মাহমুদুর রহমানের মন্তব্য প্রতিবেদনঃ চুরি করলে ইজ্জত যায় না!
দিন তিনেক আগে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোর গলায় বলেছেন, বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করলেও তাতে দেশের ভাবমূর্তি নাকি মোটেও ক্ষুণ্ন হয়নি। দেশবাসীর কাছে প্রায় অচেনা দীপু মনির বর্তমান সরকারে পর-রাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ পদ প্রাপ্তিতে দেশের অধিকাংশ মানুষ চমকিত হলেও সুশীল (?) সমাজভুক্তরা অত্যন্ত প্রীত হয়েছিলেন। মন্ত্রী হওয়ার আগে মিজ দীপু মনির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রধানত সুশীল (?) সমাজ ও বাংলাদেশের বিদেশি দূতাবাসসমূহ ঘিরেই যে আবর্তিত হতো, এই তথ্য এ দেশের মিডিয়া জগতের মোটামুটি জানা। এহেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই দুর্নীতি প্রীতিতে সুশীল (?)
গোষ্ঠী এবং তার বিদেশি সমর্থককুল কতখানি প্রীত হচ্ছেন, সেটা জানার অপেক্ষায় রইলাম। মহাজোট সরকারের দুর্নীতি প্রসঙ্গে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে বিনা টেন্ডারে কাজ বণ্টন সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের একটি সংবাদ আমার দেশ পত্রিকায় ছাপিয়ে ক্ষমতাসীনদের ভয়ানক ক্ষুব্ধ করে তুলেছিলাম। তখনও প্রথম বছরের সরকারের সঙ্গে জনগণের মধুচন্দ্রিমার উষ্ণতা একেবারে উবে যায়নি। ফল যা হওয়ার, তাই হয়েছিল। শীর্ষ থেকে নির্দেশ এলো, ব্যাটার বড় বাড় বেড়েছে, জন্মের মতো শায়েস্তা করতে হবে। আমি রিমান্ড ও জেলে গেলাম, আমার দেশ বন্ধ হলো, আইনি লড়াই এবং দেশ-বিদেশে সমালোচনা ও আন্দোলনের মুখে পত্রিকা আবার চালু হলো, আমিও এক সময় মুক্তি পেলাম, এসব কাহিনী পাঠক জানেন। শায়েস্তা করার অর্থ যদি কাউকে রিমান্ডে নিয়ে কিঞ্চিত্ পুলিশি থেরাপি প্রয়োগ এবং বছরখানেক জেলের ঘানি টানানো হয়ে থাকে, তাহলে সরকার তার মিশনে সফল হয়েছে। তবে নীতিনির্ধারকদের টার্গেট আমার কলম অথবা মুখ বন্ধ করা হয়ে থাকলে জনগণ দেখতেই পাচ্ছেন যে, তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। যে আদর্শ ধারণ করার অপরাধে আমি গ্রেফতার হয়েছিলাম, জেল জীবনের নিগ্রহ ও আমার মুক্তির জন্য দেশপ্রেমিক নাগরিকদের দীর্ঘ, স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন সেই আদর্শকে অধিকতর শাণিত করেছে। সন্তোষের বিষয় হলো, রাষ্ট্র পরিচালনায় দুর্নীতি উন্মোচনে ২০০৯ সালে আমার দেশ একাকী থাকলেও এখন কিন্তু অনেক পত্রিকাতেই দুর্নীতির সংবাদ ছাপা হচ্ছে। বর্তমান সরকারের তিন বছরের মাথায় ক্ষমতাসীন মহলের দুর্নীতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের ক্রমেই সোচ্চার হয়ে ওঠা এবং দীপু মনির দুর্নীতিবিষয়ক নতুন থিওরির প্রেক্ষিতেই এই ক্ষুদ্র ভূমিকাটি লিখতে হলো।
আমাদের সদা হাস্যময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তার সাম্প্রতিক ওয়াশিংটন সফরে যে কতটা বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেটি সরকারে পাঁচ বছর কাটানোর অভিজ্ঞতায় বেশ আন্দাজ করতে পারছি। বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা যখন তার মুখের ওপর দুর্নীতির দলিলপত্র তুলে ধরেছিলেন, ধারণা করছি তখন জনাব মুহিতের পক্ষেও তার সুবিখ্যাত হাসি ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। বিপর্যয় এবং অপমানের মুখে হাসতে পারা এক বিরাট গুণ। ঘটনাচক্রে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মুহিত এবং যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন, উভয়েই এই বিশেষ গুণটি চমত্কার রপ্ত করেছেন। যাই হোক, অর্থমন্ত্রীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রওয়ানা হওয়ার ঠিক প্রাক্কালে রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েও জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বিরাট মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছিল উন্নয়ন সহযোগীদের মন পাওয়ার মরিয়া চেষ্টায়।
আমি সাকুল্যে ষোল মাস জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলাম। সাইফুর রহমানের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের মানুষ তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সেই সময়ও অর্থমন্ত্রীর বিদেশে যাওয়ার সময় হলেই আমি দুরু দুরু বক্ষে অপেক্ষা করতাম। এই বুঝি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে তেলের দাম বাড়ানোর চাপ আসে। বাধ্য হয়ে দাম বাড়ালে ভোক্তাদের গালাগাল আমাকেই সহ্য করতে হবে। আমার সেই বিপদের সময় একাধিকবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মধ্যস্থতা করতে হয়েছে। তবে বিদেশিদের কাছ থেকে কোনো রকম দুর্নীতির অভিযোগ সরাসরি শোনার অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি। অবশ্য আমার একটা সুবিধাও ছিল। আমি কেবল জ্বালানি মন্ত্রণালয়েরই দায়িত্বে ছিলাম। কাজেই বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয় নিয়ে দুর্নীতিবিষয়ক যেসব গল্প-গাঁথা সেই সময় বাজারে চাউর ছিল, তার দায়দায়িত্ব সঙ্গত কারণেই আমাকে নিতে হয়নি।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে আমার সহকর্মীদেরও প্রশাসনে সততার যথেষ্ট সুনাম ছিল। মন্ত্রণালয়ে লোক বাছাইয়ের ব্যাপারে আমি অবশ্য ভীষণ রকম খুঁতখুঁতে ছিলাম। দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের হয় জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে ঠাঁই দেইনি, নয়তো তাদের অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখেছিলাম, যাতে দুর্নীতির সুযোগ না পায়। বর্তমান সরকারের কাছে সততার যে কোনো মূল্য নেই এবং তারা যে কেবল দলীয়করণেই বিশ্বাসী তার প্রমাণস্বরূপ আমার জ্বালানি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকালীন তিন সিনিয়র কর্মকর্তার এই আমলে পরিণতি দেখলেই চলবে। আমি তিনজন অতিশয় সত্ কর্মকর্তার নাম এখানে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করব। তখন জ্বালানি সচিব ছিলেন মো. নাসির উদ্দিন। অত্যন্ত সত্ ও ধার্মিক এই সচিবের মধ্যে মুখ্য সচিব অথবা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব হওয়ার মতো সততা ও যোগ্যতা থাকলেও তাকে শেষ পর্যন্ত ওএসডি অবস্থায় এলপিআরে (LPR) যেতে হয়েছে। তার অপরাধ বোধহয় তিনি একেবারেই অরাজনৈতিক মানুষ। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো শেখ পরিবারের গুণকীর্তনে অন্যান্য সচিবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেননি। সেই সময় জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিবদের অন্যতম ছিলেন ড. শেখ আব্দুর রশীদ। আমার পাঁচ বছরের সরকারি চাকরি জীবনে আব্দুর রশীদের চেয়ে মেধাবী, দক্ষ, সত্ এবং সম্পূর্ণভাবে অরাজনৈতিক অফিসারের দেখা আমি অন্তত পাইনি। যতদূর জানি তার ব্যাচে (বিসিএস ১৯৮১) তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। জরুরি সরকারের সময় আবদুর রশীদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এমন একজন দক্ষ অফিসারকে এই দুর্নীতিপরায়ণ সরকার তার প্রাপ্য পদোন্নতি না দিয়ে প্রায় তিন বছর ওএসডি করে রেখে এখন নাকি চাকরিচ্যুত করার অপকর্মেও লিপ্ত হয়েছে।
তৃতীয় যে সত্ কর্মকর্তাটিকে আমি বিশেষ পছন্দ করতাম, তার নাম মো. মোশাররফ হোসেন ভূইয়া। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হলে আমিই তাকে ওই পদে রীতিমত তদবির করে নিয়ে এনেছিলাম। সেই সময় আমাকে কানে কানে বলা হয়েছিল মোশাররফ হোসেন ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী শামস কিবরিয়ার একান্ত সচিব ছিলেন। এ কথার মর্মার্থ, সেই ‘অপরাধে’ বিএনপি আমলে তাকে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া যায় না। বলাই বাহুল্য, শুভানুধ্যায়ীদের এই পরামর্শ আমার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। সেই মো. মোশাররফ হোসেন সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায় আমি যুগপত্ বিস্মিত ও আনন্দিত হয়েছি। মোশাররফ হোসেন ভূইয়ার গায়ে আওয়ামী লীগের খানিক গন্ধ থাকাতেই বোধহয় তার ভাগ্য খুলেছে। তবে আমার প্রশংসার পর বেচারা বিপদে পড়লে আমি আশ্চর্য হব না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ভরসা দিয়ে জানিয়ে রাখছি, মোশাররফ হোসেন ভূইয়াকে আগেও চিনতাম না এবং সরকারি দায়িত্ব ত্যাগের পর তার সঙ্গে আমার আর কখনও সাক্ষাতও হয়নি। সাবেক জ্বালানি সচিব মো. নাসিরউদ্দিন এবং শেখ আবদুর রশিদের প্রতি সরকারের অন্যায় জিঘাংসা আমাকে ভয়ানক পীড়া দেয়। এদের সততা ও যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন না করা আমাদের সিস্টেমেরই ব্যর্থতা।
এসব কর্মকর্তার সমন্বয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে যথাসম্ভব দুর্নীতিমুক্ত একটি প্রশাসন আমরা ষোল মাসের জন্য অন্তত গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলাম। বর্তমান সরকারের আমলে সেই একই জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির দুর্গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। দীপু মনির ভাষ্য অনুযায়ী তাতে অবশ্য সরকারের কিংবা দেশের ইজ্জতের কোনো রকম হানি হচ্ছে না। কতটা অপকর্ম করলে ইজ্জত যাবে, তা তিনিই ভালো জানেন। মানির মান তো আবার সহজে যায় না!
যোগাযোগ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির গল্পের চর্চা আন্তর্জাতিক অঙ্গন পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ায় সে বিষয়ে আমার লেখার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
আমি আজ প্রধানত বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয় নিয়েই লিখতে চাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুযোগ পেলেই যথেষ্ট গর্ব সহকারে দাবি করে থাকেন যে, গত তিন বছরে তার সরকার নাকি প্রায় ২২০০ মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুত্ উত্পাদনে সক্ষম হয়েছে। প্রথমত, তার এই বক্তব্য অর্ধসত্য। কারণ, ২২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ নতুন রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলো থেকে উত্পন্ন হলেও সরকারি খাতের পুরনো কেন্দ্র থেকে কত উত্পাদন কমে গেছে, তার কোনো পরিসংখ্যান তিনি কিন্তু দেশবাসীকে দিচ্ছেন না। আমার হিসেবে সেই কমার পরিমাণ ১০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাত্ বিদ্যুতের জন্য আমরা ক্রমেই বিপজ্জনকভাবে বেসরকারি খাত নির্ভর হয়ে পড়ছি। দ্বিতীয়ত, অতিরিক্ত বিদ্যুত্ উত্পাদনের অছিলায় সরকারে এখন দুর্নীতির মহোত্সব চলছে। পাঠক জ্ঞাত আছেন যে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বত্সরাধিককাল বিদ্যুতের সমস্যা সমাধানে তারা কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি।
বিদ্যুত্ সঙ্কটে জনগণের যখন নাভিশ্বাস উঠে গেছে, সেই সুযোগে বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয় কোনো রকম দরপত্র আহ্বান না করেই বেসরকারি খাতের দলীয় লোকজনের সঙ্গে কুইক রেন্টালের নামে একের পর এক বিদ্যুত্ ক্রয় চুক্তি সম্পাদন শুরু করে। সীমাহীন বিদ্যুত্ সঙ্কটকে পুঁজি করে তারা ৬ টাকার বিদ্যুত্ ১৪ টাকা প্রতি ইউনিট দরে কুইক রেন্টাল সরবরাহকারীদের কাছ থেকে কেনার চুক্তি করে। উপরন্তু, চুক্তিপত্রে বিদ্যুতের মূল্য প্রতি ইউনিট ১৪ টাকা উল্লেখ থাকলেও জ্বালানির ভর্তুকি যোগ করলে এই বিদ্যুতের মূল্য ১৮ টাকার নিচে হবে না। অর্থাত্ প্রতি ইউনিটে গড়ে প্রায় ১২ টাকা সরকারি কোষাগার থেকে লুটে নেয়া হচ্ছে। ফলে জাতীয় অর্থনীতি আজ ভয়াবহ সঙ্কটে পতিত হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বিদ্যুতের অতিরিক্ত মূল্য প্রদান বাবদ জাতীয় বাজেট থেকে দশ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। বর্তমান সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই এই অংক প্রতি বছর অন্তত বিশ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এই বিপুল পরিমাণ টাকা ভাগাভাগি হবে বিদেশের বিভিন্ন শহরে। ফলে এই দেশ থেকে মুদ্রা পাচারের পরিমাণও যে আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করবে, তা আগাম বলে দেয়া যায়। মুদ্রা বাজারে ডলারের চাহিদা ও মূল্যবৃদ্ধি থেকেও লুটপাটের মাত্রা জনগণ হয়তো খানিকটা টের পাচ্ছেন। নীতিনির্ধারকরা ভালোভাবেই অবগত আছেন যে, কুইক রেন্টালের নামে তারা প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতির বাজার খুলে বসেছেন। এই বিশেষ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে মন্ত্রী, এমপি এবং তাদের পরিবার ও কাছের লোকজন। ভবিষ্যতে যাতে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে এই গোষ্ঠীকে কারাগারে যেতে না হয়, সেই লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে যে কুইক রেন্টাল নিয়ে আদালতে কোনো মামলা করা যাবে না। যুগে যুগে দুর্নীতিবাজরা এভাবেই পিঠ বাঁচাতে চেয়েছে। কিন্তু, দুর্নীতি করলে শেষ পর্যন্ত যে পার পাওয়া যায় না, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।
শেখ হাসিনা এবং জেনারেল মইন ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়কালে তাদের দাবি অনুযায়ী বিদ্যুত্ খাত থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের জন্য বিএনপি সরকারকে বহুবার অভিযুক্ত করেছেন। আমার একাধিক লেখায় উল্লেখ করেছি যে, ওই পাঁচ বছরে বিদ্যুত্ খাতে মোট বাজেটই ছিল সাড়ে তের হাজার কোটি টাকা। ১৩ হাজার ৫শ’ কোটি টাকার বাজেট থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা লুট করা যে সম্ভব নয়, এই সামান্য বিষয়টি ক্লাস ওয়ানে পাঠরত একজন শিশু বুঝলেও আওয়ামী মিডিয়ায় এসব প্রচারণা থেমে থাকেনি। চারদলীয় জোট সরকারের বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বাধ্য হয়ে জেনারেল মইনের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন, যেটি এখনও বিচারাধীন রয়েছে। শেখ হাসিনা বিএনপি’র পাঁচ বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ করলেও এ দেশের ষোল কোটি নাগরিকের দুর্ভাগ্য, এখন তারই আমলে সেই বিদ্যুত্ খাত থেকেই প্রতি বছর ২০ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দেশের সম্পদ লুটে নেয়ার বিনিময়ে বিদ্যুত্ সমস্যা সমাধানের সরকারি বাগাড়ম্বরে জনগণ আদৌ কোনো রকম আস্থা স্থাপন করছেন কিনা, সেই প্রশ্নের জবাব আওয়ামী লীগ আগামী জাতীয় নির্বাচনেই পেয়ে যাবে। অবশ্য, সেই নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়েও তো আবার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতদিন দাবি করতেন যে, তার মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে নাকি এখন পর্যন্ত দুর্নীতির কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক ও এডিবি পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দাবিকে অসাড় প্রমাণিত করেছে। সারা দুনিয়া এখন জেনে গেছে, বাংলাদেশের প্রশাসন এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত যে, এই দেশে উন্নয়ন খাতেও আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী সংস্থাসমূহ আর বিনিয়োগে আগ্রহী নয়। এই সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রী ও তার পারিষদবর্গ আদৌ বিব্রত হয়েছেন কিনা জানি না, তবে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের নাক কাটা গেছে। তিনি অবশ্য এখনও বলে চলেছেন অভিযোগ যথেষ্ট নয়, জনগণকেই দুর্নীতির প্রমাণ দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর দাবি প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, যোগাযোগমন্ত্রী এবং বাণিজ্যমন্ত্রীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে সরকারের সঙ্গে একচেটিয়া ব্যবসা নিয়ে এ বছরের ১৫ মে তারিখে আমার দেশ পত্রিকায় তথ্যপ্রমাণসহকারে লিড নিউজ ছাপা হয়েছিল, ‘বিদ্যুত্ এক মন্ত্রীর রাস্তা সেতু অন্যজনের’।
শেয়ারবাজার থেকে মন্ত্রী, এমপি এবং সরকারি দলের চাঁইদের লুটপাটের কাহিনীও আমাদের পত্রিকায় বহুবার তুলে ধরেছি। কিন্তু, কেউ জেগে ঘুমালে তাকে ঘুম থেকে ওঠানোর সাধ্য কার? টিআইবি’র জরিপে এক সময় বিশ্বে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের কুখ্যাতি ছিল। পর পর চারবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ২০০৪ সাল থেকে অবস্থার যত্সামান্য উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতির সর্বব্যাপী বিস্তার ও মন্ত্রীদের ঔদ্ধত্যে আশঙ্কা হচ্ছে, আবারও না আমাদের দুর্নীতির শীর্ষ স্থানে ফিরে যেতে হয়। শেয়ারবাজার থেকে লক্ষ কোটি টাকা লুণ্ঠিত হয়েছে। অতিরিক্ত মূল্যে বিদ্যুত্ কেনার বোঝা সাধারণ ভোক্তার কাঁধে চাপানো হয়েছে। একদিকে তাদের করের টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে, এখন আবার গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বাড়িয়ে দ্বিতীয়বার জনগণের পকেট কাটার ব্যবস্থা হচ্ছে। বাংলাদেশে সব আমলেই দুর্নীতি করে শাসকশ্রেণী স্ফীত হচ্ছে, আর দেশের অসহায় জনগণ সেই বোঝার ভার বহন করছে।
২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ যেসব আকাশ-কুসুম প্রতিশ্রুতির পসরা নিয়ে ভোটারের সামনে হাজির হয়েছিল, তার মধ্যে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুদককে প্রকৃত স্বাধীনতা দিয়ে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতিও স্থান পেয়েছিল। সরকারের প্রায় তিন বছর অন্তে দেখা যাচ্ছে, এমন একটি মন্ত্রণালয়ও আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে দুর্নীতি ও লুটপাট হচ্ছে না। এখন আর শুধু আমার দেশ পত্রিকা নয়, আওয়ামী ও ভারতপন্থী হিসেবে চিহ্নিত পত্রিকা সমূহেও প্রায় প্রতিদিন মন্ত্রী, এমপিদের দুর্নীতির অভিযোগ সংবলিত সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। সরকার প্রধানের সদিচ্ছা থাকলে তিনি এসব সংবাদ দ্বারা উপকৃত হতে পারতেন। কিন্তু, শেখ হাসিনা উল্টো সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিচ্ছেন। তথ্যপ্রমাণসহ দুর্নীতির সুস্পষ্ট অভিযোগ করার পর বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে এই সরকার কবে মামলা দায়ের করবে, সেটি দেখার অপেক্ষাতেই এখন আছি। লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দি ইকনোমিস্ট’য়ের বিরুদ্ধেও কিছুদিন আগে সরকারি মহল থেকে মামলা করার হুঙ্কার শুনতে পেয়েছিলাম। দুর্নীতি প্রতিরোধের পরিবর্তে মহাজোট সরকারের মিডিয়া বিদ্বেষের কাহিনী এখন দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন গত সপ্তাহেই দীপু মনিকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়ার তাগিদ দিয়েছেন।
আর দুদকের কথা যত কম বলা যায়, ততই ভালো। বিএনপি আমলে দুদকের নিষ্ক্রিয়তায় বিরক্ত হয়ে তত্কালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিকে একটি ‘রসিকতা’ (Joke) বলে উল্লেখ করেছিলাম। আমার সেই মন্তব্যটি সম্প্রতি উইকিলিক্স-এ ফাঁসও হয়েছে। বর্তমানে দুদকের কর্তা ব্যক্তিদের লাজলজ্জাহীনভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের লেজুড়বৃত্তি করতে দেখে তাদের মনুষ্যপদবাচ্য বিবেচনা করতেও আমার ঘৃণাবোধ হয়। দেশব্যাপী দুর্নীতির মহোত্সব চলছে, অথচ দুদক ব্যস্ত সরকারের হুকুম অনুযায়ী ভিন্ন মতাবলম্বীদের মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় ফাঁসানোর আয়োজনে। সরকারি কেনা-বেচায় বৃহত্ মাপের দুর্নীতি তো অকাতরে চলছেই।
পথে-ঘাটে চাঁদাবাজি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তার একটি উদাহরণ দেই। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূত ক’দিন আগে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খানের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে চট্টগ্রাম বন্দরে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের চাঁদাবাজি বন্ধে তার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। একটি মালয়েশীয় কোম্পানি চট্টগ্রাম বন্দরের নাব্য রক্ষায় ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজে নিয়োজিত ছিল। সরকারি চাঁদাবাজদের দাপটে তাদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে বাধ্য হয়ে রাষ্ট্রদূত জামালউদ্দিন বিন সাবে নৌমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। একজন সরকারি এমপি কর্তৃক মালয়েশিয়াতেই আদম পাচারের কাহিনী আমার দেশ পত্রিকায় প্রমাণ সহকারে ছাপা হওয়ার পরও অভিযুক্ত এমপি’র বিরুদ্ধে সরকার কিংবা দুদক কোনো ব্যবস্থা আমার জানা মতে নেয়নি। মালয়েশিয়ার বিনিয়োগে স্থাপিত বাংলাদেশে একটি প্রতিষ্ঠানের সরকারের কাছের লোকজনের দখল করে নেয়ার গুজবও বেশ কিছুদিন ধরে বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাবি করে থাকেন যে, তার আমলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নাকি বৃদ্ধি পেয়েছে। দীপু মনি বলছেন, চুরি করলেও সম্মান ক্ষুণ্ন হয় না। বিশ্বে মাথা হেট করা দুর্নীতির বেশুমার গল্প পত্র-পল্লবে বিকশিত হওয়া সত্ত্বেও তারা যদি এ জাতীয় আত্মশ্লাঘায় ভোগেন, তাহলে জনগণের কপালে করাঘাত ছাড়া আর কী করার আছে?
এই শতকের গোড়ার দিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বলা হচ্ছিল, বাংলাদেশের ঋণনির্ভরতা থেকে ক্রমেই বাণিজ্য নির্ভরতায় উত্তরণ ঘটছে। গোল্ডম্যান স্যাকস বাংলাদেশকে বিশ্বে এগারটি দ্রুত অর্থনৈতিকভাবে বিকাশমান রাষ্ট্রের একটি বিবেচনা করেছিল। সেসব আশাবাদ এখন কর্পূরের মতো উবে গেছে। সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি আমাদের ললাট লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি দায়িত্ব পালনের পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে দাবি করতে পারি, কোনো মন্ত্রী নিজে যদি দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকেন এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্ঠায় তিনি সরকার প্রধানের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেলে মন্ত্রণালয় থেকে দুর্নীতি দূর করা অবশ্যই সম্ভব। তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ, সহিংসতা এবং দুর্নীতিকে উপলক্ষ্য করেই এক এগারোর কুশীলবরা ২০০৬ সালে বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদী পড়শি ভারতের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করার নীলনকশা প্রণয়ন করতে পেরেছে, যেটি বর্তমান সরকার ভারতের সহায়তায় ক্ষমতায় আসার প্রতিদানে ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়ন করছে। এক এগারোর এত বড় সর্বনাশের মধ্যেও আশা করেছিলাম, রাজনীতিবিদরা অন্তত দুর্নীতির বিষয়ে কিছুটা শিক্ষা গ্রহণ করবেন। কিন্তু বর্তমান সরকারের তিন বছরে প্রমাণিত হয়েছে, তারা কোনো রকম শিক্ষা গ্রহণ না করে বরঞ্চ, দুর্নীতির মাত্রাই বৃদ্ধি করেছেন। কোটি টাকা দুর্নীতির পরিবর্তে কোটি ডলারের দুর্নীতি জনগণকে সহ্য করতে হচ্ছে। বর্তমান সরকার আমাদের চরমভাবে আশাহত করেছে। এবার আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বিরোধীদল বাংলাদেশে একটি সত্ ও দক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করবে কিনা, সেটা দেখার জন্য জনগণকে তাদের ক্ষমতায় আসা অবধি অপেক্ষা করতে হবে।
আমাদের সদা হাস্যময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তার সাম্প্রতিক ওয়াশিংটন সফরে যে কতটা বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেটি সরকারে পাঁচ বছর কাটানোর অভিজ্ঞতায় বেশ আন্দাজ করতে পারছি। বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা যখন তার মুখের ওপর দুর্নীতির দলিলপত্র তুলে ধরেছিলেন, ধারণা করছি তখন জনাব মুহিতের পক্ষেও তার সুবিখ্যাত হাসি ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। বিপর্যয় এবং অপমানের মুখে হাসতে পারা এক বিরাট গুণ। ঘটনাচক্রে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মুহিত এবং যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন, উভয়েই এই বিশেষ গুণটি চমত্কার রপ্ত করেছেন। যাই হোক, অর্থমন্ত্রীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রওয়ানা হওয়ার ঠিক প্রাক্কালে রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েও জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বিরাট মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছিল উন্নয়ন সহযোগীদের মন পাওয়ার মরিয়া চেষ্টায়।
আমি সাকুল্যে ষোল মাস জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলাম। সাইফুর রহমানের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের মানুষ তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সেই সময়ও অর্থমন্ত্রীর বিদেশে যাওয়ার সময় হলেই আমি দুরু দুরু বক্ষে অপেক্ষা করতাম। এই বুঝি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে তেলের দাম বাড়ানোর চাপ আসে। বাধ্য হয়ে দাম বাড়ালে ভোক্তাদের গালাগাল আমাকেই সহ্য করতে হবে। আমার সেই বিপদের সময় একাধিকবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মধ্যস্থতা করতে হয়েছে। তবে বিদেশিদের কাছ থেকে কোনো রকম দুর্নীতির অভিযোগ সরাসরি শোনার অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি। অবশ্য আমার একটা সুবিধাও ছিল। আমি কেবল জ্বালানি মন্ত্রণালয়েরই দায়িত্বে ছিলাম। কাজেই বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয় নিয়ে দুর্নীতিবিষয়ক যেসব গল্প-গাঁথা সেই সময় বাজারে চাউর ছিল, তার দায়দায়িত্ব সঙ্গত কারণেই আমাকে নিতে হয়নি।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে আমার সহকর্মীদেরও প্রশাসনে সততার যথেষ্ট সুনাম ছিল। মন্ত্রণালয়ে লোক বাছাইয়ের ব্যাপারে আমি অবশ্য ভীষণ রকম খুঁতখুঁতে ছিলাম। দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের হয় জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে ঠাঁই দেইনি, নয়তো তাদের অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখেছিলাম, যাতে দুর্নীতির সুযোগ না পায়। বর্তমান সরকারের কাছে সততার যে কোনো মূল্য নেই এবং তারা যে কেবল দলীয়করণেই বিশ্বাসী তার প্রমাণস্বরূপ আমার জ্বালানি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকালীন তিন সিনিয়র কর্মকর্তার এই আমলে পরিণতি দেখলেই চলবে। আমি তিনজন অতিশয় সত্ কর্মকর্তার নাম এখানে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করব। তখন জ্বালানি সচিব ছিলেন মো. নাসির উদ্দিন। অত্যন্ত সত্ ও ধার্মিক এই সচিবের মধ্যে মুখ্য সচিব অথবা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব হওয়ার মতো সততা ও যোগ্যতা থাকলেও তাকে শেষ পর্যন্ত ওএসডি অবস্থায় এলপিআরে (LPR) যেতে হয়েছে। তার অপরাধ বোধহয় তিনি একেবারেই অরাজনৈতিক মানুষ। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো শেখ পরিবারের গুণকীর্তনে অন্যান্য সচিবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেননি। সেই সময় জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিবদের অন্যতম ছিলেন ড. শেখ আব্দুর রশীদ। আমার পাঁচ বছরের সরকারি চাকরি জীবনে আব্দুর রশীদের চেয়ে মেধাবী, দক্ষ, সত্ এবং সম্পূর্ণভাবে অরাজনৈতিক অফিসারের দেখা আমি অন্তত পাইনি। যতদূর জানি তার ব্যাচে (বিসিএস ১৯৮১) তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। জরুরি সরকারের সময় আবদুর রশীদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এমন একজন দক্ষ অফিসারকে এই দুর্নীতিপরায়ণ সরকার তার প্রাপ্য পদোন্নতি না দিয়ে প্রায় তিন বছর ওএসডি করে রেখে এখন নাকি চাকরিচ্যুত করার অপকর্মেও লিপ্ত হয়েছে।
তৃতীয় যে সত্ কর্মকর্তাটিকে আমি বিশেষ পছন্দ করতাম, তার নাম মো. মোশাররফ হোসেন ভূইয়া। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হলে আমিই তাকে ওই পদে রীতিমত তদবির করে নিয়ে এনেছিলাম। সেই সময় আমাকে কানে কানে বলা হয়েছিল মোশাররফ হোসেন ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী শামস কিবরিয়ার একান্ত সচিব ছিলেন। এ কথার মর্মার্থ, সেই ‘অপরাধে’ বিএনপি আমলে তাকে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া যায় না। বলাই বাহুল্য, শুভানুধ্যায়ীদের এই পরামর্শ আমার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। সেই মো. মোশাররফ হোসেন সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায় আমি যুগপত্ বিস্মিত ও আনন্দিত হয়েছি। মোশাররফ হোসেন ভূইয়ার গায়ে আওয়ামী লীগের খানিক গন্ধ থাকাতেই বোধহয় তার ভাগ্য খুলেছে। তবে আমার প্রশংসার পর বেচারা বিপদে পড়লে আমি আশ্চর্য হব না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ভরসা দিয়ে জানিয়ে রাখছি, মোশাররফ হোসেন ভূইয়াকে আগেও চিনতাম না এবং সরকারি দায়িত্ব ত্যাগের পর তার সঙ্গে আমার আর কখনও সাক্ষাতও হয়নি। সাবেক জ্বালানি সচিব মো. নাসিরউদ্দিন এবং শেখ আবদুর রশিদের প্রতি সরকারের অন্যায় জিঘাংসা আমাকে ভয়ানক পীড়া দেয়। এদের সততা ও যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন না করা আমাদের সিস্টেমেরই ব্যর্থতা।
এসব কর্মকর্তার সমন্বয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে যথাসম্ভব দুর্নীতিমুক্ত একটি প্রশাসন আমরা ষোল মাসের জন্য অন্তত গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলাম। বর্তমান সরকারের আমলে সেই একই জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির দুর্গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। দীপু মনির ভাষ্য অনুযায়ী তাতে অবশ্য সরকারের কিংবা দেশের ইজ্জতের কোনো রকম হানি হচ্ছে না। কতটা অপকর্ম করলে ইজ্জত যাবে, তা তিনিই ভালো জানেন। মানির মান তো আবার সহজে যায় না!
যোগাযোগ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির গল্পের চর্চা আন্তর্জাতিক অঙ্গন পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ায় সে বিষয়ে আমার লেখার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
আমি আজ প্রধানত বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয় নিয়েই লিখতে চাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুযোগ পেলেই যথেষ্ট গর্ব সহকারে দাবি করে থাকেন যে, গত তিন বছরে তার সরকার নাকি প্রায় ২২০০ মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুত্ উত্পাদনে সক্ষম হয়েছে। প্রথমত, তার এই বক্তব্য অর্ধসত্য। কারণ, ২২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ নতুন রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলো থেকে উত্পন্ন হলেও সরকারি খাতের পুরনো কেন্দ্র থেকে কত উত্পাদন কমে গেছে, তার কোনো পরিসংখ্যান তিনি কিন্তু দেশবাসীকে দিচ্ছেন না। আমার হিসেবে সেই কমার পরিমাণ ১০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাত্ বিদ্যুতের জন্য আমরা ক্রমেই বিপজ্জনকভাবে বেসরকারি খাত নির্ভর হয়ে পড়ছি। দ্বিতীয়ত, অতিরিক্ত বিদ্যুত্ উত্পাদনের অছিলায় সরকারে এখন দুর্নীতির মহোত্সব চলছে। পাঠক জ্ঞাত আছেন যে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বত্সরাধিককাল বিদ্যুতের সমস্যা সমাধানে তারা কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি।
বিদ্যুত্ সঙ্কটে জনগণের যখন নাভিশ্বাস উঠে গেছে, সেই সুযোগে বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয় কোনো রকম দরপত্র আহ্বান না করেই বেসরকারি খাতের দলীয় লোকজনের সঙ্গে কুইক রেন্টালের নামে একের পর এক বিদ্যুত্ ক্রয় চুক্তি সম্পাদন শুরু করে। সীমাহীন বিদ্যুত্ সঙ্কটকে পুঁজি করে তারা ৬ টাকার বিদ্যুত্ ১৪ টাকা প্রতি ইউনিট দরে কুইক রেন্টাল সরবরাহকারীদের কাছ থেকে কেনার চুক্তি করে। উপরন্তু, চুক্তিপত্রে বিদ্যুতের মূল্য প্রতি ইউনিট ১৪ টাকা উল্লেখ থাকলেও জ্বালানির ভর্তুকি যোগ করলে এই বিদ্যুতের মূল্য ১৮ টাকার নিচে হবে না। অর্থাত্ প্রতি ইউনিটে গড়ে প্রায় ১২ টাকা সরকারি কোষাগার থেকে লুটে নেয়া হচ্ছে। ফলে জাতীয় অর্থনীতি আজ ভয়াবহ সঙ্কটে পতিত হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বিদ্যুতের অতিরিক্ত মূল্য প্রদান বাবদ জাতীয় বাজেট থেকে দশ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। বর্তমান সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই এই অংক প্রতি বছর অন্তত বিশ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এই বিপুল পরিমাণ টাকা ভাগাভাগি হবে বিদেশের বিভিন্ন শহরে। ফলে এই দেশ থেকে মুদ্রা পাচারের পরিমাণও যে আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করবে, তা আগাম বলে দেয়া যায়। মুদ্রা বাজারে ডলারের চাহিদা ও মূল্যবৃদ্ধি থেকেও লুটপাটের মাত্রা জনগণ হয়তো খানিকটা টের পাচ্ছেন। নীতিনির্ধারকরা ভালোভাবেই অবগত আছেন যে, কুইক রেন্টালের নামে তারা প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতির বাজার খুলে বসেছেন। এই বিশেষ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে মন্ত্রী, এমপি এবং তাদের পরিবার ও কাছের লোকজন। ভবিষ্যতে যাতে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে এই গোষ্ঠীকে কারাগারে যেতে না হয়, সেই লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে যে কুইক রেন্টাল নিয়ে আদালতে কোনো মামলা করা যাবে না। যুগে যুগে দুর্নীতিবাজরা এভাবেই পিঠ বাঁচাতে চেয়েছে। কিন্তু, দুর্নীতি করলে শেষ পর্যন্ত যে পার পাওয়া যায় না, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।
শেখ হাসিনা এবং জেনারেল মইন ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়কালে তাদের দাবি অনুযায়ী বিদ্যুত্ খাত থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের জন্য বিএনপি সরকারকে বহুবার অভিযুক্ত করেছেন। আমার একাধিক লেখায় উল্লেখ করেছি যে, ওই পাঁচ বছরে বিদ্যুত্ খাতে মোট বাজেটই ছিল সাড়ে তের হাজার কোটি টাকা। ১৩ হাজার ৫শ’ কোটি টাকার বাজেট থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা লুট করা যে সম্ভব নয়, এই সামান্য বিষয়টি ক্লাস ওয়ানে পাঠরত একজন শিশু বুঝলেও আওয়ামী মিডিয়ায় এসব প্রচারণা থেমে থাকেনি। চারদলীয় জোট সরকারের বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বাধ্য হয়ে জেনারেল মইনের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন, যেটি এখনও বিচারাধীন রয়েছে। শেখ হাসিনা বিএনপি’র পাঁচ বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ করলেও এ দেশের ষোল কোটি নাগরিকের দুর্ভাগ্য, এখন তারই আমলে সেই বিদ্যুত্ খাত থেকেই প্রতি বছর ২০ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দেশের সম্পদ লুটে নেয়ার বিনিময়ে বিদ্যুত্ সমস্যা সমাধানের সরকারি বাগাড়ম্বরে জনগণ আদৌ কোনো রকম আস্থা স্থাপন করছেন কিনা, সেই প্রশ্নের জবাব আওয়ামী লীগ আগামী জাতীয় নির্বাচনেই পেয়ে যাবে। অবশ্য, সেই নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়েও তো আবার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতদিন দাবি করতেন যে, তার মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে নাকি এখন পর্যন্ত দুর্নীতির কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক ও এডিবি পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দাবিকে অসাড় প্রমাণিত করেছে। সারা দুনিয়া এখন জেনে গেছে, বাংলাদেশের প্রশাসন এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত যে, এই দেশে উন্নয়ন খাতেও আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী সংস্থাসমূহ আর বিনিয়োগে আগ্রহী নয়। এই সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রী ও তার পারিষদবর্গ আদৌ বিব্রত হয়েছেন কিনা জানি না, তবে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের নাক কাটা গেছে। তিনি অবশ্য এখনও বলে চলেছেন অভিযোগ যথেষ্ট নয়, জনগণকেই দুর্নীতির প্রমাণ দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর দাবি প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, যোগাযোগমন্ত্রী এবং বাণিজ্যমন্ত্রীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে সরকারের সঙ্গে একচেটিয়া ব্যবসা নিয়ে এ বছরের ১৫ মে তারিখে আমার দেশ পত্রিকায় তথ্যপ্রমাণসহকারে লিড নিউজ ছাপা হয়েছিল, ‘বিদ্যুত্ এক মন্ত্রীর রাস্তা সেতু অন্যজনের’।
শেয়ারবাজার থেকে মন্ত্রী, এমপি এবং সরকারি দলের চাঁইদের লুটপাটের কাহিনীও আমাদের পত্রিকায় বহুবার তুলে ধরেছি। কিন্তু, কেউ জেগে ঘুমালে তাকে ঘুম থেকে ওঠানোর সাধ্য কার? টিআইবি’র জরিপে এক সময় বিশ্বে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের কুখ্যাতি ছিল। পর পর চারবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ২০০৪ সাল থেকে অবস্থার যত্সামান্য উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতির সর্বব্যাপী বিস্তার ও মন্ত্রীদের ঔদ্ধত্যে আশঙ্কা হচ্ছে, আবারও না আমাদের দুর্নীতির শীর্ষ স্থানে ফিরে যেতে হয়। শেয়ারবাজার থেকে লক্ষ কোটি টাকা লুণ্ঠিত হয়েছে। অতিরিক্ত মূল্যে বিদ্যুত্ কেনার বোঝা সাধারণ ভোক্তার কাঁধে চাপানো হয়েছে। একদিকে তাদের করের টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে, এখন আবার গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বাড়িয়ে দ্বিতীয়বার জনগণের পকেট কাটার ব্যবস্থা হচ্ছে। বাংলাদেশে সব আমলেই দুর্নীতি করে শাসকশ্রেণী স্ফীত হচ্ছে, আর দেশের অসহায় জনগণ সেই বোঝার ভার বহন করছে।
২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ যেসব আকাশ-কুসুম প্রতিশ্রুতির পসরা নিয়ে ভোটারের সামনে হাজির হয়েছিল, তার মধ্যে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুদককে প্রকৃত স্বাধীনতা দিয়ে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতিও স্থান পেয়েছিল। সরকারের প্রায় তিন বছর অন্তে দেখা যাচ্ছে, এমন একটি মন্ত্রণালয়ও আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে দুর্নীতি ও লুটপাট হচ্ছে না। এখন আর শুধু আমার দেশ পত্রিকা নয়, আওয়ামী ও ভারতপন্থী হিসেবে চিহ্নিত পত্রিকা সমূহেও প্রায় প্রতিদিন মন্ত্রী, এমপিদের দুর্নীতির অভিযোগ সংবলিত সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। সরকার প্রধানের সদিচ্ছা থাকলে তিনি এসব সংবাদ দ্বারা উপকৃত হতে পারতেন। কিন্তু, শেখ হাসিনা উল্টো সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিচ্ছেন। তথ্যপ্রমাণসহ দুর্নীতির সুস্পষ্ট অভিযোগ করার পর বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে এই সরকার কবে মামলা দায়ের করবে, সেটি দেখার অপেক্ষাতেই এখন আছি। লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দি ইকনোমিস্ট’য়ের বিরুদ্ধেও কিছুদিন আগে সরকারি মহল থেকে মামলা করার হুঙ্কার শুনতে পেয়েছিলাম। দুর্নীতি প্রতিরোধের পরিবর্তে মহাজোট সরকারের মিডিয়া বিদ্বেষের কাহিনী এখন দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন গত সপ্তাহেই দীপু মনিকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়ার তাগিদ দিয়েছেন।
আর দুদকের কথা যত কম বলা যায়, ততই ভালো। বিএনপি আমলে দুদকের নিষ্ক্রিয়তায় বিরক্ত হয়ে তত্কালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিকে একটি ‘রসিকতা’ (Joke) বলে উল্লেখ করেছিলাম। আমার সেই মন্তব্যটি সম্প্রতি উইকিলিক্স-এ ফাঁসও হয়েছে। বর্তমানে দুদকের কর্তা ব্যক্তিদের লাজলজ্জাহীনভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের লেজুড়বৃত্তি করতে দেখে তাদের মনুষ্যপদবাচ্য বিবেচনা করতেও আমার ঘৃণাবোধ হয়। দেশব্যাপী দুর্নীতির মহোত্সব চলছে, অথচ দুদক ব্যস্ত সরকারের হুকুম অনুযায়ী ভিন্ন মতাবলম্বীদের মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় ফাঁসানোর আয়োজনে। সরকারি কেনা-বেচায় বৃহত্ মাপের দুর্নীতি তো অকাতরে চলছেই।
পথে-ঘাটে চাঁদাবাজি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তার একটি উদাহরণ দেই। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূত ক’দিন আগে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খানের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে চট্টগ্রাম বন্দরে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের চাঁদাবাজি বন্ধে তার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। একটি মালয়েশীয় কোম্পানি চট্টগ্রাম বন্দরের নাব্য রক্ষায় ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজে নিয়োজিত ছিল। সরকারি চাঁদাবাজদের দাপটে তাদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে বাধ্য হয়ে রাষ্ট্রদূত জামালউদ্দিন বিন সাবে নৌমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। একজন সরকারি এমপি কর্তৃক মালয়েশিয়াতেই আদম পাচারের কাহিনী আমার দেশ পত্রিকায় প্রমাণ সহকারে ছাপা হওয়ার পরও অভিযুক্ত এমপি’র বিরুদ্ধে সরকার কিংবা দুদক কোনো ব্যবস্থা আমার জানা মতে নেয়নি। মালয়েশিয়ার বিনিয়োগে স্থাপিত বাংলাদেশে একটি প্রতিষ্ঠানের সরকারের কাছের লোকজনের দখল করে নেয়ার গুজবও বেশ কিছুদিন ধরে বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাবি করে থাকেন যে, তার আমলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নাকি বৃদ্ধি পেয়েছে। দীপু মনি বলছেন, চুরি করলেও সম্মান ক্ষুণ্ন হয় না। বিশ্বে মাথা হেট করা দুর্নীতির বেশুমার গল্প পত্র-পল্লবে বিকশিত হওয়া সত্ত্বেও তারা যদি এ জাতীয় আত্মশ্লাঘায় ভোগেন, তাহলে জনগণের কপালে করাঘাত ছাড়া আর কী করার আছে?
এই শতকের গোড়ার দিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বলা হচ্ছিল, বাংলাদেশের ঋণনির্ভরতা থেকে ক্রমেই বাণিজ্য নির্ভরতায় উত্তরণ ঘটছে। গোল্ডম্যান স্যাকস বাংলাদেশকে বিশ্বে এগারটি দ্রুত অর্থনৈতিকভাবে বিকাশমান রাষ্ট্রের একটি বিবেচনা করেছিল। সেসব আশাবাদ এখন কর্পূরের মতো উবে গেছে। সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি আমাদের ললাট লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি দায়িত্ব পালনের পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে দাবি করতে পারি, কোনো মন্ত্রী নিজে যদি দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকেন এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্ঠায় তিনি সরকার প্রধানের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেলে মন্ত্রণালয় থেকে দুর্নীতি দূর করা অবশ্যই সম্ভব। তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ, সহিংসতা এবং দুর্নীতিকে উপলক্ষ্য করেই এক এগারোর কুশীলবরা ২০০৬ সালে বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদী পড়শি ভারতের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করার নীলনকশা প্রণয়ন করতে পেরেছে, যেটি বর্তমান সরকার ভারতের সহায়তায় ক্ষমতায় আসার প্রতিদানে ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়ন করছে। এক এগারোর এত বড় সর্বনাশের মধ্যেও আশা করেছিলাম, রাজনীতিবিদরা অন্তত দুর্নীতির বিষয়ে কিছুটা শিক্ষা গ্রহণ করবেন। কিন্তু বর্তমান সরকারের তিন বছরে প্রমাণিত হয়েছে, তারা কোনো রকম শিক্ষা গ্রহণ না করে বরঞ্চ, দুর্নীতির মাত্রাই বৃদ্ধি করেছেন। কোটি টাকা দুর্নীতির পরিবর্তে কোটি ডলারের দুর্নীতি জনগণকে সহ্য করতে হচ্ছে। বর্তমান সরকার আমাদের চরমভাবে আশাহত করেছে। এবার আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বিরোধীদল বাংলাদেশে একটি সত্ ও দক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করবে কিনা, সেটা দেখার জন্য জনগণকে তাদের ক্ষমতায় আসা অবধি অপেক্ষা করতে হবে।
No comments