ছারপোকা
ভারতের রাজনীতিতে এক বর্ণাঢ্য চরিত্র লালুপ্রসাদ যাদব। গত সিকি শতাব্দীতে তিনি বহুবার সংবাদ শিরোনামে এসেছেন। যখন তিনি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী, তখন তাঁকে দেখা গেছে ধর্মপত্নী রাবড়ি দেবীর হাতে সেঁকা রুটি খাচ্ছেন রান্নাঘরে বসে। গরুর ওলান থেকে দুধও দোহায়েছেন নিজ হাতে। রাবড়ি দেবীর হাতের রুটি নয়, গত কয়েক দিন যাবৎ তিনি ঝাড়খন্ডের রাজধানী রাঁচির বীরসা মুন্ডা কেন্দ্রীয় কারাগারের কয়েদিদের হাতে বানানো রুটি খাচ্ছেন। ওই উঁচু প্রাচীরঘেরা স্থাপনার নিবাসী হিসেবে প্রথমে তাঁর নম্বর ছিল ৩৩১২। তিনি ভিআইপি, তাই এখন তাঁর কয়েদি নম্বর কমে হয়েছে ১৫২৮। প্রাচীরঘেরা ভবনে ঢুকে প্রথম রাতটি কেটেছে তাঁর চরম অস্বস্তিতে। বলতে গেলে বিনিদ্র। ছারপোকা তাঁকে ঘুমাতে দেয়নি।
যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁদের বাসভবন থেকে জেলখানার দূরত্ব খুবই কম। রাজনৈতিক কারণে জেলে যাওয়া কোনো অসম্মানজনক ব্যাপার নয়। কখনো কখনো জেলে গেলেই বরং গৌরব বাড়ে। জেলখানায় রাজার হালে থাকা যায়। রাজবন্দীদের ক্ষেত্রে আগে তাই ছিল। বেরোনোর দিন জেলগেটে প্রচুর ফুলের মালা পাওয়া যেত। কিন্তু দুর্নীতির মতো অপরাধ করে জেলে যাওয়া গ্লানিকর। ছারপোকার কামড়ের চেয়ে অসম্মানের দংশন অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক। ছারপোকা অতি ক্ষুদ্র প্রাণী। কিন্তু প্রাণী বটে! প্রাণী হিসেবে ছারপোকার এমন কিছু বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই, যা অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে লক্ষ করা যায় না। এক. কামড়ে মানুষকে কষ্ট দেয়। ছারপোকার সূক্ষ্ম দংশন এমন যন্ত্রণাদায়ক, যা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ টেরও পায় না। (রাজনীতিকেরাও ক্ষমতায় গিয়ে বা না গিয়েও জনগণকে এমন যন্ত্রণা দেন, যার কিছু দেখা যায়, কিছু থাকে অদৃশ্য।) দুই. ছারপোকা শুধু কামড়ায় না, মানুষের রক্ত শোষণ করে।
রক্ত চুষে পেট ফোলায়। (রাজনীতিকেরাও জনগণের রক্ত অর্থাৎ তাদের অর্থ ও সম্পদ শোষণ করে মোটাতাজা হন ছারপোকার মতো।) তিন. ছারপোকা একটি দুর্গন্ধময় প্রাণী। (পেশাজীবী হিসেবে রাজনীতিকদের শরীরে কোনো দুর্গন্ধ আছে তা আমরা কস্মিনকালেও বলব না। বরং দামি সেন্ট ব্যবহার করার ফলে তাঁদের শরীর থেকে ভুরভুর করে তীব্র সুগন্ধই বের হয়।) লালুপ্রসাদ জেলে গেছেন অনেক দিন আগের এক অপরাধে। অনেক দেশ আছে, যেখানে হাতেনাতে ধরা পড়লেও হাজতে যাওয়া তো দূরের কথা, পদটি পর্যন্ত যায় না। কর্তৃপক্ষ তার লোমটিও স্পর্শ করার প্রয়োজন মনে করে না। সাবেক রেলমন্ত্রী, তার আগে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, লালুপ্রসাদকে সিবিআই আদালত বহু বছর আগের পশুখাদ্য দুর্নীতিতে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। সিবিআই আদালত তাঁকে ছেড়ে দিয়ে তাঁর আরদালি, ড্রাইভার, পিএ, অফিসের কেরানি বা বাড়ির দারোয়ানকে পাকড়াও করেননি। এই দুনিয়ার কোনো কোনো দেশ হলে তা-ই করত। যেসব দেশে আইনের শাসন নয়—ব্যক্তির শাসন, সেখানে যেকোনো রকমের দুর্নীতি, বস্তা বস্তা টাকা চুরি-চামারি, দু-পাঁচজনকে খুনখারাবি করেও বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। গোলটেবিলে কষে নীতিকথামূলক বক্তৃতা দেওয়া যায়। ভারতে বহু মন্ত্রী, সাংসদ, পদস্থ কর্মকর্তা জেলের ভাত খেয়েছেন এবং খাচ্ছেন। অন্যান্য দেশেও। তবে কোনো কোনো দেশে একজন সাংসদের গাড়িতে, সাংসদের পিস্তলে তাঁরই কোনো সহকর্মী খুন হলেও থানা-পুলিশের সাধ্য নেই সাংসদকে আটক করার।
কোনো কোনো দেশে দুর্নীতি তো কোনো ব্যাপারই নয়। সেসব দেশে দুর্নীতি দমন বিভাগের কাজ দুই রকম। সরকারি দলের দুর্নীতিবাজদের জন্য একটি উদার শাখা। এই শাখার কাজ তাদের দুর্নীতি যত ধামাচাপা দেওয়া যায়। অভিযুক্তকে সাজা না দিক, তাদের ডেকে যে জিজ্ঞেস করবে সে মুরোদটুকু পর্যন্ত নেই। বিরোধী দলের জন্য আর একটি শাখা। এটি বড়ই কঠোর। খুবই নির্মম। এখানে লোকবল বেশি। কাজের চাপও প্রচণ্ড। অনেক রাত অবধি কর্মকর্তাদের কাজ করতে হয়। যেসব গণতান্ত্রিক দেশে আইনের শাসন রয়েছে, সেখানে সরকারেই থাকুন আর সরকারের বাইরেই থাকুন, যিনি যত বড়ই হোন, অপরাধ ও দুর্নীতি করে পার পান না কেউ। ক্ষমতার অপব্যবহার করে কিছু সময়ের জন্য বাঁচা গেলেও পাঁচ-দশ বছর পরে হলেও ধরা পড়তেই হবে। বিচার হবে। সাজা হবে, জেলের শয্যায় শুতে হবে। ছারপোকার কামড়ও খেতে হবে। লালুপ্রসাদের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে। বসে বসে খাওয়া আর ঘুমানো চলবে না। যত জনপ্রিয় নেতাই হোন, কিছু শ্রম দিতে হবে। ওই কারাগারে শিক্ষিত কয়েদি আছেন অনেকে। লালুপ্রসাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স। তাঁকে দিয়ে কয়েদিদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ানোর কথা ভাবছে জেল কর্তৃপক্ষ। এথিকস বা নীতিশাস্ত্র পড়ানোর দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হবে না। তাঁর যোগ্যতা-দক্ষতা যথেষ্ট। ভাড়া না বাড়িয়েও তিনি ভারতের রেলওয়েকে লাভজনক করেছিলেন। সুতরাং ছারপোকা নির্মূলেও তিনি একটি ভূমিকা রাখতে পারেন।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments