আগামী নির্বাচন কি হচ্ছে, হলে কিভাবে হচ্ছে এবং না হলে? by বদিউর রহমান
আমাদের
সংবিধান অনুসারে সাধারণভাবে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর জাতীয় নির্বাচন
হওয়ার কথা। ব্যতিক্রম হিসেবে সামরিক সরকার এলে, জাতীয় দুর্যোগ হলে কিংবা
রাজনৈতিক সহিংসতায় এক-এগারো ধরনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে এ নিয়মে ছেদ
পড়ে। কখনোবা সাদেক আলী-মার্কা ফেব্র“য়ারি নির্বাচন হলেও আবার পাঁচ বছর
অপেক্ষা করতে হয় না। আগাম নির্বাচনের ফায়দা নিতে চাইলেও হয়তো এর ব্যতিক্রম
ঘটতে পারে। আমার প্রত্যাশা, প্রতিটি সরকার পাঁচ বছর পূর্ণ করুক এবং কোনো
আন্দোলনেও যেন সরকারের মেয়াদ-পূর্ব অবসান না ঘটে। এ প্রত্যাশায় বলীয়ান হয়ে
এবং বাজাদের (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) অপ্রয়োজনীয় হুমকির অসারতা বিবেচনায়
আমরা এবারও যথারীতি আলী (আওয়ামী লীগ) সরকারের মেয়াদান্তে জাতীয় নির্বাচন
হবে মর্মে আশাবাদী। কেউ কেউ অবশ্য এই ‘হবে’-কে ‘হতে পারে’ বলতে বেশি
আগ্রহী। সভা-সেমিনার এবং ইফতারি-ঈদ মিলনী-প্রচারণার রাজনীতিতে অংশগ্রহণকারী
অনেক নেতা-পাতিনেতা এবং সুশীল-কুশীল বা সুজন-কুজনরা হরহামেশা একটা আশংকা
প্রকাশ করে আমাদের নির্বাচন সম্পর্কে ভীত-সন্ত্রস্ত অথবা সন্দিহান করে
তুলছেন। আমি যেহেতু সব সময় আশাবাদী মানুষ, সেহেতু আমি মনে করি এবং এখনও
বিশ্বাস করি, যথারীতি ও যথাসময়ে আগামী নির্বাচন হবে এবং হতে হবে। অতএব
আগামী নির্বাচন কি হচ্ছে- এমন প্রশ্নে আমার সোজা জবাব, আগামী নির্বাচন এখন
পর্যন্ত বিদ্যমান রাজনৈতিক অবস্থায়ই হচ্ছে।
যারা আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে চলেছেন, তাদের মধ্যে হয়তো দুটি উদ্দেশ্য বিদ্যমান। এক. তারা নির্বাচন হোক তা-ই চান না। এতে তাদের কোনো লুকানো এজেন্ডা হয়তো বাস্তবায়িত হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে আনন্দ পেতে চান। তারা গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আগ্রহী নন। তারা অবশ্যই অগণতান্ত্রিক সরকারে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আমি নিজেও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় অনেককে সামরিক শাসনে বা অগণতান্ত্রিক এমনকি সাময়িকভাবে স্বীকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বেশ স্বস্তি অনুভব করতে দেখেছি। আমলাদের অনেকে তো ওই ধরনের সরকারের অংশীদার হতেও ভালোবাসেন, আপন-আপনভাবে কাজ করতে বেশ আরাম পান, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনেক অন্যায়-আবদার ও অযৌক্তিক গালাগাল থেকে মুক্তি পান। এটা অবশ্যই এক বড় গবেষণার বিষয়- আমলারা সামরিক শাসন বা অন্য ধরনের অগণতান্ত্রিক সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক ধরনের সরকারে আরাম পান কেন? আমি যতটুকু পর্যবেক্ষণ করেছি তাতে লক্ষ্য করেছি যে, এ ধরনের সরকারগুলোতে আমলাদের কর্তৃত্ব তুলনামূলকভাবে বাড়ে, লেখাপড়া জানা আমলাদের এসব সরকারে কদরও বাড়ে, অসহিষ্ণু প্রকৃতির, মূর্খ প্রকৃতির রাজনৈতিক ‘বেয়াদব’ মন্ত্রী-নেতাদের নির্যাতন-নিপীড়ন এবং অযথা তোষামোদ প্রত্যাশা থেকে আমলারা রক্ষা পান। সুযোগ-সুবিধা ভোগেও আমলারা একটু ভালো শেয়ারিংয়ে যেতে পারেন। মূলত রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বের অভাব, জ্ঞানের তুলনামূলক ঘাটতি, অসহিষ্ণু আচরণ, অতিমাত্রায় স্বজনপ্রীতি, দলকানা মনোভাব এবং ন্যায়ানুগ সিদ্ধান্তের কমতি তাদের প্রতি আমলাদের বিরূপ করে তোলে। অপরদিকে রাজনৈতিক সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি থেকে রক্ষা পেতেও অন্য শ্রেণী-গোষ্ঠী যথা ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, পেশাজীবী এবং আমজনতাও এ ধরনের সরকারকে সাময়িকভাবে পছন্দ করে।
বস্তুত রাজনৈতিক ব্যর্থতাই সামরিক বা অন্য সরকারকে সাময়িকভাবে প্রিয় করে তোলে, যেমনটি আমরা অন্তত তিন-তিনবার দেখেছি- প্রথমবার বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়ার সামরিক আমলে, দ্বিতীয়বার এরশাদের সামরিক আমলে এবং তৃতীয়বার ২০০৭-এ এক-এগারোর পর। এ সরকারগুলোর অর্থাৎ অনির্বাচিত বা অগণতান্ত্রিক এ সরকারগুলোর জনপ্রিয়তা প্রাথমিকভাবে, ছয় মাস থেকে এক বছরে, এমন তুঙ্গে থাকে যে তখন তাদের সমর্থনে গণভোট দিলেও তারা জনসমর্থন পেয়ে যাওয়ার অবস্থায় থাকে। রাজনৈতিক সরকারের অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হওয়ার কারণে জনগণ তখন এসব সরকারের মাঝে ‘মুক্তি’ খোঁজে। কিন্তু এ সরকারগুলোই যখন আবার দুর্নীতিপরায়ণ এবং অযথা কর্তৃত্বপরায়ণ হওয়া শুরু করে, তখন জনগণ আবার সম্বিত ফিরে পায় এবং মুখ ফিরিয়ে নেয়। এ এক কঠিন বাস্তবতা এ দেশে। এত কিছুর পরও সময়ের পরীক্ষায় সেই পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অজনপ্রিয় হলেও বা হয়ে গেলেও নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের কোনো বিকল্প নেই। সামরিক বা সেনাসমর্থিত যে কোনো অনির্বাচিত সরকারই দেশের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। কারণ বেনাভোলেন্ট ডিক্টেটর পাওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি বেনাভোলেন্ট ডিক্টেটররাও পরে আর বেনাভোলেন্ট থাকে না। জনগণও পরিবর্তনে বিশ্বাসী, পরিবর্তনে আশাবাদী এবং পরিবর্তন প্রত্যাশী। এসব বিবেচনায় আমরা আশাবাদী যে আগামী নির্বাচন হচ্ছে।
আগামী নির্বাচন যে হচ্ছে, তার পেছনে আমার যুক্তি পর্যালোচনার দাবি রাখে। কারও কাছে পছন্দ না হওয়া ভিন্ন কথা। নির্বাচন না হওয়ার বা না করার অথবা না হতে দেয়ার অনুঘটক তো এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত বড় দু’দল আলী ও বাজাদ। আলীর দিকটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে নির্বাচন না করলে তার কী লাভ-ক্ষতি আর করলে কী লাভ-ক্ষতি। নির্বাচন করলে আলী গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণের বিশ্বাস ধরে রাখতে সক্ষম হবে। তৃণমূল পর্যায়ের সুসংগঠিত ঐতিহ্যবাহী দল হিসেবে এ দলের প্রতি মানুষের আস্থা অন্তত অটুট থাকবে। জনগণের নিকট-অতীতের দুটি ঘটনা থেকে এমন একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত আছে, আলী সুযোগ বুঝে সামরিক বা অগণতান্ত্রিক শাসনকেও সমর্থন করে অথবা অন্তত এর বিরোধিতা করে না। আর বাজাদ সরকারের বিরুদ্ধে তেমন পরিবর্তন হলে তো কথাই নেই। যেমন এরশাদের সামরিক আইন জারির সময় আলী কোনো প্রতিবাদ করেনি, কারণ ক্ষমতাটা নেয়া হয়েছিল বাজাদ থেকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়ার সম্পৃক্ততা নিয়ে এবং আলীকে সাইজ করার জন্য বাজাদ বিকল্প শক্তি হিসেবে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ায় বাজাদের সঙ্গে আলীর শত্র“তা এবং ভাইস-ভারসা এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে, এ থেকে পরিত্রাণের আশু সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। জয়-তারেকের প্রজন্ম তেমন কিছু ঘটলে অবশ্য ভিন্ন কথা। আবার বাজাদের পুতুল রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে হটিয়ে তিন ‘উদ্দিনে’র সরকার এলেও আলী খুশি হয় এবং ওই সরকারকে তাদের লগি-বৈঠার আন্দোলনের ফসল বলে দাবি করে। এমন আশা করা হয়তো এখনও অমূলক হবে না যে, ভবিষ্যতেও যদি বাজাদ থেকে অন্য কেউ ক্ষমতা অগণতান্ত্রিকভাবে কেড়ে নেয় তাহলেও আলী শত্র“র শত্র“ বন্ধু বিবেচনায় খুশিই হবে। আলী সব সময় অগণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও এ ক্ষেত্রে তাদের চরিত্র ভিন্ন। আলী নিজে নির্বাচন না দিয়ে এমন কোনো দায় হয়তো নিতে চাইবে না, কারণ আলী থেকে অন্য কেউ জোর করে ক্ষমতা নিয়ে নিলে বাজাদও একইভাবে হয়তো খুশি হবে। তবে এবারে আলীর ক্ষমতায় থাকাবস্থায় তেমন অবস্থা তার অনুকূলে না ভাবা পর্যন্ত আলী নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতা হস্তান্তরে আগ্রহী হবে। আলী অবশ্যই চাইবে পঞ্চদশ সংশোধনী অনুসারেই নির্বাচন হোক। বাজাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানা আলীর পক্ষে এখন এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে এত আন্দোলন আর প্রাণহানির পর আদালতের রায়ের অজুহাতে তড়িঘড়ি করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে এখন আবার তাতে ফিরে যাওয়া মানেই জাতীয় নির্বাচনে আলীর নিশ্চিত পরাজয় মেনে নেয়া। তখন আরও অনেকে রাগে-ক্ষোভেও আলীকে ভোট দেবে না। বলবে, এই যদি করবে তাহলে আগে এত নাটক কেন, হরতালে-আন্দোলনে মানুষকে কেন এত কষ্ট দেয়া?
আমি নিজে ফাও তত্ত্বাবধায়ক এখনও সমর্থন করি না। নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচনই আমি সমর্থন করি। আলী হেরে গেলেও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচনের আদর্শ স্থাপন করতে পারে এবং তা আলীর জন্য পরবর্তী নির্বাচনেও ইতিবাচক হবে। অতএব আলী নির্বাচন দেবে। না দিলে আলীকে জনগণ বিশ্বাসঘাতকই শুধু বলবে না, ঘৃণাও করবে। সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল হিসেবে আলী নির্বাচন বন্ধ করবে না।
বাজাদের দিক বিবেচনা করলে এটা পরিষ্কার, বাজাদ এখন জয় প্রত্যাশী। বাজাদের জনপ্রিয়তায় নয়, আলীর প্রতি অসন্তোষে নেতিবাচক ভোটে বাজাদ এখন তৃপ্ত। সিটি নির্বাচন ছাড়িয়ে জাতীয় নির্বাচনে তেমন জয়ের হাওয়া বাজাদ দেখছে। তত্ত্বাবধায়ক না দিলেও অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই বাজাদ নির্বাচনে যাবে। না গেলে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় যে বাজাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়, সেটা বাজাদও বোঝে। মুখে হুংকার ছাড়লেও বাজাদ বোঝে যে, এবার নির্বাচনে অংশ না নিয়ে আলীকে মাঠ ছেড়ে দিলে পরের মেয়াদেও বাজাদ আর আলীকে উৎখাত করতে পারবে না। বরং ক্রমাগতভাবে ১২ বছর অর্থাৎ একযুগ (২+৫+৫) ক্ষমতার বাইরে থেকে দল টিকিয়ে রাখাই হবে কার্যকর। রাজনীতি করলে ক্ষমতায় যেতে হয়, দলীয় কর্মীদেরও কলাটা-মুলাটা দিতে হয়। ক্ষমতায় না থাকলে এ দেয়া সম্ভব নয়। অতএব, বাজাদও নির্বাচনে যাবে। আমি আশাবাদী, নির্বাচন হচ্ছে। আলী আর বাজাদ নির্বাচনে অংশ নিলে সমস্যাই থাকে না।
এখন প্রশ্নটা হল, কীভাবে হচ্ছে? অবশ্যই আলাদীনের চেরাগের মাধ্যমে বাজাদ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরে পেতে পারে না। ওই দাবি মানা মানে আলীর পরাজয় মেনে নেয়া- তা আগেই বলেছি। অতএব শেখ হাসিনার অধীনে না হলে আপসের মাধ্যমে দু’দলের সমঝোতায় একটা নির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই শেষতক শেষরক্ষা হতে হবে। দু’দলই বোঝে যে, তা না হলে আবার রাজনৈতিক পিঠাভাগের জন্য একটা ‘অরাজনৈতিক বানর’ হলেও এসে যেতে পারে, যেমন এক ফখরুদ্দীন এসেছিলেন। এতে ক্ষতি বেশি হবে বাজাদের, কেননা বাজাদ অর্জিত নেতিবাচক জনপ্রিয়তাও হারাবে তখন। এখন বাজাদের রাশি যে অবস্থানে, তাতে হাসিনার অধীনে নির্বাচন হলেও বাজাদের যাওয়া উচিত এবং দেখিয়ে দেয়া দরকার যে, জনগণ এবার তাদের চায়। জনগণ এখন সচেতন ও সতর্ক, ভোট-চুরির সুযোগ এখন নেই। নির্বাচন কমিশন তাদের অফিসারকে রিটার্নিং অফিসার করলে, নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিয়োজিত থাকলে এবং আগের নিয়মে ব্যালটে ভোট হলে অর্থাৎ ইভিএম ব্যবহার না হলে আর অসুবিধা কোথায়? ফলে মিডিয়া ক্যু এখন কি আর সম্ভব?
আর নির্বাচন না হলে? একটি সম্ভাবনা থাকে মাত্র তখন, যখন আলী পরিপূর্ণ নিশ্চিত হবে যে তারা হেরে যাবে এবং হারটা তারা মানতে চাইবে না, কেবল তখনই আলী নির্বাচন না চাইলে একটা অরাজক অবস্থা সৃষ্টির প্রয়াস নিতে পারে। তখন হয়তো জরুরি অবস্থা জারি বা ভিন্ন কোনো পন্থায় সরে যাওয়ার চিন্তা করতে পারে। তবে আমার বিশ্বাস, আলী তেমন কোনো অপচিন্তায় গিয়ে বিতর্কিত হতে চাইবে না। কেননা তাতে আপাতত বাজাদকে ঠেকানো গেলেও পরে আলীর নিজেকে পুনরুদ্ধার করা আরও কঠিন হবে। তখন ঐকিক নিয়মের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
যারা আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে চলেছেন, তাদের মধ্যে হয়তো দুটি উদ্দেশ্য বিদ্যমান। এক. তারা নির্বাচন হোক তা-ই চান না। এতে তাদের কোনো লুকানো এজেন্ডা হয়তো বাস্তবায়িত হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে আনন্দ পেতে চান। তারা গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আগ্রহী নন। তারা অবশ্যই অগণতান্ত্রিক সরকারে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আমি নিজেও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় অনেককে সামরিক শাসনে বা অগণতান্ত্রিক এমনকি সাময়িকভাবে স্বীকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বেশ স্বস্তি অনুভব করতে দেখেছি। আমলাদের অনেকে তো ওই ধরনের সরকারের অংশীদার হতেও ভালোবাসেন, আপন-আপনভাবে কাজ করতে বেশ আরাম পান, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনেক অন্যায়-আবদার ও অযৌক্তিক গালাগাল থেকে মুক্তি পান। এটা অবশ্যই এক বড় গবেষণার বিষয়- আমলারা সামরিক শাসন বা অন্য ধরনের অগণতান্ত্রিক সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক ধরনের সরকারে আরাম পান কেন? আমি যতটুকু পর্যবেক্ষণ করেছি তাতে লক্ষ্য করেছি যে, এ ধরনের সরকারগুলোতে আমলাদের কর্তৃত্ব তুলনামূলকভাবে বাড়ে, লেখাপড়া জানা আমলাদের এসব সরকারে কদরও বাড়ে, অসহিষ্ণু প্রকৃতির, মূর্খ প্রকৃতির রাজনৈতিক ‘বেয়াদব’ মন্ত্রী-নেতাদের নির্যাতন-নিপীড়ন এবং অযথা তোষামোদ প্রত্যাশা থেকে আমলারা রক্ষা পান। সুযোগ-সুবিধা ভোগেও আমলারা একটু ভালো শেয়ারিংয়ে যেতে পারেন। মূলত রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বের অভাব, জ্ঞানের তুলনামূলক ঘাটতি, অসহিষ্ণু আচরণ, অতিমাত্রায় স্বজনপ্রীতি, দলকানা মনোভাব এবং ন্যায়ানুগ সিদ্ধান্তের কমতি তাদের প্রতি আমলাদের বিরূপ করে তোলে। অপরদিকে রাজনৈতিক সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি থেকে রক্ষা পেতেও অন্য শ্রেণী-গোষ্ঠী যথা ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, পেশাজীবী এবং আমজনতাও এ ধরনের সরকারকে সাময়িকভাবে পছন্দ করে।
বস্তুত রাজনৈতিক ব্যর্থতাই সামরিক বা অন্য সরকারকে সাময়িকভাবে প্রিয় করে তোলে, যেমনটি আমরা অন্তত তিন-তিনবার দেখেছি- প্রথমবার বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়ার সামরিক আমলে, দ্বিতীয়বার এরশাদের সামরিক আমলে এবং তৃতীয়বার ২০০৭-এ এক-এগারোর পর। এ সরকারগুলোর অর্থাৎ অনির্বাচিত বা অগণতান্ত্রিক এ সরকারগুলোর জনপ্রিয়তা প্রাথমিকভাবে, ছয় মাস থেকে এক বছরে, এমন তুঙ্গে থাকে যে তখন তাদের সমর্থনে গণভোট দিলেও তারা জনসমর্থন পেয়ে যাওয়ার অবস্থায় থাকে। রাজনৈতিক সরকারের অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হওয়ার কারণে জনগণ তখন এসব সরকারের মাঝে ‘মুক্তি’ খোঁজে। কিন্তু এ সরকারগুলোই যখন আবার দুর্নীতিপরায়ণ এবং অযথা কর্তৃত্বপরায়ণ হওয়া শুরু করে, তখন জনগণ আবার সম্বিত ফিরে পায় এবং মুখ ফিরিয়ে নেয়। এ এক কঠিন বাস্তবতা এ দেশে। এত কিছুর পরও সময়ের পরীক্ষায় সেই পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অজনপ্রিয় হলেও বা হয়ে গেলেও নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের কোনো বিকল্প নেই। সামরিক বা সেনাসমর্থিত যে কোনো অনির্বাচিত সরকারই দেশের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। কারণ বেনাভোলেন্ট ডিক্টেটর পাওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি বেনাভোলেন্ট ডিক্টেটররাও পরে আর বেনাভোলেন্ট থাকে না। জনগণও পরিবর্তনে বিশ্বাসী, পরিবর্তনে আশাবাদী এবং পরিবর্তন প্রত্যাশী। এসব বিবেচনায় আমরা আশাবাদী যে আগামী নির্বাচন হচ্ছে।
আগামী নির্বাচন যে হচ্ছে, তার পেছনে আমার যুক্তি পর্যালোচনার দাবি রাখে। কারও কাছে পছন্দ না হওয়া ভিন্ন কথা। নির্বাচন না হওয়ার বা না করার অথবা না হতে দেয়ার অনুঘটক তো এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত বড় দু’দল আলী ও বাজাদ। আলীর দিকটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে নির্বাচন না করলে তার কী লাভ-ক্ষতি আর করলে কী লাভ-ক্ষতি। নির্বাচন করলে আলী গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণের বিশ্বাস ধরে রাখতে সক্ষম হবে। তৃণমূল পর্যায়ের সুসংগঠিত ঐতিহ্যবাহী দল হিসেবে এ দলের প্রতি মানুষের আস্থা অন্তত অটুট থাকবে। জনগণের নিকট-অতীতের দুটি ঘটনা থেকে এমন একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত আছে, আলী সুযোগ বুঝে সামরিক বা অগণতান্ত্রিক শাসনকেও সমর্থন করে অথবা অন্তত এর বিরোধিতা করে না। আর বাজাদ সরকারের বিরুদ্ধে তেমন পরিবর্তন হলে তো কথাই নেই। যেমন এরশাদের সামরিক আইন জারির সময় আলী কোনো প্রতিবাদ করেনি, কারণ ক্ষমতাটা নেয়া হয়েছিল বাজাদ থেকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়ার সম্পৃক্ততা নিয়ে এবং আলীকে সাইজ করার জন্য বাজাদ বিকল্প শক্তি হিসেবে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ায় বাজাদের সঙ্গে আলীর শত্র“তা এবং ভাইস-ভারসা এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে, এ থেকে পরিত্রাণের আশু সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। জয়-তারেকের প্রজন্ম তেমন কিছু ঘটলে অবশ্য ভিন্ন কথা। আবার বাজাদের পুতুল রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে হটিয়ে তিন ‘উদ্দিনে’র সরকার এলেও আলী খুশি হয় এবং ওই সরকারকে তাদের লগি-বৈঠার আন্দোলনের ফসল বলে দাবি করে। এমন আশা করা হয়তো এখনও অমূলক হবে না যে, ভবিষ্যতেও যদি বাজাদ থেকে অন্য কেউ ক্ষমতা অগণতান্ত্রিকভাবে কেড়ে নেয় তাহলেও আলী শত্র“র শত্র“ বন্ধু বিবেচনায় খুশিই হবে। আলী সব সময় অগণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও এ ক্ষেত্রে তাদের চরিত্র ভিন্ন। আলী নিজে নির্বাচন না দিয়ে এমন কোনো দায় হয়তো নিতে চাইবে না, কারণ আলী থেকে অন্য কেউ জোর করে ক্ষমতা নিয়ে নিলে বাজাদও একইভাবে হয়তো খুশি হবে। তবে এবারে আলীর ক্ষমতায় থাকাবস্থায় তেমন অবস্থা তার অনুকূলে না ভাবা পর্যন্ত আলী নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতা হস্তান্তরে আগ্রহী হবে। আলী অবশ্যই চাইবে পঞ্চদশ সংশোধনী অনুসারেই নির্বাচন হোক। বাজাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানা আলীর পক্ষে এখন এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে এত আন্দোলন আর প্রাণহানির পর আদালতের রায়ের অজুহাতে তড়িঘড়ি করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে এখন আবার তাতে ফিরে যাওয়া মানেই জাতীয় নির্বাচনে আলীর নিশ্চিত পরাজয় মেনে নেয়া। তখন আরও অনেকে রাগে-ক্ষোভেও আলীকে ভোট দেবে না। বলবে, এই যদি করবে তাহলে আগে এত নাটক কেন, হরতালে-আন্দোলনে মানুষকে কেন এত কষ্ট দেয়া?
আমি নিজে ফাও তত্ত্বাবধায়ক এখনও সমর্থন করি না। নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচনই আমি সমর্থন করি। আলী হেরে গেলেও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচনের আদর্শ স্থাপন করতে পারে এবং তা আলীর জন্য পরবর্তী নির্বাচনেও ইতিবাচক হবে। অতএব আলী নির্বাচন দেবে। না দিলে আলীকে জনগণ বিশ্বাসঘাতকই শুধু বলবে না, ঘৃণাও করবে। সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল হিসেবে আলী নির্বাচন বন্ধ করবে না।
বাজাদের দিক বিবেচনা করলে এটা পরিষ্কার, বাজাদ এখন জয় প্রত্যাশী। বাজাদের জনপ্রিয়তায় নয়, আলীর প্রতি অসন্তোষে নেতিবাচক ভোটে বাজাদ এখন তৃপ্ত। সিটি নির্বাচন ছাড়িয়ে জাতীয় নির্বাচনে তেমন জয়ের হাওয়া বাজাদ দেখছে। তত্ত্বাবধায়ক না দিলেও অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই বাজাদ নির্বাচনে যাবে। না গেলে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় যে বাজাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়, সেটা বাজাদও বোঝে। মুখে হুংকার ছাড়লেও বাজাদ বোঝে যে, এবার নির্বাচনে অংশ না নিয়ে আলীকে মাঠ ছেড়ে দিলে পরের মেয়াদেও বাজাদ আর আলীকে উৎখাত করতে পারবে না। বরং ক্রমাগতভাবে ১২ বছর অর্থাৎ একযুগ (২+৫+৫) ক্ষমতার বাইরে থেকে দল টিকিয়ে রাখাই হবে কার্যকর। রাজনীতি করলে ক্ষমতায় যেতে হয়, দলীয় কর্মীদেরও কলাটা-মুলাটা দিতে হয়। ক্ষমতায় না থাকলে এ দেয়া সম্ভব নয়। অতএব, বাজাদও নির্বাচনে যাবে। আমি আশাবাদী, নির্বাচন হচ্ছে। আলী আর বাজাদ নির্বাচনে অংশ নিলে সমস্যাই থাকে না।
এখন প্রশ্নটা হল, কীভাবে হচ্ছে? অবশ্যই আলাদীনের চেরাগের মাধ্যমে বাজাদ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরে পেতে পারে না। ওই দাবি মানা মানে আলীর পরাজয় মেনে নেয়া- তা আগেই বলেছি। অতএব শেখ হাসিনার অধীনে না হলে আপসের মাধ্যমে দু’দলের সমঝোতায় একটা নির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই শেষতক শেষরক্ষা হতে হবে। দু’দলই বোঝে যে, তা না হলে আবার রাজনৈতিক পিঠাভাগের জন্য একটা ‘অরাজনৈতিক বানর’ হলেও এসে যেতে পারে, যেমন এক ফখরুদ্দীন এসেছিলেন। এতে ক্ষতি বেশি হবে বাজাদের, কেননা বাজাদ অর্জিত নেতিবাচক জনপ্রিয়তাও হারাবে তখন। এখন বাজাদের রাশি যে অবস্থানে, তাতে হাসিনার অধীনে নির্বাচন হলেও বাজাদের যাওয়া উচিত এবং দেখিয়ে দেয়া দরকার যে, জনগণ এবার তাদের চায়। জনগণ এখন সচেতন ও সতর্ক, ভোট-চুরির সুযোগ এখন নেই। নির্বাচন কমিশন তাদের অফিসারকে রিটার্নিং অফিসার করলে, নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিয়োজিত থাকলে এবং আগের নিয়মে ব্যালটে ভোট হলে অর্থাৎ ইভিএম ব্যবহার না হলে আর অসুবিধা কোথায়? ফলে মিডিয়া ক্যু এখন কি আর সম্ভব?
আর নির্বাচন না হলে? একটি সম্ভাবনা থাকে মাত্র তখন, যখন আলী পরিপূর্ণ নিশ্চিত হবে যে তারা হেরে যাবে এবং হারটা তারা মানতে চাইবে না, কেবল তখনই আলী নির্বাচন না চাইলে একটা অরাজক অবস্থা সৃষ্টির প্রয়াস নিতে পারে। তখন হয়তো জরুরি অবস্থা জারি বা ভিন্ন কোনো পন্থায় সরে যাওয়ার চিন্তা করতে পারে। তবে আমার বিশ্বাস, আলী তেমন কোনো অপচিন্তায় গিয়ে বিতর্কিত হতে চাইবে না। কেননা তাতে আপাতত বাজাদকে ঠেকানো গেলেও পরে আলীর নিজেকে পুনরুদ্ধার করা আরও কঠিন হবে। তখন ঐকিক নিয়মের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
No comments