সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে কওমি মাদরাসার জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ by দীন ইসলাম
দেশের সব কওমি মাদরাসাগুলোকে সরকারের
নিয়ন্ত্রণে আনতে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠন করা হচ্ছে। এ কর্তৃপক্ষে একজন
চেয়ারম্যান ও সাত জন সদস্য থাকবেন। তারা কর্তৃপক্ষের নীতিনির্ধারণী কাজ
করবেন।
গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে
অনুষ্ঠিত প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির বৈঠকে ‘বাংলাদেশ কওমি
মাদরাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইন-২০১৩’ খসড়া নীতিগত অনুমোদনের জন্য ওঠানো হয়।
তড়িঘড়ি করে ওঠানোর কারণে খুব একটা যাচাই বাছাই না করেই আইনটি সচিব কমিটি
অনুমোদন দিয়েছে। আইনটি নিয়ে দেশের বিশিষ্ট আলেমরা বলেন, কওমি মাদরাসাগুলোকে
সব সময় সরকারের প্রভাবমুক্ত থাকতে হয়। এটাই কওমি মাদরাসার চরিত্র। এখন
কওমি মাদরাসার আলেমদের সরকারপন্থি করার মিশনকে কেউ মেনে নেবে না। এটা
স্পষ্ট দালালি ছাড়া আর কিছু নয়। কওমি মাদরাসাগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থানে
স্থানে অনেক বোর্ড রয়েছে। তাই আলাদাভাবে কর্তৃপক্ষ গঠন করার কোন মানে হয়
না। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকালেই সচিব কমিটির সভায়
উত্থাপনের জন্য শিক্ষা সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী সারসংক্ষেপ
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠান। এরপরই তা প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব
কমিটির বৈঠকে ওঠানো হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ কওমি
মাদরাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার জন্যই আইনটি তৈরি করা হয়েছে। খসড়া
আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে- কর্তৃপক্ষ একটি স্বতন্ত্র ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা
হবে। এছাড়া, ধারা ৫-এ বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের একজন চেয়ারম্যান, কওমি
শিক্ষাক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় সাত জন আলেম সরকার নিয়োগ করবে। একই সঙ্গে কওমি
মাদরাসার উল্লেখযোগ্য বোর্ডগুলোর প্রধানসহ অন্যদের নিয়ে কর্তৃপক্ষ গঠন করা
হবে। প্রস্তাবিত আইনের ধারা ৯-এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা
কর্তৃপক্ষের কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা, কওমি বোর্ডগুলোর কার্যক্রম
পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন, কওমি মাদরাসাগুলোর পরিদর্শন পদ্ধতি নির্ধারণ, কওমি
মাদরাসা শিক্ষার জন্য যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম নির্ধারণ, কওমি মাদরাসা শিক্ষায়
জ্ঞানের বিকাশ, বিস্তার ও অগ্রগতির লক্ষ্যে শিক্ষাদান ও গবেষণার ব্যবস্থা
করা, কওমি মাদরাসা শিক্ষকদের বুনিয়াদি, চাকরিকালীন এবং বিষয় ভিত্তিক
প্রাগ্রসর জ্ঞানের প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এই আইনে বিধান
রাখা হয়েছে। ওদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো সারসংক্ষেপে শিক্ষা
মন্ত্রণালয় বলেছে, এই মুহূর্তে আইনটি বাস্তবায়নে সরকারের কোন আর্থিক
সংশ্লেষ নেই। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ বিধৃত মাদরাসা শিক্ষার কৌশল হিসেবে
মাদরাসা শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কওমি মাদরাসা
শিক্ষা কমিশন গঠন করার কথা উল্লেখ রয়েছে। ওই আলোকে ২০১২ সালের ১৫ই এপ্রিল
১৭ সদস্যবিশিষ্ট ‘বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা কমিশন’ গঠন করা হয়। কমিশনে
চট্টগ্রাম হাটহাজারীর দারুল উলূম মঈনুল ইসলামের মহাপরিচালক আল্লামা শাহ
আহমেদ শফীকে চেয়ারম্যান করা হয়। এছাড়া কো-চেয়ারম্যান ইকরা বাংলাদেশের
পরিচালক মাওলানা আল্লামা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ এবং গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা
মাদরাসা মহাপরিচালক মাওলানা মুফতি রুহুল আমিনকে সদস্য সচিব করা হয়। সদস্য
করা হয় দেশের বিভিন্ন জেলার বিশিষ্ট আলেমদের। কমিশন তার কার্যক্রম শেষে
প্রতিবেদন হিসেবে কওমি শিক্ষানীতির খসড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। যদিও
প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময় কমিশনের চেয়ারম্যান ও বেশির ভাগ সদস্য অনুপস্থিত
ছিলেন। কমিশনের কো-চেয়ারম্যান আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসুদের নেতৃত্বে তিন
সদস্যের টিম প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ
নীতি পেশ করেন। ওই সময় কমিশনের সদস্য সচিব আল্লামা মুফতি রুহুল আমিন ও
প্রশাসনিক কর্মকর্তা এম নাজমুল হক উপস্থিত ছিলেন। কওমি কমিশনের দাখিল করা
খসড়া নীতিমালায় কওমি মাদরাসা শিক্ষা কমিশন গঠন করার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষা
মন্ত্রণালয়ের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, খসড়া আইনটি নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয়
কওমি আলেমদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। প্রস্তাবিত খসড়া নীতিমালার আলোকে
কওমি মাদরাসার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, মান উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের সনদ প্রদান
কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য একটি কওমি মাদরাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ
প্রতিষ্ঠার জন্য ‘বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইন ২০১৩’-এর
খসড়া তৈরি করা হয়। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আইনটির খসড়া তৈরির
পর থেকেই এ নিয়ে তড়িঘড়ি শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ৮ই অক্টোবর একটি
আন্তঃ মন্ত্রণালয় সভা আহ্বান করে খসড়া আইনটি চূড়ান্ত করা হয়। এরপর অতি
দ্রুত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং অর্থ বিভাগের মতামত নেয়া হয়। এরপর গতকাল
সকালে তা প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির বৈঠকে ওঠানো হয়। এখন শুধু
মন্ত্রিসভা বৈঠক বাকি। মন্ত্রিসভার অনুমোদন মিললেই তা অধ্যাদেশ আকারে জারি
হবে। এর আগে এ বছরের ২৫শে জুন সংসদে প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা জানান, সরকার দেশের সব কওমি মাদরাসাকে নিয়মের আওতায় আনতে পদক্ষেপ
নিয়েছে। এ জন্য কওমি মাদরাসা শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কওমি
শিক্ষা ব্যবস্থাকে মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কোন
পদক্ষেপ নেয়া হয়নি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমান
সরকারই প্রথম কওমি মাদরাসার শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে
একটি কওমি মাদরাসা শিক্ষা কমিশন গঠন করে।
No comments