নান্দনিক ঐক্য by জাহিদ মুস্তাফা
ঢাকা আর্ট সেন্টারে ১২ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত চলেছে একটি যৌথ চিত্রপ্রদর্শনী। প্রাণের উৎসবে শিরোনামে এ প্রদর্শনীতে নানা বয়সী ১৭ জন চিত্রশিল্পী অংশ নিয়েছেন। বিশ শতকের সত্তরের দশক থেকে চলমান সময়ে শিল্পচর্চায় নিয়োজিত শিল্পী দলের এ প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে ছাপচিত্র, ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে আঁকা, কাগজে তেলরঙে আঁকা ও মিশ্রমাধ্যমের ৩৬টি কাজ।
কাজগুলোতে যেমন আছে নিরাবয়ব বিমূর্ততা, তেমনি আছে অবয়বনির্ভরতা। স্বাধীনতা-উত্তরকালের প্রকাশবাদী নিমূর্ততার রেশটাও এখানে যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র অভ্যুদয়ের গৌরব যেমন এ শিল্পী দলের জ্যেষ্ঠরা অবলোকন করেছেন, তেমনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতাদের রক্তরঞ্জিত কালরাত্রির নখরাঘাতে গণতন্ত্রের পতন দেখেছেন। এ সময়ের শিল্পীদের চিত্রকর্মে রাষ্ট্র ও সমাজের চরিত্রহীন চেহারা উঠে এসেছে বিভিন্নভাবে। সময়ের মাপকাঠিতে এ শিল্পী দলটির অভিজ্ঞতা ও আঙ্গিক স্বতন্ত্র। প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত চিত্রকর্মগুলো সাম্প্রতিক। ভিন্ন দুটি সময়ের শিল্পীদের নানাবিধ প্রকাশপ্রবণতা এতে স্পষ্ট।
এই শিল্পী দলের অন্তর্ভুক্ত জামাল আহমেদ, নিসার হোসেন, দিলারা বেগম জলি, সৈয়দ হাসান মাহমুদ, ওয়াকিলুর রহমান, আতিয়া ইসলাম এ্যানি শুরু থেকেই দৃশ্যকলার নানা মাধ্যমে কাজ করে পরিচিতি পেয়েছেন। প্রদর্শনীতে জামাল আহমেদের তিনটি সৃজনকর্ম। তিনটিই বাস্তবানুগরীতিতে আঁকা। নদীতীরে বিশাল বালুচরের পটভূমিতে গরুর দল নিয়ে গৃহাভিমুখে যাত্রারত রাখাল কিংবা গরমে অতিষ্ঠ এক নারীর শায়িত রূপ শিল্পীর দৃষ্টিনন্দন সৃজন। সৈয়দ হাসান মাহমুদ ক্যানভাসে বর্ণ লেপন করেছেন স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দে মেতে উঠে। নারী যেন ফুল হয়ে তার সৃজনী ক্ষমতা নিয়ে উঠে এসেছেন দিলারা বেগম জলির চিত্রপটে। ওয়াকিলুর রহমান চিত্রপট থেকে ফর্মকে প্রায় বাদ দিয়েছেন, স্পষ্ট-অস্পষ্ট কিছু রেখা আছে বটে, তাও যেন অপসৃত হতে হতে রয়ে গেছে। জার্মান প্রবাসী এই শিল্পী এতকাল যা এঁকেছেন, বিশ্বাস করেছেন, তা থেকে সম্প্রতি নিজেকে বিমুক্ত করছেন।
‘নরখাদকের নৃত্য’ এঁকেছেন শিল্পী নিসার হোসেন কাগজে মিশ্রমাধ্যমে। রক্তলাল প্রেক্ষাপটে নৃশংস নরখাদকদের নৃত্যরত অবয়ব এঁকেছেন তিনি। আতিয়া ইসলাম এ্যানি এঁকেছেন ‘নারী ও সমাজ’ নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক ছবি। এঁদেরই সমসাময়িক শিল্পী সেলিনা চৌধুরী মিলি উডকাঠ ছাপচিত্র মাধ্যমে এঁকেছেন দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত মানুষ ও পরিবেশ। সৈয়দা মাহবুবা করিম মিলি ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে এঁকেছেন বন্ধুতার ছবি।
এই শিল্পী দলের প্রদর্শনীর সংগঠক নাসিমা খানম কুইনির অবস্থান দুটি প্রজন্মের মাঝখানে। সমসাময়িক অগ্রজ ও অনুজদের পেয়েছেন ঢাকার চারুকলায় স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়নকালে। নবীনদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটেছে ইউডার চারুকলা অনুষদের স্নাতকোত্তর পাঠকালে। দুর্যোগের আগে ও পরের দুটি রূপে সুন্দরবন এঁকেছেন তিনি। আফরোজা জামিল কঙ্কা এঁকেছেন প্রাচ্যনারী অবয়ব। সামসুল আলম আজাদ এঁকেছেন প্রকৃতি ছন্দ। হূদয়ের গান শিরোনামে অনুকুল চন্দ্র মজুমদার এঁকেছেন নারী-পুরুষের ঘনিষ্ঠ অবয়ব। এ এইচ ঢালী তমাল কাঠখোদাই করে ঘাসের বুকে ছাগলের দৃষ্টিনন্দন ছাপাই করেছেন। শাফিন ওমর এঁকেছেন গোধূলিলগ্নে মোষের ছবি। শৈশবস্মৃতি এঁকেছেন মিন্টু দে। ফেরদৌস আরা রসুল প্রীতি মিশ্রমাধ্যমে এঁকেছেন স্বপ্নের ছবি। এ দলের কনিষ্ঠ শিল্পী ফারজানা রহমান ববি মিশ্রমাধ্যমে প্রিন্টে ল্যান্ডস্কেপ এঁকেছেন সাদা-কালোয়।
বিভাজিত এ সময়ে এই শিল্পী দলের ঢিলেঢালা নান্দনিক ঐক্য রচনা অভিনন্দনীয়।
No comments