ইতিহাসে নাম লেখাবার সুযোগ সমাগত by মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
স্বাভাবিক
সময়ের রাজনীতির সঙ্গে জাতীয় সংকটকালীন রাজনীতির পার্থক্য অনেক। স্বাভাবিক
সময় রাজনৈতিক দলের নেতারা নিজেদের জনসেবা ও জনকল্যাণে নিবেদিত বলে দাবি
করেন। তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করে জনগণকে প্রতিশ্র“তি
দেন, স্বপ্ন দেখান। জনগণের সমস্যা সমাধানে নিজেদের বিশেষজ্ঞ দাবি করতে
কার্পণ্য করেন না। এমন কাজ করা রাজনৈতিক নেতাদের সহজাত স্বভাব। এ দেশের বড়
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় সব নেতাই এমন কাজে পারদর্শী। কিন্তু এসব নেতাই
জাতীয় সংকটকালে সব সময় দেশপ্রেমের পরীক্ষায় ভালো করতে পারেন না। বড় মন আর
ত্যাগের মানসিকতা না থাকলে জাতীয় সংকটকালে মানুষের কল্যাণে ভূমিকা রাখা যায়
না। যারা জাতীয় সংকটকালে জনকল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারেন, মানুষ তাদের
সম্মান করে, ইতিহাস তাদের জায়গা করে দেয়। সবাই চাইলেও এমন কাজ করতে পারেন
না। কারণ, সব নেতার সামনে হরহামেশা জাতীয় সংকট মোকাবেলার সুযোগ আসে না।
যারা নেতৃত্বে থাকাকালে জাতীয় সংকট সৃষ্টি হয় এবং যারা ওই সংকটে ভূমিকা
রাখার সুযোগ পান, কেবল তারাই জাতীয় সংকটে দেশপ্রেমের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে
জনগণের হৃদয়ে ও জাতীয় ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নাম লেখাতে পারেন। এ রকম
সুযোগ পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার সামনে ঐক্যবদ্ধ
পাকিস্তানে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে অভ্যন্তরীণ উপনিবাসবাদের বিরুদ্ধে পূর্ব
পাকিস্তানের শোষিত ও অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ের সুযোগ এসেছিল। আর সে
সুযোগ কাজে লাগিয়ে এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা রোধে তিনি সমগ্র
পূর্ব পাকিস্তানবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর
বিরুদ্ধে আপসহীন আন্দোলন করে সে আন্দোলনে সফলকাম হয়েছিলেন। তার এ অকুতোভয়
নেতৃত্ব ও আপসহীন সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে নিজবক্ষে
সম্মানজনক আসন দিতে কার্পণ্য করেনি। নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের মানুষের
স্বার্থের জন্য যে নেতা লড়াই করেন, তাকে সম্মান দিতে দেশবাসী কার্পণ্য
করবেন কেন? স্বাধীনতা-পরবর্তী ষড়যন্ত্র ও সমস্যা সংকুল রাজনীতিতে
বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা আলোচনা করে তার আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা
গেলেও এ মহান নেতার অবদান ইতিহাসে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে।
আবার রাজনীতির ধারাবাহিকতায় দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র যখন পথভ্রষ্ট হয়, রাজনীতি ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হয় সংকুচিত, স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের চাপে সততা ও ন্যায়নীতি হয়ে পড়ে রুগ্ন, জাতীয় পরিচিতি নিয়ে দেখা দেয় দ্বন্দ্ব- ১৯৭৫-এর পর তেমন দুঃসময়ে সেনাবাহিনী থেকে রাজনীতিতে এসে স্বাধীনতাযুদ্ধের লড়াকু সেনানী জিয়াউর রহমান স্বজনপ্রীতি দূর করে, একদলীয় প্রবণতা থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ধারা চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ধারা তৈরি ও জনপ্রিয় করে ওই সংকটকালীন রাজনীতিতে অবদানমূলক ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের কাছে গ্রহণীয় হন। সামরিক বাহিনী থেকে রাজনীতিতে আগত নেতাদের সৃষ্টি করা দল ওই নেতার অবর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিলীন বা দুর্বল হয়ে গেলেও জাতির বিপদকালীন রাজনীতিতে জিয়ার সাহসী অবদানমূলক ভূমিকার কারণে তার সৃষ্ট দলটি তার মৃত্যুর পর আরও জনপ্রিয় হয়ে একাধিকবার নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। এসব কারণে এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসের পাতায় জিয়া তার স্থান পান।
পরবর্তী সময়ে এ সুযোগ পান রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ জিয়াপত্নী ও গৃহবধূ খালেদা জিয়া। ১৯৯০-এর দশকে এরশাদ শাসনামলে সামরিক শাসন যখন দীর্ঘায়িত হয়, দুর্নীতি পায় প্রাতিষ্ঠানিকতা, নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হওয়ায় ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত বোধ করেন, তেমন এক সময়ে বেগম জিয়ার সামনে দেশের রাজনীতিকে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনার সুযোগ আসে। অনেক রাজনৈতিক দল যখন সামরিক সরকারের পাতা ফাঁদে পড়ে আন্দোলনবিমুখ হয়, প্রলোভনের টোপ গিলে অনেক রাজনৈতিক নেতা যখন দেশপ্রেম জলাঞ্জলি দিয়ে পরোক্ষভাবে ক্ষমতাসীনদের পরোক্ষ সমর্থন দেন, অনেক বড় দলও সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন থেকে হঠাৎ সরে এসে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সামরিক সরকারকে নির্বাচন করতে সুবিধা করে দেয়, রাজনীতির বেচাকেনার মাঠে তেমন এক সংকটকালে বেগম জিয়া সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে অনড় ও আপসহীন ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসে নিজের স্থান করে নেন। তার সামরিক শাসনবিরোধী আপসহীন ভূমিকায় পরবর্তীকালে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে এরশাদের সামরিক সরকারের অবসান ঘটে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাও গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতিতে ১৯৭৫-পরবর্তী বিশৃংখল আওয়ামী লীগকে গঠনমূলকভাবে পরিচালনা করে স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রধান ভূমিকা পালনকারী এ দলটিকে শক্তিশালী করে তোলেন। ১৯৯৪-১৯৯৬ সালে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সরকারবিরোধী আন্দোলন করে সে আন্দোলনে সফলতা পাওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি নিজের ভাবমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এ নেত্রী ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে ২১ বছর পর আবারও ক্ষমতায় এনে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জনপ্রিয়তা প্রমাণের মধ্য দিয়ে নিজের স্থান করে নেন। পরবর্তী সময়ে তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে সুকৌশলে ২০০৭ সালের রাজনৈতিক সুনামি মোকাবেলা করে নবম সংসদ নির্বাচনে জনগণকে দিন বদলের প্রতিশ্র“তি দিয়ে আবারও বিশাল বিজয় নিয়ে সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনার সুযোগ পান। গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাবাহিকতায় অবদান রেখে শেখ হাসিনাও বাংলাদেশী রাজনীতির ইতিহাসে নিজের স্থান করে নেন।
গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তিত হলে ওই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক নেতাদের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠে না। কেবল জাতীয় রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হলে তারা ওই সংকট থেকে জাতিকে মুক্ত করার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে স্মরণীয় হয়ে ওঠেন। মহাজোট আমলে উচ্চ আদালতের একটি বিভক্ত রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশের একাংশের ওপর ভিত্তি করে জনমতের তোয়াক্কা না করে জাতীয় সংসদে এককভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করায় জাতি এক সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। বিরোধী দলগুলো সরকারি দলকে বিশ্বাস করছে না। তারা মনে করছে, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন করার মতো পরিবেশ এখনও দেশে তৈরি হয়নি। সে কারণে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে প্রধান বিরোধী দলের নেতৃত্বে গঠিত ১৮ দলীয় জোট ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে তুলেছে। সরকার এ আন্দোলন দমন করে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় দেশবাসী এক নিশ্চিত রক্তপাত ও দীর্ঘমেয়াদি সহিংসতার আশংকার মধ্যে রয়েছেন। এ অবস্থায় শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের সামনে জাতিকে উল্লিখিত সংকট থেকে উদ্ধার করার সুযোগ এসেছে। কোনো রাজনৈতিক নেতা তার মেধা ও দূরদর্শিতা ব্যবহার করে আসন্ন সংকট থেকে জাতিকে উদ্ধার করে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দিতে পারলে ওই নেতা একদিকে কেবল দেশবাসীর প্রশংসাভাজনই হবেন না, সেই সঙ্গে দেশের রাজনীতির ইতিহাসে নিজের নামটিও লেখাবার বিরল সুযোগ পাবেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ সুযোগ কেবল দেশের প্রধান দুই নেত্রীরই ব্যবহারের সম্ভাবনা বেশি। দেশের অন্য নেতাদের পক্ষে এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সহজেই এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আলোচ্য সংকটের সমাধানের মধ্য দিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দিয়ে ওই নির্বাচনে দলীয় জয়-পরাজয় যা-ই হোক না কেন, সে ফলাফল মেনে উদার মনের পরিচয় দিয়ে রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশী রাজনীতির ইতিহাসে নিজ আসনকে উজ্জ্বল করে তোলা সম্ভব। তিনি সহজ ও শান্তিপূর্ণ পথে আলোচ্য সমস্যার সমাধান করে ফেললে বেগম জিয়ার পক্ষে আর এ সংকট থেকে লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী যদি সহজ পথে না গিয়ে বিরোধীদলীয় আন্দোলন দমন করে শক্তি প্রয়োগ এবং সহিংসতা ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে একতরফা নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তাহলে এ সংকট উত্তরণে বেগম জিয়া ভূমিকা পালনের সুযোগ পাবেন। সেক্ষেত্রে ১৮ দলীয় জোটনেত্রী হিসেবে তিনি যদি দেশবাসীকে তার দাবির পক্ষে সম্পৃক্ত করে বৃহত্তর আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি মেনে নিতে বাধ্য করে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করাতে সক্ষম হন, তাহলে একজন বিচক্ষণ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার পক্ষে রাজনীতির ইতিহাসের পাতায় অধিকতর উজ্জ্বল হয়ে ওঠা সম্ভব হবে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য-বিবৃতি শুনে মনে হয়, তিনি রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা পালনের চেয়ে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার দিকে বেশি মনোযোগী। দেশের স্বার্থের চেয়ে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে অধিক মনোযোগী হয়ে প্রধানমন্ত্রী কি ইতিহাসের পাতায় নাম উজ্জ্বল করার সুযোগটি বিরোধীদলীয় নেত্রীর দিকেই ঠেলে দিচ্ছেন? লক্ষণীয়, রাজনীতির সাম্প্রতিক খেলায় বিরাধীদলীয় নেত্রী বিচক্ষণতার পরিচয় দিচ্ছেন। বিশেষ করে সরকারি নেতাদের ‘আন্দোলনের মুরোদ নেই’ ধরনের অনেক খোঁচা খেয়েও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বড় ধরনের আন্দোলন কর্মসূচি না দিয়ে তিনি জনগণকে নিজ দাবির পক্ষে সভা-সমাবেশ ও অহিংস কর্মসূচির মধ্য দিয়ে অধিকতর সম্পৃক্ত করার কর্মসূচি দীর্ঘায়িত করে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। এখন দেখার বিষয়, প্রধানমন্ত্রী কিছুটা নমনীয় হয়ে জয়-পরাজয়ের বিষয়টিকে প্রাধান্য না দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে যদি রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার সুযোগ কাজে না লাগান, তাহলে বেগম জিয়া ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলনের মাধ্যমে শেষ মুহূর্তে জোরালো চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা আদায় করে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে ইতিহাসে নিজের নাম উজ্জ্বল করতে পারেন কি-না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই নেত্রীর সামনেই চলমান সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান করে ইতিহাসে নিজ নাম উজ্জ্বল করার সুযোগ সমাগত। প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক হলে খুব সহজেই এ কৃতিত্ব অর্জন করতে পারেন। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতার জন্য সুযোগ এলে তাকে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে হয়তো এ কৃতিত্ব অর্জন করতে হবে। আর কিছুদিন পরই দেশবাসী বুঝতে পারবেন, আলোচ্য সংকট সমাধানের খেলায় কে সফল ভূমিকা রেখে রাজনীতির ইতিহাসের পাতায় তার নাম উজ্জ্বল ও স্থায়ী করতে পারবেন।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আবার রাজনীতির ধারাবাহিকতায় দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র যখন পথভ্রষ্ট হয়, রাজনীতি ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হয় সংকুচিত, স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের চাপে সততা ও ন্যায়নীতি হয়ে পড়ে রুগ্ন, জাতীয় পরিচিতি নিয়ে দেখা দেয় দ্বন্দ্ব- ১৯৭৫-এর পর তেমন দুঃসময়ে সেনাবাহিনী থেকে রাজনীতিতে এসে স্বাধীনতাযুদ্ধের লড়াকু সেনানী জিয়াউর রহমান স্বজনপ্রীতি দূর করে, একদলীয় প্রবণতা থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ধারা চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ধারা তৈরি ও জনপ্রিয় করে ওই সংকটকালীন রাজনীতিতে অবদানমূলক ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের কাছে গ্রহণীয় হন। সামরিক বাহিনী থেকে রাজনীতিতে আগত নেতাদের সৃষ্টি করা দল ওই নেতার অবর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিলীন বা দুর্বল হয়ে গেলেও জাতির বিপদকালীন রাজনীতিতে জিয়ার সাহসী অবদানমূলক ভূমিকার কারণে তার সৃষ্ট দলটি তার মৃত্যুর পর আরও জনপ্রিয় হয়ে একাধিকবার নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। এসব কারণে এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসের পাতায় জিয়া তার স্থান পান।
পরবর্তী সময়ে এ সুযোগ পান রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ জিয়াপত্নী ও গৃহবধূ খালেদা জিয়া। ১৯৯০-এর দশকে এরশাদ শাসনামলে সামরিক শাসন যখন দীর্ঘায়িত হয়, দুর্নীতি পায় প্রাতিষ্ঠানিকতা, নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হওয়ায় ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত বোধ করেন, তেমন এক সময়ে বেগম জিয়ার সামনে দেশের রাজনীতিকে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনার সুযোগ আসে। অনেক রাজনৈতিক দল যখন সামরিক সরকারের পাতা ফাঁদে পড়ে আন্দোলনবিমুখ হয়, প্রলোভনের টোপ গিলে অনেক রাজনৈতিক নেতা যখন দেশপ্রেম জলাঞ্জলি দিয়ে পরোক্ষভাবে ক্ষমতাসীনদের পরোক্ষ সমর্থন দেন, অনেক বড় দলও সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন থেকে হঠাৎ সরে এসে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সামরিক সরকারকে নির্বাচন করতে সুবিধা করে দেয়, রাজনীতির বেচাকেনার মাঠে তেমন এক সংকটকালে বেগম জিয়া সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে অনড় ও আপসহীন ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসে নিজের স্থান করে নেন। তার সামরিক শাসনবিরোধী আপসহীন ভূমিকায় পরবর্তীকালে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে এরশাদের সামরিক সরকারের অবসান ঘটে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাও গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতিতে ১৯৭৫-পরবর্তী বিশৃংখল আওয়ামী লীগকে গঠনমূলকভাবে পরিচালনা করে স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রধান ভূমিকা পালনকারী এ দলটিকে শক্তিশালী করে তোলেন। ১৯৯৪-১৯৯৬ সালে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সরকারবিরোধী আন্দোলন করে সে আন্দোলনে সফলতা পাওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি নিজের ভাবমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এ নেত্রী ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে ২১ বছর পর আবারও ক্ষমতায় এনে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জনপ্রিয়তা প্রমাণের মধ্য দিয়ে নিজের স্থান করে নেন। পরবর্তী সময়ে তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে সুকৌশলে ২০০৭ সালের রাজনৈতিক সুনামি মোকাবেলা করে নবম সংসদ নির্বাচনে জনগণকে দিন বদলের প্রতিশ্র“তি দিয়ে আবারও বিশাল বিজয় নিয়ে সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনার সুযোগ পান। গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাবাহিকতায় অবদান রেখে শেখ হাসিনাও বাংলাদেশী রাজনীতির ইতিহাসে নিজের স্থান করে নেন।
গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তিত হলে ওই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক নেতাদের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠে না। কেবল জাতীয় রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হলে তারা ওই সংকট থেকে জাতিকে মুক্ত করার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে স্মরণীয় হয়ে ওঠেন। মহাজোট আমলে উচ্চ আদালতের একটি বিভক্ত রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশের একাংশের ওপর ভিত্তি করে জনমতের তোয়াক্কা না করে জাতীয় সংসদে এককভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করায় জাতি এক সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। বিরোধী দলগুলো সরকারি দলকে বিশ্বাস করছে না। তারা মনে করছে, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন করার মতো পরিবেশ এখনও দেশে তৈরি হয়নি। সে কারণে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে প্রধান বিরোধী দলের নেতৃত্বে গঠিত ১৮ দলীয় জোট ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে তুলেছে। সরকার এ আন্দোলন দমন করে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় দেশবাসী এক নিশ্চিত রক্তপাত ও দীর্ঘমেয়াদি সহিংসতার আশংকার মধ্যে রয়েছেন। এ অবস্থায় শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের সামনে জাতিকে উল্লিখিত সংকট থেকে উদ্ধার করার সুযোগ এসেছে। কোনো রাজনৈতিক নেতা তার মেধা ও দূরদর্শিতা ব্যবহার করে আসন্ন সংকট থেকে জাতিকে উদ্ধার করে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দিতে পারলে ওই নেতা একদিকে কেবল দেশবাসীর প্রশংসাভাজনই হবেন না, সেই সঙ্গে দেশের রাজনীতির ইতিহাসে নিজের নামটিও লেখাবার বিরল সুযোগ পাবেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ সুযোগ কেবল দেশের প্রধান দুই নেত্রীরই ব্যবহারের সম্ভাবনা বেশি। দেশের অন্য নেতাদের পক্ষে এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সহজেই এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আলোচ্য সংকটের সমাধানের মধ্য দিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দিয়ে ওই নির্বাচনে দলীয় জয়-পরাজয় যা-ই হোক না কেন, সে ফলাফল মেনে উদার মনের পরিচয় দিয়ে রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশী রাজনীতির ইতিহাসে নিজ আসনকে উজ্জ্বল করে তোলা সম্ভব। তিনি সহজ ও শান্তিপূর্ণ পথে আলোচ্য সমস্যার সমাধান করে ফেললে বেগম জিয়ার পক্ষে আর এ সংকট থেকে লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী যদি সহজ পথে না গিয়ে বিরোধীদলীয় আন্দোলন দমন করে শক্তি প্রয়োগ এবং সহিংসতা ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে একতরফা নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তাহলে এ সংকট উত্তরণে বেগম জিয়া ভূমিকা পালনের সুযোগ পাবেন। সেক্ষেত্রে ১৮ দলীয় জোটনেত্রী হিসেবে তিনি যদি দেশবাসীকে তার দাবির পক্ষে সম্পৃক্ত করে বৃহত্তর আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি মেনে নিতে বাধ্য করে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করাতে সক্ষম হন, তাহলে একজন বিচক্ষণ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার পক্ষে রাজনীতির ইতিহাসের পাতায় অধিকতর উজ্জ্বল হয়ে ওঠা সম্ভব হবে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য-বিবৃতি শুনে মনে হয়, তিনি রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা পালনের চেয়ে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার দিকে বেশি মনোযোগী। দেশের স্বার্থের চেয়ে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে অধিক মনোযোগী হয়ে প্রধানমন্ত্রী কি ইতিহাসের পাতায় নাম উজ্জ্বল করার সুযোগটি বিরোধীদলীয় নেত্রীর দিকেই ঠেলে দিচ্ছেন? লক্ষণীয়, রাজনীতির সাম্প্রতিক খেলায় বিরাধীদলীয় নেত্রী বিচক্ষণতার পরিচয় দিচ্ছেন। বিশেষ করে সরকারি নেতাদের ‘আন্দোলনের মুরোদ নেই’ ধরনের অনেক খোঁচা খেয়েও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বড় ধরনের আন্দোলন কর্মসূচি না দিয়ে তিনি জনগণকে নিজ দাবির পক্ষে সভা-সমাবেশ ও অহিংস কর্মসূচির মধ্য দিয়ে অধিকতর সম্পৃক্ত করার কর্মসূচি দীর্ঘায়িত করে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। এখন দেখার বিষয়, প্রধানমন্ত্রী কিছুটা নমনীয় হয়ে জয়-পরাজয়ের বিষয়টিকে প্রাধান্য না দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে যদি রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার সুযোগ কাজে না লাগান, তাহলে বেগম জিয়া ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলনের মাধ্যমে শেষ মুহূর্তে জোরালো চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা আদায় করে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে ইতিহাসে নিজের নাম উজ্জ্বল করতে পারেন কি-না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই নেত্রীর সামনেই চলমান সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান করে ইতিহাসে নিজ নাম উজ্জ্বল করার সুযোগ সমাগত। প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক হলে খুব সহজেই এ কৃতিত্ব অর্জন করতে পারেন। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতার জন্য সুযোগ এলে তাকে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে হয়তো এ কৃতিত্ব অর্জন করতে হবে। আর কিছুদিন পরই দেশবাসী বুঝতে পারবেন, আলোচ্য সংকট সমাধানের খেলায় কে সফল ভূমিকা রেখে রাজনীতির ইতিহাসের পাতায় তার নাম উজ্জ্বল ও স্থায়ী করতে পারবেন।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments