শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন চাই by ধীরাজ কুমার নাথ
নির্বাচন
নিয়ে ভাবনা শুরু হয়েছে প্রায় সব মহলেই। নির্বাচন হবে কী হবে না, হলে কেমন
হবে, কোন দল ও জোটের জনসমর্থন কেমন- কত কথা ভাবছে জনগণ! একই সঙ্গে বিতর্ক
শুরু হয়েছে ২৫ অক্টোবর পরবর্তী সরকারের কাঠামো এবং ২৪ জানুয়ারির আগে কখন
নির্বাচন হবে- এসব নানা বিষয়ে। রাজনীতিকরাও নির্বাচন নিয়ে বিবিধ ভাবনায়
বিভোর। যে যেমন ভাবছে, তেমনই বলছে। আশংকা ও অনিশ্চয়তার মাঝে দোদুল্যমান
দেশবাসী। বাংলাদেশের সংবিধানের সপ্তম ভাগে ১১৮ থেকে ১২৬ অনুচ্ছেদে
নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা এবং কমিশনের দায়িত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ
আছে। নির্বাচন কমিশন হচ্ছে সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি সংস্থা, যা অবাধ
ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার একমাত্র অভিভাবক। এছাড়াও নির্বাচনী আচরণ
বিধিমালা প্রণয়ন, রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধীকরণ, নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ,
প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ভোটার তালিকা প্রণয়ন, নির্বাচনী ব্যয়
নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ ইত্যাদি কমিশনের
দায়িত্ব। সংক্ষেপে বলা যায়, দেশের শাসনভার কাদের হাতে ভবিষ্যতে অর্পিত হতে
পারে, তার নিয়ামক হচ্ছে নির্বাচন কমিশন।
কমিশনের পৃথক সত্তাকে প্রোজ্জ্বল করার লক্ষ্যে সরকার ২০০৯ সালে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় অ্যাক্ট বা আইন প্রণয়ন করে কমিশনের সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রভাব থেকে মুক্ত করা হয় নির্বাচন কমিশনকে। বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের ১০টি আঞ্চলিক অফিস, বিভাগীয় সদর দফতরে ৭টি এবং জেলা সদরে ৩টি কার্যালয় আছে। প্রায় ৮৩টি নির্বাচনী অফিস ৬৪টি জেলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সংক্ষেপে বলা যায়, নির্র্বাচন কমিশন একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান, যা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে অমূল্য অবদান রাখতে পারে এবং যার পর্যাপ্ত অবকাঠামো বিরাজমান।
কিন্তু নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজের অনেক প্রতিনিধি এটিকে একটি শক্তিশালী নিরপেক্ষ সংস্থা হিসেবে বিবেচনা করেননি। একে সরকারের একটি ‘দীর্ঘহাত’ বলে অনেক সময় আখ্যায়িত করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো এমন অভিযোগ সঠিক নয়, আবার কিছু সময়ে তা দৃশ্যমানও হয়েছে। তবে সবচেয়ে হাসির খোরাক সৃষ্টি হয় যখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আজিজের সমর্থনে বরিশালের কিছু মানুষ জাজেস কমপ্লেক্সে দুধ-কলা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। ঢাকার ব্যবসায়ীরা সাবেক এই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে কোনো কিছু বিক্রি করতেই অপারগতা জানিয়েছিলেন। পৃথিবীর কোনো দেশে এ ধরনের আধা-বিচারিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে নিয়ে এমন কাণ্ড ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই।
এর মূল কারণ হচ্ছে, এমন একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা সদস্য হওয়ার জন্য যে সততা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা সম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রয়োজন, অনেক সময় তা হয়েছে উপেক্ষিত। পক্ষান্তরে দলীয় সমর্থক ও দুর্বল মানসিকতার লোকজনকে এমন একটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার করা হয়েছে, যা অবশ্যই অনভিপ্রেত। তাই বিভিন্ন সময়ে অবাঞ্ছিত অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ক্ষুণœ হয়েছে। তবে অনেক ভালো ও দক্ষ ব্যক্তিও কমিশনের বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন এবং তারা নির্বাচনী কর্মকাণ্ড ভালোভাবে পরিচালনা করে দেশের গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। দেশবাসী তাদের কথা এখনও স্মরণ করে।
নির্বাচন সমাগত। দেশবাসীর প্রত্যাশা, নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে। বড় কথা হচ্ছে, কোনো প্রকার পক্ষপাতিত্ব দেশবাসী বরদাশত করবে না। সবার জন্য সমান সুযোগের নিশ্চয়তা দিতে হবে। নির্বাচন কমিশন শুধু নিরপেক্ষ থাকলেই চলবে না, তার নিরপেক্ষতাকে দৃশ্যমানও করতে হবে। কথায় ও কাজে স্বচ্ছ হতে হবে, যেন বোঝা যায় কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা নিরপেক্ষতা বজায় রাখছেন। কমিশন বলতে শুধু প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনারদের মনে করা সঠিক হবে না। নির্বাচন কমিশনের ১০টি আঞ্চলিক অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মীবাহিনী তাদের কাজে কোনো অবস্থাতেই পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করতে পারবেন না। প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এ কথা পরিষ্কারভাবে তার কর্মীবাহিনী এবং সব কর্মকর্তাকে বোঝাতে হবে। তারা যেন তা প্রতিপালন করেন, এ ব্যাপারে কমিশনকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। প্রথমে নিজের ঘরকে নিরপেক্ষ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরপরই সব রিটার্নিং অফিসারকে নিয়ন্ত্রণের এবং কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্ব হবে নির্বাচন কমিশনের। তাদের চাকরি ন্যস্ত হবে কমিশনের ওপর। কমিশন নতুন করে ভাবতে পারে কাকে কোথায় রাখতে হবে অথবা কাকে বদলি বা প্রত্যাহার করতে হবে। বর্তমানে যা আলামত দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হয় নির্বাচন কমিশনে নিরপেক্ষতার স্বার্থে প্রচুর রদবদল করতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জেলা-উপজেলা এবং অন্যান্য পর্যায়ের কর্মীবাহিনীর চাকরি নির্বাচন কমিশনের কাছে ন্যস্ত করতে হবে। এছাড়া নির্বাচন কমিশন ঠিক করবে আইন-শৃংখলা বাহিনীকে কীভাবে কোথায় নিয়োজিত করবে। প্রয়োজনে স্ট্রাইকিং ফোর্স ও রিজার্ভ বাহিনীকে জরুরি হস্তক্ষেপের জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে। কমিশনকে এসব বিষয়ে এখনই কাজ শুরু করতে হবে এবং নির্বাচনকালীন সব বিশৃংখলা নিরাময়ের লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিতে হবে।
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেশবাসীকে উপহার দেয়ার। কমিশন যাতে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে সেজন্য সব রাজনৈতিক দলেরই উচিত সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা। আমাদের মতো দেশে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা অথবা ক্ষমতায় যাওয়া। এ ব্যাপারেও কমিশনকে কঠোর হতে হবে। কুঠারকে কুঠার বলার সাহস ও সদিচ্ছা তাদের অবশ্যই থাকতে হবে।
চতুর্থ যে বিষয়টিতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা প্রাধান্য দিয়ে থাকেন তা হচ্ছে, নির্বাচনী আচরণবিধি প্রণয়ন এবং তা কঠোরভাবে প্রতিপালন করা। নির্বাচন কমিশন প্রণীত বিধিমালা অনুসরণ করতে বাধ্য সব প্রার্থী। অনেক সময় দেখা যায়, নির্বাচন কমিশনের কর্মীরা কোনো কোনো প্রার্থীর প্রতি দুর্বল, তাদের খারাপ কাজ দেখেও দেখেন না। আবার কারও ক্ষেত্রে রাস্তায় চলতে গেলেই দোষ-ত্র“টি খুঁজে পান। এমনটি হলে অভিযোগের আঙুল উত্থাপিত হবে কমিশনের দিকে। তাই রিটার্নিং অফিসার বা সহকারী রিটার্নিং অফিসারসহ প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে যাতে কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব না হয় তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। নির্বাচন আচরণ বিধিমালায় টাকার খেলা কীভাবে বন্ধ করতে হবে, তা অবশ্যই কমিশনের কর্মকর্তাদের অজানা নয়। টাকা দিয়ে যেসব বণিক সংসদে বসার অভিলাষে বিভোর, তাদের অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে কঠোর আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন করে।
বর্তমান বাস্তবতায় দেশবাসীর একমাত্র আশা-ভরসার স্থল হচ্ছে নির্বাচন কমিশন এবং তাদের নিরপেক্ষতা ও সততা এবং দৃশ্যমান দক্ষতা। এক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা করতে প্রজাতন্ত্রের সর্বস্তরের কর্মচারী প্রস্তুত থাকবে, যদি তারা কমিশনের কাছ থেকে সাহস ও শক্তি পায়। পৃথিবীর প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন কমিশন সাহসী ভূমিকা রেখে থাকে এবং নির্বাচন কমিশনকে সবাই যমের মতো ভয় করে। ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনাব টি এন সেসানের দায়িত্ব গ্রহণের আগে উত্তর প্রদেশে এক নির্বাচনী সংঘর্ষে ৯১ জন নিহত এবং কয়েক হাজার মানুষ পঙ্গু হয়েছিল। কিন্তু মি. সেসন নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর একটিও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। দাঙ্গাবাজদের নিরস্ত্র করা হয়েছে এবং তারা প্রশাসনের ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। প্রশাসন নিরপেক্ষ ও কঠোর হলে সুযোগসন্ধানীরা পালানোর পথ খুঁজে বেড়ায়, রুদ্ধ হয় দুর্বৃত্তায়নের পথ।
দেশের বর্তমান ক্রান্ত্রিলগ্নে নির্বাচন কমিশনের সত্যিকার নিরপেক্ষ ও কঠোর ভূমিকা দেখতে চায় দেশবাসী। কমিশন নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী হলে দেশের গণতন্ত্রের সুরক্ষায় বড় ধরনের অবদান রাখতে সক্ষম হবেন তারা।
ধীরাজ কুমার নাথ : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব
কমিশনের পৃথক সত্তাকে প্রোজ্জ্বল করার লক্ষ্যে সরকার ২০০৯ সালে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় অ্যাক্ট বা আইন প্রণয়ন করে কমিশনের সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রভাব থেকে মুক্ত করা হয় নির্বাচন কমিশনকে। বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের ১০টি আঞ্চলিক অফিস, বিভাগীয় সদর দফতরে ৭টি এবং জেলা সদরে ৩টি কার্যালয় আছে। প্রায় ৮৩টি নির্বাচনী অফিস ৬৪টি জেলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সংক্ষেপে বলা যায়, নির্র্বাচন কমিশন একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান, যা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে অমূল্য অবদান রাখতে পারে এবং যার পর্যাপ্ত অবকাঠামো বিরাজমান।
কিন্তু নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজের অনেক প্রতিনিধি এটিকে একটি শক্তিশালী নিরপেক্ষ সংস্থা হিসেবে বিবেচনা করেননি। একে সরকারের একটি ‘দীর্ঘহাত’ বলে অনেক সময় আখ্যায়িত করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো এমন অভিযোগ সঠিক নয়, আবার কিছু সময়ে তা দৃশ্যমানও হয়েছে। তবে সবচেয়ে হাসির খোরাক সৃষ্টি হয় যখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আজিজের সমর্থনে বরিশালের কিছু মানুষ জাজেস কমপ্লেক্সে দুধ-কলা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। ঢাকার ব্যবসায়ীরা সাবেক এই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে কোনো কিছু বিক্রি করতেই অপারগতা জানিয়েছিলেন। পৃথিবীর কোনো দেশে এ ধরনের আধা-বিচারিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে নিয়ে এমন কাণ্ড ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই।
এর মূল কারণ হচ্ছে, এমন একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা সদস্য হওয়ার জন্য যে সততা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা সম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রয়োজন, অনেক সময় তা হয়েছে উপেক্ষিত। পক্ষান্তরে দলীয় সমর্থক ও দুর্বল মানসিকতার লোকজনকে এমন একটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার করা হয়েছে, যা অবশ্যই অনভিপ্রেত। তাই বিভিন্ন সময়ে অবাঞ্ছিত অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ক্ষুণœ হয়েছে। তবে অনেক ভালো ও দক্ষ ব্যক্তিও কমিশনের বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন এবং তারা নির্বাচনী কর্মকাণ্ড ভালোভাবে পরিচালনা করে দেশের গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। দেশবাসী তাদের কথা এখনও স্মরণ করে।
নির্বাচন সমাগত। দেশবাসীর প্রত্যাশা, নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে। বড় কথা হচ্ছে, কোনো প্রকার পক্ষপাতিত্ব দেশবাসী বরদাশত করবে না। সবার জন্য সমান সুযোগের নিশ্চয়তা দিতে হবে। নির্বাচন কমিশন শুধু নিরপেক্ষ থাকলেই চলবে না, তার নিরপেক্ষতাকে দৃশ্যমানও করতে হবে। কথায় ও কাজে স্বচ্ছ হতে হবে, যেন বোঝা যায় কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা নিরপেক্ষতা বজায় রাখছেন। কমিশন বলতে শুধু প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনারদের মনে করা সঠিক হবে না। নির্বাচন কমিশনের ১০টি আঞ্চলিক অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মীবাহিনী তাদের কাজে কোনো অবস্থাতেই পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করতে পারবেন না। প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এ কথা পরিষ্কারভাবে তার কর্মীবাহিনী এবং সব কর্মকর্তাকে বোঝাতে হবে। তারা যেন তা প্রতিপালন করেন, এ ব্যাপারে কমিশনকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। প্রথমে নিজের ঘরকে নিরপেক্ষ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরপরই সব রিটার্নিং অফিসারকে নিয়ন্ত্রণের এবং কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্ব হবে নির্বাচন কমিশনের। তাদের চাকরি ন্যস্ত হবে কমিশনের ওপর। কমিশন নতুন করে ভাবতে পারে কাকে কোথায় রাখতে হবে অথবা কাকে বদলি বা প্রত্যাহার করতে হবে। বর্তমানে যা আলামত দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হয় নির্বাচন কমিশনে নিরপেক্ষতার স্বার্থে প্রচুর রদবদল করতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জেলা-উপজেলা এবং অন্যান্য পর্যায়ের কর্মীবাহিনীর চাকরি নির্বাচন কমিশনের কাছে ন্যস্ত করতে হবে। এছাড়া নির্বাচন কমিশন ঠিক করবে আইন-শৃংখলা বাহিনীকে কীভাবে কোথায় নিয়োজিত করবে। প্রয়োজনে স্ট্রাইকিং ফোর্স ও রিজার্ভ বাহিনীকে জরুরি হস্তক্ষেপের জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে। কমিশনকে এসব বিষয়ে এখনই কাজ শুরু করতে হবে এবং নির্বাচনকালীন সব বিশৃংখলা নিরাময়ের লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিতে হবে।
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেশবাসীকে উপহার দেয়ার। কমিশন যাতে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে সেজন্য সব রাজনৈতিক দলেরই উচিত সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা। আমাদের মতো দেশে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা অথবা ক্ষমতায় যাওয়া। এ ব্যাপারেও কমিশনকে কঠোর হতে হবে। কুঠারকে কুঠার বলার সাহস ও সদিচ্ছা তাদের অবশ্যই থাকতে হবে।
চতুর্থ যে বিষয়টিতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা প্রাধান্য দিয়ে থাকেন তা হচ্ছে, নির্বাচনী আচরণবিধি প্রণয়ন এবং তা কঠোরভাবে প্রতিপালন করা। নির্বাচন কমিশন প্রণীত বিধিমালা অনুসরণ করতে বাধ্য সব প্রার্থী। অনেক সময় দেখা যায়, নির্বাচন কমিশনের কর্মীরা কোনো কোনো প্রার্থীর প্রতি দুর্বল, তাদের খারাপ কাজ দেখেও দেখেন না। আবার কারও ক্ষেত্রে রাস্তায় চলতে গেলেই দোষ-ত্র“টি খুঁজে পান। এমনটি হলে অভিযোগের আঙুল উত্থাপিত হবে কমিশনের দিকে। তাই রিটার্নিং অফিসার বা সহকারী রিটার্নিং অফিসারসহ প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে যাতে কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব না হয় তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। নির্বাচন আচরণ বিধিমালায় টাকার খেলা কীভাবে বন্ধ করতে হবে, তা অবশ্যই কমিশনের কর্মকর্তাদের অজানা নয়। টাকা দিয়ে যেসব বণিক সংসদে বসার অভিলাষে বিভোর, তাদের অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে কঠোর আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন করে।
বর্তমান বাস্তবতায় দেশবাসীর একমাত্র আশা-ভরসার স্থল হচ্ছে নির্বাচন কমিশন এবং তাদের নিরপেক্ষতা ও সততা এবং দৃশ্যমান দক্ষতা। এক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা করতে প্রজাতন্ত্রের সর্বস্তরের কর্মচারী প্রস্তুত থাকবে, যদি তারা কমিশনের কাছ থেকে সাহস ও শক্তি পায়। পৃথিবীর প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন কমিশন সাহসী ভূমিকা রেখে থাকে এবং নির্বাচন কমিশনকে সবাই যমের মতো ভয় করে। ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনাব টি এন সেসানের দায়িত্ব গ্রহণের আগে উত্তর প্রদেশে এক নির্বাচনী সংঘর্ষে ৯১ জন নিহত এবং কয়েক হাজার মানুষ পঙ্গু হয়েছিল। কিন্তু মি. সেসন নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর একটিও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। দাঙ্গাবাজদের নিরস্ত্র করা হয়েছে এবং তারা প্রশাসনের ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। প্রশাসন নিরপেক্ষ ও কঠোর হলে সুযোগসন্ধানীরা পালানোর পথ খুঁজে বেড়ায়, রুদ্ধ হয় দুর্বৃত্তায়নের পথ।
দেশের বর্তমান ক্রান্ত্রিলগ্নে নির্বাচন কমিশনের সত্যিকার নিরপেক্ষ ও কঠোর ভূমিকা দেখতে চায় দেশবাসী। কমিশন নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী হলে দেশের গণতন্ত্রের সুরক্ষায় বড় ধরনের অবদান রাখতে সক্ষম হবেন তারা।
ধীরাজ কুমার নাথ : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব
No comments