অসহায় ব্যাঙের পুরনো গল্প এবং হিংসার রাজনীতি by একেএম শাহ নাওয়াজ
সবার
জানা গল্প। বালকরা মহা-উৎসাহে ঢিল ছুড়ছে ডোবায়। সেখানে বসত অনেক ব্যাঙের।
ঢিল ব্যাঙদের গায়ে লাগছে। আহত হচ্ছে অনেকে। এতে উৎসাহ বেড়ে গেল বালকদের।
হাতের নিশানা প্র্যাকটিসে মত্ত হল। এবার জল থেকে ভেসে উঠল এক প্রবীণ ব্যাঙ।
বালকদের উদ্দেশে বলল, তোমাদের জন্য যা আনন্দের, আমাদের জন্য তা মৃত্যুর।
আজ আমাদের ক্ষমতাবান রাজনীতিকরা ভয়ংকর বালকসুলভ বা বালখিল্যসুলভ আচরণে
মেতেছেন। নিজেদের লোভের পেয়ালা পূর্ণ করতে চাইছেন। আর সে পথে মোক্ষে
পৌঁছতে গিনিপিগ সাধারণ মানুষের ওপর মরণ ঢিল ছোড়া শুরু করেছেন। নিজেদের
স্বার্থ আদায়ে আর কোনো দেশে এভাবে রাজনীতিকরা দেশবাসীকে জিম্মি করেন কি-না
আমাদের জানা নেই। আওয়ামী লীগ বলি আর বিএনপি বলি- বর্তমানে যে ধারায় দল
পরিচালিত হচ্ছে, তাতে এ দুই দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা আছে এমনটি জোর
করেও বিশ্বাস করা কঠিন হবে। গণতন্ত্র চর্চার সংকট আছে বলেই বক্তৃতার মঞ্চে
আর সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে বেশি বেশি গণতন্ত্রের জপ করেন আমাদের
নেতা-নেত্রীরা। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য গণতান্ত্রিক পন্থা
অবলম্বন করার আগ্রহ কোনো পক্ষের নেই। কার ঘাড়ে পা রেখে কে ক্ষমতার মসনদে
বসবেন, তারা এ কসরৎই করছেন প্রতিনিয়ত। ফলে একের পর এক স্বেচ্ছাচারী
কর্মসূচি চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। কোনো গণতান্ত্রিক বোধের
পরিচয় মিলছে না আমাদের রাজনীতিকদের মধ্যে। এ কারণেই সাধারণ মানুষের
সমর্থনের ধার না ধেরে জনবিধ্বংসী কর্মসূচি ঘোষণা করে যাচ্ছেন জনগণের দোহাই
দিয়ে।
দুই অনড় প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং তার জোটবন্ধুরা যার যার খেয়া তরীতে দাঁড়িয়ে নিশ্চল। দেশে নিজেরাই আগুন লাগিয়ে নিরোর ভূমিকায় বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছেন। সে আগুনের বিষাক্ত ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে সাধারণ মানুষের, তবুও প্রতারকের মতো উভয় পক্ষ জনগণের নাম ব্যবহার করছে অবলীলায়। একদল জনগণকে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক অথবা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করবেন। আর অন্যদল কাটা-ছেঁড়ায় শতছিন্ন সংবিধানের দোহাই দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করবেন। কেউ কাউকে ‘একচুল’ও ছাড় দেবেন না। এসব কিছুর একটাই লক্ষ্য- মসনদ পাওয়া। একদল যে করেই হোক ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবেনই। আর অন্যদল মসনদ হারানোর সাত বছর অতিক্রম করে অস্থির হয়ে পড়েছে। যে করেই হোক মসনদ এবার পেতে হবেই। তাই রণরঙ্গিনী মূর্তি। রাজনীতি দিয়ে রাজনীতির মোকাবেলা করতে হলে চাই গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। দলের ভেতরে এবং দলের আদর্শে গণতান্ত্রিক বোধ ও চর্চা থাকলে রাজনীতির গতিপথ ধরেই মোক্ষে পৌঁছা সম্ভব। জনগণই এ চলার পথ সহজ করে দেবে। কিন্তু জনগণের প্রতি ভরসা রাখার মতো মনের জোর কোনো পক্ষের নেই। দলগুলোর পরিচালকরা গণশক্তির ওপর আস্থাশীল না হয়ে অর্থশক্তি আর পেশিশক্তির ওপর ভরসা করেছেন বেশি। তাই শক্তি প্রয়োগে সুবিধার ফসল ঘরে তুলতে চান তারা। নির্বাচন পদ্ধতি কী হবে এ নিয়ে ঝগড়া তো চলছে অনেক দিন ধরে। রাজনীতির মাঠে মধ্যাহ্ন অপরাহœ পেরিয়ে এখন সন্ধ্যা নামিয়ে দিয়েছেন ক্ষমতার রাজনীতিকরা। তবুও কোনো আপস ফর্মুলায় আসতে পারেনি দুই পক্ষ। বলা ভালো, আপসের পথে হাঁটেনি কোনো পক্ষ। যার যার অবস্থানে গোঁ ধরে বসে আছেন। এ নিয়েও মজা কম হয়নি। গত এক-দেড় বছর আগে যখন সংলাপের কথা বলা হয়েছে, তখন আওয়ামী লীগ আগ্রহী হলেও বিএনপি পিছু হটেছে। আর চার সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা জিতে গেলে পায়ের নিচে মাটি পেয়ে যায় বিএনপি। এবার সংলাপের জন্য বিএনপি অগ্রণী হতে থাকে আর পেছাতে থাকে আওয়ামী লীগ। এসব নাটকে বোঝা যায় সংলাপ-টংলাপ কোনো বিষয় নয়, কোনো পক্ষই জনগণের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবছে না। তাদের ভাবনা সিংহাসন নিয়ে। তাই সুস্থতা নয়, হিংসার রাজনীতি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে চারপাশে।
আলোচনার টেবিলে বসে জাতীয় সংকট মোকাবেলার সভ্য আচরণ আমাদের ক্ষমতার রাজনীতিকরা ভুলে গেছেন অনেক আগেই। বিএনপি নেতারা তাদের নির্দলীয় সরকারের দাবি সংসদীয় গণতন্ত্রের বাংলাদেশে সংসদে এসে উত্থাপনে সাহস পাচ্ছেন না। দুর্বল সদস্যসংখ্যার ভীতি তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কণ্ঠভোটে নাকচ হওয়ার ভয়ে বিএনপি বরাবর কম্পমান। লাগাতার সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি বিএনপির মধ্যে সংসদ সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টির পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বাস্তবতার কারণে আলোচনায় দ্বন্দ্বের সুরাহা হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায়। তাছাড়া সংলাপের ইতিহাস মানুষ ভুলে যায়নি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মরহুম আবদুল জলিল এবং বিএনপির পক্ষ থেকে মরহুম মান্নান ভূঁইয়া সংলাপ করেছেন। শেষ পর্যন্ত অশ্বডিম্বই প্রসব করতে হয়েছে। এ বাস্তবতা মানতে হবে যে, শত সদিচ্ছা থাকলেও সিদ্ধান্তে পৌঁছা অসম্ভব। কারণ এমনই গণতন্ত্র দুই দলে রয়েছে যে, ছোট-বড় যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা বা এখতিয়ার রয়েছে শুধু দুই দলের সভানেত্রীর হাতে। তাই সংলাপকারীদের দৃষ্টি শুধু থাকে যার যার নেত্রীদের জ্বালানো লালবাতি-সবুজবাতির দিকে। জাতীয় স্বার্থে সার্থক সংলাপ হতে হলে দুই নেত্রীকেই মুখোমুখি বসতে হবে। কিন্তু এ তো সুকঠিন বিষয়। যে দেশে দুই প্রধান নেত্রী পরস্পরের ছায়াটা পর্যন্ত মাড়ান না, দৃষ্টপাত করেন না একে অন্যের দিকে, বক্তৃতার মঞ্চে একে অন্যের প্রতি গড়ল উগড়ে দেন- সেখানে সংলাপে বসার চিন্তা অলীক স্বপ্নবিলাস।
এ অবস্থায় অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে হাঁটতে হয় দেশবাসীকে। বলা যায়, অন্ধকার গহ্বরের দিকেই হাঁটতে হয়। আমাদের ক্ষমতাবান রাজনীতিকরা জনগণকে স্বস্তি দিতে না পারলেও সন্ত্রস্ত করে তুলতে পারেন অনায়াসেই। তাই নির্বাচনী ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন রাজনীতিকদের তৈরি তমসায় আবর্তিত মানুষ কুহক কাটাতে পারছে না, তখন তারা ভয়ংকর ভবিষ্যৎ রচনার গল্প শোনালেন। দেশবাসীকে পিষে চিড়ে চ্যাপটা করে হলেও ক্ষমতায় যাওয়ার হিংসার রাজনীতির পথটাই বেছে নিতে চাইলেন। বিএনপি ঘোষণা দিল ২৫ অক্টোবর থেকে তারা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে রাজপথ দখল করবে। প্রয়োজনে সব কিছু অচল করে দেয়ার ঘোষণাও দেয়া হল। অর্থাৎ ক্ষমতা দখলের রণহুঙ্কার।
আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থা ঘরপোড়া গরুর মতো। সাম্প্রতিক সময়ে রাজপথ আন্দোলনে বিএনপির পারফরম্যান্স দেখেছে দেশবাসী। সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে মাঠ আগলে রাখার ক্ষমতা নেই বিএনপির। তাই ভাড়াটে শক্তি দলটির ভরসা। এর আগেও অবরোধের নামে জামায়াত-শিবিরের জঙ্গি তাণ্ডবে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছিল। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় অনালোচিত হেফাজতে ইসলাম নামে একটি সংগঠিত মৌলবাদী দল বিএনপির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দুই মৌলবাদী দলের পেশিশক্তিকে ভরসা করে সরকার পতনের বড় রকম চেষ্টা করেছে বিএনপি। সরকারি তৎপরতায় শেষ পর্যন্ত ফিনিশিং দেয়া সম্ভব হয়নি। ফাঁস হওয়া ষড়যন্ত্র সব সময় ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য বিপজ্জনক। তাই ২৫ অক্টোবর বিএনপির মাঠ দখলের কর্মসূচিকে সর্বাধিক সতর্কতায় দেখছে সরকার পক্ষ। রাজনৈতিক কূটকৌশল হিসেবে একই দিনে ঢাকায় আওয়ামী লীগও সমাবেশ ডেকেছে। অর্থাৎ দুই পক্ষ সম্মুখ সমরে। পরে অবশ্য সুর নরম হয়েছে। আওয়ামী লীগ সমাবেশ থেকে সরে আসার চিন্তার কথা জানিয়েছে।
আমাদের মান্যবর নেতা-নেত্রীরা কখন কী বলেন, কতটা ভেবে বলেন অথবা জনগণকে বেকুব ঠাউরে বলেন কি-না, আমরা জানি না। তবে মানুষের এই আতংকিত অবস্থায় বোমা ফাটালেন বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা। তার কথার ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়, তিনি ঢাকার সমাবেশে আসার সময় নেতা-কর্মীদের দা, কুড়াল, জুতি, টেঁটার মতো ধারালো অস্ত্র বহন করার নির্দেশ দিয়েছেন। সরকারি দলের কাছ থেকে বাধা পেলে তারা যাতে হাতের অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রাজনীতিকদের কী ভয়ানক দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য! বিস্মিত স্তম্ভিত অনেকেই ভাবছেন, পাল্টাপাল্টি রাজনীতির এ দেশে এটা বোধহয় সাত বছর আগের লগি-বৈঠার ডাকের প্রতিশোধ। ডিজিটাল বাংলাদেশে সময় এগিয়ে যাচ্ছে। তাই লগি-বৈঠার সেকেলে অস্ত্রের চেয়ে অপেক্ষাকৃত আধুনিক ধারালো অস্ত্র বহনের কথা বলেছেন জনাব খোকা। আশংকা করছি, এর পর আধুনিক কোনো পক্ষ আগ্নেয়াস্ত্র বহনের নির্দেশ হয়তো দেবে! অবশ্য সে ইঙ্গিতও আছে। বিএনপি নেতা রিজভী সম্ভবত বারুদ বহনের নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ তিনি সমাবেশে আসা ‘পদাতিক’ নেতাকর্মীদের প্রয়োজনে ‘গোলন্দাজ বাহিনী’তে পরিণত হতে বলেছেন। অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, সেদিন ফাইনাল খেলা হবে। এটি কী ধরনের খেলা আমরা কমবখত তা ঠাহর করতে না পেরে আরও বেশি আতংকিত হয়েছি। এর আগে নাকি কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল হয়ে গেছে। এসব খেলার খোঁজ আমার দুর্বল অ্যান্টেনা এখনও ধরতে পারছে না। তবে এ ধারার বাৎচিত যে জনমনে আতংক ছড়াচ্ছে, তা আর বলে বোঝাতে হবে না।
জনগণের প্রতি বিরোধী দল দায়িত্ব পালন না করলেও সরকার পক্ষ দায়িত্ব এড়াতে পারে না। মানুষকে নির্ভয় করা, নিরাপত্তা দেয়া সরকারেরই দায়িত্ব। সে দায়িত্ব সরল পথে সরকার পালন করছে, এমনটি ভাবতে পারছে না মানুষ। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ব্যাপারে গোঁ ধরে বসে না থাকলে হয়তো একটি বিকল্প পথ বেরিয়ে আসতে পারত। সেসব রাস্তায় না হেঁটে হিংসার রাজনীতির পথই যেন বেছে নিল সরকার পক্ষ। বল প্রয়োগে আন্দোলন থামানোর পুরনো পথেই হাঁটার সিদ্ধান্ত নিল। দুই পক্ষের এই রাজনীতির খেলা দুরন্ত বালকদের ঢিল ছোড়ার মতোই ভয়ংকর। সাধারণ মানুষ ও জনজীবন এখন ভীষণভাবে আতংকগ্রস্ত। প্রবীণ ব্যাঙের করুণ আর্তি বালকেরা শুনেছিল কি-না জানি না। তবে সাধারণ মানুষের আর্তি শুনে ক্ষমতার মসনদে যাওয়ার প্রতিযোগিতার পথে নিজ গতি শ্লথ করে দেয়ার মতো বোকামি করতে রাজি নয় কোনো পক্ষ।
শেষ পর্যন্ত মঙ্গল চিন্তা করতে ভালো লাগে। পবিত্র ঈদের দিনে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া অপেক্ষাকৃত নমনীয়ভাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব দিয়ে তাতে যোগ দেয়ার জন্য বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আমি মর্নিং ওয়াক করতে গিয়ে দুই শালিক দেখেছি। শুভ কিছুর প্রত্যাশায় অপেক্ষা করতে চাই।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
দুই অনড় প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং তার জোটবন্ধুরা যার যার খেয়া তরীতে দাঁড়িয়ে নিশ্চল। দেশে নিজেরাই আগুন লাগিয়ে নিরোর ভূমিকায় বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছেন। সে আগুনের বিষাক্ত ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে সাধারণ মানুষের, তবুও প্রতারকের মতো উভয় পক্ষ জনগণের নাম ব্যবহার করছে অবলীলায়। একদল জনগণকে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক অথবা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করবেন। আর অন্যদল কাটা-ছেঁড়ায় শতছিন্ন সংবিধানের দোহাই দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করবেন। কেউ কাউকে ‘একচুল’ও ছাড় দেবেন না। এসব কিছুর একটাই লক্ষ্য- মসনদ পাওয়া। একদল যে করেই হোক ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবেনই। আর অন্যদল মসনদ হারানোর সাত বছর অতিক্রম করে অস্থির হয়ে পড়েছে। যে করেই হোক মসনদ এবার পেতে হবেই। তাই রণরঙ্গিনী মূর্তি। রাজনীতি দিয়ে রাজনীতির মোকাবেলা করতে হলে চাই গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। দলের ভেতরে এবং দলের আদর্শে গণতান্ত্রিক বোধ ও চর্চা থাকলে রাজনীতির গতিপথ ধরেই মোক্ষে পৌঁছা সম্ভব। জনগণই এ চলার পথ সহজ করে দেবে। কিন্তু জনগণের প্রতি ভরসা রাখার মতো মনের জোর কোনো পক্ষের নেই। দলগুলোর পরিচালকরা গণশক্তির ওপর আস্থাশীল না হয়ে অর্থশক্তি আর পেশিশক্তির ওপর ভরসা করেছেন বেশি। তাই শক্তি প্রয়োগে সুবিধার ফসল ঘরে তুলতে চান তারা। নির্বাচন পদ্ধতি কী হবে এ নিয়ে ঝগড়া তো চলছে অনেক দিন ধরে। রাজনীতির মাঠে মধ্যাহ্ন অপরাহœ পেরিয়ে এখন সন্ধ্যা নামিয়ে দিয়েছেন ক্ষমতার রাজনীতিকরা। তবুও কোনো আপস ফর্মুলায় আসতে পারেনি দুই পক্ষ। বলা ভালো, আপসের পথে হাঁটেনি কোনো পক্ষ। যার যার অবস্থানে গোঁ ধরে বসে আছেন। এ নিয়েও মজা কম হয়নি। গত এক-দেড় বছর আগে যখন সংলাপের কথা বলা হয়েছে, তখন আওয়ামী লীগ আগ্রহী হলেও বিএনপি পিছু হটেছে। আর চার সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা জিতে গেলে পায়ের নিচে মাটি পেয়ে যায় বিএনপি। এবার সংলাপের জন্য বিএনপি অগ্রণী হতে থাকে আর পেছাতে থাকে আওয়ামী লীগ। এসব নাটকে বোঝা যায় সংলাপ-টংলাপ কোনো বিষয় নয়, কোনো পক্ষই জনগণের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবছে না। তাদের ভাবনা সিংহাসন নিয়ে। তাই সুস্থতা নয়, হিংসার রাজনীতি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে চারপাশে।
আলোচনার টেবিলে বসে জাতীয় সংকট মোকাবেলার সভ্য আচরণ আমাদের ক্ষমতার রাজনীতিকরা ভুলে গেছেন অনেক আগেই। বিএনপি নেতারা তাদের নির্দলীয় সরকারের দাবি সংসদীয় গণতন্ত্রের বাংলাদেশে সংসদে এসে উত্থাপনে সাহস পাচ্ছেন না। দুর্বল সদস্যসংখ্যার ভীতি তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কণ্ঠভোটে নাকচ হওয়ার ভয়ে বিএনপি বরাবর কম্পমান। লাগাতার সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি বিএনপির মধ্যে সংসদ সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টির পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বাস্তবতার কারণে আলোচনায় দ্বন্দ্বের সুরাহা হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায়। তাছাড়া সংলাপের ইতিহাস মানুষ ভুলে যায়নি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মরহুম আবদুল জলিল এবং বিএনপির পক্ষ থেকে মরহুম মান্নান ভূঁইয়া সংলাপ করেছেন। শেষ পর্যন্ত অশ্বডিম্বই প্রসব করতে হয়েছে। এ বাস্তবতা মানতে হবে যে, শত সদিচ্ছা থাকলেও সিদ্ধান্তে পৌঁছা অসম্ভব। কারণ এমনই গণতন্ত্র দুই দলে রয়েছে যে, ছোট-বড় যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা বা এখতিয়ার রয়েছে শুধু দুই দলের সভানেত্রীর হাতে। তাই সংলাপকারীদের দৃষ্টি শুধু থাকে যার যার নেত্রীদের জ্বালানো লালবাতি-সবুজবাতির দিকে। জাতীয় স্বার্থে সার্থক সংলাপ হতে হলে দুই নেত্রীকেই মুখোমুখি বসতে হবে। কিন্তু এ তো সুকঠিন বিষয়। যে দেশে দুই প্রধান নেত্রী পরস্পরের ছায়াটা পর্যন্ত মাড়ান না, দৃষ্টপাত করেন না একে অন্যের দিকে, বক্তৃতার মঞ্চে একে অন্যের প্রতি গড়ল উগড়ে দেন- সেখানে সংলাপে বসার চিন্তা অলীক স্বপ্নবিলাস।
এ অবস্থায় অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে হাঁটতে হয় দেশবাসীকে। বলা যায়, অন্ধকার গহ্বরের দিকেই হাঁটতে হয়। আমাদের ক্ষমতাবান রাজনীতিকরা জনগণকে স্বস্তি দিতে না পারলেও সন্ত্রস্ত করে তুলতে পারেন অনায়াসেই। তাই নির্বাচনী ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন রাজনীতিকদের তৈরি তমসায় আবর্তিত মানুষ কুহক কাটাতে পারছে না, তখন তারা ভয়ংকর ভবিষ্যৎ রচনার গল্প শোনালেন। দেশবাসীকে পিষে চিড়ে চ্যাপটা করে হলেও ক্ষমতায় যাওয়ার হিংসার রাজনীতির পথটাই বেছে নিতে চাইলেন। বিএনপি ঘোষণা দিল ২৫ অক্টোবর থেকে তারা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে রাজপথ দখল করবে। প্রয়োজনে সব কিছু অচল করে দেয়ার ঘোষণাও দেয়া হল। অর্থাৎ ক্ষমতা দখলের রণহুঙ্কার।
আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থা ঘরপোড়া গরুর মতো। সাম্প্রতিক সময়ে রাজপথ আন্দোলনে বিএনপির পারফরম্যান্স দেখেছে দেশবাসী। সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে মাঠ আগলে রাখার ক্ষমতা নেই বিএনপির। তাই ভাড়াটে শক্তি দলটির ভরসা। এর আগেও অবরোধের নামে জামায়াত-শিবিরের জঙ্গি তাণ্ডবে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছিল। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় অনালোচিত হেফাজতে ইসলাম নামে একটি সংগঠিত মৌলবাদী দল বিএনপির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দুই মৌলবাদী দলের পেশিশক্তিকে ভরসা করে সরকার পতনের বড় রকম চেষ্টা করেছে বিএনপি। সরকারি তৎপরতায় শেষ পর্যন্ত ফিনিশিং দেয়া সম্ভব হয়নি। ফাঁস হওয়া ষড়যন্ত্র সব সময় ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য বিপজ্জনক। তাই ২৫ অক্টোবর বিএনপির মাঠ দখলের কর্মসূচিকে সর্বাধিক সতর্কতায় দেখছে সরকার পক্ষ। রাজনৈতিক কূটকৌশল হিসেবে একই দিনে ঢাকায় আওয়ামী লীগও সমাবেশ ডেকেছে। অর্থাৎ দুই পক্ষ সম্মুখ সমরে। পরে অবশ্য সুর নরম হয়েছে। আওয়ামী লীগ সমাবেশ থেকে সরে আসার চিন্তার কথা জানিয়েছে।
আমাদের মান্যবর নেতা-নেত্রীরা কখন কী বলেন, কতটা ভেবে বলেন অথবা জনগণকে বেকুব ঠাউরে বলেন কি-না, আমরা জানি না। তবে মানুষের এই আতংকিত অবস্থায় বোমা ফাটালেন বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা। তার কথার ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়, তিনি ঢাকার সমাবেশে আসার সময় নেতা-কর্মীদের দা, কুড়াল, জুতি, টেঁটার মতো ধারালো অস্ত্র বহন করার নির্দেশ দিয়েছেন। সরকারি দলের কাছ থেকে বাধা পেলে তারা যাতে হাতের অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রাজনীতিকদের কী ভয়ানক দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য! বিস্মিত স্তম্ভিত অনেকেই ভাবছেন, পাল্টাপাল্টি রাজনীতির এ দেশে এটা বোধহয় সাত বছর আগের লগি-বৈঠার ডাকের প্রতিশোধ। ডিজিটাল বাংলাদেশে সময় এগিয়ে যাচ্ছে। তাই লগি-বৈঠার সেকেলে অস্ত্রের চেয়ে অপেক্ষাকৃত আধুনিক ধারালো অস্ত্র বহনের কথা বলেছেন জনাব খোকা। আশংকা করছি, এর পর আধুনিক কোনো পক্ষ আগ্নেয়াস্ত্র বহনের নির্দেশ হয়তো দেবে! অবশ্য সে ইঙ্গিতও আছে। বিএনপি নেতা রিজভী সম্ভবত বারুদ বহনের নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ তিনি সমাবেশে আসা ‘পদাতিক’ নেতাকর্মীদের প্রয়োজনে ‘গোলন্দাজ বাহিনী’তে পরিণত হতে বলেছেন। অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, সেদিন ফাইনাল খেলা হবে। এটি কী ধরনের খেলা আমরা কমবখত তা ঠাহর করতে না পেরে আরও বেশি আতংকিত হয়েছি। এর আগে নাকি কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল হয়ে গেছে। এসব খেলার খোঁজ আমার দুর্বল অ্যান্টেনা এখনও ধরতে পারছে না। তবে এ ধারার বাৎচিত যে জনমনে আতংক ছড়াচ্ছে, তা আর বলে বোঝাতে হবে না।
জনগণের প্রতি বিরোধী দল দায়িত্ব পালন না করলেও সরকার পক্ষ দায়িত্ব এড়াতে পারে না। মানুষকে নির্ভয় করা, নিরাপত্তা দেয়া সরকারেরই দায়িত্ব। সে দায়িত্ব সরল পথে সরকার পালন করছে, এমনটি ভাবতে পারছে না মানুষ। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ব্যাপারে গোঁ ধরে বসে না থাকলে হয়তো একটি বিকল্প পথ বেরিয়ে আসতে পারত। সেসব রাস্তায় না হেঁটে হিংসার রাজনীতির পথই যেন বেছে নিল সরকার পক্ষ। বল প্রয়োগে আন্দোলন থামানোর পুরনো পথেই হাঁটার সিদ্ধান্ত নিল। দুই পক্ষের এই রাজনীতির খেলা দুরন্ত বালকদের ঢিল ছোড়ার মতোই ভয়ংকর। সাধারণ মানুষ ও জনজীবন এখন ভীষণভাবে আতংকগ্রস্ত। প্রবীণ ব্যাঙের করুণ আর্তি বালকেরা শুনেছিল কি-না জানি না। তবে সাধারণ মানুষের আর্তি শুনে ক্ষমতার মসনদে যাওয়ার প্রতিযোগিতার পথে নিজ গতি শ্লথ করে দেয়ার মতো বোকামি করতে রাজি নয় কোনো পক্ষ।
শেষ পর্যন্ত মঙ্গল চিন্তা করতে ভালো লাগে। পবিত্র ঈদের দিনে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া অপেক্ষাকৃত নমনীয়ভাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব দিয়ে তাতে যোগ দেয়ার জন্য বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আমি মর্নিং ওয়াক করতে গিয়ে দুই শালিক দেখেছি। শুভ কিছুর প্রত্যাশায় অপেক্ষা করতে চাই।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments