অনেক মান খুইয়ে পেলাম অপরাধী প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা by তুষার আবদুল্লাহ
উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা এসেছে সন্দেহভাজন এবং গ্রেফতারকৃতকে মিডিয়ার সামনে হাজির করা যাবেনা। নির্দেশনাটি অন্তবর্তীকালীন। পুরোকালীন হলে আরো ভাল।
সন্দেহভাজন এবং গ্রেফতারকৃতদের গণমাধ্যমের সামনে হাজির করার রেওয়াজটি চালু করে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। তারা আধা কেজি হিরোইন, পাচ কৌটা নকল ঘি, বিশ বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার এবং ভাসমান জনা পাঁচেক পতিতা ও দালাল পাকড়াও করে গণমাধ্যমকে ডাক দিতো। যতোটা না উদ্ধার তারচেয়ে অধিক সমাগম হতো গোয়ান্দা কর্তাদের। মূলত নিজেদের বীরত্ব দেখাতেই এই কৌশল।শুরুতে এজন্য পত্রিকাগুলোই ছিল তাদের মূল ভরসা। পরে একের পর এক টেলিভিশন যোগ হতে থাকলে, এই রেওয়াজটি আরো জমে উঠে। এটা প্রায় ১৫ বছরের একটা রুটিন কাজে পরিনত হয়েছিল গোয়েন্দা বিভাগের। পরবর্তীতে যখন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান (র্যাব) বিভিন্ন অভিযানে অংশ নিতে শুরু করে, তখন তারাও এক পর্যায়ে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের যোগ্য অনুসারী হয়ে ওঠে। সন্দেহভাজন এবং গ্রেফতারকৃতদের গণমাধ্যমের সামনে উপস্থিত করাটা এক পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকতায় রূপ নেয়।সাংবাদিক সম্মেলন’ ব্যানার টাঙিয়ে তারা ঘটা করে উদ্ধার ও আটকের বীরত্ব তুলে ধরতে থাকে। গণমাধ্যম গুলোও র্যাব এবং গোয়েন্দা বিভাগের এসব ব্রিফিং-এ ঝাপিয়ে পড়েছে। সেটা ডাকসাইটে কোন সন্দেহভাজন বা চিহ্নিত অপরাধী হোক কিংবা হোক মামুলি বোতল কয়েক ফেন্সিডিল উদ্ধার।
মজার বিষয় হলো একট্রাক ফেন্সিডিল উদ্ধারের সংগে যাকে আটক করা হয়েছে, তাকেও আখ্যা দেয়া হচ্ছে ফেন্সিডিল সম্রাজ্ঞী বলে, আবার যে পঞ্চাশ বোতল ফেন্সিডিলসহ ধরা পড়েছে তাকেও বলা হয় সম্রাজ্ঞী। আর যে কোন নিষিদ্ধ ইসলামী সংগঠনের চুনোপুটি ধরা পড়লেই তাকে বলা হয় আমীর বা সেকেন্ড ইন কমান্ড। মিডিয়াও চোখ বুজে নিরাপত্তা বাহিনীর তুলে দেওয়া লোকমা গুলো হজম করেছে। তবে দুই একটি আলোচিত অপরাধের ঘটনায় র্যাব এবং পুলিশ রকমারী নামের অভিযান চালিয়ে, কিছু সন্দেহ ভাজনকে হাজির করেছিল গণমাধ্যমের সামনে। সাগর- রুনী, খালাফ এবং ডা. নারায়ণ হত্যার পর যাদের গনমাধ্যমের সামনে হাজির করা হয়েছিল, তাদের নিয়ে সাধারনের মনে সংশয় তৈরি হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমও প্রশ্ন তোলে আসলেই তারা ঐ ঘটনা গুলোর সংগে জড়িত কিনা? সংশয়ের সদুত্তর না মিললেও র্যাব এবং পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিট কিন্তু তাতক্ষণিক বাহবা কুড়িয়ে নিয়েছে। কোন কোন কর্মকর্তা পরবর্তী বিভাগীয় বীরত্বের সম্মানও জুটিয়ে নিয়েছেন। সরকারও এসব বাহবার কিছুটা ভাগ পেয়েছে।
মূল প্রতিপাদ্য হলো যে কোন ব্যক্তি, যে কোন অপরাধের সংগে জড়িত থাকার অভিযোগে আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে আটক হতেই পারেন। কিন্তু যতক্ষণ না তিনি আদালতে অপরাধী হিসেবে প্রমানিত হচ্ছেন, ততোক্ষণ পর্যন্ত তার সংগে অপরাধীর মতো আচরন করা যাবেনা। কিন্তু আইন শৃংখলা বাহিনীগুলো এতোদিন তাই করে আসছিল। যে কাউকে যে কোন অজুহাতে আটক করে বুকে লেবেল এটে দাঁড় করিয়ে দিতো মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে। মিডিয়াও নিঃসংশয়ে ঐ ব্যক্তিদের ছবি, কথা প্রচার করে আসছে। কিন্তু আদতে যাকে ভুলভাবে আটক করা হয়েছে, উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে আটক করা হয়েছে, সেই ব্যক্তি সামাজিক ভাবে হেয় হয়ে গেলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগটি যখন প্রমাণিত হলোনা। তিনি টাকা বা অন্য উপায়ে আপোষ করে বেরিয়ে এলেন যখন, তখন কিন্তু মিডিয়া সেই খবরটি ফলাও করে প্রচার করছেনা। আর মিডিয়ার পক্ষ থেকে এধরনের আটকের বিরুদ্ধে সংশয় করে প্রতিবেদন তৈরির নজির খুব একটা নেই। কারণ অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিকতা এখন পুলিশ এবং র্যাবের বিবৃতিনির্ভর হয়ে উঠেছে। অথচ একথাতো সবার জানা প্রতিনিয়ত শত শত মানুষ নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পুলিশ ও র্যাবের হয়রানীর কবলে পড়ছে। তাই বিশেষ করে সন্দেহভাজনদের মিডিয়া্র সামনে হাজির করার বিষয়টি মানবাধিকার লংঘনের সমতুল্য। যদিও গত দেড় দশকে এ ব্যাপারে কোন গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংগঠন সোচ্চার হয়নি।
অবশেষে বিষয়টি আদালতের নজরে এলো। কখন এলো? যখন রাজধানীর ইডেন কলেজের সামনে থেকে একজন জেষ্ঠ্য সহকারি জজকে মাদক বিক্রির অভিযোগে আটক করে নিউমার্কেট থানা পুলিশ। পরে তাকে মহানগর গোয়োন্দা পুলিশ গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে। এতে যেমন আদালত বিব্রত হয়েছেন। তেমনি বিব্রত হয়েছেন আদালতের প্রতি আনুগত্য যাদের সেই সাধারন জনগন। কিন্তু এই সাধারন জনগনদের কাউকে কাউকে যখন বছরের পর বছর র্যাব –পুলিশের দ্বারা মিডিয়ার সামনে হাজিরা দিয়ে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হেয় বা ঘৃনিত হতে হয়েছে বিনা অপরাধে, তাদের জন্য বিব্রত হবেন কারা? কিংবা তাদের জন্য কেন কোন ব্যক্তি বা সংগঠন আদালতের কাছে এমন নিদের্শনা দাবি করেনি? বিব্রত হবার ঐ যন্ত্রণা আদালতের একজন বিচরককে সহ্য করতে হয়েছে বলেই, নির্দেশনাটি এলো অবশেষে, এই বা কম কি! তবে সাধারন মানুষকে উপলক্ষ করে এমন একটি নির্দেশনা আরো আগে এলো, আদালতের প্রতি সাধারন মানুষের শ্রদ্ধা আরো গাঢ় হতো।
No comments