আসন্ন নির্বাচনে জনগণের শান্তির উপায় কী? by আল আমীন চৌধুরী
সংসদ
নির্বাচন এলেই সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে যে কদর্য ও সহিংস ক্ষমতার লড়াই
শুরু হয়, তার একাধিকবারের শিকার হয় এদেশের মানুষ। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে,
যারা ইংরেজ শাসনবিরোধী সংগ্রামে, ভাষা আন্দোলনে এবং মুক্তিযুদ্ধে জয়ী
হয়েছিল, এমনকি স্বাধীনতার পর সামরিক শাসনের পতন ঘটিয়েছিল, তারা কি এহেন
নৈরাজ্য থেকে মুক্তি পাবে না? আর মুক্তির পথে বাধাই বা কোথায়? আসলে যে কোনো
মহান অর্জনের জন্য যেমন চাই একটি চেতনা ও সংকল্পবদ্ধ প্রজন্ম, তেমনি চাই
একটি নিষ্ঠাবান ও নিঃস্বার্থ নেতৃত্ব। স্বাধীনতাসহ সব অর্জনের ক্ষেত্রেই
কমবেশি এ তিনটি উপাদানই ছিল বিদ্যমান। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে ত্যাগ-তিতিক্ষা ও
নিঃস্বার্থ সেবার আদর্শ নিয়ে যে রাজনীতির যাত্রা শুরু হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধ
নাগাদ সে ধারাই অনেকটা অব্যাহত থাকে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পরও বহু বছর
রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্তদের অধিকাংশই সে ধারা থেকে বিচ্যুত হয়নি।
সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও মানুষের বাঁচার মতো বাঁচার স্বপ্ন তখনও
মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র-জনতার হৃদয়ে দেদীপ্যমান ছিল। ফলে বৃহত্তর রাজনৈতিক
পরিসরে কিংবা ছাত্র-যুব রাজনীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাঁদাবাজি, দখলবাজি
ইত্যাদি স্থান করে নিতে পারেনি। এজন্যই সম্ভব হয়েছিল গণঅভ্যুত্থানের
মাধ্যমে সামরিক শাসনের পতন ঘটানো।
তবে রাজনীতিকে রাজনীতিকদের জন্য কঠিন করে তুলতে যে কৌশল সামরিক শাসনামলে গ্রহণ করা হয়েছিল, তার সর্বনাশা ফল ভোগ করছে এদেশের সাধারণ মানুষ, রাজনীতিকরা নয়। ওই কৌশলের অংশ হিসেবে টাকা ও নানা সুবিধার বিনিময়ে রাজনৈতিক দলে বিভাজন, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবীসহ দেশের প্রায় সব সংগঠনে বিভক্তি, স্থানীয় পর্যায়ে আধিপত্য বিস্তার ও অর্থ আহরণের সুযোগ দিয়ে দলের সমর্থক ও কর্মী সৃষ্টির যে অপকৃষ্টি চালু হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে নির্বাচনী-গণতন্ত্রে, বলতে গেলে, তা আনুষ্ঠানিক রূপ নেয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, নির্বাচনে জয়লাভের পর নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে বিজয়ী দল সারাদেশের একচ্ছত্র মালিক হয়ে বসে। শুরু হয় স্বার্থান্বেষী, অর্থকেন্দ্রিক, দখল ও লুণ্ঠনের রাজনীতি। নেতাকর্মী, ছাত্র-যুবসহ সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরে তা বিস্তৃত হতে থাকে। সরকারপরম্পরায় তা শুধু পাল্লা দিয়ে বাড়তেই থাকে। একই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায়ও চলে দুর্বৃত্তায়ন। এ পুরো কর্মযজ্ঞে সহায়তা করার জন্য প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গে চলে দলীয়করণ। এক কথায়, এসবের ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে কায়েমি স্বার্থ গেড়ে বসেছে- তাকে পরাভূত করে জাতীয় মুক্তি ও বৃহত্তর কল্যাণে যে কোনো অর্জন আগের চেয়ে আজ অনেক দুরূহ।
এ কঠিন অবস্থায় মুক্তি অর্জনের জন্য প্রয়োজন আগে উল্লিখিত তৃতীয় উপাদান- একটি নিষ্ঠাবান ও নিঃস্বার্থ নেতৃত্ব। যারা সব ধরনের দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতি নিরোধ করে, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী, সংগঠন ও গোষ্ঠীর মধ্যে কৃত্রিম বিভাজন অবসান করে দেশকে একটি সুখী শান্তিপ্রিয় ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের নেতৃত্ব অনেকটা যেন এর উল্টো ধাঁচের। ক্ষমতা ও নিজেদের স্বার্থের জন্য জনস্বার্থ শুধু নয়, জনজীবন বিসর্জন থেকে শুরু করে আমাদের রাজনীতিতে বিদেশীদের অনধিকার চর্চার অবাধ সুযোগ করে দেয়াসহ যে কোনো কিছু করতে তারা দ্বিধা করে না। যে দুর্নীতি ও দুুর্বৃত্তায়ন সমাজদেহে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, তাকে তারা স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিজেদের কৌশল ঠিক করে নিয়েছে- এর বিরোধিতা নয়, একে উল্টিয়ে ফেলার চেষ্টা তো নয়ই বরং এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়াই তাদের একমাত্র করণীয়!
উপরোক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায়, ক্ষমতার লড়াইয়ের ধ্বংসাত্মক পরিণতি থেকে জনগণের মুক্তি যেমন কঠিন, মুক্তির পথও তেমনি বন্ধুর।
চলুন এখন আসন্ন সংসদ নির্বাচনের সর্বশেষ পরিস্থিতি দেখা যাক। এরই মধ্যে জাতীয় পার্টির ছয়জনসহ সর্বদলীয় নামে মহাজোটের মোট ২৯ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। মন্ত্রীদের মধ্যে দফতরও বণ্টন হয়ে গেছে। সরকার পক্ষ থেকে মন্ত্রিসভায় যোগদান করার এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য বিএনপির প্রতি আহ্বান জানানো সত্ত্বেও তাদের কেউ মন্ত্রিসভায় যোগদান করেননি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীন ছাড়া তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার পূর্বাবস্থানে অনড় রয়েছেন। হরতাল ও আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন। অসাধারণ কিছু না ঘটলে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এদিকে নির্বাচন কমিশন এ সপ্তাহের মধ্যেই নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফলে সংঘাত ও সহিংসতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। আর এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা বাজার অর্থনীতির এ যুগে সহজও হয়ে উঠেছে। দলীয় লোকেরা যদি এ কাজ না করতে চায় তাহলে ‘আউটসোর্সিং’ বা বাইরের কাউকে দিয়ে করানো এবং ব্যবস্থাপনা ঠিকাদারের মাধ্যমে পরিচালনা করা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানা যায়। তাই শেষ মুহূর্তে ১৮ দলীয় জোট যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে হরতাল, অবরোধ, ধ্বংসযজ্ঞ চলবে; অস্থিরতা, জনদুর্ভোগ অব্যাহত থাকবে। তবে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচন প্রতিহত করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সবার কাম্য। কিন্তু এর সম্ভাবনা কম বলে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সক্রিয় সহায়তায় নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ যদি নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করে এবং গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষক দল যদি নির্বাচনে নিবিড় নজরদারি চালায়, সেক্ষেত্রে শেষ মুহূর্তে যদি ১৮ দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং জয়লাভ করে তাহলে সোনায় সোহাগা। একদিকে পরাজিত সরকারি দল বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে, অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের অঙ্গীকার অক্ষরে অক্ষরে সত্য; অন্যদিকে এর মাধ্যমে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্থায়ী ব্যবস্থার প্রতি আস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতার একটি ঐতিহ্য গড়ে উঠবে। এর অন্যথায় অর্থাৎ নির্বাচন যদি অবাধ ও নিরপেক্ষ না হয় অথবা তাতে কারচুপি হয়, তাহলে বিরোধী দল সহজেই এবং সঙ্গত কারণেই সরকার পতনের একটি সফল আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে।
তৃতীয় সম্ভাব্য পরিস্থিতি হচ্ছে, ১৮ দল বাদেই মহাজোট নিজেরা ছাড়াও অন্য কিছু দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল এবং তাতে বিপুল ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত হল এবং প্রার্থীদের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি হল। এ রকম একটি নির্বাচন দেশ-বিদেশের সবার কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও তার বিশুদ্ধতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা সম্বন্ধে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। এমন অবস্থায় বিরোধী দল অবশ্য হরতালসহ বিভিন্ন কঠিন কর্মসূচি দিয়ে প্রতিবাদ ও আন্দোলন চালিয়ে যাবে, কিন্তু নৈতিক বা আইনগত কোনো শক্ত অবস্থান নিতে অপারগ হবে। ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হবে, অর্থনীতিতে ধস নামবে। কিন্তু সরকারি দল সহজে এবং স্বল্পসময়ের মধ্যে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে বিরোধী দলের দাবি মেনে নিয়ে আবার নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ নেবে বলে মনে হয় না।
সর্বশেষ সম্ভাব্য দৃশ্য হতে পারে এমন, যেখানে বিরোধী দলের প্রবল প্রতিরোধের মুখে ভোটারহীন বা নগণ্যসংখ্যক ভোটারের অংশগ্রহণে নির্বাচন হল। তথাপি সফল নির্বাচনে জয়ী হয়েছে বলে দাবি করে মহাজোট সরকার গঠন করল। ঠিক যেমনটি হয়েছিল বিএনপি সরকারের আমলে ১৯৯৬ সালের ফেব্র“য়ারি মাসের নির্বাচনে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না, আসন্ন নির্বাচন সেরূপ ভোটারহীন হবে বা পরবর্তী সময়ে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হবে।
পাঠক, মনে রাখতে হবে, বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা আমাদের রাজনীতিক ও তাদের দল এবং জোটের সৃষ্ট। তাই তাদেরই এর নিরসন করতে হবে। কোনো বিদেশী গোষ্ঠী বা তৃতীয় কোনো শক্তি নয় এবং তা অভিপ্রেতও নয়। একটি দেশে দুই দশকের অধিক গণতন্ত্র চর্চার (নির্বাচনসর্বস্ব হলেও) পরও যদি আমরা একটি সরকারের মেয়াদ শেষে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের মতো বুনিয়াদি ব্যবস্থাতেই একমত হতে না পারি বা বিশ্বাস স্থাপনে অসমর্থ হই, তাহলে নিজেদের ধিক্কার দেয়া ছাড়া আর কি-ই বা করার আছে?
নিবন্ধটি এ প্রশ্ন দিয়ে শেষ করতে খারাপ লাগছে বলে বিরাজমান অবস্থায় পূর্বোক্ত দ্বিতীয় উত্তম বিকল্পটি অক্ষরে অক্ষরে এবং মর্মে মর্মে কার্যকর হোক- যেখানে শেষ মুহূর্তে হলেও ১৮ দলীয় জোট নির্বাচনে অংশ নেবে- সে আশা নিয়ে আজ বিদায় নিতে চাই।
আল আমীন চৌধুরী : সাবেক সচিব ও কলাম লেখক
তবে রাজনীতিকে রাজনীতিকদের জন্য কঠিন করে তুলতে যে কৌশল সামরিক শাসনামলে গ্রহণ করা হয়েছিল, তার সর্বনাশা ফল ভোগ করছে এদেশের সাধারণ মানুষ, রাজনীতিকরা নয়। ওই কৌশলের অংশ হিসেবে টাকা ও নানা সুবিধার বিনিময়ে রাজনৈতিক দলে বিভাজন, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবীসহ দেশের প্রায় সব সংগঠনে বিভক্তি, স্থানীয় পর্যায়ে আধিপত্য বিস্তার ও অর্থ আহরণের সুযোগ দিয়ে দলের সমর্থক ও কর্মী সৃষ্টির যে অপকৃষ্টি চালু হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে নির্বাচনী-গণতন্ত্রে, বলতে গেলে, তা আনুষ্ঠানিক রূপ নেয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, নির্বাচনে জয়লাভের পর নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে বিজয়ী দল সারাদেশের একচ্ছত্র মালিক হয়ে বসে। শুরু হয় স্বার্থান্বেষী, অর্থকেন্দ্রিক, দখল ও লুণ্ঠনের রাজনীতি। নেতাকর্মী, ছাত্র-যুবসহ সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরে তা বিস্তৃত হতে থাকে। সরকারপরম্পরায় তা শুধু পাল্লা দিয়ে বাড়তেই থাকে। একই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায়ও চলে দুর্বৃত্তায়ন। এ পুরো কর্মযজ্ঞে সহায়তা করার জন্য প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গে চলে দলীয়করণ। এক কথায়, এসবের ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে কায়েমি স্বার্থ গেড়ে বসেছে- তাকে পরাভূত করে জাতীয় মুক্তি ও বৃহত্তর কল্যাণে যে কোনো অর্জন আগের চেয়ে আজ অনেক দুরূহ।
এ কঠিন অবস্থায় মুক্তি অর্জনের জন্য প্রয়োজন আগে উল্লিখিত তৃতীয় উপাদান- একটি নিষ্ঠাবান ও নিঃস্বার্থ নেতৃত্ব। যারা সব ধরনের দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতি নিরোধ করে, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী, সংগঠন ও গোষ্ঠীর মধ্যে কৃত্রিম বিভাজন অবসান করে দেশকে একটি সুখী শান্তিপ্রিয় ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের নেতৃত্ব অনেকটা যেন এর উল্টো ধাঁচের। ক্ষমতা ও নিজেদের স্বার্থের জন্য জনস্বার্থ শুধু নয়, জনজীবন বিসর্জন থেকে শুরু করে আমাদের রাজনীতিতে বিদেশীদের অনধিকার চর্চার অবাধ সুযোগ করে দেয়াসহ যে কোনো কিছু করতে তারা দ্বিধা করে না। যে দুর্নীতি ও দুুর্বৃত্তায়ন সমাজদেহে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, তাকে তারা স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিজেদের কৌশল ঠিক করে নিয়েছে- এর বিরোধিতা নয়, একে উল্টিয়ে ফেলার চেষ্টা তো নয়ই বরং এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়াই তাদের একমাত্র করণীয়!
উপরোক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায়, ক্ষমতার লড়াইয়ের ধ্বংসাত্মক পরিণতি থেকে জনগণের মুক্তি যেমন কঠিন, মুক্তির পথও তেমনি বন্ধুর।
চলুন এখন আসন্ন সংসদ নির্বাচনের সর্বশেষ পরিস্থিতি দেখা যাক। এরই মধ্যে জাতীয় পার্টির ছয়জনসহ সর্বদলীয় নামে মহাজোটের মোট ২৯ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। মন্ত্রীদের মধ্যে দফতরও বণ্টন হয়ে গেছে। সরকার পক্ষ থেকে মন্ত্রিসভায় যোগদান করার এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য বিএনপির প্রতি আহ্বান জানানো সত্ত্বেও তাদের কেউ মন্ত্রিসভায় যোগদান করেননি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীন ছাড়া তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার পূর্বাবস্থানে অনড় রয়েছেন। হরতাল ও আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন। অসাধারণ কিছু না ঘটলে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এদিকে নির্বাচন কমিশন এ সপ্তাহের মধ্যেই নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফলে সংঘাত ও সহিংসতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। আর এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা বাজার অর্থনীতির এ যুগে সহজও হয়ে উঠেছে। দলীয় লোকেরা যদি এ কাজ না করতে চায় তাহলে ‘আউটসোর্সিং’ বা বাইরের কাউকে দিয়ে করানো এবং ব্যবস্থাপনা ঠিকাদারের মাধ্যমে পরিচালনা করা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানা যায়। তাই শেষ মুহূর্তে ১৮ দলীয় জোট যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে হরতাল, অবরোধ, ধ্বংসযজ্ঞ চলবে; অস্থিরতা, জনদুর্ভোগ অব্যাহত থাকবে। তবে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচন প্রতিহত করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সবার কাম্য। কিন্তু এর সম্ভাবনা কম বলে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সক্রিয় সহায়তায় নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ যদি নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করে এবং গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষক দল যদি নির্বাচনে নিবিড় নজরদারি চালায়, সেক্ষেত্রে শেষ মুহূর্তে যদি ১৮ দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং জয়লাভ করে তাহলে সোনায় সোহাগা। একদিকে পরাজিত সরকারি দল বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে, অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের অঙ্গীকার অক্ষরে অক্ষরে সত্য; অন্যদিকে এর মাধ্যমে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্থায়ী ব্যবস্থার প্রতি আস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতার একটি ঐতিহ্য গড়ে উঠবে। এর অন্যথায় অর্থাৎ নির্বাচন যদি অবাধ ও নিরপেক্ষ না হয় অথবা তাতে কারচুপি হয়, তাহলে বিরোধী দল সহজেই এবং সঙ্গত কারণেই সরকার পতনের একটি সফল আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে।
তৃতীয় সম্ভাব্য পরিস্থিতি হচ্ছে, ১৮ দল বাদেই মহাজোট নিজেরা ছাড়াও অন্য কিছু দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল এবং তাতে বিপুল ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত হল এবং প্রার্থীদের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি হল। এ রকম একটি নির্বাচন দেশ-বিদেশের সবার কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও তার বিশুদ্ধতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা সম্বন্ধে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। এমন অবস্থায় বিরোধী দল অবশ্য হরতালসহ বিভিন্ন কঠিন কর্মসূচি দিয়ে প্রতিবাদ ও আন্দোলন চালিয়ে যাবে, কিন্তু নৈতিক বা আইনগত কোনো শক্ত অবস্থান নিতে অপারগ হবে। ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হবে, অর্থনীতিতে ধস নামবে। কিন্তু সরকারি দল সহজে এবং স্বল্পসময়ের মধ্যে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে বিরোধী দলের দাবি মেনে নিয়ে আবার নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ নেবে বলে মনে হয় না।
সর্বশেষ সম্ভাব্য দৃশ্য হতে পারে এমন, যেখানে বিরোধী দলের প্রবল প্রতিরোধের মুখে ভোটারহীন বা নগণ্যসংখ্যক ভোটারের অংশগ্রহণে নির্বাচন হল। তথাপি সফল নির্বাচনে জয়ী হয়েছে বলে দাবি করে মহাজোট সরকার গঠন করল। ঠিক যেমনটি হয়েছিল বিএনপি সরকারের আমলে ১৯৯৬ সালের ফেব্র“য়ারি মাসের নির্বাচনে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না, আসন্ন নির্বাচন সেরূপ ভোটারহীন হবে বা পরবর্তী সময়ে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হবে।
পাঠক, মনে রাখতে হবে, বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা আমাদের রাজনীতিক ও তাদের দল এবং জোটের সৃষ্ট। তাই তাদেরই এর নিরসন করতে হবে। কোনো বিদেশী গোষ্ঠী বা তৃতীয় কোনো শক্তি নয় এবং তা অভিপ্রেতও নয়। একটি দেশে দুই দশকের অধিক গণতন্ত্র চর্চার (নির্বাচনসর্বস্ব হলেও) পরও যদি আমরা একটি সরকারের মেয়াদ শেষে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের মতো বুনিয়াদি ব্যবস্থাতেই একমত হতে না পারি বা বিশ্বাস স্থাপনে অসমর্থ হই, তাহলে নিজেদের ধিক্কার দেয়া ছাড়া আর কি-ই বা করার আছে?
নিবন্ধটি এ প্রশ্ন দিয়ে শেষ করতে খারাপ লাগছে বলে বিরাজমান অবস্থায় পূর্বোক্ত দ্বিতীয় উত্তম বিকল্পটি অক্ষরে অক্ষরে এবং মর্মে মর্মে কার্যকর হোক- যেখানে শেষ মুহূর্তে হলেও ১৮ দলীয় জোট নির্বাচনে অংশ নেবে- সে আশা নিয়ে আজ বিদায় নিতে চাই।
আল আমীন চৌধুরী : সাবেক সচিব ও কলাম লেখক
No comments