণে মানুষ মারা যাচ্ছে, সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে, অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। এরূপ পরিস্থিতিতে সামনে আরও কঠোর আন্দোলনের কথা বলা হয়েছে বিরোধী শিবিরের পক্ষ থেকে। এরপর থেকে সরকারদলীয় বুদ্ধিজীবীরা বলতে শুরু করলেন, বিরোধী দল দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে অগ্রগতি বন্ধ করে দিচ্ছে, বিরোধী দল মানুষ মারছে ইত্যাদি। সরকার কর্তৃক আনীত অভিযোগগুলো প্রতিহিংসামূলক। কারণ বিরোধী দল দীর্ঘদিন ধরে শান্তিপূর্ণভাবে যে দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে পেশ করে আসছে, তার প্রতি সরকার কোনোভাবেই কর্ণপাত করেনি। যদি করত তাহলে দেশবাসীকে আজকের অস্থির রাজনীতি দেখতে হতো না। বিরোধী দলের দাবি অযৌক্তিক নয়। নিরপেক্ষ-নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চাওয়া অবশ্যই গণতান্ত্রিক অধিকার। বরং সরকারই এ দাবিকে অস্বীকার করে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। আর সরকারের এরূপ নিরপেক্ষহীনতা এবং পরিকল্পিত কিছু কর্মকাণ্ডের কারণেই দেশে এ অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। সুতরাং দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আনতে হলে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।
পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত ছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পাশে কেউ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ কেউই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর পাশে নেই। কোন সাহসে তিনি এগোচ্ছেন? অদৃশ্য এমন কী কারণ রয়েছে যার ওপর নির্ভর করে তিনি কাউকেই তোয়াক্কা করছেন না? একজনমাত্র সতীর্থকে নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছা দুষ্কর। বিষয়টি তিনি নিজেও বেশ ভালো করেই জানেন। তারপরও কেন ঢাল-তলোয়ারহীন অবস্থায় দুস্তর পারাপারে যাত্রা করেছেন, আমার জানা নেই। আমার আবেদন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেন ইতিহাসে কলঙ্কিতদের তালিকায় নিজের নাম যুক্ত না করেন, এটা বিবেচনায় রাখবেন। তার শুভবুদ্ধির উদয় হবে সেই প্রার্থনাই করি।
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক : কলাম লেখক; চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
এরূপ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে পর্যবেক্ষকদের মত হল, সরকার এটা পরিকল্পিতভাবেই চেয়েছিল। কারণ সরকার ভেবেছিল, যুদ্ধাপরাধের বিচার ও অরাজক পরিস্থিতির বিষয়টি সামনে এনে জনগণের খুব কাছে যেতে পারবে এবং এমন পরিস্থিতি নির্বাচনের জন্য তাদের সহায়ক হবে। ক্ষমতাসীন দল তিন বছর আগে থেকেই তাদের এ পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। তিন বছর আগে তারা যখন রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত ছিল, তখন তারা ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের বা ২০১৪ সালের জানুয়ারির কথা মাথায় রেখেই কৌশল নির্ধারণ ও পরিকল্পনা করেছিল। তাদের মূল্যায়নে প্রধান বিষয় ছিল, আবার ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কী কী বাধা আসতে পারে এবং সেগুলো থেকে কিভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়। ক্ষমতাসীন দল আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিল, ভারতপ্রীতি ও মন্ত্রীদের প্রশ্নাতীত দুর্নীতির কারণে তাদের জনসমর্থন কমবে। সুতরাং সে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের বিষয়টি মাথায় রেখেই তারা সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দেন। সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করলে রাজনৈতিক অঙ্গন অস্থির হয়ে উঠবে, এটাও তারা ভালো করেই জানতেন। সুতরাং পরিকল্পনা করেই ও প্রস্তুতি নিয়েই তারা মাঠে নেমেছেন। অথচ সংবিধান সংশোধনের আগে ক্ষমতাসীন দল বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও আলাপচারিতায় তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির পক্ষে বক্তব্য দিয়ে গেছে। এটা যে জনসমর্থন পাওয়ার জন্য তা বেশ স্পষ্ট এবং পরবর্তী সময়ে সেটি বাতিল করলে পানি ঘোলা হবে, সেই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা সহজ হবে, এটাও তারা জানতেন। আর জেনেশুনেই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের মাধ্যমে প্রদত্ত একটি মৌখিক রায়ের উসিলায় তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিকে সংবিধান থেকে মুছে দেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গটি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ ছিল, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিলের বিষয়টির উল্লেখ ছিল না। ২০১১ সালের মাঝামাঝিতে পাস করা পঞ্চদশ সংশোধনী দ্বারা শুধু তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিই বাতিল করা হয়নি, সংবিধানের আরও অনেক মৌলিক বিষয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ পরিবর্তনগুলোও অস্থিরতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
সরকার জনগণকে; মিডিয়াকর্মী, পত্রিকার কলাম লেখক ও টকশোয় অংশগ্রহণকারীদের ব্যস্ত রাখার জন্য এমন কিছু বিষয়ের অবতারণা করতে থাকে, যাতে সবাই মূল বিষয় থেকে দূরে থাকে। কারণ নির্বাচনের আগে মানুষ সরকারের কর্মকাণ্ডগুলোর মূল্যায়ন করবে। সরকারের দুর্নীতি ও ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করবে। এতে করে স্বাভাবিকভাবেই সরকারের জনসমর্থন কমবে। তাই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল পরিকল্পনা করে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টি করাল যাতে করে ওগুলো নিয়ে মানুষ ব্যস্ত থাকে। এর কিছুদিন পর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামকে মহাসমাবেশ করার অনুমতি দেয় এবং নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ এনে র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সমন্বয়ে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। এ ঘটনাটিও সরকার ঘটিয়েছে যাতে করে হেফাজতে ইসলাম নিয়ে বেশ কিছুদিন মানুষ ব্যস্ত থাকে। সুতরাং অফিস-আদালতে, পথেঘাটে, চায়ের দোকানে আলোচনার বিষয়বস্তু পাল্টে গেছে। গত পাঁচ-ছয় মাস যাবত কোথাও পদ্মা সেতুর দুর্নীতি, হলমার্ক-ডেসটিনি কেলেংকারি, বিসমিল্লাহ গ্র“পের ঋণ জালিয়াতি, শেয়ার মার্কেটের মহাদুর্নীতি এবং রেলমন্ত্রীর কালো বিড়াল নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। মিডিয়া থেকেও এসব বিষয় প্রায় উধাও হয়ে গেছে। সরকারপন্থী মিডিয়াগুলো সরকারের এরূপ পরিকল্পনায় প্রভূত সহযোগিতা করে। ২০১৩ সালের শেষাংশে যেরূপ পরিস্থিতি আমরা দেখছি, সেরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এমনটি সরকার আগেই কল্পনা করে নিয়েছিল। রাজনৈতিক যুদ্ধে মিডিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য, এটা স্বীকার করেই সরকার তাদের অনুগত কিছু ব্যক্তিকে টেলিভিশন লাইসেন্স প্রদান করেছিল। সেই টেলিভিশনগুলো নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন ও মূল্যায়ন করতে চেষ্টা করলেও সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার কারণে যথার্থ নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত পাঁচ-ছয় মাস যাবত অব্যাহতভাবে বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং বিরোধী দলের উদ্দেশে বেশিরভাগ সময় আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা বলছেন, যার কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একটি শোভনীয় বা সহনশীল আবহ সৃষ্টি হয়নি। সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে বিরোধের মূল জায়গাটি জনগণের কাছে অস্পষ্ট রাখার বিষয়ে সরকার দক্ষতা দেখিয়েছে। সরকার চাচ্ছে, তাদের দলীয় সরকারের অধীনে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরই অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিরোধী দল চাচ্ছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরূপ পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষকে কাছাকাছি আনার জন্য প্রায় সমগ্র বিশ্ব চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে কোনো ফল মেলেনি।
এবার একটু ব্যতিক্রমী প্রসঙ্গে আসি। গত প্রায় দশ দিন ধরে বিভিন্ন দৈনিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা তাদের হলফনামায় নিজেদের সম্পর্কে যে বিবরণ দিয়েছেন, সে বিবরণ দেখে মানুষের চক্ষু প্রায় চড়কগাছ! আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সম্পদের বিবরণ দেখে এটা বেশ সহজেই অনুমেয় তারা কী পরিমাণ দুর্নীতি করছেন। অনেকে মন্তব্য করেছেন, আমরা প্রার্থীদের সম্পদ গড়ার দুর্নীতির যে বিবরণ পাচ্ছি, সেটি একটি সামান্য অংশ মাত্র। কারণ হলফনামায় কেউই তার দুর্নীতির পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করবে না। অতএব সেই প্রকাশিত ক্ষুদ্র অংশটিই যদি এত মারাত্মক ও ভয়ংকর হয়, তাহলে পূর্ণ অংশটি কত ভয়ংকর ও মারাত্মক হতে পারে? বিষয়টি খুব সহজেই অনুমেয়। মহাজোট সরকারকে অনেকেই এখন মহাদুর্নীতিবাজ সরকার বলে সম্বোধন করছেন। আরও আশ্চর্যের বিষয়, প্রার্থীদের হলফনামাগুলো যেন জনসমক্ষে প্রকাশ করা না হয় সেজন্য ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করেছে। কেননা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের দুর্নীতির চিত্র জনসমক্ষে প্রকাশ পেয়ে গেলে সাজানো নির্বাচনের সাজানো হাওয়ার দিক বদলে যেতে পারে। অনেকে রসিকতা করে বলছেন, এতদিন একটি কালো বিড়ালের গল্প জানতাম, আওয়ামী লীগে যে এত কালো বিড়ালের জন্ম হয়েছে, আমরা সেটা জানতাম না! স্বাধীন চেতনাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে, দায়িত্ববোধকে বিসর্জন দিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের অনুরোধ রক্ষা করেছে এবং দুর্নীতির চিত্রগুলো তাদের ওয়েবসাইট থেকে গায়েব করে ফেলেছে। অর্থাৎ এভাবে তারা দুর্নীতিবাজদের সহায়তা করছেন। জনগণের জানার অধিকারকে খর্ব করছেন।
যাই হোক, ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলকে দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে এতটাই কোণঠাসা করে রেখেছে যে, তারা রাজপথে আন্দোলন করার কোনো সুযোগই পাচ্ছেন না, যা গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের নামান্তর বললে কম বলা হবে। আজ ২৯ ডিসেম্বর মার্চ ফর ডেমোক্রেসির সমাবেশের ওপর সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সরকার কোনো আইন-কানুন, রেওয়াজের তোয়াক্কা না করে আইন-শৃংখলা বাহিনী দিয়ে যেসব কাজ করিয়েছে, তা দেখে মানুষ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা ভুলে গেছে। সহিংসতার কারণে মানুষ মারা যাচ্ছে, সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে, অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। এরূপ পরিস্থিতিতে সামনে আরও কঠোর আন্দোলনের কথা বলা হয়েছে বিরোধী শিবিরের পক্ষ থেকে। এরপর থেকে সরকারদলীয় বুদ্ধিজীবীরা বলতে শুরু করলেন, বিরোধী দল দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে অগ্রগতি বন্ধ করে দিচ্ছে, বিরোধী দল মানুষ মারছে ইত্যাদি। সরকার কর্তৃক আনীত অভিযোগগুলো প্রতিহিংসামূলক। কারণ বিরোধী দল দীর্ঘদিন ধরে শান্তিপূর্ণভাবে যে দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে পেশ করে আসছে, তার প্রতি সরকার কোনোভাবেই কর্ণপাত করেনি। যদি করত তাহলে দেশবাসীকে আজকের অস্থির রাজনীতি দেখতে হতো না। বিরোধী দলের দাবি অযৌক্তিক নয়। নিরপেক্ষ-নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চাওয়া অবশ্যই গণতান্ত্রিক অধিকার। বরং সরকারই এ দাবিকে অস্বীকার করে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। আর সরকারের এরূপ নিরপেক্ষহীনতা এবং পরিকল্পিত কিছু কর্মকাণ্ডের কারণেই দেশে এ অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। সুতরাং দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আনতে হলে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।
পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত ছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পাশে কেউ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ কেউই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর পাশে নেই। কোন সাহসে তিনি এগোচ্ছেন? অদৃশ্য এমন কী কারণ রয়েছে যার ওপর নির্ভর করে তিনি কাউকেই তোয়াক্কা করছেন না? একজনমাত্র সতীর্থকে নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছা দুষ্কর। বিষয়টি তিনি নিজেও বেশ ভালো করেই জানেন। তারপরও কেন ঢাল-তলোয়ারহীন অবস্থায় দুস্তর পারাপারে যাত্রা করেছেন, আমার জানা নেই। আমার আবেদন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেন ইতিহাসে কলঙ্কিতদের তালিকায় নিজের নাম যুক্ত না করেন, এটা বিবেচনায় রাখবেন। তার শুভবুদ্ধির উদয় হবে সেই প্রার্থনাই করি।
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক : কলাম লেখক; চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
No comments