পোশাক শিল্পের উন্নয়নে বিদেশী ক্রেতাদের সহায়তা by ড. আনু মাহমুদ
বাংলাদেশের
পোশাক কারখানার শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ উন্নত করতে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান
কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যারা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করে
থাকে। মার্কিন ও কানাডিয়ান কোম্পানিগুলোর এ উদ্যোগের নাম দেয়া হয়েছে
‘বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটি ইনিশিয়েটিভ’। পাঁচ বছর মেয়াদি এ পরিকল্পনার
অধীনে আগামী এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো প্রথমে তারা
পরিদর্শন করবে। যেসব কারখানায় পর্যাপ্ত শ্রমিক নিরাপত্তা নেই বা কারখানা
স্থানান্তরের প্রয়োজন রয়েছে, তা চিহ্নিত করে সমস্যা নিরসনে মালিকপক্ষকে
স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করবে। পাশাপাশি জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়ক
সংস্থা জাইকাও পোশাক খাতের উন্নয়নে ১০০ কোটি টাকা ঋণ দেবে। এ উদ্যোগ
বাস্তবায়িত হলে দেশের পোশাক শিল্পে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে ধরে নেয়া যায়।
দেশে ও বিদেশে আমাদের পোশাক শিল্পের অর্থনৈতিক গুরুত্ব কত ব্যাপক, তা
বিদেশী এ পরিকল্পনা থেকেই সহজে অনুমান করা যায়। তাদের এ পরিকল্পনাগুলো
আপাতদৃষ্টিতে একটি সুখবর হলেও কিঞ্চিৎ বিব্রতকরও বটে। পোশাক শিল্পের
মাধ্যমে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা অর্জিত হলেও মালিকপক্ষ ও যথাযথ
কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা এবং শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হওয়ায়
বিদেশী এ পরিকল্পনা আমাদের আন্তরিকতা ও সফলতার ক্ষেত্রে একটি প্রশ্নবোধক
চিহ্নও এঁকে দেয় বটে।
দেশের পোশাক কারখানাগুলোয় শ্রমিকদের নিরাপত্তা, শ্রম অধিকার ও শ্রমিক কল্যাণ পরিবেশ নিয়ে অনেক আগে থেকেই শ্রমিক, মানবাধিকার সংগঠনগুলো আন্দোলন করে আসছিল। সাভারে রানা প্লাজা ধসে হাজারের অধিক শ্রমিক নিহত হলে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকে। সেদিকে কেউ কর্ণপাত না করায় শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা জিএসপি হারায় বাংলাদেশ। খোদ ওবামা প্রশাসন এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে নিুগামী তো হয়ই, পোশাক শিল্পের প্রতি দেখা দেয় হুমকি হিসেবেও। আশার কথা, জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশের জন্য স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ হয়নি। এ সুবিধা স্থগিত করা হয়েছে। এ সুবিধা ফিরে পেতে মার্কিন প্রশাসন বেশকিছু শর্তারোপ করেছে। নভেম্বরের মধ্যে যেসব শর্ত পূরণ করলে জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশ ফিরে পেতে পারে, সেসব শর্তের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ উন্নয়ন ও দেশের শ্রম আইন সংশোধন।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও জাইকার উদ্যোগও পোশাক কারখানায় কর্মপরিবেশের উন্নয়নসহ নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ হাজার পোশাক কারখানায় ওই সংগঠন পরিদর্শন করবে এক বছর ধরে। এর জন্য প্রাথমিকভাবে তারা তহবিল গঠন করেছে চার কোটি ডলারের বেশি। কারখানাগুলোর সার্বিক মানোন্নয়নের জন্য তারা দশ কোটি ডলার ঋণের ব্যবস্থা করবে। জাইকাও ঋণের ব্যবস্থা করবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। এ ঋণ দেয়া হবে বিশেষ কোনো নির্দিষ্ট দিক নির্দেশ করে নয়, সার্বিক উন্নয়নে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের আওতায় ব্যাংক ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সহজশর্তে এ ঋণ প্রদান করা হবে। আশার কথা, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো যে ঋণ সহায়তা প্রদান করবে, তাও সহজশর্তে। দেশের ব্যাংকগুলোর প্রচলিত প্রায় ১৬ শতাংশ উচ্চ সুদ হারে নয়, বরং ৫ থেকে ৬ শতাংশ সুদ হারে ঋণ দেবে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় বারবার সংঘটিত দুর্ঘটনায় হাজার হাজার শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনা এবং শ্রমিকদের বেতন-ভাতাসহ অন্য ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের জন্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ও প্রচার মাধ্যম বারবার সোচ্চার ও সতর্ক করার পরও তা বাস্তবায়িত না হওয়া দুঃখজনক। শ্রমিক হত্যা ও বঞ্চনার ঘটনা ঘটেই চলেছে এত কিছুর পরও।
২
ইউরোপীয় ইউনিয়নও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে তিনটি বিষয়ে অগ্রগতির সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কারখানা পরিদর্শকের সংখ্যা ২০০-তে উন্নীত করতে হবে এবং আগামী বছরের জুনের মধ্যে সব কারখানার কাঠামো ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরিদর্শন সম্পন্ন করতে হবে। জেনেভায় ইইউ আয়োজিত উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। ইইউ ছাড়াও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং যুক্তরাষ্ট্র এ বৈঠকে অংশ নেয়। এ বিষয়ে বৈঠক-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ইইউ ট্রেড কমিশনার ক্যারল ডি গুশ বলেন, বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করা হলে বড় ধরনের বিপর্যয় হবে। অনেক শ্রমিক চাকরি হারাবেন। তিনি আরও জানান, অগ্রগতি নিয়ে আলোচনার জন্য ২০১৪ সালে বাংলাদেশ নিয়ে আবার একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর নিরাপত্তার মানোন্নয়নে সহায়তা করবে বিদেশী ক্রেতারা। এ বিষয়ে একটি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে শীর্ষস্থানীয় ৭৩টি পশ্চিমা খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। এর অংশ হিসেবে চলতি মাসের শেষের দিকে কারখানা পরিদর্শনে আসছেন তারা। এএফপি ও বিবিসির সংবাদ থেকে জানা যায়, ‘অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ’ নামে এ চুক্তি বাধ্যতামূলক। এতে বিদেশী কোম্পানিগুলোর জন্য বাংলাদেশী যেসব কারখানা পোশাক প্রস্তুত করে, সেগুলোতে আগামী নয় মাসের মধ্যে পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদের এ চুক্তির বাস্তবায়ন দেখভাল করতে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে একটি সদর দফতর প্রতিষ্ঠা করা হবে। এছাড়া বাংলাদেশে আরেকটি দফতর খোলা হবে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের মানোন্নয়নে বিদেশী ক্রেতাদের এ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে এ দেশের পোশাক শিল্প খাতে শ্রমমান নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও একথা পরিষ্কার যে, জিএসপি বাতিল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক শিল্প কোনো জিএসপি সুবিধা পায় না। অথচ জিএসপি সুবিধা পায় এমন শিল্প-কারখানাগুলোর শ্রমমান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি কোনো মহল থেকে। এর মানে এই নয় যে, জিএসপি সুবিধাপ্রাপ্ত শিল্প-কারখানাগুলো সবাই শ্রমমানের আইএলও স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখছে। বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের পক্ষ থেকে সব সময় দাবি ছিল, ক্রেতারা যেন ন্যায্য দাম দিয়ে পোশাক কেনে। কিন্তু উল্লিখিত কোনো আলোচনাতেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্য পাশ্চাত্যের কাছে লোভনীয় এ খাতে সস্তা মজুরির কারণে। অধিক মুনাফার লোভে ইউরোপীয় ক্রেতারা ক্রমাগত দাম কমিয়ে বাংলাদেশ থেকে পণ্য সরবরাহের চাপ দেয়। এর বাইরে আবার বড় বড় বায়াররা বাংলাদেশে না এসে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, দুবাই, দিল্লি, মুম্বাইয়ে বসে সেদেশের বায়িং হাউসগুলোকে অর্ডার দেয়। এ বায়িং হাউসগুলো আবার আরও সস্তা দাম ধরে বাংলাদেশ থেকে পোশাক তৈরির অর্ডার দেয়। কম দামের ওপর আবার মধ্যস্বত্বভোগীদের এই কমিশন বোঝা নিয়ে পোশাক তৈরি করতে গিয়ে দেশের পোশাক শিল্পের অবস্থা খুবই করুণ। এরই মধ্যে অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে ব্যবসায় লোকসান গুনে। কিন্তু তাদের এই দাম কমানোর প্রধান শিকার হয় গার্মেন্ট শ্রমিকরা। কাজেই সত্যিকারভাবে যদি পাশ্চাত্যের আমদানিকারকরা পোশাকের উৎপাদন মূল্য না বাড়ায়, তাহলে কমপ্লায়েন্সের নামে খরচ বাড়িয়ে দেশের পোশাক শিল্প তার উৎপাদনশীলতা ধরে রাখতে পারবে না। যেসব পশ্চিমা কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বা শ্রম সংস্থার প্রতিনিধি বাংলাদেশের পোশাক খাতের শ্রমমান নিয়ে দিন-রাত জ্ঞানগর্ভ তত্ত্ব, তথ্য ও উপদেশ দেন, তারা যদি সংকটের মূল কারণ অনুধাবন করে পাশ্চাত্যের বায়ারদের বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিতে রাজি করাতে সক্ষম হন, তাহলে এ সংকটের সমাধান খুব সহজেই সম্ভব হবে।
ড. আনু মাহমুদ : অর্থনীতি বিশ্লেষক
দেশের পোশাক কারখানাগুলোয় শ্রমিকদের নিরাপত্তা, শ্রম অধিকার ও শ্রমিক কল্যাণ পরিবেশ নিয়ে অনেক আগে থেকেই শ্রমিক, মানবাধিকার সংগঠনগুলো আন্দোলন করে আসছিল। সাভারে রানা প্লাজা ধসে হাজারের অধিক শ্রমিক নিহত হলে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকে। সেদিকে কেউ কর্ণপাত না করায় শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা জিএসপি হারায় বাংলাদেশ। খোদ ওবামা প্রশাসন এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে নিুগামী তো হয়ই, পোশাক শিল্পের প্রতি দেখা দেয় হুমকি হিসেবেও। আশার কথা, জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশের জন্য স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ হয়নি। এ সুবিধা স্থগিত করা হয়েছে। এ সুবিধা ফিরে পেতে মার্কিন প্রশাসন বেশকিছু শর্তারোপ করেছে। নভেম্বরের মধ্যে যেসব শর্ত পূরণ করলে জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশ ফিরে পেতে পারে, সেসব শর্তের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ উন্নয়ন ও দেশের শ্রম আইন সংশোধন।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও জাইকার উদ্যোগও পোশাক কারখানায় কর্মপরিবেশের উন্নয়নসহ নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ হাজার পোশাক কারখানায় ওই সংগঠন পরিদর্শন করবে এক বছর ধরে। এর জন্য প্রাথমিকভাবে তারা তহবিল গঠন করেছে চার কোটি ডলারের বেশি। কারখানাগুলোর সার্বিক মানোন্নয়নের জন্য তারা দশ কোটি ডলার ঋণের ব্যবস্থা করবে। জাইকাও ঋণের ব্যবস্থা করবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। এ ঋণ দেয়া হবে বিশেষ কোনো নির্দিষ্ট দিক নির্দেশ করে নয়, সার্বিক উন্নয়নে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের আওতায় ব্যাংক ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সহজশর্তে এ ঋণ প্রদান করা হবে। আশার কথা, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো যে ঋণ সহায়তা প্রদান করবে, তাও সহজশর্তে। দেশের ব্যাংকগুলোর প্রচলিত প্রায় ১৬ শতাংশ উচ্চ সুদ হারে নয়, বরং ৫ থেকে ৬ শতাংশ সুদ হারে ঋণ দেবে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় বারবার সংঘটিত দুর্ঘটনায় হাজার হাজার শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনা এবং শ্রমিকদের বেতন-ভাতাসহ অন্য ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের জন্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ও প্রচার মাধ্যম বারবার সোচ্চার ও সতর্ক করার পরও তা বাস্তবায়িত না হওয়া দুঃখজনক। শ্রমিক হত্যা ও বঞ্চনার ঘটনা ঘটেই চলেছে এত কিছুর পরও।
২
ইউরোপীয় ইউনিয়নও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে তিনটি বিষয়ে অগ্রগতির সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কারখানা পরিদর্শকের সংখ্যা ২০০-তে উন্নীত করতে হবে এবং আগামী বছরের জুনের মধ্যে সব কারখানার কাঠামো ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরিদর্শন সম্পন্ন করতে হবে। জেনেভায় ইইউ আয়োজিত উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। ইইউ ছাড়াও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং যুক্তরাষ্ট্র এ বৈঠকে অংশ নেয়। এ বিষয়ে বৈঠক-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ইইউ ট্রেড কমিশনার ক্যারল ডি গুশ বলেন, বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করা হলে বড় ধরনের বিপর্যয় হবে। অনেক শ্রমিক চাকরি হারাবেন। তিনি আরও জানান, অগ্রগতি নিয়ে আলোচনার জন্য ২০১৪ সালে বাংলাদেশ নিয়ে আবার একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর নিরাপত্তার মানোন্নয়নে সহায়তা করবে বিদেশী ক্রেতারা। এ বিষয়ে একটি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে শীর্ষস্থানীয় ৭৩টি পশ্চিমা খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। এর অংশ হিসেবে চলতি মাসের শেষের দিকে কারখানা পরিদর্শনে আসছেন তারা। এএফপি ও বিবিসির সংবাদ থেকে জানা যায়, ‘অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ’ নামে এ চুক্তি বাধ্যতামূলক। এতে বিদেশী কোম্পানিগুলোর জন্য বাংলাদেশী যেসব কারখানা পোশাক প্রস্তুত করে, সেগুলোতে আগামী নয় মাসের মধ্যে পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদের এ চুক্তির বাস্তবায়ন দেখভাল করতে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে একটি সদর দফতর প্রতিষ্ঠা করা হবে। এছাড়া বাংলাদেশে আরেকটি দফতর খোলা হবে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের মানোন্নয়নে বিদেশী ক্রেতাদের এ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে এ দেশের পোশাক শিল্প খাতে শ্রমমান নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও একথা পরিষ্কার যে, জিএসপি বাতিল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক শিল্প কোনো জিএসপি সুবিধা পায় না। অথচ জিএসপি সুবিধা পায় এমন শিল্প-কারখানাগুলোর শ্রমমান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি কোনো মহল থেকে। এর মানে এই নয় যে, জিএসপি সুবিধাপ্রাপ্ত শিল্প-কারখানাগুলো সবাই শ্রমমানের আইএলও স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখছে। বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের পক্ষ থেকে সব সময় দাবি ছিল, ক্রেতারা যেন ন্যায্য দাম দিয়ে পোশাক কেনে। কিন্তু উল্লিখিত কোনো আলোচনাতেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্য পাশ্চাত্যের কাছে লোভনীয় এ খাতে সস্তা মজুরির কারণে। অধিক মুনাফার লোভে ইউরোপীয় ক্রেতারা ক্রমাগত দাম কমিয়ে বাংলাদেশ থেকে পণ্য সরবরাহের চাপ দেয়। এর বাইরে আবার বড় বড় বায়াররা বাংলাদেশে না এসে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, দুবাই, দিল্লি, মুম্বাইয়ে বসে সেদেশের বায়িং হাউসগুলোকে অর্ডার দেয়। এ বায়িং হাউসগুলো আবার আরও সস্তা দাম ধরে বাংলাদেশ থেকে পোশাক তৈরির অর্ডার দেয়। কম দামের ওপর আবার মধ্যস্বত্বভোগীদের এই কমিশন বোঝা নিয়ে পোশাক তৈরি করতে গিয়ে দেশের পোশাক শিল্পের অবস্থা খুবই করুণ। এরই মধ্যে অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে ব্যবসায় লোকসান গুনে। কিন্তু তাদের এই দাম কমানোর প্রধান শিকার হয় গার্মেন্ট শ্রমিকরা। কাজেই সত্যিকারভাবে যদি পাশ্চাত্যের আমদানিকারকরা পোশাকের উৎপাদন মূল্য না বাড়ায়, তাহলে কমপ্লায়েন্সের নামে খরচ বাড়িয়ে দেশের পোশাক শিল্প তার উৎপাদনশীলতা ধরে রাখতে পারবে না। যেসব পশ্চিমা কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বা শ্রম সংস্থার প্রতিনিধি বাংলাদেশের পোশাক খাতের শ্রমমান নিয়ে দিন-রাত জ্ঞানগর্ভ তত্ত্ব, তথ্য ও উপদেশ দেন, তারা যদি সংকটের মূল কারণ অনুধাবন করে পাশ্চাত্যের বায়ারদের বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিতে রাজি করাতে সক্ষম হন, তাহলে এ সংকটের সমাধান খুব সহজেই সম্ভব হবে।
ড. আনু মাহমুদ : অর্থনীতি বিশ্লেষক
No comments