একটি গল্প, ক্ষমতাসীনদের সম্পদ ও দায়হীন কমিশন by আলমগীর স্বপন
একটি অপরাধবিষয়ক গল্প দিয়েই শুরু করা যাক।
একদল ডাকাত ব্যাংকে ঢুকেছে ডাকাতির জন্য। উপস্থিত গ্রাহক আর কর্মচারীরা
প্রথমে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে তাদের। এ সময় ডাকাতেরা বন্দুক তাক করে বলে,
‘ভাইসব, টাকা গেলে সরকারের যাবে, আর প্রাণ গেলে যাবে আপনাদের। আপনারাই
বুঝুন কোনটা বাঁচাবেন।’ এই হুমকিতে সবাই প্রাণ বাঁচানোর পথই বেছে নিলেন।
তাই ডাকাতদের নির্বিঘ্নে টাকা নিয়ে আস্তানায় ফিরে যেতে আর কোনো বাধার মুখে
পড়তে হল না। আস্তানায় ফিরে ডাকাতদের একজন বলল, ‘এবার গুনে দেখি কত টাকা লুট
করলাম।’ এতে একজন বাধা দিয়ে বলে, ‘ধুর, এত টাকা গোনা কষ্টের ব্যাপার।
টিভির খবর দেখেই জানা যাবে কত টাকা লুট করেছি।’ এদিকে ঘটনা শুনে মন্ত্রী
মহোদয় ব্যাংক পরিদর্শনে গেলেন। সব কিছু দেখে তিনি বললেন, ‘ডাকাতেরা শুধু
কয়েক বস্তা টাকাই নিয়েছে। বেশিরভাগ টাকাই তো রয়ে গেছে, আর সেফ ডিপোজিট
বক্সগুলোও তো আছে। আসুন আমরা ওগুলো নিজেদের মাঝে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিই।
ডাকাতদের দোষ হবে। কেউ বুঝতে পারবে না।’ যেমন কথা তেমন কাজ, সব ভাগাভাগি
হয়ে গেল। আর ডাকাতির দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল ডাকাত দলের সদস্যদের।
এই গল্পের মোরাল হল, যে যত উপরে, তার চুরি তত বড় এবং তা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর চুরি-ডাকাতি করার ইচ্ছা থাকলে ভোটে দাঁড়িয়ে ক্ষমতায় গিয়ে মন্ত্রী-এমপি হয়ে করাটাই ভালো। এটাই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নির্ভুল পদ্ধতি! গত পাঁচ বছরে ক্ষমতাসীন মন্ত্রী-এমপিদের অর্জিত সম্পদ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও এই সত্য একটু ঘুরিয়ে স্বীকার করেছেন। তিনি রাখঢাক না করে সরাসরিই বলেছেন, ‘ক্ষমতাবানরা তো সম্পদশালী হবেনই।’ এ জন্যই আমরা দেখতে পাচ্ছি ক্ষমতার পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি ও নেতাকর্মীদের একটি অংশের সম্পদ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর সাবেক বিশেষ সহকারী মাহবুব-উল আলম হানিফের সম্পদের পাহাড় গড়ার খবর যেমন এসেছে, তেমনি সবচেয়ে আলোচিত হয়েছেন ২০ একর থেকে ২ হাজার ৮৬৫ একর কৃষি জমির মালিক বনে যাওয়া সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান। অন্যদিকে আলাদীনের জাদুর চেরাগের ছোঁয়া এসব প্রভাবশালীর স্ত্রীরাও কিন্তু কম পাননি। ঘরে বসে কোনো কিছু না করেও তারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। তবে এ তো গেল হলফনামায় তারা যে সম্পদের তথ্য দিয়েছেন তার চিত্র। এর বাইরে তাদের আরও বেশি সম্পদ আছে বলেই স্বাভাবিক ধারণা। এ জন্যই প্যারোডি করে বলা হচ্ছে, ‘আগে ছিল হাওয়া ভবন/এখন দেখি বহু ভবন’।
এ অবস্থায় ক্ষমতার জাদুর চেরাগে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠা এই রাজরাজড়াদের জবাবদিহিতার কি কোনো সুযোগ আছে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় নেই। কেননা নব্য এই জমিদারি শাসনে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কিংবা নির্বাচন কমিশন (ইসি) মনে হয় প্রজা হয়েই থাকতে চায়। তা না হলে স্বাধীন হয়েও কেন দুদক এক্ষেত্রে গা-ঝাড়া দিয়ে মাঠে নামতে চায় না? নির্বাচন কমিশনই বা কেন ক্ষমতাসীন সম্পদশালীদের সম্পদের তথ্য আড়াল করতে চায়?
হলফনামায় প্রার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশে সর্বোচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। এই নির্দেশনার বাধ্যবাধকতার কথা জানিয়ে, সম্পদের তথ্য লুকাতে নির্বাচন কমিশনে যাওয়া আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের আবদার নাকচ করে দিতে পারতেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। কিন্তু তা না করে আদালতের নির্দেশ ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) মাঝখানে ফাঁকফোকর খুঁজেছেন তিনি। এর পরপরই ইসির ওয়েবসাইট থেকে রহস্যজনকভাবে প্রার্থীদের তথ্য-প্রমাণ গায়েবও হয়ে গিয়েছিল। যেখানে জনমত, আদালতের নির্দেশনা ইসির পক্ষে, সেখানে কেন সিইসি আলাদীনের চেরাগওয়ালাদের পক্ষ নিতে চেয়েছেন? অবশ্য আশার বিষয়, সমালোচনার মুখে ইসি তার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন।
অন্যদিকে কারও অস্বাভাবিক সম্পদ আছে এমন সন্দেহ হলেই ব্যবস্থা নেয়ার কথা দুদকের। কিন্তু প্রার্থীদের ফুলে ফেঁপে ওঠা সম্পদের খবর গণমাধ্যমে এলেও এক্ষেত্রে কার্যত নির্বিকার প্রতিষ্ঠানটি। দুদকের কর্তাব্যক্তিরা বরং বলছেন, নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের সম্পদ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে বিশৃংখলা সৃষ্টি হতে পারে। দুদকের এত জনবল নেই যে সব বিষয়ে তারা হাত দেবে। কিন্তু দুদক আইন কী বলে। দুদক আইনের ২৬ (১) ধারা অনুযায়ী, ‘কমিশন কোনো তথ্যের ভিত্তিতে এবং উহার বিবেচনায় প্রয়োজনীয় তদন্ত পরিচালনার পর যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে, কোনো ব্যক্তি বা তাহার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি, বৈধ উৎসের সহিত অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পত্তির দখলে রহিয়াছেন বা মালিকানা অর্জন করিয়াছেন, তাহা হইলে কমিশন লিখিত আদেশ দ্বারা উক্ত ব্যক্তিকে কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত পদ্ধতিতে দায়-দায়িত্বের বিবরণ দাখিলসহ উক্ত আদেশে নির্ধারিত অন্য যে কোনো তথ্য দাখিলের নির্দেশ দিতে পারবে।’
দুদক আইনে আমরা স্পষ্টই দেখছি, মন্ত্রী, এমপি, ক্ষমতাসীন বা সন্দেহভাজনদের অস্বাভাবিক সম্পদের তথ্য খতিয়ে দেখতে কী করতে হবে প্রতিষ্ঠানটিকে। অবশ্য সমালোচনার পর এখন দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ বদিউজ্জামান বলছেন, নির্বাচনের পর সন্দেহভাজনদের সম্পদের তথ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। সংশ্লিষ্টরা কীভাবে অল্প সময়ে এত বেশি সম্পদ অর্জন করেছেন সে বিষয়ে যৌক্তিক তথ্য চাওয়া হবে। তার কথা সত্যি হলে ভালো। আর পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য কৌশলী বক্তব্য হলে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানটির গ্রহণযোগ্যতা আরও তলানিতে ঠেকবে।
এক্ষেত্রে অবশ্য অতীতের অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত। গত পাঁচ বছর দুদক স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো ক্ষমতাসীনের সম্পত্তির তথ্য খতিয়ে দেখেনি। ইতিহাসে একবারই ভিভিআইপি, ভিআইপি রাজনীতিকদের বা তাদের প্রতিনিধিদের সম্পদের হিসাব নিয়ে দুদকের চৌকাঠে দৌড়াতে দেখা গেছে। আর সেটি ছিল সেনাসমর্থিত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তবে তত্ত্বাবধায়কের আমলের সেই আশার বেলুন নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের আমলে পুরোটাই চুপসে গেছে। কেননা অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় বিশেষ আদালতে যাদের সে সময় সাজা হয়েছিল, গত পাঁচ বছরে তাদের অনেকেরই মামলা বাতিল হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে অবশ্য সৌভাগ্যবান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা। আর যাদের বিরুদ্ধে এখনও মামলা আছে, বিশেষ করে বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে, সেসব মামলা গত পাঁচ বছর উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত হয়ে আছে। এসব ক্ষেত্রে দুদকের বিরুদ্ধে অভিযোগ হল ক্ষমতাসীন ভিভিআইপি-ভিআইপি রাজনীতিকদের অবৈধ সম্পদের মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি শৈথিল্য দেখিয়েছে। প্রশ্ন আছে তাদের তদন্তের দুর্বলতা নিয়েও। আবার এক্ষেত্রে আদালতের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে খোদ দুদকই। বছরের পর বছর মামলা ঝুলিয়ে না রেখে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে এর সুরাহা করতে পারতেন আদালত। এ কারণে বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ঝুলে থাকা এসব মামলাই আবার বাতিল হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে, যদি তারা আবার ক্ষমতায় আসে।
ক্ষমতার এই চক্রে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হয়েও দুদক কিংবা নির্বাচন কমিশন সব সময় গিনিপিগ হিসেবে থেকে যাচ্ছে। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানে যারা আসছেন, প্রধান কিংবা সদস্য হচ্ছেন, তারা চাকরি জীবনে সর্বোচ্চ অর্জনের পরই দায়িত্ব নিচ্ছেন। অবসর থেকে ফিরে এক্ষেত্রে কি তাদের চাওয়া-পাওয়ার কিছু থাকতে পারে? কিন্তু দলীয় ও নতজানু মনোবৃত্তির কারণে তারা সাহসী ভূমিকা রেখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারছেন না। ইতিহাসের বরপুত্র হওয়ার সেই সুযোগ অবশ্য এখনও আছে দুদকের কর্তাদের সামনে। নির্বাচন কমিশনও অনমনীয় হয়ে এসব ক্ষেত্রে রাখতে পারে দৃষ্টান্ত। সুযোগ আছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনেও। কেননা তিনিই প্রতিবছর মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব জমা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। যদিও গত পাঁচ বছরে তা কথার কথাই থেকে গেছে। তারপরও আমরা হতাশ হতে চাই না। কেননা অর্থমন্ত্রী, দুদক চেয়ারম্যান বলছেন ব্যবস্থা নেয়ার কথা, আশ্বাস দিয়েছেন নতুন কিছু করার, সন্দেহভাজন সম্পদশালীদের ধরার। তাই এ দেশের আমজনতা ভারতের দিল্লির আম আদমি পার্টি হয়ে ওঠার আগে আরও সুযোগ দিতে চায় তাদের। অপেক্ষা করে দেখতে চায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীল অবস্থান।
আলমগীর স্বপন : সাংবাদিক
এই গল্পের মোরাল হল, যে যত উপরে, তার চুরি তত বড় এবং তা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর চুরি-ডাকাতি করার ইচ্ছা থাকলে ভোটে দাঁড়িয়ে ক্ষমতায় গিয়ে মন্ত্রী-এমপি হয়ে করাটাই ভালো। এটাই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নির্ভুল পদ্ধতি! গত পাঁচ বছরে ক্ষমতাসীন মন্ত্রী-এমপিদের অর্জিত সম্পদ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও এই সত্য একটু ঘুরিয়ে স্বীকার করেছেন। তিনি রাখঢাক না করে সরাসরিই বলেছেন, ‘ক্ষমতাবানরা তো সম্পদশালী হবেনই।’ এ জন্যই আমরা দেখতে পাচ্ছি ক্ষমতার পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি ও নেতাকর্মীদের একটি অংশের সম্পদ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর সাবেক বিশেষ সহকারী মাহবুব-উল আলম হানিফের সম্পদের পাহাড় গড়ার খবর যেমন এসেছে, তেমনি সবচেয়ে আলোচিত হয়েছেন ২০ একর থেকে ২ হাজার ৮৬৫ একর কৃষি জমির মালিক বনে যাওয়া সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান। অন্যদিকে আলাদীনের জাদুর চেরাগের ছোঁয়া এসব প্রভাবশালীর স্ত্রীরাও কিন্তু কম পাননি। ঘরে বসে কোনো কিছু না করেও তারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। তবে এ তো গেল হলফনামায় তারা যে সম্পদের তথ্য দিয়েছেন তার চিত্র। এর বাইরে তাদের আরও বেশি সম্পদ আছে বলেই স্বাভাবিক ধারণা। এ জন্যই প্যারোডি করে বলা হচ্ছে, ‘আগে ছিল হাওয়া ভবন/এখন দেখি বহু ভবন’।
এ অবস্থায় ক্ষমতার জাদুর চেরাগে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠা এই রাজরাজড়াদের জবাবদিহিতার কি কোনো সুযোগ আছে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় নেই। কেননা নব্য এই জমিদারি শাসনে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কিংবা নির্বাচন কমিশন (ইসি) মনে হয় প্রজা হয়েই থাকতে চায়। তা না হলে স্বাধীন হয়েও কেন দুদক এক্ষেত্রে গা-ঝাড়া দিয়ে মাঠে নামতে চায় না? নির্বাচন কমিশনই বা কেন ক্ষমতাসীন সম্পদশালীদের সম্পদের তথ্য আড়াল করতে চায়?
হলফনামায় প্রার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশে সর্বোচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। এই নির্দেশনার বাধ্যবাধকতার কথা জানিয়ে, সম্পদের তথ্য লুকাতে নির্বাচন কমিশনে যাওয়া আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের আবদার নাকচ করে দিতে পারতেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। কিন্তু তা না করে আদালতের নির্দেশ ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) মাঝখানে ফাঁকফোকর খুঁজেছেন তিনি। এর পরপরই ইসির ওয়েবসাইট থেকে রহস্যজনকভাবে প্রার্থীদের তথ্য-প্রমাণ গায়েবও হয়ে গিয়েছিল। যেখানে জনমত, আদালতের নির্দেশনা ইসির পক্ষে, সেখানে কেন সিইসি আলাদীনের চেরাগওয়ালাদের পক্ষ নিতে চেয়েছেন? অবশ্য আশার বিষয়, সমালোচনার মুখে ইসি তার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন।
অন্যদিকে কারও অস্বাভাবিক সম্পদ আছে এমন সন্দেহ হলেই ব্যবস্থা নেয়ার কথা দুদকের। কিন্তু প্রার্থীদের ফুলে ফেঁপে ওঠা সম্পদের খবর গণমাধ্যমে এলেও এক্ষেত্রে কার্যত নির্বিকার প্রতিষ্ঠানটি। দুদকের কর্তাব্যক্তিরা বরং বলছেন, নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের সম্পদ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে বিশৃংখলা সৃষ্টি হতে পারে। দুদকের এত জনবল নেই যে সব বিষয়ে তারা হাত দেবে। কিন্তু দুদক আইন কী বলে। দুদক আইনের ২৬ (১) ধারা অনুযায়ী, ‘কমিশন কোনো তথ্যের ভিত্তিতে এবং উহার বিবেচনায় প্রয়োজনীয় তদন্ত পরিচালনার পর যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে, কোনো ব্যক্তি বা তাহার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি, বৈধ উৎসের সহিত অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পত্তির দখলে রহিয়াছেন বা মালিকানা অর্জন করিয়াছেন, তাহা হইলে কমিশন লিখিত আদেশ দ্বারা উক্ত ব্যক্তিকে কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত পদ্ধতিতে দায়-দায়িত্বের বিবরণ দাখিলসহ উক্ত আদেশে নির্ধারিত অন্য যে কোনো তথ্য দাখিলের নির্দেশ দিতে পারবে।’
দুদক আইনে আমরা স্পষ্টই দেখছি, মন্ত্রী, এমপি, ক্ষমতাসীন বা সন্দেহভাজনদের অস্বাভাবিক সম্পদের তথ্য খতিয়ে দেখতে কী করতে হবে প্রতিষ্ঠানটিকে। অবশ্য সমালোচনার পর এখন দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ বদিউজ্জামান বলছেন, নির্বাচনের পর সন্দেহভাজনদের সম্পদের তথ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। সংশ্লিষ্টরা কীভাবে অল্প সময়ে এত বেশি সম্পদ অর্জন করেছেন সে বিষয়ে যৌক্তিক তথ্য চাওয়া হবে। তার কথা সত্যি হলে ভালো। আর পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য কৌশলী বক্তব্য হলে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানটির গ্রহণযোগ্যতা আরও তলানিতে ঠেকবে।
এক্ষেত্রে অবশ্য অতীতের অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত। গত পাঁচ বছর দুদক স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো ক্ষমতাসীনের সম্পত্তির তথ্য খতিয়ে দেখেনি। ইতিহাসে একবারই ভিভিআইপি, ভিআইপি রাজনীতিকদের বা তাদের প্রতিনিধিদের সম্পদের হিসাব নিয়ে দুদকের চৌকাঠে দৌড়াতে দেখা গেছে। আর সেটি ছিল সেনাসমর্থিত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তবে তত্ত্বাবধায়কের আমলের সেই আশার বেলুন নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের আমলে পুরোটাই চুপসে গেছে। কেননা অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় বিশেষ আদালতে যাদের সে সময় সাজা হয়েছিল, গত পাঁচ বছরে তাদের অনেকেরই মামলা বাতিল হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে অবশ্য সৌভাগ্যবান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা। আর যাদের বিরুদ্ধে এখনও মামলা আছে, বিশেষ করে বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে, সেসব মামলা গত পাঁচ বছর উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত হয়ে আছে। এসব ক্ষেত্রে দুদকের বিরুদ্ধে অভিযোগ হল ক্ষমতাসীন ভিভিআইপি-ভিআইপি রাজনীতিকদের অবৈধ সম্পদের মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি শৈথিল্য দেখিয়েছে। প্রশ্ন আছে তাদের তদন্তের দুর্বলতা নিয়েও। আবার এক্ষেত্রে আদালতের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে খোদ দুদকই। বছরের পর বছর মামলা ঝুলিয়ে না রেখে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে এর সুরাহা করতে পারতেন আদালত। এ কারণে বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ঝুলে থাকা এসব মামলাই আবার বাতিল হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে, যদি তারা আবার ক্ষমতায় আসে।
ক্ষমতার এই চক্রে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হয়েও দুদক কিংবা নির্বাচন কমিশন সব সময় গিনিপিগ হিসেবে থেকে যাচ্ছে। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানে যারা আসছেন, প্রধান কিংবা সদস্য হচ্ছেন, তারা চাকরি জীবনে সর্বোচ্চ অর্জনের পরই দায়িত্ব নিচ্ছেন। অবসর থেকে ফিরে এক্ষেত্রে কি তাদের চাওয়া-পাওয়ার কিছু থাকতে পারে? কিন্তু দলীয় ও নতজানু মনোবৃত্তির কারণে তারা সাহসী ভূমিকা রেখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারছেন না। ইতিহাসের বরপুত্র হওয়ার সেই সুযোগ অবশ্য এখনও আছে দুদকের কর্তাদের সামনে। নির্বাচন কমিশনও অনমনীয় হয়ে এসব ক্ষেত্রে রাখতে পারে দৃষ্টান্ত। সুযোগ আছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনেও। কেননা তিনিই প্রতিবছর মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব জমা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। যদিও গত পাঁচ বছরে তা কথার কথাই থেকে গেছে। তারপরও আমরা হতাশ হতে চাই না। কেননা অর্থমন্ত্রী, দুদক চেয়ারম্যান বলছেন ব্যবস্থা নেয়ার কথা, আশ্বাস দিয়েছেন নতুন কিছু করার, সন্দেহভাজন সম্পদশালীদের ধরার। তাই এ দেশের আমজনতা ভারতের দিল্লির আম আদমি পার্টি হয়ে ওঠার আগে আরও সুযোগ দিতে চায় তাদের। অপেক্ষা করে দেখতে চায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীল অবস্থান।
আলমগীর স্বপন : সাংবাদিক
No comments