সার্বিক বিচারে ক্ষতিকারকই by ড.কে এইচ এম নাজমুল হুসাইন নাজির
আগামীকাল ২২ অক্টোবর উদ্বোধন হওয়ার কথা
রয়েছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক
মেগাপ্রজেক্ট রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের। দারুণ খবর! দেশের ক্রমবর্ধমান
বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে কেন্দ্রটি। উৎপাদন শুরু
হলে রামপালে প্রতিদিন প্রয়োজন হবে ১০ হাজার টন কয়লা। ঠিকই দেখছেন, সংখ্যাটি
১০ হাজার টন। শুধু বিদ্যুৎ নয়, সঙ্গে উপহার হিসেবে কেন্দ্রটি অন্যান্য
ক্ষতিকর উপাদানের সঙ্গে প্রতিদিন দেবে ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড ও
৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড। বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা
পুড়িয়ে সাড়ে ৭ লাখ টন ফ্লাই-অ্যাশ পাওয়া যাবে। শুধু বাতাস নয়, মাটি-পানিও
পাবে ২ লাখ টন বটম-অ্যাশ। এ বিপুল পরিমাণ অ্যাশ বাতাস, পানি বা মাটিতে
নিরাপদ টানেল বানিয়ে বিদেশে রফতানি করা হবে কিনা- সে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
অবশ্যই না। আমাদের দেশেই থেকে যাবে। ছড়িয়ে পড়বে আশপাশের এলাকায়। পরিবেশ হবে
দারুণভাবে বিপর্যস্ত। ইকো-সিস্টেম মারাÍক হুমকির মুখে পড়বে। জীব-বৈচিত্র্য
হবে বিপন্ন। বলা হচ্ছে, অতি উচ্চপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে যার ফলে মাত্র
১৫ ভাগ ফ্লাই-অ্যাশ বাতাসে মিশবে। যদিও বটম-অ্যাশ বা বিষাক্ত সালফার
ডাই-অক্সাইডের কথা পরিষ্কার নয়। একই ধরনের কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে
১৯৭৯ সালে একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল যা থেকে বছরে ৩০
হাজার টন সালফার ডাই-অক্সাইড তৈরি হচ্ছে। ২০১০ সাল পর্যন্ত হিসাবে দেখা যায়
বিশেষত সালফার ডাই-অক্সাইডের ভয়াবহ প্রভাব কেন্দ্রটি থেকে ৪৮ কিমি দূর
পর্যন্ত পৌঁছলে সেখানকার পেকান, ওক প্রভৃতি গাছের বাগান মারা পড়েছে।
উল্লেখ্য, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিমি দূরে
অবস্থিত। রামপাল থেকে তৈরি হবে বছরে ৫১ হাজার ৮৩০ টন সালফার ডাই-অক্সাইড যা
টেক্সাসের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির তুলনায় অনেক বেশি। টেক্সাসের অভিজ্ঞতা থেকে
পরিষ্কার বোঝা যায়, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে সুন্দরবনকে বাঁচানো
কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যেই বিলীন
হবে সুন্দরবন।
পশুর নদকে সুন্দরবনের প্রাণ বলা যেতে পারে। অনেকে এ নদকে সুন্দরবনের প্রাণভোমরা বলে থাকেন। সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্য প্রধানত এ নদের ওপর নির্ভরশীল। জানা গেছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য প্রয়োজনীয় ঘণ্টাপ্রতি ৯১৫০ ঘনমিটার পানি সংগ্রহ করা হবে পশুর নদ থেকে। ব্যবহার ও পরিশোধন শেষে ৫১৫০ ঘনমিটার পানি পশুর নদকে ফেরত দেয়া হবে। সুতরাং পশুর নদের পানি প্রবাহে ঘাটতি হবে দিনে ৯৬০০০ ঘনমিটার। পানি ফেরত কম দেয়া হলেও বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ বাড়তি হিসেবে যোগ হবে সে পানিতে বলা যায়। কারণ পরিশোধন কত দূর হবে সে ব্যাপারেও যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশে শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য পরিশোধন শেষে পরিবেশে উন্মুক্ত করার কথা থাকলেও বাস্তবে কী হয় তা আমরা কমবেশি সবাই জানি। বুড়িগঙ্গার পানির অবস্থা স্মরণে রাখা যেতে পারে। বুড়িগঙ্গার পানিকে অনেকে বিষ বলে অভিহিত করে থাকেন। তেমনিভাবে রামপালের ফ্লাই-অ্যাশ, বটম-অ্যাশ ও অন্যান্য ক্ষতিকর বর্জ্যরে মাধ্যমে বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডসহ আর্সেনিক, সিসা, নিকেল, ক্রোমিয়াম, ভেনাডিয়াম, পারদ ইত্যাদি প্রতিনিয়ত মিশবে মাটি-পানি-বাতাসের সঙ্গে। পশুর নদের মাছসহ অন্যান্য প্রাণী, সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের জীবনচক্রে পড়বে মারাত্মক প্রভাব। একে একে ধ্বংস হবে সব। সুন্দরবন বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার না থাকলে ছাগল, বিড়াল বা কাঠবিড়ালিকে হয়তো দেশের জাতীয় পশু করা হবে কোনো একদিন।
যতটুকু জানা গেছে, রামপালের মালিকানা বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের ৫০ ভাগ করে। মূলধনের ১৫ ভাগ বাংলাদেশের ও ১৫ ভাগ ভারতের, বাকি ৭০ ভাগ আসবে ঋণ থেকে। ঋণ কোথা থেকে আসবে এবং তার সুদ কত তা পরিষ্কার নয়। বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশের পিডিবি। বিদ্যুতের দাম নির্ভর করবে কয়লার দামের ওপর। কয়লার দাম নির্ভর করবে প্রাপ্যতা ও পরিবহন খরচের ওপর। উৎপাদন খরচ পড়বে অনেক বেশি- সহজেই অনুমেয়। বিভিন্ন অজুহাতে ধাপে ধাপে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। বিদ্যুতের দাম যত বাড়বে ভারতের লাভ তত বেশি। টাকা আসবে বাংলাদেশের মানুষের পকেট থেকে। লাভের ৫০ ভাগ পাবে ভারত। সমীকরণ খুব সহজ। ভারত দেবে প্রযুক্তি ও ১৫ ভাগ মূলধন। জমিসহ বাকি সব যাবে বাংলাদেশ থেকে। সুন্দরবন বিপন্ন হওয়াসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘানিও টানতে হবে আমাদের। জানা গেছে, একই কোম্পানি (ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি) ভারতের গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশে একই ধরনের দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে চেয়েও জনসাধারণের তীব্র প্রতিবাদে ব্যর্থ হয়েছে। সুপার ক্রিটিকাল প্রযুক্তির দোহাই দেয়া হচ্ছে। প্রশ্ন জাগে, ভারত কেন সে দেশের বনসীমার ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ আইন করে নিষিদ্ধ করল? নিজের জন্য ষোল আনা অন্যের জন্য আঁটি- এমন নীতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সুন্দরবনের মতো স্পর্শকাতর স্থানের পাশে কোম্পানিটি কিভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি পেল ও বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি হল তা ভেবে দেখার বিষয়। চুক্তির বিষয়বস্তু বিস্তারিতভাবে জানা সবার যৌক্তিক অধিকার নয় কি? সরকারি প্রেসনোটে দাবি করা হয়েছে, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে ওই এলাকায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে, জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে- আরও কত কী। জানা গেছে, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মসংস্থান হবে মাত্র ছয়শ মানুষের। অন্যদিকে, সুন্দরবনের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কমপক্ষে ২ লাখ মানুষ নির্ভরশীল। ছয়শ ও ২ লাখ- তুলনা চলে কি? তাছাড়া সুন্দরবনই যদি না থাকে তাহলে জীববৈচিত্র্য বা নির্ভরশীলতার কথা অমূলক, তাই নয় কি?
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবনের আয়তন অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে ছিল বর্তমান আয়তনের প্রায় দ্বিগুণ। নানা কারণে আয়তন ছোট হয়ে বর্তমানে ঠেকেছে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারে। যার ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত। উইকিপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৭ সালে সুন্দরবন ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সুতরাং বলা যায়, সুন্দরবন এখন শুধু বাংলাদেশের সম্পদ নয়। বাংলাদেশ অংশের বন ধ্বংসের জন্য কেউ সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। সরকারি প্রেসনোটে বলা হয়েছে, রামপালের কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না সুন্দরবনের ওপর। যা আদৌ নির্ভরযোগ্য নয় বলে অনেকের মতো আমিও মনে করি। প্রেসনোট তৈরিতে কারও প্রভাব বা চাপ রয়েছে কিনা, অর্থের লোভ বা প্রাণের ভয় ছিল কিনা- ভেবে দেখা দরকার। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা না শুনলে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকির মতো বিষয়ও থাকতে পারে এর পেছনে।
পারিবারিক শান্তি থেকে শুরু করে জাতীয় উন্নয়নে বিদ্যুতের গুরুত্ব বলে শেষ নেই। কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তাও কম নয়। বিভিন্ন দেশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার ৯৩ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় কয়লা থেকে। তেমনিভাবে চীন ও অস্ট্রেলিয়া ৭৮ ভাগ, যুক্তরাষ্ট্র ৪৯ ভাগ, ভারত ৬৮ ভাগ ও জাপান ২৭ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কয়লা থেকে। সেখানে বাংলাদেশে এক ভাগেরও কম। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে রয়েছে চড়া মূল্যের গ্যাসচালিত কুইক রেন্টাল প্লান্ট যা খুব কম দেশেই আছে। কুইক রেন্টাল স্থায়ী সমাধান নয়। যাই হোক, আমাদের দেশে গ্যাসের পাশাপাশি রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কয়লা। কুইক রেন্টালের মাধ্যমে নিঃশেষ হচ্ছে দেশের অমূল্য সম্পদ প্রাকৃতিক গ্যাস। পরিবেশবান্ধব কয়লানীতি প্রণয়ন করে দেশীয় কয়লা ব্যবহার করা গেলে বিদেশী কয়লা বা দেশীয় গ্যাসের প্রতি নির্ভরশীলতা কমানো যাবে। রামপালের পাশাপাশি দেশের অন্য দুটি স্থানে জাপান ও মালয়েশিয়ার সহায়তায় আরও দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সেগুলোর ব্যাপারে তেমন আপত্তির কথা শোনা যায় না। রামপালের বিপক্ষে সিংহভাগ জনগণের অবস্থান কিসের কারণে? একটাই উত্তর- সুন্দরবনকে রক্ষা করা। সরকারের বেশির ভাগ যুক্তি নির্ভরযোগ্যতা হারিয়েছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার যেভাবেই হোক রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়। নিশ্চিত জাতীয় স্বার্থবিরোধী এমন কাজে কী কারণে বা কার স্বার্থ রক্ষার্থে সরকার একগুঁয়েমির পথ বেছে নিচ্ছে সে প্রশ্ন উঠছে হরহামেশাই। তারপরও বলব, শেষবারের মতো ভেবে দেখুন। রামপালের ব্যাপারে হাইকোর্টে করা রিট আবেদন আমলে নিন। জাতির কপালে একবার রামপালের চিহ্ন বসে গেলে তা সরানো কঠিন হবে। সে টনটনে বিষফোঁড়া বয়ে বেড়াতে হবে সবাইকে সারাজীবন। মাশুল দিতে হবে গোটা জাতিকে। ক্রমবর্ধমান চাহিদার নিরিখে বিদ্যুৎ উৎপাদন অবশ্যই বাড়ানো দরকার। পরিবেশের ওপর কিছুটা বিরূপ প্রভাব থাকলেও অন্যান্য দেশের মতো কয়লার ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে- এতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। যে কোনো দেশ এমনকি ভারত, নেপাল বা মিয়ানমারের ভালো প্রযুক্তিকে দেশের মানুষ গ্রহণ করবে সানন্দে। তবে কোনো অবস্থাতেই তা সুন্দরবনের মতো অমূল্য সম্পদের বিনিময়ে নয়। রামপাল অভিমুখী লংমার্চ ও তার প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন সে বার্তাই দিচ্ছে। সিডরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে সুন্দরবন না থাকলে আর কেউ নিজেকে বিলীন করে বাংলাদেশকে রক্ষা করবে না- মনে রাখা চাই।
ড. কেএইচএম নাজমুল হুসাইন নাজির : সহযোগী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি ও হাইজিন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়; গবেষক, ইয়াংনাম ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণ কোরিয়া
পশুর নদকে সুন্দরবনের প্রাণ বলা যেতে পারে। অনেকে এ নদকে সুন্দরবনের প্রাণভোমরা বলে থাকেন। সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্য প্রধানত এ নদের ওপর নির্ভরশীল। জানা গেছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য প্রয়োজনীয় ঘণ্টাপ্রতি ৯১৫০ ঘনমিটার পানি সংগ্রহ করা হবে পশুর নদ থেকে। ব্যবহার ও পরিশোধন শেষে ৫১৫০ ঘনমিটার পানি পশুর নদকে ফেরত দেয়া হবে। সুতরাং পশুর নদের পানি প্রবাহে ঘাটতি হবে দিনে ৯৬০০০ ঘনমিটার। পানি ফেরত কম দেয়া হলেও বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ বাড়তি হিসেবে যোগ হবে সে পানিতে বলা যায়। কারণ পরিশোধন কত দূর হবে সে ব্যাপারেও যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশে শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য পরিশোধন শেষে পরিবেশে উন্মুক্ত করার কথা থাকলেও বাস্তবে কী হয় তা আমরা কমবেশি সবাই জানি। বুড়িগঙ্গার পানির অবস্থা স্মরণে রাখা যেতে পারে। বুড়িগঙ্গার পানিকে অনেকে বিষ বলে অভিহিত করে থাকেন। তেমনিভাবে রামপালের ফ্লাই-অ্যাশ, বটম-অ্যাশ ও অন্যান্য ক্ষতিকর বর্জ্যরে মাধ্যমে বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডসহ আর্সেনিক, সিসা, নিকেল, ক্রোমিয়াম, ভেনাডিয়াম, পারদ ইত্যাদি প্রতিনিয়ত মিশবে মাটি-পানি-বাতাসের সঙ্গে। পশুর নদের মাছসহ অন্যান্য প্রাণী, সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের জীবনচক্রে পড়বে মারাত্মক প্রভাব। একে একে ধ্বংস হবে সব। সুন্দরবন বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার না থাকলে ছাগল, বিড়াল বা কাঠবিড়ালিকে হয়তো দেশের জাতীয় পশু করা হবে কোনো একদিন।
যতটুকু জানা গেছে, রামপালের মালিকানা বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের ৫০ ভাগ করে। মূলধনের ১৫ ভাগ বাংলাদেশের ও ১৫ ভাগ ভারতের, বাকি ৭০ ভাগ আসবে ঋণ থেকে। ঋণ কোথা থেকে আসবে এবং তার সুদ কত তা পরিষ্কার নয়। বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশের পিডিবি। বিদ্যুতের দাম নির্ভর করবে কয়লার দামের ওপর। কয়লার দাম নির্ভর করবে প্রাপ্যতা ও পরিবহন খরচের ওপর। উৎপাদন খরচ পড়বে অনেক বেশি- সহজেই অনুমেয়। বিভিন্ন অজুহাতে ধাপে ধাপে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। বিদ্যুতের দাম যত বাড়বে ভারতের লাভ তত বেশি। টাকা আসবে বাংলাদেশের মানুষের পকেট থেকে। লাভের ৫০ ভাগ পাবে ভারত। সমীকরণ খুব সহজ। ভারত দেবে প্রযুক্তি ও ১৫ ভাগ মূলধন। জমিসহ বাকি সব যাবে বাংলাদেশ থেকে। সুন্দরবন বিপন্ন হওয়াসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘানিও টানতে হবে আমাদের। জানা গেছে, একই কোম্পানি (ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি) ভারতের গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশে একই ধরনের দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে চেয়েও জনসাধারণের তীব্র প্রতিবাদে ব্যর্থ হয়েছে। সুপার ক্রিটিকাল প্রযুক্তির দোহাই দেয়া হচ্ছে। প্রশ্ন জাগে, ভারত কেন সে দেশের বনসীমার ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ আইন করে নিষিদ্ধ করল? নিজের জন্য ষোল আনা অন্যের জন্য আঁটি- এমন নীতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সুন্দরবনের মতো স্পর্শকাতর স্থানের পাশে কোম্পানিটি কিভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি পেল ও বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি হল তা ভেবে দেখার বিষয়। চুক্তির বিষয়বস্তু বিস্তারিতভাবে জানা সবার যৌক্তিক অধিকার নয় কি? সরকারি প্রেসনোটে দাবি করা হয়েছে, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে ওই এলাকায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে, জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে- আরও কত কী। জানা গেছে, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মসংস্থান হবে মাত্র ছয়শ মানুষের। অন্যদিকে, সুন্দরবনের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কমপক্ষে ২ লাখ মানুষ নির্ভরশীল। ছয়শ ও ২ লাখ- তুলনা চলে কি? তাছাড়া সুন্দরবনই যদি না থাকে তাহলে জীববৈচিত্র্য বা নির্ভরশীলতার কথা অমূলক, তাই নয় কি?
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবনের আয়তন অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে ছিল বর্তমান আয়তনের প্রায় দ্বিগুণ। নানা কারণে আয়তন ছোট হয়ে বর্তমানে ঠেকেছে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারে। যার ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত। উইকিপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৭ সালে সুন্দরবন ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সুতরাং বলা যায়, সুন্দরবন এখন শুধু বাংলাদেশের সম্পদ নয়। বাংলাদেশ অংশের বন ধ্বংসের জন্য কেউ সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। সরকারি প্রেসনোটে বলা হয়েছে, রামপালের কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না সুন্দরবনের ওপর। যা আদৌ নির্ভরযোগ্য নয় বলে অনেকের মতো আমিও মনে করি। প্রেসনোট তৈরিতে কারও প্রভাব বা চাপ রয়েছে কিনা, অর্থের লোভ বা প্রাণের ভয় ছিল কিনা- ভেবে দেখা দরকার। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা না শুনলে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকির মতো বিষয়ও থাকতে পারে এর পেছনে।
পারিবারিক শান্তি থেকে শুরু করে জাতীয় উন্নয়নে বিদ্যুতের গুরুত্ব বলে শেষ নেই। কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তাও কম নয়। বিভিন্ন দেশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার ৯৩ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় কয়লা থেকে। তেমনিভাবে চীন ও অস্ট্রেলিয়া ৭৮ ভাগ, যুক্তরাষ্ট্র ৪৯ ভাগ, ভারত ৬৮ ভাগ ও জাপান ২৭ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কয়লা থেকে। সেখানে বাংলাদেশে এক ভাগেরও কম। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে রয়েছে চড়া মূল্যের গ্যাসচালিত কুইক রেন্টাল প্লান্ট যা খুব কম দেশেই আছে। কুইক রেন্টাল স্থায়ী সমাধান নয়। যাই হোক, আমাদের দেশে গ্যাসের পাশাপাশি রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কয়লা। কুইক রেন্টালের মাধ্যমে নিঃশেষ হচ্ছে দেশের অমূল্য সম্পদ প্রাকৃতিক গ্যাস। পরিবেশবান্ধব কয়লানীতি প্রণয়ন করে দেশীয় কয়লা ব্যবহার করা গেলে বিদেশী কয়লা বা দেশীয় গ্যাসের প্রতি নির্ভরশীলতা কমানো যাবে। রামপালের পাশাপাশি দেশের অন্য দুটি স্থানে জাপান ও মালয়েশিয়ার সহায়তায় আরও দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সেগুলোর ব্যাপারে তেমন আপত্তির কথা শোনা যায় না। রামপালের বিপক্ষে সিংহভাগ জনগণের অবস্থান কিসের কারণে? একটাই উত্তর- সুন্দরবনকে রক্ষা করা। সরকারের বেশির ভাগ যুক্তি নির্ভরযোগ্যতা হারিয়েছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার যেভাবেই হোক রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়। নিশ্চিত জাতীয় স্বার্থবিরোধী এমন কাজে কী কারণে বা কার স্বার্থ রক্ষার্থে সরকার একগুঁয়েমির পথ বেছে নিচ্ছে সে প্রশ্ন উঠছে হরহামেশাই। তারপরও বলব, শেষবারের মতো ভেবে দেখুন। রামপালের ব্যাপারে হাইকোর্টে করা রিট আবেদন আমলে নিন। জাতির কপালে একবার রামপালের চিহ্ন বসে গেলে তা সরানো কঠিন হবে। সে টনটনে বিষফোঁড়া বয়ে বেড়াতে হবে সবাইকে সারাজীবন। মাশুল দিতে হবে গোটা জাতিকে। ক্রমবর্ধমান চাহিদার নিরিখে বিদ্যুৎ উৎপাদন অবশ্যই বাড়ানো দরকার। পরিবেশের ওপর কিছুটা বিরূপ প্রভাব থাকলেও অন্যান্য দেশের মতো কয়লার ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে- এতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। যে কোনো দেশ এমনকি ভারত, নেপাল বা মিয়ানমারের ভালো প্রযুক্তিকে দেশের মানুষ গ্রহণ করবে সানন্দে। তবে কোনো অবস্থাতেই তা সুন্দরবনের মতো অমূল্য সম্পদের বিনিময়ে নয়। রামপাল অভিমুখী লংমার্চ ও তার প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন সে বার্তাই দিচ্ছে। সিডরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে সুন্দরবন না থাকলে আর কেউ নিজেকে বিলীন করে বাংলাদেশকে রক্ষা করবে না- মনে রাখা চাই।
ড. কেএইচএম নাজমুল হুসাইন নাজির : সহযোগী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি ও হাইজিন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়; গবেষক, ইয়াংনাম ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণ কোরিয়া
No comments