আগুনের পরশমণি
আশি হাজারেরও বেশি ছেলেমেয়ে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে টেলিটকের সহযোগিতায় দেশব্যাপী আয়োজন করা হয়েছিল এই ছেলেমেয়েদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। গত শুক্রবার শেষ দুটো অনুষ্ঠান হলো ঢাকার অদূরে নন্দন পার্কে। এতে যোগ দিয়েছে প্রায় ১৫ হাজার ছাত্রছাত্রী। এর আগে এ রকম অনুষ্ঠান হয়েছে প্রতিটি জেলায়। রংপুরের অনুষ্ঠানে আমি গিয়েছিলাম। আর গিয়েছিলাম গাজীপুরের নন্দন পার্কের অনুষ্ঠান দুটোয়। এসব অনুষ্ঠানে গেলে, এই তরুণ মেধাবীদের আশা আর কৌতূহলে ভরা চোখগুলোর দিকে তাকালে আপনি নতুন উদ্যম লাভ করবেন, নতুন আশায় আপনার চেতনা যেন পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠবে। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল গণিত অলিম্পিয়াডের ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে একটা কথা বলেন: মোবাইল ফোনের ব্যাটারি নিয়মিত চার্জ দিতে হয়। তেমনিভাবে আমাদের শরীরমনেরও চার্জ লাগে। এ রকম মেধাবী তরুণদের দেখলে আমরা সেই চার্জটাই যেন লাভ করি। এই ছেলেমেয়েরা দেশপ্রেমের শপথ নেয়।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান ঘোষণা করে চিৎকার করে। মাদক আর মিথ্যাকে ‘না’ বলে। বাবা-মা, শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। মন দিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে বলে প্রতিজ্ঞা করে। আর তারা ব্যক্ত করে তাদের জীবনের উদ্দেশ্য, মানুষের মতো মানুষ হওয়া। তারা সবাই ভালো মানুষ হতে চায়। আজকে বাংলাদেশে ৯৮ ভাগের বেশি ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। আমাদের দেশে যত ছেলেমেয়ে নবম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ছে, পৃথিবীর অনেক দেশের লোকসংখ্যাই তার সমান নয়। নিউজিল্যান্ডের জনসংখ্যা ৪৪ লাখ। বাংলাদেশের জনসংখ্যার বেশির ভাগই তরুণ। এদের বেশির ভাগই লেখাপড়া করছে। শিক্ষা একটা পরশমণি। আলোর পরশমণি। এর ছোঁয়ায় মানুষ সোনা হয়ে যেতে পারে। সত্যিকারের আলোকিত মানুষ হয়ে উঠতে পারে। ধরা যাক বেগম রোকেয়ার কথা। রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দের এই মেয়েটির বাড়িতে বাংলা পড়া ছিল নিষিদ্ধ, ইংরেজি পড়া ছিল পাপ। মেয়েরা পড়বে, সেটা ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু বালিকার অপরিসীম আগ্রহ, সে পড়া শিখবে। ভাইয়ের কাছ থেকে চুপি চুপি সে লেখাপড়া শেখে।
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, একা জেগে মেয়েটি বই পড়ে। ঘুমন্ত গৃহবাসীর যাতে ঘুম ভেঙে না যায়, তাই প্রদীপের আলো আড়াল করে একটা কার্ড দিয়ে। সেই মেয়েটি বাংলা শিখল, ইংরেজি শিখল। এত সুন্দর বাংলা শিখল যে তার বই অবরোধবাসিনী কিংবা মতিচূরের ভাষা আজও আমাদের মুগ্ধ করে। সে এত সুন্দর ইংরেজি শিখল যে সুলতানা’স ড্রিম নামে ইংরেজি বই লিখে ফেলল নিজেই। আর একটা হূদয় যখন আলোকিত হলো, সে আলো তো কেবল নিজের মধ্যে সীমিত রইল না, সে স্কুল প্রতিষ্ঠা করল, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী আনার চেষ্টা করল। আজকে যখন বাংলাদেশের দিকে তাকাই, তখন দেখি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী আর বিরোধী নেত্রী নারী, স্পিকার নারী, আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অনেক মন্ত্রী নারী, তিনজন ছেলে এভারেস্টে উঠল তো দুজন মেয়েও উঠে গেল এভারেস্টে। ওই যে একটা হূদয় শিক্ষার পরশমণিতে হূদয় ছুঁয়েছিল, তারই ছোঁয়ায় আলোকিত হচ্ছে সারা দেশ, আজও। জানি, আমাদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হারও বেশি। জানি, আমাদের শিক্ষার পরিমাণগত বৃদ্ধি যতটা ঘটছে, গুণগত উৎকর্ষ নিয়ে আমাদের উদ্বেগও তত বাড়ছে। তবু বলি, শিক্ষা কাকে যে কীভাবে সোনার মানুষ করে তুলবে, আমরা কেউ জানি না। প্রত্যেক মানুষের ভেতরে একটা বিশাল সম্ভাবনা রয়ে গেছে। কেউ হয়তো অঙ্কে ভালো, কেউ সাহিত্যে, কেউ হয়তো বিজ্ঞানে, কারও বা আছে নেতৃত্বের গুণ, কারও আছে উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষমতা। কেউ ভালো ব্যবসায়ী হবে, কেউ বা হবে সমাজসেবক।
শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে, তবে পরিমাণগত বিশালত্বও একটা বড় আশার কারণ। অনেক বড় হিমালয় পর্বতমালা আছে বলেই একটা এভারেস্ট শৃঙ্গ আছে। এত লাখ লাখ ছেলেমেয়ে আছে, এদের ভেতর থেকে অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষ তৈরি হবে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। আবার এই বিশাল অঙ্কটাও আমাদের কাজে লাগবে। ২০ বছর পরে এই দেশের কৃষকেরা সবাই হবেন শিক্ষিত, শ্রমিকেরাও হবেন শিক্ষিত। এখনই কৃষকেরা বিপ্লব করে ফেলেছেন। মাছ চাষে বিপ্লব ঘটে গেছে, পোলট্রিতে বিপ্লব ঘটে গেছে, ধান থেকে আম—সর্বত্রই তো আমাদের কৃষকদের পরিশ্রম, সৃজনশীলতা আর মেধার চিহ্ন স্পষ্ট। ২০ বছর পরে এই বাংলাদেশটা একটা উন্নত বাংলাদেশ হবেই। আর এই মেধাবীরা যখন দেশের হাল ধরবে, তখন সব দিক থেকেই আলোয় আলোয় ভরে উঠবে বাংলাদেশ। প্রায় ৯০ লাখ বাংলাদেশি আজ ছড়িয়ে আছে সারা পৃথিবীতে, এই সংখ্যা আগামী ১০ বছরে তিন কোটি হবে বলে আমার বিশ্বাস। প্রবাসীদের পাঠানো টাকা, আমাদের শিল্প খাতের অর্জিত বিদেশি মুদ্রা, আমাদের সৃজনশীল কৃষকের উৎপাদনশীলতা, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আমাদের তরুণ প্রজন্মের সাফল্য—সবটা একত্র করলে ২০ বছর পরের বাংলাদেশ একটা উন্নত, সম্পদশালী, আলোকিত বাংলাদেশ ছাড়া কিছুই নয়। আমাদের মাথাপিছু আয় তখন বৃদ্ধি পাবে অনেক গুণ।
আর ড. মোশতাক খানের তথ্যটায় আমি বেশ আস্থা পাই, মাথাপিছু আয় বাড়লে সুশাসনও আসবে। শুধু আমাদের রাজনীতিকে হতে হবে উন্নয়নবান্ধব। বাংলাদেশ নানা দিক থেকে এত ভালো করছে। নব্বইয়ের পরে গণতন্ত্রের আমলেও আমরা খুবই ভালো করেছি। এ জন্য উভয় দলের সরকারের দুই দুই চার মেয়াদের শাসনকালেরও কৃতিত্ব আছে। যেমন, বেগম জিয়ার সরকার মেয়েদের জন্য বৃত্তি চালু করেছিল, শেখ হাসিনার সরকার সেটাকে আরও জোরদার করেছে। মানব উন্নয়ন সূচকে আমরা অনেক ক্ষেত্রে ভালো করছি ভারতের চেয়েও, অমর্ত্য সেন বারবার সে কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ, আমাদের সরকার, আমাদের বেসরকারি সংস্থা—সবাই মিলেই দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে গেছে। আবার আমাদের উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের দুর্নীতি, সুশাসনের অভাব এবং রাজনৈতিক দলাদলি। আমরা আরও কত উন্নতি করতে পারতাম, যদি হরতাল না হতো! আমরা আরও কত উন্নতি করতে পারতাম, যদি আমাদের লাভের গুড় দুর্নীতিতে খেয়ে না ফেলত। যদি দেশের টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার না করা হতো। যদি আমাদের আমলাতন্ত্র মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে না দাঁড়াত!
দেশের জনসংখ্যার ৬০ ভাগ তরুণ। এরা আমাদের ছেলেমেয়ে। প্রত্যেক অভিভাবক—প্রত্যেক বাবা, প্রত্যেক মা সন্তানের আমরা ভালো চাই। তারা সুখে থাকুক, শান্তিতে থাকুক, নিরাপদ থাকুক, সেটা চাই। তাহলে দেশের যাঁরা অভিভাবক, এই ৬০ ভাগ তরুণসহ ১৫ কোটি মানুষের যাঁরা অভিভাবক, তাঁরা ঘুমান কী করে? তাঁরা কী করে এমন ভাব দেখান যে দেশের ভবিষ্যৎ যা-ই হোক না কেন, আমারটা আমি ছাড়ব না? আসলে আমাদের মনের মধ্যে গণতন্ত্র নেই। আমাদের মানসিকতার মধ্যে গণতন্ত্র নেই। একটা খুব খারাপ ধারণা আমাদের মনে বদ্ধমূল হয়ে আছে: দেশপ্রেমিক কেবল আমরাই, দেশের উন্নতি করার ক্ষমতা কেবল আমাদেরই আছে, কাজেই দেশের স্বার্থেই ক্ষমতা আমারই চাই। এই মানসিকতা মোটেও গণতান্ত্রিক নয়। ওদের চেয়ে আমরা দেশ ভালো বুঝি, রাজনীতি ভালো বুঝি, ওরা কী বোঝে, আর ওদের দেশপ্রেমই বা কই—এই মানসিকতা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের একটা উদাহরণই তো যথেষ্ট। বুশ জুনিয়র তো দ্বিতীয়বার কম ভোট পেয়ে আদালতের রায়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তার পরও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাটরা সেই রায় মাথা পেতে নিয়েছিলেন। গণতন্ত্র মানে সরকার আর বিরোধী দল উভয়ে মিলেই দেশের ভালোর জন্য কাজ করে যাওয়া। এটা খুবই দুঃখজনক যে মেয়াদ শেষে একটা সর্বজনগ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া আমরা পেলাম না। নির্বাচন সামনে রেখে দেশে আবারও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা, সংঘাতের আশঙ্কা।
এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত আমাদের উন্নয়ন ব্যাহত করবে। এই যে কোটি কোটি ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে, এই যে আট কোটি তরুণ জনগোষ্ঠী, তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমাদের উচিত হানাহানির পথ পরিহার করে সমঝোতার মাধ্যমে গণতন্ত্রের ঝান্ডা ঊর্ধ্বে তুলে ধরা। রংপুরের জিপিএ-৫ পাওয়া ছেলেমেয়েদের সংবর্ধনায় এক ছেলে এসেছিল, যার বাবা জেলে। সে রাতের বেলা মাছ ধরে, দিনের বেলা স্কুলে যায়। ঢাকায় প্রথম আলো অদম্য মেধাবীদের বৃত্তি প্রদানের একটা অনুষ্ঠান করেছিল ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগিতায়। সেখানেও আমরা দেখেছি, কত কষ্ট করে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে, আর ভালো করছে। আমরা সেই অনুষ্ঠানেই পেয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে, যাঁর পারিবারিক অবস্থা ছিল খুবই সঙিন, তার ভাষায়, ‘আমাদের ভাঙা ঘরে সূর্যের আলো তো ঢুকতই, চাঁদের আলোও ঢুকত, কুকুর-বিড়ালও ঢুকত।’ তাঁদের পরিবারে কেউ কোনো দিন লেখাপড়া করেনি। সেই ছেলে পড়াশোনায় ভালো করল, বৃত্তি পেল,
একসময় প্রথম আলোর অদম্য মেধাবী বৃত্তিও সে পেয়েছিল, অবশেষে সে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি তাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে শিক্ষা একটা জাদুর কাঠি, যা মানুষকে জাগিয়ে তোলে, মানুষের ভেতরের অনন্ত সম্ভাবনাকে বিকশিত করে। আমাদের ছেলেমেয়েরা সেই জাদুর কাঠির ছোঁয়া পাচ্ছে। পাষাণপুরীতে জেগে উঠছে প্রাণের স্পন্দন। এই স্পন্দনেই আমাদের বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সুন্দর হয়ে উঠবে। কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে কী ঘটবে, তা তো বলতে পারছি না। বারবার নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছি, বাংলাদেশের মানুষের সৃজনশীলতার কোনো তুলনা হয় না, বর্তমান সংকট ঘোরতর বিপদে পরিণত হওয়ার আগেই নিশ্চয়ই কোনো সৃজনশীল সমাধান আমরা পেয়ে যাব। আশা করতে দোষ নেই। কিন্তু আশাকে বাস্তবে পরিণত করার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা যেন একটিবার ভাবেন, তাঁরা কেবল নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলছেন না, তাঁদের সঙ্গে ১৫ কোটি মানুষের নিয়তিও বাঁধা। শুভবুদ্ধির পরিচয়ই যেন তাঁরা দেন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments