দেশে এখন উদারনৈতিক রাজনীতির বড়ই প্রয়োজন by কাজী সাইফুল ইসলাম
উদার
রাজনীতি আর পরিশীলিত গণতন্ত্রে নাগরিকের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটে অতি দ্রুত। উদার
গণতন্ত্র চর্চার মধ্য দিয়েই গোটা জাতি এগিয়ে চলে সামনের পথে। শিক্ষা,
কর্মমুখিতা, সংস্কৃতি আর ধর্মকে মেনে নিয়ে গড়ে ওঠে একটি সুন্দর সভ্য জাতি
এবং পরিণত হয় সফল রাষ্ট্রে। অন্যদিকে অনুদার রাজনীতি বা যেমনিভাবে
গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে, ঠিক তেমনি এর অভাব একটি রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণরূপে
ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য যথেষ্ট। বাংলাদেশ এখন সেই ব্যর্থ আর
অকার্যকর একটি রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার জন্যই দিন গুনছে। যদি রাজনীতির এই অচল
অবস্থাটা দূর না হয়, তাহলে দেশের সব নাগরিককে নির্বিকার হয়ে দেখতে হবে
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির রেষারেষিতে দেশটা কিভাবে অকার্যকর একটি রাষ্ট্রে
পরিণত হয়। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরিই দুটি ভাগে বিভক্ত। এটাই হচ্ছে মহাশঙ্কার
কথা। আওয়ামী লীগের জোটে থাকা দলগুলো বিএনপি এবং বিএনপির জোটে থাকা দলগুলোকে
সব সময়ই বলছে- জঙ্গিবাদী। এর কারণ হিসেবে তারা যুক্তি দাঁড় করিয়েছে,
ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো সব বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধেছে এবং তারা
রক্ষণশীল, উদার নীতিতে বিশ্বাস করে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্ম পালন করলেই
কি মানুষ জঙ্গি হয়ে যাবে? শুধু কি মুসলমানরাই ধর্ম পালন করছে এ দেশে?
হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টানরা কি ধর্ম পালন করেন না? তারা কি ধার্মিক নন?
ঠিক একইভাবে বিএনপির সঙ্গে জোটভুক্ত দলগুলো মনে করে আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে কেউ কেউ ধর্মে বিশ্বাস করে না। এদের হাতে দেশের শাসনভার মানেই ধার্মিকদের অসুবিধায় পড়তে হয়। এখন প্রশ্ন হল, উদার ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মনিরপেক্ষতার মানেই কি ধর্মহীনতা?
সত্যি কথা হচ্ছে, এসব কথাবার্তা দু’দলেরই অপপ্রচার ছাড়া আর কিছুই নয়। সবই হচ্ছে রাজনৈতিক চালবাজি। সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়া আর প্রতিশোধের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করা। দল দুটি একই নীতিতে বিশ্বাস করে। একই আদর্শের মধ্যেই নিজেদের ধরে রেখেছে এখন পর্যন্ত। একদল ডান রাজনীতির ছোট দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের দল ভারি করছে। অপর দলটি বাম রাজনীতির ছোট দলগুলোকে নিজেদের বগলদাবা করে রাখতে মহাব্যস্ত। এর বাইরে আর কিছুই নয়।
এর বড় উদাহরণ হচ্ছে, আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির বিপক্ষে রাজপথে আন্দোলন করেছিল। কেন করেছে? রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার জন্য। ঠিক এই সময়ে হেফাজতে ইসলাম এবং জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগের চোখে বিশাল জঙ্গি আর যুদ্ধাপরাধী। ঠিক কালকেই যদি জামায়াতে ইসলামী আর হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো রকম কোয়ালিশন হয়েই যায়, আর বাম ঘরানার দলগুলো যদি আওয়ামী লীগকে ত্যাগ করে, তাহলে বিএনপি কি বাম দলগুলোকে সঙ্গে না নিয়ে জামায়াতে ইসলামী এবং হেফাজতের জন্য শোক পালন করবে? কখনোই নয়। আওয়ামী লীগও ঠিক তাই করবে। আজ যদি বাম দলগুলো তাকে ত্যাগ করে, কালকেই সে ডান দলগুলোকে সঙ্গে নেয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগবে। তখন স্বৈরাচার আর যুদ্ধাপরাধী বলে কিছুই থাকবে না।
আওয়ামী লীগ দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যেও একটি মুখস্থ বুলি চালু রয়েছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের দল, উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে। এই বুলিটা যদি সত্যি হতো তাহলে দেশের জন্য এর চেয়ে ভালো আর কিছুই হতো না। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? দলটি যখন ক্ষমতায় যায় তখন কি সত্যিই উদার রাজনীতির চর্চা হয় এদেশে? না, হয় না। কোনো দিন হবে কিনা তাও বলতে পারবে না কেউ। তবে বর্তমান সময়ে যে নোংরা রাজনীতির মধ্যে জড়িয়ে আছে দলগুলো, তা থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। মানুষ এখন আর দলগুলোর মিথ্যা প্রতিশ্র“তিতে বিশ্বাস করছে না। বরং বিরক্ত হচ্ছে। এদেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের পিঠ দেয়ালের সঙ্গে ঠেকে আছে। যে মানুষটি দল করছে সেও যেমন ক্ষেপে আছে এই পরিবারতন্ত্রের ওপর, যে মানুষটি দলের সাথেপিছে নেই সেও চরমভাবে ক্ষিপ্ত।
একটি কথা সবারই মনে রাখা দরকার। নাগরিকের ওপর শোষণ-নির্যাতন চালিয়ে কোনো দলই টিকে থাকতে পারে না। যদি টিকেই থাকা যেত, তাহলে সারা জীবন ধরে পৃথিবীর শাসনকর্তা হয়ে থাকত হিটলার। আর সাদ্দাম হোসেনের বাথ পার্টিও চিরদিন ইরাক শাসন করত।
ইহুদিদের ওপর হিটলারের নির্মমতার বর্ণনা দেয়া প্রায় অসম্ভব। হিটলার ইহুদিদের নিজের শত্র“ মনে করত। অথচ ইহুদিরা জার্মানিরই নাগরিক ছিল। একটি রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন মতের, বিভিন্ন জাতি আর বিভিন্ন ধর্মের নাগরিক থাকবে এটা খুবই স্বাভাবিক। তাই বলে মুসলিম শাসক যদি হিন্দু বা বৌদ্ধ নাগরিকের ওপর অন্যায়ভাবে অত্যাচার চালিয়ে তাদের একেবারেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়, তাহলে সেটা কতটুকু সভ্যতার স্বাক্ষর বহন করবে? বা তার পরিণামই বা কি হতে পারে?
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে কতগুলো মুখস্থ শব্দের চালবাজি রয়েছে। রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বিপক্ষের শক্তি, নাস্তিক, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ইত্যাদি। সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গেলে এসব শব্দগুলো কতটা জরুরি, আমি বুঝি না। কে দেশপ্রেমিক আর কে দেশদ্রোহী, কে রাজাকার আর কে মুক্তিযোদ্ধা এ খবর দেশের দশ বছর বয়সী নাগরিকের কাছেও রয়েছে। এসব অতিকথনের কারণে বরং অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের গুরুত্ব হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
রাষ্ট্র চালাতে গিয়ে উন্নত রাষ্ট্রনীতি বা সঠিক পরিকল্পনা কখনোই করতে পারেনি আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি। একবার ক্ষমতায় গেলে জোর করে টিকে থাকার মানসিকতা এই আধুনিক যুগেও তারা ধরে রেখেছে অসভ্য প্রাগৈতিহাসিক যুগের মতো। বাংলাদেশের নাগরিক মোটেও পিছিয়ে নেই, বিশ্বের ধনিক দেশগুলোর নাগরিকদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই তাল মিলিয়ে চলছে তারা। কিন্তু শুধু উদার রাজনীতি আর পরিশীলিত গণতন্ত্রের অভাবের কারণেই এগিয়ে যাচ্ছে না বাংলাদেশ।
বর্তমানে একটি কথা খুবই উচ্চারিত হচ্ছে। সেটি হচ্ছে কন্সার্ন (Concern)- উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা। সত্যি বলতে কী, গোটা জাতিই আজ উৎকণ্ঠিত। রাজনৈতিক এই অচল অবস্থা থেকে মুক্তি চায় জাতি। কিভাবে এই সমস্যার নিরসন হবে হয়তো অনেকেই বুঝতে পারে না। কিন্তু যে কোনোভাবেই হোক তারা চায় বড় দল দুটির মধ্যে সমঝোতা। আরেকটি বিষয় নিয়েও জাতি উৎকণ্ঠিত। যদি দল দুটির মধ্যে সমঝোতা না হয়ে সংঘর্ষ বেধে বসে, তাহলে সুবিধাবাদীদেরই লাভ হবে সব থেকে বেশি। কেউ কেউ দেশটা লুটে নিতে পারবে নির্দ্বিধায়। কেউ আবার গদি দখলে ব্যস্ত হবে। কেউ কেউ আবার ধর্মের নামে জঙ্গিবাদের ক্ষেত্র রচনার মহা-উদ্যোগ নেবে। ইতিহাস তাই বলে।
আর এসব হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের নাগরিক। তারপর আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো। তাছাড়া আওয়ামী লীগ যদি বিএনপির মতোই একতরফা নির্বাচনে যায়, তাহলে তারা দুটি ক্ষতির মধ্যে পড়বে। এক, তারা যে উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে তার কোনো মূল্য থাকবে না। অন্যটি, তারা যদি নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে না পারে তাহলে বিএনপির মতোই ভরাডুবি হবে তাদের। সেটা দেশের জন্যও ভালো হবে না।
আওয়ামী লীগ যদি মনে করে, তারা উদার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে এবং দেশের মঙ্গলের জন্য যে কোনো ত্যাগ তারা স্বীকার করতে পারে, তাহলে এখনই বিরোধী জোটের সঙ্গে তাদের একটা সমঝোতায় আসা উচিত। তাহলে দেশের জনগণ তাদের এই সুচিন্তিত ত্যাগকে অবশ্যই বিবেচনায় নেবে। এটা ইতিহাসও হয়ে থাকবে। কারণ, গত নির্বাচনে সম্পূর্ণ একগুঁয়েমি করেছিল বিএনপি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ যদি দেশকে একটা নির্বাচন উপহার দিতে পারে (যে নির্বাচন হবে সর্বদলের অংশগ্রহণে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ), তাহলে দেশের জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা অনেক গুণ বেড়ে যাবে। হতে পারে, এবার তারা সরকারে যেতে পারছে না, তাতে কী। এদেশে আওয়ামী লীগ দলটি যেসব নীতির কথা বলে, তা মানুষের কাছে পরিষ্কার হবে। আর দেশের স্বার্থও বিশালভাবে রক্ষা হবে।
কাজী সাইফুল ইসলাম : কলাম লেখক
ঠিক একইভাবে বিএনপির সঙ্গে জোটভুক্ত দলগুলো মনে করে আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে কেউ কেউ ধর্মে বিশ্বাস করে না। এদের হাতে দেশের শাসনভার মানেই ধার্মিকদের অসুবিধায় পড়তে হয়। এখন প্রশ্ন হল, উদার ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মনিরপেক্ষতার মানেই কি ধর্মহীনতা?
সত্যি কথা হচ্ছে, এসব কথাবার্তা দু’দলেরই অপপ্রচার ছাড়া আর কিছুই নয়। সবই হচ্ছে রাজনৈতিক চালবাজি। সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়া আর প্রতিশোধের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করা। দল দুটি একই নীতিতে বিশ্বাস করে। একই আদর্শের মধ্যেই নিজেদের ধরে রেখেছে এখন পর্যন্ত। একদল ডান রাজনীতির ছোট দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের দল ভারি করছে। অপর দলটি বাম রাজনীতির ছোট দলগুলোকে নিজেদের বগলদাবা করে রাখতে মহাব্যস্ত। এর বাইরে আর কিছুই নয়।
এর বড় উদাহরণ হচ্ছে, আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির বিপক্ষে রাজপথে আন্দোলন করেছিল। কেন করেছে? রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার জন্য। ঠিক এই সময়ে হেফাজতে ইসলাম এবং জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগের চোখে বিশাল জঙ্গি আর যুদ্ধাপরাধী। ঠিক কালকেই যদি জামায়াতে ইসলামী আর হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো রকম কোয়ালিশন হয়েই যায়, আর বাম ঘরানার দলগুলো যদি আওয়ামী লীগকে ত্যাগ করে, তাহলে বিএনপি কি বাম দলগুলোকে সঙ্গে না নিয়ে জামায়াতে ইসলামী এবং হেফাজতের জন্য শোক পালন করবে? কখনোই নয়। আওয়ামী লীগও ঠিক তাই করবে। আজ যদি বাম দলগুলো তাকে ত্যাগ করে, কালকেই সে ডান দলগুলোকে সঙ্গে নেয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগবে। তখন স্বৈরাচার আর যুদ্ধাপরাধী বলে কিছুই থাকবে না।
আওয়ামী লীগ দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যেও একটি মুখস্থ বুলি চালু রয়েছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের দল, উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে। এই বুলিটা যদি সত্যি হতো তাহলে দেশের জন্য এর চেয়ে ভালো আর কিছুই হতো না। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? দলটি যখন ক্ষমতায় যায় তখন কি সত্যিই উদার রাজনীতির চর্চা হয় এদেশে? না, হয় না। কোনো দিন হবে কিনা তাও বলতে পারবে না কেউ। তবে বর্তমান সময়ে যে নোংরা রাজনীতির মধ্যে জড়িয়ে আছে দলগুলো, তা থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। মানুষ এখন আর দলগুলোর মিথ্যা প্রতিশ্র“তিতে বিশ্বাস করছে না। বরং বিরক্ত হচ্ছে। এদেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের পিঠ দেয়ালের সঙ্গে ঠেকে আছে। যে মানুষটি দল করছে সেও যেমন ক্ষেপে আছে এই পরিবারতন্ত্রের ওপর, যে মানুষটি দলের সাথেপিছে নেই সেও চরমভাবে ক্ষিপ্ত।
একটি কথা সবারই মনে রাখা দরকার। নাগরিকের ওপর শোষণ-নির্যাতন চালিয়ে কোনো দলই টিকে থাকতে পারে না। যদি টিকেই থাকা যেত, তাহলে সারা জীবন ধরে পৃথিবীর শাসনকর্তা হয়ে থাকত হিটলার। আর সাদ্দাম হোসেনের বাথ পার্টিও চিরদিন ইরাক শাসন করত।
ইহুদিদের ওপর হিটলারের নির্মমতার বর্ণনা দেয়া প্রায় অসম্ভব। হিটলার ইহুদিদের নিজের শত্র“ মনে করত। অথচ ইহুদিরা জার্মানিরই নাগরিক ছিল। একটি রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন মতের, বিভিন্ন জাতি আর বিভিন্ন ধর্মের নাগরিক থাকবে এটা খুবই স্বাভাবিক। তাই বলে মুসলিম শাসক যদি হিন্দু বা বৌদ্ধ নাগরিকের ওপর অন্যায়ভাবে অত্যাচার চালিয়ে তাদের একেবারেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়, তাহলে সেটা কতটুকু সভ্যতার স্বাক্ষর বহন করবে? বা তার পরিণামই বা কি হতে পারে?
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে কতগুলো মুখস্থ শব্দের চালবাজি রয়েছে। রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বিপক্ষের শক্তি, নাস্তিক, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ইত্যাদি। সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গেলে এসব শব্দগুলো কতটা জরুরি, আমি বুঝি না। কে দেশপ্রেমিক আর কে দেশদ্রোহী, কে রাজাকার আর কে মুক্তিযোদ্ধা এ খবর দেশের দশ বছর বয়সী নাগরিকের কাছেও রয়েছে। এসব অতিকথনের কারণে বরং অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের গুরুত্ব হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
রাষ্ট্র চালাতে গিয়ে উন্নত রাষ্ট্রনীতি বা সঠিক পরিকল্পনা কখনোই করতে পারেনি আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি। একবার ক্ষমতায় গেলে জোর করে টিকে থাকার মানসিকতা এই আধুনিক যুগেও তারা ধরে রেখেছে অসভ্য প্রাগৈতিহাসিক যুগের মতো। বাংলাদেশের নাগরিক মোটেও পিছিয়ে নেই, বিশ্বের ধনিক দেশগুলোর নাগরিকদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই তাল মিলিয়ে চলছে তারা। কিন্তু শুধু উদার রাজনীতি আর পরিশীলিত গণতন্ত্রের অভাবের কারণেই এগিয়ে যাচ্ছে না বাংলাদেশ।
বর্তমানে একটি কথা খুবই উচ্চারিত হচ্ছে। সেটি হচ্ছে কন্সার্ন (Concern)- উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা। সত্যি বলতে কী, গোটা জাতিই আজ উৎকণ্ঠিত। রাজনৈতিক এই অচল অবস্থা থেকে মুক্তি চায় জাতি। কিভাবে এই সমস্যার নিরসন হবে হয়তো অনেকেই বুঝতে পারে না। কিন্তু যে কোনোভাবেই হোক তারা চায় বড় দল দুটির মধ্যে সমঝোতা। আরেকটি বিষয় নিয়েও জাতি উৎকণ্ঠিত। যদি দল দুটির মধ্যে সমঝোতা না হয়ে সংঘর্ষ বেধে বসে, তাহলে সুবিধাবাদীদেরই লাভ হবে সব থেকে বেশি। কেউ কেউ দেশটা লুটে নিতে পারবে নির্দ্বিধায়। কেউ আবার গদি দখলে ব্যস্ত হবে। কেউ কেউ আবার ধর্মের নামে জঙ্গিবাদের ক্ষেত্র রচনার মহা-উদ্যোগ নেবে। ইতিহাস তাই বলে।
আর এসব হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের নাগরিক। তারপর আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো। তাছাড়া আওয়ামী লীগ যদি বিএনপির মতোই একতরফা নির্বাচনে যায়, তাহলে তারা দুটি ক্ষতির মধ্যে পড়বে। এক, তারা যে উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে তার কোনো মূল্য থাকবে না। অন্যটি, তারা যদি নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে না পারে তাহলে বিএনপির মতোই ভরাডুবি হবে তাদের। সেটা দেশের জন্যও ভালো হবে না।
আওয়ামী লীগ যদি মনে করে, তারা উদার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে এবং দেশের মঙ্গলের জন্য যে কোনো ত্যাগ তারা স্বীকার করতে পারে, তাহলে এখনই বিরোধী জোটের সঙ্গে তাদের একটা সমঝোতায় আসা উচিত। তাহলে দেশের জনগণ তাদের এই সুচিন্তিত ত্যাগকে অবশ্যই বিবেচনায় নেবে। এটা ইতিহাসও হয়ে থাকবে। কারণ, গত নির্বাচনে সম্পূর্ণ একগুঁয়েমি করেছিল বিএনপি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ যদি দেশকে একটা নির্বাচন উপহার দিতে পারে (যে নির্বাচন হবে সর্বদলের অংশগ্রহণে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ), তাহলে দেশের জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা অনেক গুণ বেড়ে যাবে। হতে পারে, এবার তারা সরকারে যেতে পারছে না, তাতে কী। এদেশে আওয়ামী লীগ দলটি যেসব নীতির কথা বলে, তা মানুষের কাছে পরিষ্কার হবে। আর দেশের স্বার্থও বিশালভাবে রক্ষা হবে।
কাজী সাইফুল ইসলাম : কলাম লেখক
No comments