রবীন্দ্রনাথের ছবির নিলাম by মাহবুব আলম
রবীন্দ্রনাথ কম বয়স থেকেই নানা বিষয়ে সৃষ্টিশীল হলেও পরিপূর্ণভাবে ছবি আঁকায় হাত দেন অনেক পরে। ১৮৯৩ সালে এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘ঐ যে চিত্রবিদ্যা বলে একটা বিদ্যা আছে, তার প্রতিও আমি সর্বদা হতাশ প্রণয়ের লুব্ধ দৃষ্টিপাত করে থাকি। কিন্তু পাবার আশা নেই, সাধনা করার বয়স চলে গেছে।’ তাঁর বয়স তখন ৩২। সত্যিকারের ছবি আঁকা শুরু করেন জীবনের পড়তি বেলায়, ৬৭ বছর বয়সে। জীবনের শেষ ১৫ বছর তিনি কম করেও প্রায় আড়াই হাজার ছবি এঁকেছিলেন।
বস্তুত, লেখালেখির সময় পাণ্ডুলিপি সংশোধন করতে গিয়ে তিনি যে কাটাকুটি করতেন, কখনো কখনো তাতে অলংকরণ ও মুখাভাস দেখা দিত। এ থেকেই তাঁর ছবি আঁকার সূচনা। পাণ্ডুলিপিতে ছবি তৈরির ঝোঁক আরও গভীর হয়ে ওঠে যখন তিনি ১৯২৪ সালে অসুস্থ শরীরে দক্ষিণ আমেরিকায় বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর আতিথ্য গ্রহণ করেন। সুস্থ হয়ে ওঠার সময় পূরবীর কবিতাগুলো লিখতে গিয়ে আশ্চর্য সব অলংকরণ ফুটে ওঠে এই কলম চালনা থেকে। গবেষকদের অভিমত, এসব আঁকিবুঁকি থেকেই তিনি ছবি আঁকার প্রেরণা পেয়েছিলেন।
কবি আঁকার জন্য বেছে নিলেন সস্তা কাগজ, কালি, রং ও তুলি। তবে তেলরং তাঁকে তেমন আকৃষ্ট করেনি বলেই মনে হয়। তত দিনে ছবি আঁকা তাঁর রোজকার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। কবি এ প্রসঙ্গে নিজেই লিখেছেন, ‘রেখার মাঝখানে আমার সমস্ত মন জড়িয়ে পড়েছে। অকালে অপরিচিতার প্রতি পক্ষপাতে কবিতা একেবারে পাড়া ছেড়ে চলে গেছে।’
এমনি করে আঁকতে আঁকতে কবির হাতে বেশ কিছু ছবি জমে গেল। এগুলোর মধ্য থেকে ১২৫টি বাছাই ছবি নিয়ে প্রদর্শনী হয় প্যারিসে ২ মে ১৯৩০ সালে। এই প্রদর্শনীর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন বিক্তোরিয়া ওকাম্পো। কবি ইন্দিরা দেবীকে চিঠি লিখলেন: ‘ধরাতলে যে রবিঠাকুর বিগত শতাব্দীর ২৫ বৈশাখ অবতীর্ণ হয়েছেন, তার কবিতা সম্প্রতি আচ্ছন্ন। তিনি তখন চিত্রকররূপে প্রকাশমান।’
পৃথিবীর প্রায় সব বড় বড় শহরে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়। সুনামও কুড়ায় প্রচুর। প্রদর্শনী হয়েছে অক্সফোর্ড, বার্মিংহাম, লন্ডন, বার্লিন, মিউনিখ, কোপেনহেগেন, মস্কো, বোস্টন, নিউইয়র্ক প্রভৃতি স্থানে।
নিজের ছবি নিয়ে সেরা মূল্যায়ন করেছেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ সালে আর্ট স্কুলে তাঁর চিত্রপ্রদর্শনীতে তিনি বলেন, ‘যারা আমার এই রচনাগুলিকে (ছবিগুলিকে) কোন প্রচলিত শিল্পরীতির শ্রেণীতে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। যারা এদের ব্যাখ্যার সন্ধানে ধাঁধায় ফেরেন আমার কাছ থেকে তারা যেন সাহায্যের আশা না করেন। বস্তুত তারা হয়ে উঠেছে এ ছাড়া তাদের সম্বন্ধে অন্য কোন ব্যাখ্যা চলবে না। একটা গোলাপ ফুল তো গোলাপ ফুল মাত্র, তার বেশি কিছুই নয়। সে কোন হূদয় ভাব প্রকাশ করে না..., তার আছে কেবল রেখার সঙ্গতি বর্ণের ভঙ্গিমা।...তার মূলগত আত্মতায় সে না প্রাচ্য, না পাশ্চাত্য, এ বিভাগ তার বাহ্যিক। আমি আশা করি, আমার ছবিগুলো এ জাতের, এর বেশি আমার কিছু বলার নেই। যদি কেউ তাদের কাছ থেকে কিছু বোঝার চেষ্টা করেন, তাহলে প্রমাণ হবে তারা দুর্বোধ্য, কারণ তারা ‘একান্ত সহজ।’ তাঁর সার্ধশত জন্মবর্ষ উপলক্ষে পাদপ্রদীপের আলোয় আবার উঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথের হিরণ্ময় সৃষ্টিসম্ভার। এহেন উজ্জীবিত প্রেক্ষাপটে বিলেতের ডেভনের ডার্টিংটন হলে রাখা রবীন্দ্রনাথের ১২টি দুষ্প্রাপ্য ছবির নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্ত রবীন্দ্রানুরাগীদের বিষণ্ন ও হতাশ করেছে। বিশ্বভারতী ও নানা মহলের আপত্তি সত্ত্বেও গত ১০ জুন ২০১০ ডার্টিংটন হলের ট্রাস্টের ইচ্ছানুযায়ী লন্ডনের নিলাম কোম্পানি সদবিজের হাতুড়ির ঘায়ে এই ছবিগুলো বিক্রি হয়ে গেল। নিলাম বন্ধ করার কোনো চেষ্টাই সফল হয়নি, কারণ বিদেশের মাটিতে বৈধ নিলাম আটকানোর কোনো আইন নেই।
দীর্ঘদিন ধরে এই ছবিগুলো যত্নের সঙ্গে ডার্টিংটন হলে রাখা ছিল। একটি প্রদর্শনীকক্ষে ছবিগুলো নিয়মিত দেখার সুযোগও পেতেন ছাত্রছাত্রীরা। রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত এই ছবিগুলো উপহার দিয়েছিলেন তাঁর সহযোগী, একদা-সচিব ও অসম বয়সের বন্ধু লেনার্ড এলমহার্স্টকে, যিনি বিশের দশকে ইংল্যান্ডের ডেভনের মনোরম পরিবেশে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ডার্টিংটন হল।
ডার্টিংটন হলের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য দেড় কোটি পাউন্ডের ফান্ড গড়ে তোলার তাগিদে প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্ট এই ১২টি ছবি নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। ডার্টিংটন হলের একটি অংশে আছে শুমাখার কলেজ। সেটিও আরও বাড়ানো হবে। এর জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন। প্রস্তাবিত পরিকাঠামোর উন্নয়ন হলে ভবিষ্যতে বৃহৎ পরিসরে শিল্প ও সংস্কৃতির নানা কর্মকাণ্ড চালানো সহজ হবে এমন যুক্তি তুলে ধরেছিল ট্রাস্ট ছবিগুলো বিক্রি করার সপক্ষে। টাকা তুলতে রবিঠাকুরের ছবি বিক্রি না করে উপায় কী? নিলাম থেকে কী পরিমাণ টাকা হাতে আসতে পারে তারও একটি প্রাথমিক হিসাব কষে ফেলেছিল ডার্টিংটন হল ট্রাস্ট। কমপক্ষে এই এক ডজন ছবির দাম আড়াই লাখ পাউন্ডের কাছে তো হবেই। কিন্তু নিলাম শেষে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি অর্থই পেল ট্রাস্ট। ১২টি ছবির মোট দাম উঠল ১৫ লাখ ২২ হাজার পাউন্ড।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ডার্টিংটন হলের প্রতিষ্ঠাতা এলমহার্স্টের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। আমেরিকার কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম পরিচয় এলমহার্স্টের। কবির ব্যক্তিগত সচিব হয়ে ১৯২১ সালে এ দেশে আসেন তিনি। শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার সময়ও তিনি রবীন্দ্রনাথের পাশে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে এসেই ডার্টিংটন হলের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ার পরিকল্পনা জাগে তাঁর মনে। কয়েক বছর পর দেশে ফিরে অনেকটা শান্তিনিকেতন বা শ্রীনিকেতনের আদলে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরির কাজে হাত দিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী ডরোথি। এইভাবে ডার্টিংটন হল নামে একটি মুক্ত ভাবনার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল বিলেতে।
রবীন্দ্রনাথ ডার্টিংটন হলে একাধিকবার বেড়াতে গিয়েছিলেন। প্রথমবার যান ১৯২৬ সালে। এর চার বছর পর আবার এলেন এখানে। সেবার কবির আসার বড় কারণ ছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হির্বাট বক্তৃতা। তখন এক মাস কাটালেন ডার্টিংটনে। সে সময় ছবিও এঁকেছিলেন সেখানে বসে। রবীন্দ্রনাথ যে ঘরে ছিলেন, সেটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘টেগোর রুম’। তিনি যেভাবে ঘরটি ব্যবহার করে গেছেন, সেভাবেই সেটি রেখে দেওয়া হয়। এক দশক আগে সেই টেগোর রুম দখল করে নেয় শুমাখার কলেজ। কবির ব্যবহূত সব সামগ্রীও সরিয়ে ফেলা হয় সেই ঘর থেকে। এখন এটি কখনো ব্যবহূত হয় কনফারেন্স রুম হিসেবে আবার কখনো বিভিন্ন বাণিজ্যপ্রতিষ্ঠানের হয়ে ভাড়া খাটে।
১৯৬৮ সালে এলমহার্স্টের স্ত্রী ডরোথি প্রয়াত হন। ১৯৭৩ সালে লেনার্ড ক্যালিফোর্নিয়ায় যান, পরের বছরই তাঁর মৃত্যু ঘটে। এই দুজনের অবর্তমানে ধীরে ধীরে ডার্টিংটনে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি ম্লান হতে থাকে।
১০ জুন, সদবির ভিড়ে ঠাঁসা নিলাম ঘরে ১২টি রবি-ছবি বিক্রি হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের এই ছবিগুলো কেনার চেষ্টা করেছিল ব্রিটিশ মিউজিয়ামের এশিয়া বিভাগ। ছবিগুলো সংরক্ষণ করার ইচ্ছা ছিল তাদের। নিলামেও তারা হাজির ছিল। কিন্তু ছবির দাম বেশি হওয়ায় সরে আসতে হয় তাদের। রবীন্দ্রনাথের এই ছবিগুলো শেষবারের মতো একই প্রদর্শনীতে দেখা যাবে এ বছর। তারপর তাদের ঠাঁই হবে বিভিন্ন আর্ট-গ্যালারিতে আর ব্যক্তিগত সংগ্রহে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ২৯ জুন ১৩৯০ সনে নন্দলাল বসুকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘ভয় ছিল ইংল্যান্ডে ছবিগুলো উপেক্ষিত হবে, তা হয়নি।’ আট দশক পরে তাঁর জন্মের সার্ধশত বর্ষে আবারও সঠিক প্রমাণিত হলো রবীন্দ্রনাথের নিজের মূল্যায়ন নিজের ছবি নিয়ে।
=============================
দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ মাহবুব আলম
এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ মাহবুব আলম
এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
No comments