বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর by ফারুক উদ্দিন আহমেদ
আজকাল
লিখতে খুব কমই উৎসাহবোধ করি। কারণ দেশ ও জনগণের কথা মনে হয় অনেকেরই পছন্দ
নয়। তারা টকশোতে কথা বলা ব্যক্তিদের নিশিকুটুম্ব বলেছেন- পত্রিকায় যারা
লিখেন তাদের সম্বন্ধেও বিরূপ মন্তব্য করেন। দেশের সবচেয়ে বিজ্ঞ আইনজীবী,
সাংবাদিক ও লেখকদের ‘মোটা’, ‘মুই কার খালু’, ‘সুদখোর’, ‘সুবিধাবাদী’
ইত্যাদি নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করেছেন। অথচ এসব যাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে
তারা শুধুই দেশের মঙ্গল চান, জনস্বার্থে কথা বলেন বা বক্তব্য দেন। যারা
ক্ষমতায় আছেন তারা নিজেদের অধীনে নির্বাচন করে আবার অনেকদিনের জন্য ক্ষমতায়
যেতে চান তাই ‘উন্নয়নের ধারাবাহিকতা’, ‘ভিশন ২০-২০’ ইত্যাদি ভালো ভালো কথা
বলেন। অথচ বিগত প্রায় পাঁচ বছরে তারা তাদের বেশির ভাগ নির্বাচনী অঙ্গীকার
বাস্তবায়ন করতে পারেননি। কিন্তু তারা যে চেষ্টা করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ
নেই। তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন খাতে যে বেশকিছু অগ্রগতি হয়েছে- তা
তাদের চরম বিরোধী বিএনপির নেতারাও মুখে না বললেও মনে মনে স্বীকার করবেন।
বিএনপিকে এটাও স্বীকার করতে হবে যে, ‘মাগুরা’ টাইপের ঘাপলা করলে সরকারি দল
বিগত সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে পাঁচটার মধ্যে অন্তত একটিতে জিতত। তবুও
বিরোধী দল তাদের কেয়ারটেকার সরকার বা নিরপেক্ষ-নির্দলীয় সরকারের অধীনে
নির্বাচনের দাবি থেকে হটছে না। আর সরকারও সে দাবি কিছুতেই মানা হবে না বলে
পরিষ্কার বলে দিচ্ছে। অর্থাৎ কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না।
এই বিশ্বাস বা আস্থার অভাবের পরিপ্রেক্ষিতেই কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির ব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছিল এবং মূলত আওয়ামী লীগের অনড় অবস্থানের কারণে। অর্থাৎ যে অনড় দাবিতে আওয়ামী লীগ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা চালু করেছিল সে রকম দাবিই এখন বিএনপি করছে। ইত্যবসরে আদালতের রায়ের ভিত্তিতে সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে। কিন্তু যে রায়ে এই সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছিল সেখানেই বলা হয়েছিল প্রয়োজনে আরও দুটি জাতীয় সংসদের নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থায় হতে পারে। ইত্যবসরে বর্তমান সরকার ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ইত্যাদিতে হাজার হাজার নির্বাচন করে দেখিয়েছে তারা নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারে। কিন্তু সবাই বলছেন এই জিনিস সেই জিনিস না- জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয় আর এগুলোতে তা হয় না। আসলেও উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিতদের কর্তৃত্ব প্রায় কিছুই নেই। তাছাড়া জেলা পরিষদ নির্বাচন না করে সেখানে সবগুলোতেই সরকারের দলীয় লোকদের কর্তা বানিয়ে রাখা হয়েছে। এসব কোনো দোষের হতো না যদি এরা যোগ্য ও জনদরদি ব্যক্তি হতেন। ঠিক তেমনি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বিভিন্ন পদধারীদের যদি যোগ্যতা ও অতীত রেকর্ড দেখে নিযুক্ত করা হতো তাহলে তাদের পক্ষে এত সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি সম্ভব হতো না। আসলে আওয়ামী লীগের প্রতি বর্তমানে মানুষের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছাত্রলীগ-যুবলীগের অব্যাহত সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি, যা বন্ধ করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। আগে বিএনপির আমলে হাওয়া-ভবনকেন্দ্রিক যে দলীয়করণ ও দুর্নীতি, এখনও যদি সেরকম চলে মানুষ তাহলে যাবে কোথায়। মানুষ ওদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে আওয়ামী লীগের আশ্রয় নিয়েছিল। এখন সে আশ্রয়ই যদি অনিরাপদ হয় মানুষের যাওয়ার জায়গা কই? তাই সম্প্রতি সব সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মানুষ বিএনপিকে নয় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে- ভোট দিয়েছে অহংকার, আত্মগরিমা, দুর্নীতি ও দলীয়করণের বিরুদ্ধে।
বর্তমান অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বড় দুটি রাজনৈতিক দল কোনোটিই পরস্পরকে আস্থায় নিতে পারছে না। তারা এখন কেয়ারটেকার ব্যবস্থার পক্ষে-বিপক্ষে অনড় অবস্থান নিয়েছে; অথচ পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস থাকলে শুধু একটি ভালো ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করলেই সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারত। বর্তমান নির্বাচন কমিশনও মোসাহেবি করে সম্প্রতি এমন সব পদক্ষেপ নিয়েছে, যাতে বিরোধী দলগুলোর তাদের প্রতি অনাস্থা আরও বেড়েছে। ইত্যবসরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যা দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী চায় তা নিয়েও অনেক তেলেসমাতি হয়েছে। বিশেষত প্রতিটি ব্যাপারে অহেতুক বিলম্ব। এ বিচার আরও এক বছর আগে শেষ হলে এখন হয়তো এর বাস্তবায়ন হতো। এসব কি অনেকটা ইচ্ছাকৃত নয়? আল্লাহই মালুম। যেসব বিচারের রায় হয়েছে তা সুপ্রিমকোর্ট হয়ে কবে বাস্তবায়িত হবে কে জানে। বিচার যখন বিলম্বিত হয় তখন ‘বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে’ কবিগুরুর একথাটা আজও চিরদিনের মতোই সত্য। এদিকে এসব বিচারের প্রতিবাদে জামায়াত-শিবির এ পর্যন্ত কতটা হরতাল ডেকেছে তারাও হয়তো ঠিকমতো বলতে পারবে না। পবিত্র রমজান মাসেও তারা লাগাতার চার-পাঁচ দিন হরতাল দিল যা এর আগে কেউ কোনোদিন চিন্তাও করেননি। সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন সাধারণ মানুষ যারা ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছেন, কারণ জামায়াত-শিবির পবিত্র ঈদুল ফিতরের পরেই পরপর দু’দিন লাগাতার হরতাল ঘোষণা করেছে। ধর্মপ্রাণ মানুষদের অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার এ এক নতুন এবং অতি ধৃষ্ট কৌশল। যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় তাই সাধারণ মানুষ এসব ভোগান্তি থেকে তাদের কাছেই নিষ্কৃতি কামনা করে। যা হোক বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে অবশ্যই সমঝোতায় আসতে হবে দেশের মানুষকে শান্তি ও স্বস্তি দেয়ার লক্ষ্যে। রাজনীতি মানেই তো মানুষের কল্যাণ বৃদ্ধি- মানুষের নিরাপত্তাহীনতা ও দুর্ভোগ বাড়ানো নয়- এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে। খুন-খারাবি, চাঁদাবাজি ও প্রতিহিংসার রাজনীতি মানুষ চায় না, তাই এখন থামলে ভালো।
ফারুকউদ্দিন আহমেদ : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা
এই বিশ্বাস বা আস্থার অভাবের পরিপ্রেক্ষিতেই কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির ব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছিল এবং মূলত আওয়ামী লীগের অনড় অবস্থানের কারণে। অর্থাৎ যে অনড় দাবিতে আওয়ামী লীগ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা চালু করেছিল সে রকম দাবিই এখন বিএনপি করছে। ইত্যবসরে আদালতের রায়ের ভিত্তিতে সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে। কিন্তু যে রায়ে এই সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছিল সেখানেই বলা হয়েছিল প্রয়োজনে আরও দুটি জাতীয় সংসদের নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থায় হতে পারে। ইত্যবসরে বর্তমান সরকার ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ইত্যাদিতে হাজার হাজার নির্বাচন করে দেখিয়েছে তারা নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারে। কিন্তু সবাই বলছেন এই জিনিস সেই জিনিস না- জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয় আর এগুলোতে তা হয় না। আসলেও উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিতদের কর্তৃত্ব প্রায় কিছুই নেই। তাছাড়া জেলা পরিষদ নির্বাচন না করে সেখানে সবগুলোতেই সরকারের দলীয় লোকদের কর্তা বানিয়ে রাখা হয়েছে। এসব কোনো দোষের হতো না যদি এরা যোগ্য ও জনদরদি ব্যক্তি হতেন। ঠিক তেমনি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বিভিন্ন পদধারীদের যদি যোগ্যতা ও অতীত রেকর্ড দেখে নিযুক্ত করা হতো তাহলে তাদের পক্ষে এত সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি সম্ভব হতো না। আসলে আওয়ামী লীগের প্রতি বর্তমানে মানুষের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছাত্রলীগ-যুবলীগের অব্যাহত সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি, যা বন্ধ করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। আগে বিএনপির আমলে হাওয়া-ভবনকেন্দ্রিক যে দলীয়করণ ও দুর্নীতি, এখনও যদি সেরকম চলে মানুষ তাহলে যাবে কোথায়। মানুষ ওদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে আওয়ামী লীগের আশ্রয় নিয়েছিল। এখন সে আশ্রয়ই যদি অনিরাপদ হয় মানুষের যাওয়ার জায়গা কই? তাই সম্প্রতি সব সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মানুষ বিএনপিকে নয় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে- ভোট দিয়েছে অহংকার, আত্মগরিমা, দুর্নীতি ও দলীয়করণের বিরুদ্ধে।
বর্তমান অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বড় দুটি রাজনৈতিক দল কোনোটিই পরস্পরকে আস্থায় নিতে পারছে না। তারা এখন কেয়ারটেকার ব্যবস্থার পক্ষে-বিপক্ষে অনড় অবস্থান নিয়েছে; অথচ পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস থাকলে শুধু একটি ভালো ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করলেই সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারত। বর্তমান নির্বাচন কমিশনও মোসাহেবি করে সম্প্রতি এমন সব পদক্ষেপ নিয়েছে, যাতে বিরোধী দলগুলোর তাদের প্রতি অনাস্থা আরও বেড়েছে। ইত্যবসরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যা দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী চায় তা নিয়েও অনেক তেলেসমাতি হয়েছে। বিশেষত প্রতিটি ব্যাপারে অহেতুক বিলম্ব। এ বিচার আরও এক বছর আগে শেষ হলে এখন হয়তো এর বাস্তবায়ন হতো। এসব কি অনেকটা ইচ্ছাকৃত নয়? আল্লাহই মালুম। যেসব বিচারের রায় হয়েছে তা সুপ্রিমকোর্ট হয়ে কবে বাস্তবায়িত হবে কে জানে। বিচার যখন বিলম্বিত হয় তখন ‘বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে’ কবিগুরুর একথাটা আজও চিরদিনের মতোই সত্য। এদিকে এসব বিচারের প্রতিবাদে জামায়াত-শিবির এ পর্যন্ত কতটা হরতাল ডেকেছে তারাও হয়তো ঠিকমতো বলতে পারবে না। পবিত্র রমজান মাসেও তারা লাগাতার চার-পাঁচ দিন হরতাল দিল যা এর আগে কেউ কোনোদিন চিন্তাও করেননি। সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন সাধারণ মানুষ যারা ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছেন, কারণ জামায়াত-শিবির পবিত্র ঈদুল ফিতরের পরেই পরপর দু’দিন লাগাতার হরতাল ঘোষণা করেছে। ধর্মপ্রাণ মানুষদের অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার এ এক নতুন এবং অতি ধৃষ্ট কৌশল। যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় তাই সাধারণ মানুষ এসব ভোগান্তি থেকে তাদের কাছেই নিষ্কৃতি কামনা করে। যা হোক বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে অবশ্যই সমঝোতায় আসতে হবে দেশের মানুষকে শান্তি ও স্বস্তি দেয়ার লক্ষ্যে। রাজনীতি মানেই তো মানুষের কল্যাণ বৃদ্ধি- মানুষের নিরাপত্তাহীনতা ও দুর্ভোগ বাড়ানো নয়- এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে। খুন-খারাবি, চাঁদাবাজি ও প্রতিহিংসার রাজনীতি মানুষ চায় না, তাই এখন থামলে ভালো।
ফারুকউদ্দিন আহমেদ : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা
No comments