আত্মপরিচয়ে আত্মবঞ্চনা
চাকরিসূত্রে অন্য দেশে গিয়ে রুমমেট পেয়েছিলাম ফ্রান্সের একজন মেয়েকে। কারও ব্যক্তিগত বিষয় জানার কৌতূহল দমন করার শিক্ষা ছিল। কিন্তু কয়েক দিন যেতেই আমার রুমমেট গড়গড় করে নিজে থেকেই নিজের কথা বলে গেল। তার বাবা ছোটবেলায় তার মাকে ছেড়ে চলে গেলে সে তার নানির কাছে বড় হয়। মা আবার বিয়ে করলে মায়ের কাছে ফিরে গেলে তার নতুন বাবা তাকে মারধর করত। একদিন নতুন বাবা তার প্রতি অশোভন ইঙ্গিত করলে সে পালিয়ে চলে যায়। সে দত্তক হিসেবে বেড়ে ওঠে অন্য এক মায়ের কাছে। সে খুবই কৃতজ্ঞ যে তার সেই মা তাকে লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন বলে সে এখন ভালো চাকরি করতে পারছে। কিন্তু তার একটাই দুঃখ যে সে কোনো দিন মা হতে পারবে না। কেন, প্রশ্ন করা ঠিক হবে কি না, তা ভাবতে না-ভাবতেই সে বলে দিল যে তার ছেলেবন্ধু অস্বীকার করেছিল যে তার গর্ভের সন্তানটি তার নয়। তাই সে রাগ করে ভ্রূণ নষ্ট করতে গেলে তার সন্তান ধারণের অঙ্গটি অকার্যকর হয়ে যায়। এসব কাহিনি সে কত সহজে বলে দিল। অথচ আমরা এখনো জমিদারের নাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে উঠেপড়ে লাগি। পশ্চিমের ওরা যারা অনেক পরিশ্রম, অনেক প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করে সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়, তারা নাকি তাদের অতীত অনুকূল থাকলেও নিজের চেষ্টায় বড় হয়েছে বলতেই বেশি ভালোবাসে।
স্বনির্মাণের চেয়ে বড় কোনো সাফল্য মানুষের হতে পারে বলে তাদের জানা নেই। পৃথিবীর বিখ্যাত মানুষদের অনেকেই শৈশব-কৈশোরে অত্যন্ত দরিদ্র ও সীমাহীন কষ্ট ভোগ করে নিজের চেষ্টায় বড় হয়েছেন। অপরা উইনফ্রের মতো বিখ্যাত টিভি ব্যক্তিত্ব যে গল্প বলতে একবারও দ্বিধা করেন না, তা হলো একটা অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে কেবল মায়ের তত্ত্বাবধানে বড় হওয়া উইনফ্রে নয় বছর বয়সে ধর্ষণের শিকার হন, ১৪ বছর বয়সে মা হন এবং যাকে তিনি বাবা বলে ডাকতেন, তিনি ছিলেন একজন হতদরিদ্র নাপিত। অন্যদিকে, আমরা আশরাফ-আতরাফ নিয়ে এখনো মাঠ গরম করি। পূর্বপুরুষের হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, ১০ তলা বাড়ি, তিনতলা পুকুর—এ ধরনের গালগল্পে মেতে ওঠেন অনেকেই, যাঁরা নিজেরা কোনো দিন চেষ্টা করেননি সফল হতে। আর যাঁরা অনেক চড়াই-উতরাই পার করে বড় হয়েছেন, তাঁরা তাঁদের অতীত তুলে ধরতে লজ্জা বোধ করেন। যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, সেখানে প্রতিবছর আত্মকর্মসংস্থানে দৃষ্টান্তমূলক অবদানের জন্য সফল তরুণ-তরুণীদের জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে। সারা দেশের যোগ্য প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদনপত্র আহ্বান করা হয়। সাধারণত যাঁরা অনেক অভাব, দুঃখ, দুর্দশা, বেকারত্ব ও হতাশা মোকাবিলা করে ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস ও স্বনির্ভরতার স্বপ্নে নিজেকে প্রতিষ্ঠার বেদিতে দাঁড় করাতে সক্ষম হন, তাঁরাই এ পুরস্কার পেয়ে থাকেন। নিয়মানুযায়ী আবেদনপত্রে তাঁদের সাফল্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা করতে হয়। যিনি যত বেশি প্রতিকূলতা অতিক্রম করে জীবনযুদ্ধে জয়ী হন, তাঁর যোগ্যতা তত বেশি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়।
ইতিহাস লেখার সময় তাঁরা সত্যি কথা লেখেন। কিন্তু পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁদের সফলতার কাহিনি বলার জন্য যে পুস্তিকা প্রকাশের প্রস্তুতি নেওয়া হয়, সেখানে তাঁরা, বিশেষ করে পদকপ্রাপ্ত তরুণীরা তাঁদের কাহিনি অন্যভাবে লেখার অনুরোধ জানান। দু-তিন বছর আগে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হস্তশিল্পে সফলতার স্বাক্ষর রাখা এক তরুণী তাঁর কাহিনি অন্যভাবে লেখার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। মা-বাবা এসএসসি পরীক্ষার আগেই তাঁর বিয়ে দিলে তাঁকে আর পড়াশোনা করতে দেয়নি তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। তাঁকে উদয়াস্ত পরিশ্রম করাতেন, যৌতুকের জন্য দফায় দফায় চাপ দিতেন। কিছুদিন পর এক কন্যাসন্তান জন্ম দিলে অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। তিনি নিজে ও সন্তানটির বেঁচে থাকার জন্য পালিয়ে বাবার বাড়ি চলে যান। সেখানে গিয়ে পোশাক তৈরির প্রশিক্ষণ ও ঋণ নিয়ে মায়ের সহায়তায় ছোট আকারে প্রকল্প গড়ে তোলেন। সেই তাঁর শুরু। প্রকল্প সম্প্রসারিত হতে হতে তিনি এখন জাপান, আমেরিকা ও জার্মানিতে তাঁর তৈরি পোশাক রপ্তানি করছেন। বর্তমানে প্রকল্প থেকে তাঁর মাসিক আয় ৭৯ হাজার টাকা। মেয়েকে ভালো স্কুলে দিয়েছেন, গাড়ি কিনেছেন, ফ্ল্যাট কিনেছেন, মাস্টার্স শেষ করেছেন। এর সবই জানা তাঁর জীবনেতিহাস থেকে। কিন্তু যখন তাঁকে মঞ্চে উঠে পুরস্কারপ্রাপ্তিতে তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করতে বলা হলো, তিনি তাঁর সংগ্রামের কথার কিছুই বললেন না। উপরন্তু তাঁর স্বামীর সহযোগিতার কথাই বললেন।
আরও একজন সফল তরুণী শ্বশুরবাড়ি থেকে কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে এসে অন্য এক সহমর্মী পুরুষের সাহচর্যে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন, তিনিও তাঁর পরম বন্ধুটির কথা কোথাও উল্লেখ করলেন না। অন্য একজন ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানালেন, স্থানীয়ভাবে শীর্ষ পুরস্কারটি গ্রহণের দিন তাঁর স্বামী তাঁকে অনুষ্ঠানে যেতে নিষেধ করেন। তিনি নিষেধ অমান্য করে বের হলে যাওয়ার পথে তাঁকে মেরে গুরুতর আহত করেন। কিন্তু এসব কষ্টের কথা জনগণ জানুক, তা তাঁরা চান না। এসব বললে নাকি সমাজ তাঁদের ভালো চোখে দেখবে না, তাই। বিখ্যাত প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরীর ‘আমরা ও তোমরা’ প্রবন্ধটা অনেকেই পড়েছেন। প্রবন্ধের শেষে তিনি বলছেন, ‘প্রাচী ও প্রতীচী পৃথক। আমরাও ভালো, তোমরাও ভালো—শুধু তোমাদের ভালো আমাদের মন্দ ও আমাদের ভালো তোমাদের মন্দ। সুতরাং অতীতের আমরা ও বর্তমানের তোমরা, এই দুয়ে মিলে যে ভবিষ্যতের তারা হবে—তাও অসম্ভব।’ তবে এখন ‘অসম্ভব’ শব্দটি অনেকেই অভিধান থেকে তুলে দিতে চাইছেন। স্যাটেলাইটের বদৌলতে আমরা আর ওরা অনেক কাছাকাছি। সত্যের সহজ স্বীকারোক্তিতে মানুষ ছোট হয় না, বরং তার সংগ্রামের কাহিনি হতাশাগ্রস্ত ও অকৃতকার্য ব্যক্তিদের কাছে সফল হওয়ার প্রধান মূলমন্ত্র।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।
No comments