পাকিস্তানে জঙ্গিদের হাতে পরমাণু অস্ত্র! by আসিফ রশীদ
পাকিস্তানে
সন্ত্রাসী হামলা এখন নিত্যঘটনা। এমন কোনো দিন নেই যেদিন দেশটির কোথাও না
কোথাও বোমা হামলায় প্রাণহানি না ঘটছে। এসব ঘটনার জন্য পাঞ্জাবি তালেবান
নামে পরিচিত তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) ও তাদের মিত্র
সংগঠনগুলোকে দায়ী করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের তৎপরতা এতই বেড়েছে যে,
দেশটির পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
পর্যন্ত উদ্বিগ্ন। উল্লেখ্য, পাকিস্তানে পারমাণবিক অস্ত্র প্রকল্প গড়ে
উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রেরই গোপন সহায়তায়। পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ-
সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান, সোয়াত উপত্যকায় বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং
ওয়াজিরিস্তান ও ফাতা অঞ্চলে পশতুনদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে
একটি বিষয় সামনে এসেছে। তা হল, প্রশিক্ষিত জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলো অথবা
সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে তাদের লোকরা এখন দেশটির পারমাণবিক, জীবাণু ও
রাসায়নিক অস্ত্রের দিকে নজর দিতে পারে। গত ৪ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের
শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলো সে দেশের পারমাণবিক অস্ত্রের ওপর
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা পর্যবেক্ষণ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা
যায়, পাকিস্তানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোয় পাঞ্জাবি তালেবান ও অন্যান্য
জঙ্গি সংগঠনের সম্ভাব্য হামলার বিষয়টি পেন্টাগন ও সিআইএকে ভাবিয়ে তুলেছে।
এর আগে ৯ আগস্ট নিউইয়র্ক টাইমসে বলা হয়, পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী হঠাৎ
করেই দেশের সামরিক স্থাপনাগুলোর ওপর সম্ভাব্য তালেবান হামলার ব্যাপারে উচ্চ
সতর্কতা জারি করেছে। কারণ তালেবান ও তার মিত্ররা দেশের পারমাণবিক
কেন্দ্রগুলোতে নাশকতা চালানো এবং বোমা হামলার পরিকল্পনা করছে।
উদ্বেগের আরেকটি কারণ হল পাকিস্তানের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোয় কালোবাজারে পরমাণু সামগ্রী সহজলভ্য হয়ে ওঠা। জঙ্গিরা পরমাণু অস্ত্র ও এ-সংক্রান্ত প্রযুক্তি পেলে তার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। আসলে নব্বইয়ের দশকেই পাকিস্তান পরমাণু সামগ্রীর চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েছিল। দেশটির পরমাণু বিজ্ঞানীদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এসব কারণে কিছু সামরিক ও পরমাণু বিশেষজ্ঞ পারমাণবিক নিরাপত্তার ব্যাপারে দেশটির ওপর আস্থাশীল নন। পাকিস্তানের স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং ডিভিশনের মহাপরিচালক লে. জেনারেল কিদওয়াই একবার বলেছিলেন, সারাদেশে ১৫টি আণবিক প্রকল্পে কাজ করছেন ৭০ হাজারেরও বেশি বিশেষজ্ঞ। তাদের মধ্যে রয়েছেন ৮ হাজার সুপ্রশিক্ষিত বিজ্ঞানী। তাদের মধ্যে আবার ২ হাজারেরও বেশি বিজ্ঞানী এ বিষয়ে সূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারী। এসব বিজ্ঞানীর একটি অংশ জঙ্গিদের পক্ষে কাজ করলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আফগানিস্তানে যখন তালেবান সরকার ছিল, সে সময় আল কায়দা পাকিস্তানের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য সহায়তা চেয়েছিল। পাকিস্তানি বিজ্ঞানী সুলতান বশিরউদ্দিন মাহমুদ এবং চৌধুরী আবদুল মজিদ তালেবান ও আল কায়দাকে সহায়তা করতে চেয়েছিলেন। তারা ২০০১ সালের আগস্টে বিন লাদেনের সঙ্গে দেখা করেন এবং আফগানিস্তানে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের অবকাঠামো নিয়ে আলোচনা করেন। ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ এসব জঙ্গি সংগঠনকে নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন। কারগিল যুদ্ধেও তাদের ব্যবহার করা হয়। এ যুদ্ধে দু’শরও বেশি আফগান তালেবান যোদ্ধা প্রাণ হারায়। এ ঘটনা তালেবান ও জঙ্গিদের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি অংশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টিও প্রমাণ করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে জঙ্গিবাদীদের অনুপ্রবেশের ব্যাপারে নীতিনির্ধারক ও সামরিক বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই চিন্তিত। আশংকা করা হয়, সেনাবাহিনীর ভেতরে কিছু জঙ্গি উপাদান পাঞ্জাবি তালেবান ও অন্যান্য সংগঠনকে পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় হামলা চালানোর বিষয়ে সহায়তা করতে পারে। পাকিস্তানের জঙ্গিবাদ, তালেবানিকরণ এবং সন্ত্রাসবাদ ‘রফতানি’ আফগানিস্তানেও অস্থিতিশীলতার সবচেয়ে বড় উৎস। ইতিপূর্বে করাচির নৌঘাঁটি, রাওয়ালপিন্ডির ওয়াহ অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি, সারগোদার দেরা গাজি খান পারমাণবিক কেন্দ্র এবং কামরার অ্যারোনটিক্যাল কমপ্লেক্সে এসব সংগঠনের কমান্ডো স্টাইলের হামলায় বোঝা যায়, পাকিস্তানের নিরাপত্তা অবকাঠামো বেশ দুর্বল এবং সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চপদে জঙ্গিবাদীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ২০১১ সালের ২২ জুন ব্রিগেডিয়ার আলী খানকে গ্রেফতার করা হয় জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে। তার স্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে নিশ্চিত করেন, ওসামা বিন লাদেন হত্যা এবং ওয়াজিরিস্তানে ড্রোন হামলার বিরোধী ছিলেন আলী খান। আইএসপিআরের (পাকিস্তান) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আতহার আব্বাস এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সেনাবাহিনীতে জেহাদি মতবাদের প্রবণতা এবং সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষতির কারণ হতে পারে। এ থেকেও বোঝা যায়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে জঙ্গিবাদের উপাদান রয়েছে।
পাকিস্তানের জঙ্গিবাদ বিশেষজ্ঞ মুসা খান জালালজাই এক নিবন্ধে লিখেছেন, পাঞ্জাবি তালেবান ও তাদের মিত্ররা ইতিমধ্যেই সশস্ত্র বাহিনীর সদর দফতরে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলায় পাকিস্তানের পারমাণবিক প্রকল্প, গবেষণা চুল্লি এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ প্রকল্পগুলো যে কোনো সময় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ইতিপূর্বে পাকিস্তানের বিভিন্ন পারমাণবিক কেন্দ্রে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় এটা স্পষ্ট যে, পাঞ্জাবি তালেবান ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠন সশস্ত্র বাহিনীতে তাদের মিত্রদের সহায়তায় পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোয় প্রবেশে সক্ষম। এছাড়া হামলার মাধ্যমেও এসব কেন্দ্রে প্রবেশ করা সম্ভব হতে পারে। ২০১১ সালে ইসলামাবাদ থেকে ২৫ মাইল দূরে অবস্থিত মিনহাস বিমান ঘাঁটিতে এক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হামলা চালিয়েছিল, যেখানে একশ’রও বেশি পারমাণবিক ওয়ারহেড মজুদ ছিল। ওই সংঘর্ষে এক সৈন্য ও আট সন্ত্রাসী নিহত হয়।
পাকিস্তান ১৫ বছর আগে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও তার পারমাণবিক অস্ত্রের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনও দুর্বল। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, পাকিস্তানে পারমাণবিক অস্ত্রগুলো সিআইএ’র কাছ থেকে লুকানোর জন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেয়ার কাজ চলে খুবই নিম্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থাধীনে, ভ্যানের মাধ্যমে। পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর কাছে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম সামরিক নিরাপত্তা আচ্ছাদিত বাহন না থাকাই এর কারণ বলে মনে করা হয়।
২০১০ সালে বেফার সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের এক সমীক্ষায় পাকিস্তানের সামরিক ভাণ্ডার জঙ্গিবাদীদের দ্বারা বড় ধরনের হুমকির সম্মুখীন বলে সতর্ক করে দেয়া হয়। খ্যাতনামা পাকিস্তানি বিজ্ঞানী ড. পারভেজ হুদভয় সতর্ক করে দিয়েছেন, সেনাবাহিনীর ব্যারাকগুলোয় জঙ্গি মতবাদ ছড়িয়ে পড়ায় দেশের পারমাণবিক অস্ত্র জঙ্গিরা ছিনিয়ে নিতে পারে।
তবে পাঞ্জাবি তালেবান ও তাদের মিত্ররা এখনই ক্ষুদ্রাকৃতির অনুন্নত পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে বলে অনেক পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞ মনে করেন। এর অর্থ হল, এসব অস্ত্র ইতিমধ্যেই জঙ্গি সংগঠনগুলোর হাতে এসেছে। ২০০৯ সালের ১৬ মে একটি ইসরাইলি ওয়েবসাইটে বলা হয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে এই বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে অবস্থিত পারমাণবিক কেন্দ্রটি ‘ইতিমধ্যেই আংশিকভাবে’ ইসলামি জঙ্গিদের হাতে চলে গেছে। এ তথ্য সত্য হয়ে থাকলে তা ভাবনার বিষয় বৈকি!
জঙ্গিরা পারমাণবিক হামলা চালাতে পারে নানাভাবেই। কমান্ডো স্টাইলের হামলা হলে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়বে। কোনো পরমাণু চুল্লির ওপর বিমান বিধ্বস্ত করে হামলা চালানো হতে পারে। সাইবার আক্রমণও চালানো হতে পারে। সব ক’টিরই পরিণতি হবে ভয়াবহ। পাকিস্তানের পারমাণবিক কেন্দ্রে একটি ছোট হামলাও দেশটির চেহারা পাল্টে দেবে। বস্তুত পারমাণবিক অস্ত্র ও এ-সংক্রান্ত প্রযুক্তি সন্ত্রাসবাদীদের হাতে আসা শুধু সে দেশের জন্য নয়, বহির্বিশ্ব বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও হুমকিস্বরূপ। কারণ জঙ্গি সংগঠনগুলোর রয়েছে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক। যেহেতু পারমাণবিক অস্ত্র পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাধীনে নেই, সেহেতু পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে জঙ্গি-সমর্থক জেনারেলরা কখনও ক্ষমতা দখল করলে স্বভাবতই অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। কারণ তাদের তীব্র পাশ্চাত্য ও ভারতবিরোধী নীতির কারণে তারা এসব অস্ত্র ব্যবহারে তৎপর থাকবেন। বিশেষ করে যুদ্ধ হলে এক্ষেত্রে কোনো চেইন অব কমান্ড কাজ না করায় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি বেশি।
পাকিস্তানি তালেবান গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কমান্ডিং পদ দখল করতে না পারলেও তারা শক্তি প্রয়োগ করে অথবা সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে তাদের লোকদের মাধ্যমে কোনো একটি পারমাণবিক স্থাপনার একটি ওয়ারহেড নিজেদের দখলে নিতে পারে। তখন তারা এর দ্বারা পাকিস্তান এমনকি বিশ্বকেও ব্ল্যাকমেইল করতে পারে।
এ প্রেক্ষাপটে সামনের দিনগুলোয় পাকিস্তানকে দীর্ঘমেয়াদি উৎকণ্ঠার সময় কাটাতে হবে বলেই মনে হয়।
আসিফ রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক
উদ্বেগের আরেকটি কারণ হল পাকিস্তানের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোয় কালোবাজারে পরমাণু সামগ্রী সহজলভ্য হয়ে ওঠা। জঙ্গিরা পরমাণু অস্ত্র ও এ-সংক্রান্ত প্রযুক্তি পেলে তার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। আসলে নব্বইয়ের দশকেই পাকিস্তান পরমাণু সামগ্রীর চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েছিল। দেশটির পরমাণু বিজ্ঞানীদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এসব কারণে কিছু সামরিক ও পরমাণু বিশেষজ্ঞ পারমাণবিক নিরাপত্তার ব্যাপারে দেশটির ওপর আস্থাশীল নন। পাকিস্তানের স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং ডিভিশনের মহাপরিচালক লে. জেনারেল কিদওয়াই একবার বলেছিলেন, সারাদেশে ১৫টি আণবিক প্রকল্পে কাজ করছেন ৭০ হাজারেরও বেশি বিশেষজ্ঞ। তাদের মধ্যে রয়েছেন ৮ হাজার সুপ্রশিক্ষিত বিজ্ঞানী। তাদের মধ্যে আবার ২ হাজারেরও বেশি বিজ্ঞানী এ বিষয়ে সূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারী। এসব বিজ্ঞানীর একটি অংশ জঙ্গিদের পক্ষে কাজ করলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আফগানিস্তানে যখন তালেবান সরকার ছিল, সে সময় আল কায়দা পাকিস্তানের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য সহায়তা চেয়েছিল। পাকিস্তানি বিজ্ঞানী সুলতান বশিরউদ্দিন মাহমুদ এবং চৌধুরী আবদুল মজিদ তালেবান ও আল কায়দাকে সহায়তা করতে চেয়েছিলেন। তারা ২০০১ সালের আগস্টে বিন লাদেনের সঙ্গে দেখা করেন এবং আফগানিস্তানে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের অবকাঠামো নিয়ে আলোচনা করেন। ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ এসব জঙ্গি সংগঠনকে নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন। কারগিল যুদ্ধেও তাদের ব্যবহার করা হয়। এ যুদ্ধে দু’শরও বেশি আফগান তালেবান যোদ্ধা প্রাণ হারায়। এ ঘটনা তালেবান ও জঙ্গিদের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি অংশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টিও প্রমাণ করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে জঙ্গিবাদীদের অনুপ্রবেশের ব্যাপারে নীতিনির্ধারক ও সামরিক বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই চিন্তিত। আশংকা করা হয়, সেনাবাহিনীর ভেতরে কিছু জঙ্গি উপাদান পাঞ্জাবি তালেবান ও অন্যান্য সংগঠনকে পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় হামলা চালানোর বিষয়ে সহায়তা করতে পারে। পাকিস্তানের জঙ্গিবাদ, তালেবানিকরণ এবং সন্ত্রাসবাদ ‘রফতানি’ আফগানিস্তানেও অস্থিতিশীলতার সবচেয়ে বড় উৎস। ইতিপূর্বে করাচির নৌঘাঁটি, রাওয়ালপিন্ডির ওয়াহ অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি, সারগোদার দেরা গাজি খান পারমাণবিক কেন্দ্র এবং কামরার অ্যারোনটিক্যাল কমপ্লেক্সে এসব সংগঠনের কমান্ডো স্টাইলের হামলায় বোঝা যায়, পাকিস্তানের নিরাপত্তা অবকাঠামো বেশ দুর্বল এবং সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চপদে জঙ্গিবাদীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ২০১১ সালের ২২ জুন ব্রিগেডিয়ার আলী খানকে গ্রেফতার করা হয় জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে। তার স্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে নিশ্চিত করেন, ওসামা বিন লাদেন হত্যা এবং ওয়াজিরিস্তানে ড্রোন হামলার বিরোধী ছিলেন আলী খান। আইএসপিআরের (পাকিস্তান) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আতহার আব্বাস এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সেনাবাহিনীতে জেহাদি মতবাদের প্রবণতা এবং সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষতির কারণ হতে পারে। এ থেকেও বোঝা যায়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে জঙ্গিবাদের উপাদান রয়েছে।
পাকিস্তানের জঙ্গিবাদ বিশেষজ্ঞ মুসা খান জালালজাই এক নিবন্ধে লিখেছেন, পাঞ্জাবি তালেবান ও তাদের মিত্ররা ইতিমধ্যেই সশস্ত্র বাহিনীর সদর দফতরে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলায় পাকিস্তানের পারমাণবিক প্রকল্প, গবেষণা চুল্লি এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ প্রকল্পগুলো যে কোনো সময় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ইতিপূর্বে পাকিস্তানের বিভিন্ন পারমাণবিক কেন্দ্রে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় এটা স্পষ্ট যে, পাঞ্জাবি তালেবান ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠন সশস্ত্র বাহিনীতে তাদের মিত্রদের সহায়তায় পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোয় প্রবেশে সক্ষম। এছাড়া হামলার মাধ্যমেও এসব কেন্দ্রে প্রবেশ করা সম্ভব হতে পারে। ২০১১ সালে ইসলামাবাদ থেকে ২৫ মাইল দূরে অবস্থিত মিনহাস বিমান ঘাঁটিতে এক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হামলা চালিয়েছিল, যেখানে একশ’রও বেশি পারমাণবিক ওয়ারহেড মজুদ ছিল। ওই সংঘর্ষে এক সৈন্য ও আট সন্ত্রাসী নিহত হয়।
পাকিস্তান ১৫ বছর আগে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও তার পারমাণবিক অস্ত্রের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনও দুর্বল। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, পাকিস্তানে পারমাণবিক অস্ত্রগুলো সিআইএ’র কাছ থেকে লুকানোর জন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেয়ার কাজ চলে খুবই নিম্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থাধীনে, ভ্যানের মাধ্যমে। পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর কাছে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম সামরিক নিরাপত্তা আচ্ছাদিত বাহন না থাকাই এর কারণ বলে মনে করা হয়।
২০১০ সালে বেফার সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের এক সমীক্ষায় পাকিস্তানের সামরিক ভাণ্ডার জঙ্গিবাদীদের দ্বারা বড় ধরনের হুমকির সম্মুখীন বলে সতর্ক করে দেয়া হয়। খ্যাতনামা পাকিস্তানি বিজ্ঞানী ড. পারভেজ হুদভয় সতর্ক করে দিয়েছেন, সেনাবাহিনীর ব্যারাকগুলোয় জঙ্গি মতবাদ ছড়িয়ে পড়ায় দেশের পারমাণবিক অস্ত্র জঙ্গিরা ছিনিয়ে নিতে পারে।
তবে পাঞ্জাবি তালেবান ও তাদের মিত্ররা এখনই ক্ষুদ্রাকৃতির অনুন্নত পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে বলে অনেক পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞ মনে করেন। এর অর্থ হল, এসব অস্ত্র ইতিমধ্যেই জঙ্গি সংগঠনগুলোর হাতে এসেছে। ২০০৯ সালের ১৬ মে একটি ইসরাইলি ওয়েবসাইটে বলা হয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে এই বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে অবস্থিত পারমাণবিক কেন্দ্রটি ‘ইতিমধ্যেই আংশিকভাবে’ ইসলামি জঙ্গিদের হাতে চলে গেছে। এ তথ্য সত্য হয়ে থাকলে তা ভাবনার বিষয় বৈকি!
জঙ্গিরা পারমাণবিক হামলা চালাতে পারে নানাভাবেই। কমান্ডো স্টাইলের হামলা হলে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়বে। কোনো পরমাণু চুল্লির ওপর বিমান বিধ্বস্ত করে হামলা চালানো হতে পারে। সাইবার আক্রমণও চালানো হতে পারে। সব ক’টিরই পরিণতি হবে ভয়াবহ। পাকিস্তানের পারমাণবিক কেন্দ্রে একটি ছোট হামলাও দেশটির চেহারা পাল্টে দেবে। বস্তুত পারমাণবিক অস্ত্র ও এ-সংক্রান্ত প্রযুক্তি সন্ত্রাসবাদীদের হাতে আসা শুধু সে দেশের জন্য নয়, বহির্বিশ্ব বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও হুমকিস্বরূপ। কারণ জঙ্গি সংগঠনগুলোর রয়েছে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক। যেহেতু পারমাণবিক অস্ত্র পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাধীনে নেই, সেহেতু পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে জঙ্গি-সমর্থক জেনারেলরা কখনও ক্ষমতা দখল করলে স্বভাবতই অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। কারণ তাদের তীব্র পাশ্চাত্য ও ভারতবিরোধী নীতির কারণে তারা এসব অস্ত্র ব্যবহারে তৎপর থাকবেন। বিশেষ করে যুদ্ধ হলে এক্ষেত্রে কোনো চেইন অব কমান্ড কাজ না করায় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি বেশি।
পাকিস্তানি তালেবান গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কমান্ডিং পদ দখল করতে না পারলেও তারা শক্তি প্রয়োগ করে অথবা সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে তাদের লোকদের মাধ্যমে কোনো একটি পারমাণবিক স্থাপনার একটি ওয়ারহেড নিজেদের দখলে নিতে পারে। তখন তারা এর দ্বারা পাকিস্তান এমনকি বিশ্বকেও ব্ল্যাকমেইল করতে পারে।
এ প্রেক্ষাপটে সামনের দিনগুলোয় পাকিস্তানকে দীর্ঘমেয়াদি উৎকণ্ঠার সময় কাটাতে হবে বলেই মনে হয়।
আসিফ রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক
No comments