আলোচনার টেবিলেই সমাধান হোক by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
অপরিণামদর্শী
রাজনীতির কারণে বাংলাদেশ এক মহাক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে। সবকিছু নিক্ষিপ্ত
হচ্ছে এক সর্বগ্রাসী সংকটের আবর্তে। সামনে সংঘাত-সংঘর্ষ ও রক্তপাত ছাড়া
মানুষের চোখে ভালো কিছু দৃশ্যমান হচ্ছে না। নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ
বিষয়ে দুই রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে যদি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত না হয়, রাজপথই যদি
হয় রাজনীতির শেষ ঠিকানা; তাহলে দেশ এক মহাক্ষতির কবলে পড়বে- এতে
বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কাজেই রাজপথ নয়, আলোচনার টেবিলেই হোক রাজনৈতিক
সংকটের সমাধান; তার জন্য খোলা মন নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে ক্ষমতাসীনদের। কিন্তু
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে পরিস্থিতি সেদিকে যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীনরা বুঝে
শুনেই একটা ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে। বিএনপিকে রুখতে গিয়ে
অসাংবিধানিক পথে কেউ ক্ষমতায় আসতে চাইলে আওয়ামী লীগ তাতেও রাজি হবে বলে
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয়। যার জন্য বেগম জিয়ার বারবার আহ্বান
সত্ত্বেও আলোচনার টেবিলের পরিবর্তে রাজনীতিকে করা হয়েছে রাজপথমুখী। কিন্তু
তাতে সবার আগে অবধারিত বেকায়দায় পড়বে আওয়ামী লীগ।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় সদ্য ক্ষমতা ত্যাগী দলের ওপরই আঘাত আসে সর্বপ্রথম। তাই রাজপথে রাজনৈতিক সংকটের ফয়সালার সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের জন্য হবে নিঃসন্দেহে মারাত্মক ভুল। তাতে রাজনৈতিকভাবে অপমৃত্যু ঘটতে পারে আওয়ামী লীগের। তা ছাড়া ২৫ অক্টোবর পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেয়াও আওয়ামী লীগের অদূরদর্শী ও ভুল সিদ্ধান্ত। এর ফলে সংঘাত ও রক্তপাত অনিবার্য। তাতেও অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হতে পারে ক্ষমতাসীন দল। বিরোধী দলের কর্মসূচি রাজপথে মোকাবেলা করতে গিয়ে একটি গৃহযুদ্ধের মোকাবেলা করতে হতে পারে আওয়ামী লীগের। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, অতীতে বিরোধী দলের কর্মসূচি মোকাবেলা করতে গিয়ে শাসক দলের জন্য পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ খারাপ।
কাজেই রাজপথ নয়, সংকটের সমাধান করতে হবে আলোচনার টেবিলে। তাতে ক্ষমতাসীন দলের যেমন মঙ্গল হবে, তেমনি মঙ্গল হবে দেশেরও। কেননা রাজনৈতিকভাবে একটি জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। দুটি রাজনৈতিক শক্তির পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি। সবাই মনে হয় একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে জন্য জনগণ আছে মহাআতংকে। তাদের ঈদ ও পূজার আনন্দ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ম্লান হয়ে গেছে। কোথাও কোনো স্বস্তি নেই।
বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বাগাড়ম্বরে মানুষ অস্বস্তিতে আছে। এই বাগাড়ম্বর শেষ পর্যন্ত থাকবে নাকি ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট কৌতূহল আছে সর্বত্র। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে একের পর এক নজিরবিহীন কেলেংকারির ঘটনা ঘটলেও সরকার অত্যন্ত স্বস্তির সঙ্গে মেয়াদ পার করছে। এটিও বাংলাদেশের রাজনীতিতে নবদিগন্তের সূচনা করেছে। তারপরও সরকার ক্ষমতা ছাড়তে ভয় পাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। কথা ছিল মেয়াদ শেষে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সব দল একসঙ্গে নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে। তাতে জনগণ যে দলকে ভোট দেয়, সে দলই সরকার গঠন করবে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। নির্বাচন তো দূরের কথা, দেশ কোথায় যাচ্ছে, তা রাজনীতিবিদরাও জানেন না। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বলা যায় দেশ, রাজনীতি ও রাজনীতিবিদরা এক অন্ধকার গহ্বরের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতি তৈরির কোনো কারণ ছিল না। শুধু ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
তৃতীয় বিশ্বে ক্ষমতার রাজনীতি খুব একটা সুখকর নয়। বাংলাদেশে যে দলই ক্ষমতায় থেকেছে, শেষ পর্যন্ত সে দল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মাত্র সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে শূন্যের কোটায় নেমে গিয়েছিল। প্রায় ২১ বছর সময় লেগেছে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন ফিরে পেতে। এসবই বাংলাদেশের রাজনীতির জলজ্যান্ত ইতিহাস। এই ইতিহাস থেকে আওয়ামী লীগ কোনো শিক্ষা নিয়েছে বলে মনে হয় না। নিলে আওয়ামী লীগ জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিত না। শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। আওয়ামী লীগের অবস্থান এর বিপরীতে। ৯০ ভাগ মানুষ যা চায়, তার বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক দল অবস্থান নিতে পারে না আর সে দল যদি আওয়ামী লীগের মতো পুরনো দল হয় তাহলে তো কোনো কথাই নেই। ১৯৯৬ সালে মানুষ সুষ্ঠু নির্বাচন চেয়ে রাজপথে নেমেছিল। কিন্তু বিএনপি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে জনগণের দাবি মেনে নিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। ফলে জনগণ পুরস্কার হিসেবে বিএনপিকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিরোধী দলের আসনে অধিষ্ঠিত করে।
আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষী ও শুভানুধ্যায়ীরা বলছেন, জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আবার ক্ষমতায় যাওয়া তো নয়ই, আওয়ামী লীগ সুস্পষ্ট বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। শেষ মুহূর্তে ক্ষমতা বা নির্বাচন নিয়ে কোনো টালবাহানা করলে আওয়ামী লীগের পরিণতি হবে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের চেয়েও ভয়াবহ। দলটি ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। সুতরাং এখনও সময় আছে আওয়ামী লীগের সুপথে আসার, জনগণের দাবি মেনে নেয়ার। জনগণের দাবি মেনে নেয়ার মধ্যে একটা গর্ব আছে কিন্তু কোনো দোষ নেই। জনগণের দাবি মেনে নিয়ে ক্ষমতা না হোক, আওয়ামী লীগ একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের আসন নিশ্চিত করতে পারে এবং আগামীতে আবার ক্ষমতায় যাওয়ার সোপান তৈরি করতে পারে। আশা করি, আওয়ামী লীগের বোধোদয় হবে।
অন্যদিকে বিরোধী দলের জন্য রাজনীতিতে কোনো সুখবর নেই। আওয়ামী লীগকে সঠিক পথে চালাতে বিরোধী দল হিসেবে যে ভূমিকা পালন করার কথা ছিল তা বিএনপি পালন করতে পারেনি বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। যতটুকু সমর্থন বিএনপির প্রতি মানুষের আছে, তা বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের জন্য নয়; আওয়ামী লীগের প্রতি ক্ষোভ থেকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে একের পর এক নজিরবিহীন কেলেংকারির ঘটনা ঘটলেও এ ক্ষেত্রে বিএনপির ভূমিকা ছিল না ঘরকা না ঘাটকা। ফলে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলসহ একের পর এক বেপরোয়া আচরণ করতে উৎসাহ পেয়েছে। মহাসচিবসহ বিরোধী দলে শীর্ষ নেতাদের পাইকারি হারে জেলে নিয়েছে। প্রধান বিরোধী দলের কার্যালয় পর্যন্ত কমান্ডো কায়দায় তছনছ করা হয়েছে, কার্যালয় থেকে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের চোর-ডাকাতের মতো ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ, যা এক নজিরবিহীন ইতিহাস। তা ছাড়া হত্যা, গুম, অপহরণ ও দমন-পীড়ন অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমান সরকারের আমলে বেশি হয়েছে।
তা ছাড়া শেয়ার মার্কেট ধ্বংস, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক লোপাট, জনশক্তি রফতানি, রিয়েল এস্টেট, গার্মেন্ট ব্যবসার বারোটা বাজানো, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূসসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নজিরবিহীনভাবে অপমান-অপদস্থ করে ও হেফাজতের সমাবেশে ক্র্যাকডাউন চালিয়েও সরকার মহাবীরের মতো দেশ চালিয়েছে- বিরোধী দল জোরালো কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। ফলে সরকার এখন আরও বেপরোয়া হয়ে একতরফা নির্বাচন করে বা নির্বাচন ছাড়াই দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। এখন এ পথ থেকে সরকারকে ফিরিয়ে আনতে বিরোধী দলের আরও জোরালো শক্তি প্রয়োগ করা দরকার। কিন্তু সে প্রস্তুতি দৃশ্যমান হচ্ছে না। আসলে গোড়া থেকেই বিরোধী দলের রাজনীতিতে একটা বন্ধ্যত্ব ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে ফুলে-ফেপে কলাগাছ হয়েছে জামায়াত-শিবির। কিন্তু জাতীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে তাদের কোনো ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তারা আছে একা বাহাদুরি দেখানোর তালে। তারা একা বাহাদুরি দেখিয়ে যে শক্তি ক্ষয় করেছে- বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে এই শক্তি ক্ষয় করলে, সরকার ভয় পেত; অনাকাক্সিক্ষত কাজ থেকে সরকার বিরত থাকত, সরকারকে সঠিক পথে রাখা সম্ভব হতো।
এখন রাজনীতি রাজপথে ও জনগণের কাছে যাচ্ছে। বিরোধী দলকে দুর্বল মনে করে সরকার রাজনীতিকে রাজপথে নিয়ে এসেছে। যার শক্তি আছে, সে-ই রাজপথ দখলে রাখবে। রাজপথ থেকেই রাজনীতি ও নির্বাচনের ভাগ্য নির্ধারণ হবে। এখন বিএনপিকে কঠিন শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হতে পারলে বিএনপির রাজনীতির জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে যার যার দলীয় ইস্যু বাদ দিয়ে বিরোধী দলের রাজনীতি একমুখী হতে হবে; সবাই একাট্টা হয়ে রাজপথে নামতে হবে এবং বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে অবস্থান অব্যাহত রাখতে হবে। রাজপথ কারও জন্যই সুখকর হয় না, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনের জন্য; রাজপথে সংকটের সমাধান হলে ক্ষমতাসীন দল অনিবার্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। কারণ জনমত সবসময় ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে থাকে আর বিরোধী দল পেয়ে থাকে জনগণের সহানুভূতি, যা রাজপথে তাদের বিশেষ সুবিধা দেয়। কাজেই ক্ষমতাসীন দলের উচিত রাজপথ থেকে রাজনীতিকে আলোচনামুখী করা।
বিরোধী দলের দাবির প্রতি জনগণের জোরালো সমর্থন রয়েছে, যা দেশের মূলধারার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। জনগণ রাজপথে নেমে এলে রক্তপাত ও সম্পদহানির সমূহ আশংকা আছে; আশংকা আছে ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়ারও। শেয়ার মার্কেট, এমএলএম ব্যবসা ও অন্যান্য কারণে কয়েক কোটি মানুষ আর্থিকভাবে নজিরবিহীন ক্ষতির শিকার হয়েছে। এই মানুষ সংক্ষুব্ধ হয়ে রাজপথে নেমে এলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে; তাই ক্ষমতাসীনদের সমঝোতার পথে হাঁটতে হবে, রাজপথ থেকে রাজনীতিকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসতে হবে এবং আলোচনার টেবিলেই সংকটের সমাধান করতে হবে।
বিরোধী দলের চাওয়াটা বড় কিছু নয়, তারা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চাচ্ছেন মাত্র, যা এ দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষেরও দাবি। শেষ পর্যন্ত এ দাবি না মেনে সরকার যাবে কোথায়? জনগণের কাছে যাওয়া ছাড়া রাজনৈতিক দলের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। শাসক দল যদি মনে করে থাকে বিরোধী দলের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নির্বাচন ছাড়াই অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকবে, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে; কেননা সুষ্ঠু নির্বাচন শুধু বিরোধী দলের দাবি নয়, এটা জনগণেরও দাবি। সেই জনগণের দাবি নিয়ে টালবাহানা করা প্রকারান্তরে জনগণের বিপরীতে অবস্থান নেয়া। জনগণের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে কোনো শাসক টিকে থাকতে পারেনি, তাদের করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে; ইতিহাসে এমন অনেক নজির আছে। আশা করি, শাসক দল ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবে। তবে ইতিহাসের শিক্ষা হল এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বাংলাদেশের বাস্তবতায় সদ্য ক্ষমতা ত্যাগী দলের ওপরই আঘাত আসে সর্বপ্রথম। তাই রাজপথে রাজনৈতিক সংকটের ফয়সালার সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের জন্য হবে নিঃসন্দেহে মারাত্মক ভুল। তাতে রাজনৈতিকভাবে অপমৃত্যু ঘটতে পারে আওয়ামী লীগের। তা ছাড়া ২৫ অক্টোবর পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেয়াও আওয়ামী লীগের অদূরদর্শী ও ভুল সিদ্ধান্ত। এর ফলে সংঘাত ও রক্তপাত অনিবার্য। তাতেও অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হতে পারে ক্ষমতাসীন দল। বিরোধী দলের কর্মসূচি রাজপথে মোকাবেলা করতে গিয়ে একটি গৃহযুদ্ধের মোকাবেলা করতে হতে পারে আওয়ামী লীগের। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, অতীতে বিরোধী দলের কর্মসূচি মোকাবেলা করতে গিয়ে শাসক দলের জন্য পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ খারাপ।
কাজেই রাজপথ নয়, সংকটের সমাধান করতে হবে আলোচনার টেবিলে। তাতে ক্ষমতাসীন দলের যেমন মঙ্গল হবে, তেমনি মঙ্গল হবে দেশেরও। কেননা রাজনৈতিকভাবে একটি জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। দুটি রাজনৈতিক শক্তির পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি। সবাই মনে হয় একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে জন্য জনগণ আছে মহাআতংকে। তাদের ঈদ ও পূজার আনন্দ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ম্লান হয়ে গেছে। কোথাও কোনো স্বস্তি নেই।
বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বাগাড়ম্বরে মানুষ অস্বস্তিতে আছে। এই বাগাড়ম্বর শেষ পর্যন্ত থাকবে নাকি ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট কৌতূহল আছে সর্বত্র। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে একের পর এক নজিরবিহীন কেলেংকারির ঘটনা ঘটলেও সরকার অত্যন্ত স্বস্তির সঙ্গে মেয়াদ পার করছে। এটিও বাংলাদেশের রাজনীতিতে নবদিগন্তের সূচনা করেছে। তারপরও সরকার ক্ষমতা ছাড়তে ভয় পাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। কথা ছিল মেয়াদ শেষে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সব দল একসঙ্গে নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে। তাতে জনগণ যে দলকে ভোট দেয়, সে দলই সরকার গঠন করবে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। নির্বাচন তো দূরের কথা, দেশ কোথায় যাচ্ছে, তা রাজনীতিবিদরাও জানেন না। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বলা যায় দেশ, রাজনীতি ও রাজনীতিবিদরা এক অন্ধকার গহ্বরের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতি তৈরির কোনো কারণ ছিল না। শুধু ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
তৃতীয় বিশ্বে ক্ষমতার রাজনীতি খুব একটা সুখকর নয়। বাংলাদেশে যে দলই ক্ষমতায় থেকেছে, শেষ পর্যন্ত সে দল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মাত্র সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে শূন্যের কোটায় নেমে গিয়েছিল। প্রায় ২১ বছর সময় লেগেছে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন ফিরে পেতে। এসবই বাংলাদেশের রাজনীতির জলজ্যান্ত ইতিহাস। এই ইতিহাস থেকে আওয়ামী লীগ কোনো শিক্ষা নিয়েছে বলে মনে হয় না। নিলে আওয়ামী লীগ জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিত না। শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। আওয়ামী লীগের অবস্থান এর বিপরীতে। ৯০ ভাগ মানুষ যা চায়, তার বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক দল অবস্থান নিতে পারে না আর সে দল যদি আওয়ামী লীগের মতো পুরনো দল হয় তাহলে তো কোনো কথাই নেই। ১৯৯৬ সালে মানুষ সুষ্ঠু নির্বাচন চেয়ে রাজপথে নেমেছিল। কিন্তু বিএনপি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে জনগণের দাবি মেনে নিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। ফলে জনগণ পুরস্কার হিসেবে বিএনপিকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিরোধী দলের আসনে অধিষ্ঠিত করে।
আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষী ও শুভানুধ্যায়ীরা বলছেন, জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আবার ক্ষমতায় যাওয়া তো নয়ই, আওয়ামী লীগ সুস্পষ্ট বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। শেষ মুহূর্তে ক্ষমতা বা নির্বাচন নিয়ে কোনো টালবাহানা করলে আওয়ামী লীগের পরিণতি হবে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের চেয়েও ভয়াবহ। দলটি ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। সুতরাং এখনও সময় আছে আওয়ামী লীগের সুপথে আসার, জনগণের দাবি মেনে নেয়ার। জনগণের দাবি মেনে নেয়ার মধ্যে একটা গর্ব আছে কিন্তু কোনো দোষ নেই। জনগণের দাবি মেনে নিয়ে ক্ষমতা না হোক, আওয়ামী লীগ একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের আসন নিশ্চিত করতে পারে এবং আগামীতে আবার ক্ষমতায় যাওয়ার সোপান তৈরি করতে পারে। আশা করি, আওয়ামী লীগের বোধোদয় হবে।
অন্যদিকে বিরোধী দলের জন্য রাজনীতিতে কোনো সুখবর নেই। আওয়ামী লীগকে সঠিক পথে চালাতে বিরোধী দল হিসেবে যে ভূমিকা পালন করার কথা ছিল তা বিএনপি পালন করতে পারেনি বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। যতটুকু সমর্থন বিএনপির প্রতি মানুষের আছে, তা বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের জন্য নয়; আওয়ামী লীগের প্রতি ক্ষোভ থেকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে একের পর এক নজিরবিহীন কেলেংকারির ঘটনা ঘটলেও এ ক্ষেত্রে বিএনপির ভূমিকা ছিল না ঘরকা না ঘাটকা। ফলে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলসহ একের পর এক বেপরোয়া আচরণ করতে উৎসাহ পেয়েছে। মহাসচিবসহ বিরোধী দলে শীর্ষ নেতাদের পাইকারি হারে জেলে নিয়েছে। প্রধান বিরোধী দলের কার্যালয় পর্যন্ত কমান্ডো কায়দায় তছনছ করা হয়েছে, কার্যালয় থেকে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের চোর-ডাকাতের মতো ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ, যা এক নজিরবিহীন ইতিহাস। তা ছাড়া হত্যা, গুম, অপহরণ ও দমন-পীড়ন অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমান সরকারের আমলে বেশি হয়েছে।
তা ছাড়া শেয়ার মার্কেট ধ্বংস, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক লোপাট, জনশক্তি রফতানি, রিয়েল এস্টেট, গার্মেন্ট ব্যবসার বারোটা বাজানো, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূসসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নজিরবিহীনভাবে অপমান-অপদস্থ করে ও হেফাজতের সমাবেশে ক্র্যাকডাউন চালিয়েও সরকার মহাবীরের মতো দেশ চালিয়েছে- বিরোধী দল জোরালো কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। ফলে সরকার এখন আরও বেপরোয়া হয়ে একতরফা নির্বাচন করে বা নির্বাচন ছাড়াই দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। এখন এ পথ থেকে সরকারকে ফিরিয়ে আনতে বিরোধী দলের আরও জোরালো শক্তি প্রয়োগ করা দরকার। কিন্তু সে প্রস্তুতি দৃশ্যমান হচ্ছে না। আসলে গোড়া থেকেই বিরোধী দলের রাজনীতিতে একটা বন্ধ্যত্ব ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে ফুলে-ফেপে কলাগাছ হয়েছে জামায়াত-শিবির। কিন্তু জাতীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে তাদের কোনো ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তারা আছে একা বাহাদুরি দেখানোর তালে। তারা একা বাহাদুরি দেখিয়ে যে শক্তি ক্ষয় করেছে- বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে এই শক্তি ক্ষয় করলে, সরকার ভয় পেত; অনাকাক্সিক্ষত কাজ থেকে সরকার বিরত থাকত, সরকারকে সঠিক পথে রাখা সম্ভব হতো।
এখন রাজনীতি রাজপথে ও জনগণের কাছে যাচ্ছে। বিরোধী দলকে দুর্বল মনে করে সরকার রাজনীতিকে রাজপথে নিয়ে এসেছে। যার শক্তি আছে, সে-ই রাজপথ দখলে রাখবে। রাজপথ থেকেই রাজনীতি ও নির্বাচনের ভাগ্য নির্ধারণ হবে। এখন বিএনপিকে কঠিন শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হতে পারলে বিএনপির রাজনীতির জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে যার যার দলীয় ইস্যু বাদ দিয়ে বিরোধী দলের রাজনীতি একমুখী হতে হবে; সবাই একাট্টা হয়ে রাজপথে নামতে হবে এবং বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে অবস্থান অব্যাহত রাখতে হবে। রাজপথ কারও জন্যই সুখকর হয় না, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনের জন্য; রাজপথে সংকটের সমাধান হলে ক্ষমতাসীন দল অনিবার্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। কারণ জনমত সবসময় ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে থাকে আর বিরোধী দল পেয়ে থাকে জনগণের সহানুভূতি, যা রাজপথে তাদের বিশেষ সুবিধা দেয়। কাজেই ক্ষমতাসীন দলের উচিত রাজপথ থেকে রাজনীতিকে আলোচনামুখী করা।
বিরোধী দলের দাবির প্রতি জনগণের জোরালো সমর্থন রয়েছে, যা দেশের মূলধারার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। জনগণ রাজপথে নেমে এলে রক্তপাত ও সম্পদহানির সমূহ আশংকা আছে; আশংকা আছে ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়ারও। শেয়ার মার্কেট, এমএলএম ব্যবসা ও অন্যান্য কারণে কয়েক কোটি মানুষ আর্থিকভাবে নজিরবিহীন ক্ষতির শিকার হয়েছে। এই মানুষ সংক্ষুব্ধ হয়ে রাজপথে নেমে এলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে; তাই ক্ষমতাসীনদের সমঝোতার পথে হাঁটতে হবে, রাজপথ থেকে রাজনীতিকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসতে হবে এবং আলোচনার টেবিলেই সংকটের সমাধান করতে হবে।
বিরোধী দলের চাওয়াটা বড় কিছু নয়, তারা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চাচ্ছেন মাত্র, যা এ দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষেরও দাবি। শেষ পর্যন্ত এ দাবি না মেনে সরকার যাবে কোথায়? জনগণের কাছে যাওয়া ছাড়া রাজনৈতিক দলের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। শাসক দল যদি মনে করে থাকে বিরোধী দলের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নির্বাচন ছাড়াই অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকবে, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে; কেননা সুষ্ঠু নির্বাচন শুধু বিরোধী দলের দাবি নয়, এটা জনগণেরও দাবি। সেই জনগণের দাবি নিয়ে টালবাহানা করা প্রকারান্তরে জনগণের বিপরীতে অবস্থান নেয়া। জনগণের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে কোনো শাসক টিকে থাকতে পারেনি, তাদের করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে; ইতিহাসে এমন অনেক নজির আছে। আশা করি, শাসক দল ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবে। তবে ইতিহাসের শিক্ষা হল এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments