উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ by বদরুদ্দীন উমর
‘উদ্ভট
উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ শিরোনামে শামসুর রাহমান এক কবিতা লিখেছিলেন। এ
কবিতা লেখার সময় তার মাথায় ছিল জামায়াতে ইসলামী ও তাদের মতো ধর্মীয়
প্রতিক্রিয়াশীল দল। তিনি বেঁচে থাকলে তার মাথায় যে এখন আওয়ামী লীগও থাকত
এটা মনে হয়। কারণ এখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটও এখন
একই ধরনের উদ্ভট এক উটের পিঠে চড়ে জনগণের ওপর লাঠি ঘোরাচ্ছে ও দেশের
সর্বনাশ করছে। এরা যে শুধু এভাবে লাঠি ঘোরাচ্ছে তাই নয়, এদের মুখেও কোনো
লাগাম নেই এবং কথা বলার সময় এদের মুখভঙ্গির মধ্যেও নেই কোনো সভ্যতার ছাপ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন যে, তিনি বাংলা
ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে গ্রাম্য বর্বরতার হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন।
এখন বাংলাদেশের এমনই অবস্থা যে, জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের
মতো রাজনৈতিক দলকে উদ্ভট উটের পিঠ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে দেশকে রক্ষা
করার মতো কোনো যথাযথ রাজনৈতিক শক্তি নেই।
বাংলাদেশের
সর্বত্র এখন এক অস্বাভাবিক অবস্থা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের কয়েকটি
হাস্যকর জোট সঙ্গী দলকে সঙ্গে নিয়ে আগামী ৫ জানুয়ারি এক প্রহসনের নির্বাচন
অনুষ্ঠানের জন্য এমনভাবে মরিয়া হয়েছে, যার প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি-জামায়াত
ঐক্য জোটও এখন একইভাবে মরিয়া হয়ে দেশজুড়ে জ্বালাও-পোড়াও অভিযান শুরু করে
এমন বিশৃংখল ও ধ্বংসাÍক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যার কোনো পূর্ব দৃষ্টান্ত এ
দেশে নেই। আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা এখন যে রাজনৈতিক
কর্মকাণ্ড করে চলেছেন, তারও কোনো পূর্ব দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে,
বলা চলে বিশ্বের অন্য কোনো দেশের রাজনীতিতেও নেই। এটাই এই সমগ্র পরিস্থিতির
মূল কারণ। পর পর তার অনেক কাজের দ্বারাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, তার চিন্তা ও
কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক বলে আখ্যায়িত হওয়ার অযোগ্য। তার মধ্যে কোনো সঙ্গতি ও
সামঞ্জস্য নেই। তিনি বিএনপির বিরুদ্ধে বেশ কিছুদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন
যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য তাদের নাছোড় দাবির অর্থ হল তারা
নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তে একটি অনির্বাচিত সরকারের অধীনে ও নিয়ন্ত্রণে
নির্বাচন করতে চান। শেখ হাসিনার দাবি হল, নির্বাচন যাতে কোনো অনির্বাচিত
সরকারের অধীনে না হতে পারে, এ জন্যই তিনি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী জাতীয়
সংসদে পাস করে দেশে গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার ব্যবস্থা করেছেন! বিস্ময়ের
ব্যাপার এই যে, ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরোধিতার মুখে তিনি দেশে এক অস্থির
পরিস্থিতি তৈরি করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্য
সংবিধান সংশোধন করেছিলেন!! সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো নির্বাচিত সরকার
ছিল না এবং সেই ধরনের সরকারের অধীনে শেখ হাসিনা ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮-এর
নির্বাচন করেছিলেন। কাজেই হঠাৎ করে এ ব্যাপারে তার সম্পূর্ণ উল্টো অবস্থান
বাস্তবিকই বিস্ময়কর। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, অনির্বাচিত
সরকারের বিরুদ্ধে ‘নীতিগত’ ও ‘গণতান্ত্রিক’ অবস্থানের ওপর দাঁড়িয়ে পঞ্চদশ
সংশোধনীকে অবলম্বন করে তিনি ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অনড়
থাকা সত্ত্বেও ইতিমধ্যে অধিকাংশ ভোটারকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে
১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে তিনি একটি অনির্বাচিত সরকারের
প্রধান হওয়া নিশ্চিত করেছেন!!! তার এই স্ববিরোধী এবং অগণতান্ত্রিক কাজের
জন্য তার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই। তিনি মনে করছেন
সরকারি ক্ষমতার জোরে এভাবে সরকার গঠন করে ক্ষমতায় টিকে যাবেন!!! কোনো সুস্থ
মানুষের পক্ষে এ চিন্তা যে সম্ভব নয়, এটা বলাই বাহুল্য।
আগামী
নির্বাচন যেভাবেই হোক তার সরকারের অধীনে ও নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তিনি
যেসব কাজ করছেন তার মধ্যে একটি হল, তাদের জোটের শরিক জাতীয় পার্টিকে ভেঙে
ফেলে নিজেদের নির্বাচন সঙ্গী করা। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ঘোষণা করেছেন যে, তিনি নির্বাচন করবেন না। এই মর্মে
তিনি তার দলের প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য চিঠি দিতে বলেছেন।
তারা সে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু হাসিনার অনুগত এবং আজ্ঞাবাহী নির্বাচন কমিশন
সব নিয়ম-কানুন শিকেয় তুলে তাদের দরখাস্ত নামঞ্জুর করে তাদের নির্বাচন
প্রার্থিতা বহাল রেখেছেন!! শুধু তাই নয়, এরশাদ যাতে সক্রিয়ভাবে নির্বাচনে
যাওয়ার বিরুদ্ধে আরও কোনো পদক্ষেপ ব্যক্তিগতভাবে নিতে না পারেন তার জন্য
তাকে শেখ হাসিনা অসুস্থ ঘোষণা করে চিকিৎসার জন্য সামরিক হাসপাতালে আটক
রেখেছেন। এরশাদ বলছেন, তিনি অসুস্থ নন। তাকে জোরপূর্বক হাসপাতালে আটক রাখা
হয়েছে! কিন্তু সরকার বলছে, তিনি অসুস্থ!! এখানেই শেষ নয়, এরশাদের স্ত্রী
রওশন এরশাদের সঙ্গে চক্রান্ত করে শেখ হাসিনা তাকে দিয়ে নির্বাচন করাচ্ছেন।
তারা ইতিমধ্যে এরশাদের মতের বিরুদ্ধে তার নামে নির্বাচনী ইশতেহারও প্রচার
করেছেন জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনের লাইনে রাখার জন্য!! অর্থাৎ শেখ হাসিনা
এখন শুধু আওয়ামী লীগেরই নয়, অন্য একটি পার্টির নির্বাচনও গায়ের জোরে
পরিচালনা করছেন!! এরও কোনো পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই। এটা কোনো সুস্থ মস্তিষ্ক ও
সুস্থ রাজনৈতিক চিন্তাপ্রসূত ব্যাপার নয়। এর সঙ্গে গণতন্ত্রচর্চার যে কোনো
সম্পর্ক নেই, এটাও বলাই বাহুল্য।
বিএনপি-জামায়াত
জোট কয়েক মাস ধরে আন্দোলনের নামে দেশে হরতাল-অবরোধ ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের
জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচি পালন করছে। শেখ হাসিনা এই জ্বালাও-পোড়াও এর মতো
বিধ্বংসী কাণ্ডের মুখর সমালোচক। তার অনুগৃহীত মন্ত্রী-এমপি ও দলীয় নেতারা
তোতাপাখির মতো তার এই কথার প্রতিধ্বনি করছেন। আগে দেখা গেছে, বিএনপির
হরতালের সমালোচনা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ নিজেও একদিন সকাল-সন্ধ্যা হরতাল
ডেকেছে। এখন বিএনপির ২৯ ডিসেম্বরের ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি বানচাল করার জন্য
তারা শুধু পুলিশকে দিয়ে ঢাকার সমাবেশের জন্য তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেই
নয়, দেশব্যাপী এক অবরোধ কর্মসূচি কার্যকর করতে পুলিশসহ সব রকম আইন-শৃংখলা
বাহিনী এবং তাদের সহযোগী হিসেবে দলীয় গুণ্ডাপাণ্ডাদেরও পথে নামিয়েছে!!
সরকারি দল আওয়ামী লীগের এই অবরোধ বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর অবরোধের মতোই অচল
পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে বিএনপি এই অবরোধের মুখে তাদের কর্মসূচি
অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। এর ফলে দেশজুড়ে যে ধ্বংসাÍক পরিস্থিতি দেখা
দেবে তার দায়ভার যে আওয়ামী লীগকে নিতে হবে, এটা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং
বুদ্ধিজীবী ছাড়া আর কে অস্বীকার করতে পারে?
এসব
থেকে বোঝার অসুবিধা নেই যে, বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর রাজনীতি দেশ ও জনগণকে
এমন এক ভয়াবহ সংকটের মধ্যে নিক্ষেপ করেছে, যার দায়িত্ব মূলত সরকারের।
নির্বাচনকালে শেখ হাসিনা নিজে সরকারি ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনে ব্যাপক
কারচুপি করার সিদ্ধান্তে অনড় থেকেই এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন। তিনি
যেভাবে সরকার ও নিজের দলের নেতৃত্ব প্রদান করছেন সাধারণভাবে রাজনৈতিক সংকট ও
সামাজিক বিশৃংখলার পূর্বশর্ত তৈরি করেছেন। অন্য কারণ বাদ দিয়েও শেখ
হাসিনার এই অবস্থা রাজনৈতিক অসুস্থতার লক্ষণ। এর চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু
অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে দেশ ও বিদেশে আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতা এখন
প্রায় সম্পূর্ণ। ভারত সরকার ছাড়া এদের সমর্থন ও শক্তির জোগান দেয়ার অন্য
কেউ নেই। কাজেই ভারত সরকার ছাড়া আর কোনো শক্তির পক্ষে এই চিকিৎসা প্রদানের
ক্ষমতা নেই। তবে পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যাতে ভারতীয়
হাসপাতালেও এ চিকিৎসা সম্ভব, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
No comments