কবির সান্নিধ্যে by ফিরোজা বেগম
আমার বয়স তখন এগারো-বারো হবে। আমরা থাকতাম ফরিদপুরে। বিভিন্ন ছুটিতে কলকাতা বেড়তে যেতাম। একবার গ্রীষ্মে এক মাস ছুটি পেলাম। ছোট মামা তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এমএ করছেন। আমার দুই কাজিন (ইমদাদুল হক ও এম এ হক) ওদের সঙ্গে অল ইন্ডিয়া বেতারের সুনীল বোসের সুসম্পর্ক ছিল। একবার এক অনুষ্ঠানে সুনীল বোস আমার গান শুনে বললেন, ‘ওকে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে একদিন নিয়ে এসো তো। ওর অডিশন নেব। এইচএমভিতেও একদিন নিয়ে এসো। দেখো, ওরা কী বলে।’
একদিন ভাই আর মামা মিলে আমাকে এইচএমভিতে নিয়ে গেলেন। সেখানে ঢুকেই দেখলাম এইচএমভির লোগো কুকুরের ছবিটা। দেখেই বললাম, ‘আরে, আমি তো এই ছবিটা রেকর্ডে দেখেছি।’ ভাই বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। এখান থেকেই সেই রেকর্ডগুলো বের হয়।’ শুনে তো আমার গলা শুকিয়ে গেল। এরপর আমাকে রিহার্সেল রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। ঢুকেই দেখলাম ঘরভর্তি অনেক লোক। ওই ঘরে ঢোকার পর যাঁর পাশে আমাকে বসতে বলা হলো, তিনিই কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি হাত বাড়িয়ে আমাকে বসতে বললেন। কাজী নজরুল ইসলাম তখন এইচএমভির প্রধান প্রশিক্ষক।
সেদিন কবি ঘিয়া রঙের পাজামা-পাঞ্জাবি পরেছিলেন। মাথায় টুপি, চোখে ছিল সোনালি ফ্রেমের চশমা। কিন্তু আমি তখনো জানি না ইনিই কাজী নজরুল ইসলাম। আমি মনে মনে ভীষণ বিরক্ত। একটা রুমে গাদাগাদি করে এত মানুষ! তার সঙ্গে হারমোনিয়ামসহ নানা বাদ্যযন্ত্র। মামা এইচএমভির এক কর্মকর্তার মাধ্যমে কবিকে জানালেন যে আমার গান শোনাতে নিয়ে এসেছেন। শুনে কাজী নজরুল ইসলাম হো হো করে হেসে উঠলেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাহ্, বেশ তো। তা কী গান শোনাবে আমাদের?’
আমি তাঁর কথার উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর অনেকটা বিরক্তি নিয়েই গান ধরলাম,
—‘যদি পরানে না জাগে আকুল পিয়াসা
শুধু চোখে দেখা দিতে এস না’
গানটি খুবই কঠিন। গান শেষ করেই উঠে দাঁড়ালাম, বাইরে চলে আসব। আমাকে কাজী নজরুল ইসলাম হাত টেনে ধরে বসালেন। বললেন, ‘ওরে সর্বনাশ! এ কী গান শোনালে তুমি। এতটুকু মেয়ে এ গান কীভাবে, কোথা থেকে শিখলে?’
একটু চুপ থেকে তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, আমার কয়েকটা কথার জবাব দেবে তুমি?’
মাথা নেড়ে বললাম দেব। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ গান তুমি কোথা থেকে শিখেছ? কার কাছ থেকে?’
আমি বললাম, ‘কারও কাছ থেকে নয়। বাড়িতে কালো মোটা ভাঙা ভাঙা রেকর্ডগুলো আছে না, ওইগুলো শুনে শুনেই শিখেছি।’
আমার এমন বোকার মতো উত্তর শুনে উনি আবার হো হো করে অট্টহাসি দিয়ে উঠলেন, আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম।
যা-ই হোক, আমার মা-বাবা, বাড়ি কোথায় ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলেন। উত্তর দিলাম। এরপর বললেন, ‘এত কঠিন গান তুমি একা একা তুলেছ। বলো কী, এত মিষ্টি কণ্ঠে মাত্র একটা গান শুনে কি ছাড়া যায়? আমরা কি আরেকটা শুনতে পারি না?’
তাঁর কথায় আমার প্রচণ্ড অস্বস্তি আর বিরক্তি লাগছিল। মাথা নেড়ে বললাম, ‘না।’
কাজী নজরুল ইসলাম বললেন, ‘তুমি হারমোনিয়াম বাজাতে পারো?’
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ।’
তিনি বললেন, ‘বলে কী? সেটাও কি নিজে নিজে শিখেছ?’
আবারও মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললাম।
তিনি বললেন, ‘একটা রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে নিজে নিজে এত সুন্দর গান শিখে ফেলেছে। এত দিন গান করছি, এ রকম প্রতিভা তো এর আগে পাইনি।’ তিনি আবারও বললেন, ‘তুমি আরেকটা গান শোনাও।’ একটা হারমোনিয়াম নিজেই টেনে আমার সামনে দিলেন। আমি খানিকটা বাজানোর পর দেখি একটা রিড উঠলে দূরের আরেকটা উঠে যায়। (পরে জেনেছি, ওটা ছিল স্কেল চেঞ্জার হারমোনিয়াম) আমি বললাম, এই হারমোনিয়াম বাজাব না। এটার আওয়াজ কেমন ভাঙা ভাঙা। আমাদের হারমোনিয়ামটা ভালো। একথা শুনে উনি আরও জোরে হেসে উঠলেন। আমার অস্বস্তিও আরও বেড়ে গেল। বললেন, ‘এ কী দেখছি! এ মেয়ে তো সবই বোঝে। এই কেউ যাও তো। কমলকে (কমল দাশগুপ্ত, পরে যাঁর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়) ডেকে আনো। এ মেয়ের গান ওর শোনা উচিত।’ তাঁর কথা শুনে কেউ একজন বেরিয়ে গেল। একটু পরই বেশ সুদর্শন একজন পুরুষ এলেন। বয়স ২২ কি ২৩। কাজী নজরুল ইসলাম বললেন, ‘কমল, আমরা এই বাচ্চা মেয়ের গান শুনে তো হতবাক হয়ে গেছি। তুমিও একটু শুনে দেখো।’ আমি দ্বিতীয় গান ধরলাম, ‘কালো পাখিটা মোরে কেন করে এত জ্বালাতন।’—ডিএল রায়ের গান এটি। গানটার মধ্যে সূক্ষ্ম কারুকাজ ছিল। ১০-১১ বছরের একটা মেয়ের গলায় ওই গান ওঠার কথা নয়। কখনো হালকা, কখনো ভারী কারুকাজ, ওঠা-নামা।
গানটি অর্ধেক গেয়ে আমার আর গাইতে ইচ্ছে করল না। বললাম, ‘আমি আর গাইতে পারব না।’
কাজী নজরুল ইসলাম বললেন, ‘ঠিক আছে, যা গেয়েছ তাতেই আমরা অবাক। তবে বলে যাও, আবার আমাকে গান শোনাতে আসবে।’
আমি মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললাম। এরপর ওখান থেকে বাইরে এলাম।
ওই ঘর থেকে বের হওয়ার পর আমার দুই চোখ ফেটে পানি ঝরছে। মামা-ভাইয়েরা কেন এখানে নিয়ে এলেন—এই অভিমানে। মামা আমার অবস্থা দেখে বললেন, ‘তুই যে বিরক্ত হচ্ছিস, তুই কি জানিস কার সামনে আজ গান করেছিস? ওই যে তোকে ডেকে পাশে বসালেন, তাঁর নাম হচ্ছে কাজী নজরুল ইসলাম।’
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, কোন কাজী নজরুল ইসলাম? ‘বল বীর’? (বাবার মুখে ‘বল বীর’ কবিতাটা অনেকবার শুনেছিলাম। ওই কবিতা দিয়েই কবির নামটি আমার কাছে পরিচিত।) পরে শুনেছিলাম, সেদিন আমি চলে আসার পর কাজী সাহেব মহড়াকক্ষে সবার উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘এই মেয়ে গান না শিখেই এত ভালো গায়। শেখালে না জানি কী গাইবে। আমি হয়তো সেদিন থাকব না, কিন্তু তোমরা দেখে নিয়ো, এই মেয়ে অনেক ভালো শিল্পী হবে। এই মেয়েকে গানের ব্যাপারে যা যা সাহায্য করতে হয় তোমরা করো।’
কবি সুস্থ থাকা অবস্থায় এর পরও তাঁর সঙ্গে পাঁচ-ছয়বার দেখা হয়েছে।
১৯৪২-এর ডিসেম্বরে এইচএমভি থেকে আমার প্রথম রেকর্ড বের হয়। মানে কবির কাছে যাওয়ার এক বছর পর। সেভেন্টি এইটে (78 rpm) বের হলো আমার প্রথম রেকর্ড। একদিকে ছিল ‘মোর আঁখিপাতে’, আরেক দিকে ‘মরুর বুকে জীবনধারা কে বহাল’। তখন আমার কতই বা বয়স, ১২-১৩ বছর হবে। কলকাতার কাগজগুলোতে আমাকে নিয়ে লেখা হলো ‘মরুর বুকে জীবনধারা কে বহাল’ সেটা আমরা জানি।
কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম অল্পের জন্য আমার রেকর্ড শুনতে পাননি। কারণ এর মাত্র মাস কয়েক আগেই উনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর একের পর এক রেকর্ড বের হতে লাগল। আধুনিক গান, রবীন্দ্রসংগীত, গীত, গজল, ভজন—সবকিছু করছি। তিনি অসুস্থ হওয়ার ১৮ বছর পর স্বরলিপির কাজে আমি হাত দিই। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আমি কলকাতায় ছিলাম, এর মধ্যে স্বরলিপির তিন তিনটি বই করে আমি কলকাতা থেকে বাংলা একাডেমীতে পাঠাই। কলকাতা থেকে শ্যামাসংগীতের স্বরলিপির বইও বের হলো।
অসুস্থ হওয়ার পরও কবিকে প্রায়ই দেখতে যেতাম। এটা আমার আর কমলের নিয়মিত কাজ ছিল। কমল বলত, ‘কি কাজীদা, চিনতে পারছেন। একসঙ্গে কত গান করলাম।’ তিনি কোনো উত্তর দিতেন না। তাঁর প্রতিটি জন্মদিনে আমরা যেতাম। মনে পড়ে, ‘দৃৃষ্টিতে আর হয় না সৃষ্টি আগের মতো গোলাপ ফুল’—নজরুলের অসাধারণ এই গানটা শুধু আমিই করেছি। কাজী নজরুল ইসলাম তখন অসুস্থ। এই গানটি তখন তাঁকে শুনিয়েছিলাম।
সেদিন কবি ঘিয়া রঙের পাজামা-পাঞ্জাবি পরেছিলেন। মাথায় টুপি, চোখে ছিল সোনালি ফ্রেমের চশমা। কিন্তু আমি তখনো জানি না ইনিই কাজী নজরুল ইসলাম। আমি মনে মনে ভীষণ বিরক্ত। একটা রুমে গাদাগাদি করে এত মানুষ! তার সঙ্গে হারমোনিয়ামসহ নানা বাদ্যযন্ত্র। মামা এইচএমভির এক কর্মকর্তার মাধ্যমে কবিকে জানালেন যে আমার গান শোনাতে নিয়ে এসেছেন। শুনে কাজী নজরুল ইসলাম হো হো করে হেসে উঠলেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাহ্, বেশ তো। তা কী গান শোনাবে আমাদের?’
আমি তাঁর কথার উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর অনেকটা বিরক্তি নিয়েই গান ধরলাম,
—‘যদি পরানে না জাগে আকুল পিয়াসা
শুধু চোখে দেখা দিতে এস না’
গানটি খুবই কঠিন। গান শেষ করেই উঠে দাঁড়ালাম, বাইরে চলে আসব। আমাকে কাজী নজরুল ইসলাম হাত টেনে ধরে বসালেন। বললেন, ‘ওরে সর্বনাশ! এ কী গান শোনালে তুমি। এতটুকু মেয়ে এ গান কীভাবে, কোথা থেকে শিখলে?’
একটু চুপ থেকে তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, আমার কয়েকটা কথার জবাব দেবে তুমি?’
মাথা নেড়ে বললাম দেব। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ গান তুমি কোথা থেকে শিখেছ? কার কাছ থেকে?’
আমি বললাম, ‘কারও কাছ থেকে নয়। বাড়িতে কালো মোটা ভাঙা ভাঙা রেকর্ডগুলো আছে না, ওইগুলো শুনে শুনেই শিখেছি।’
আমার এমন বোকার মতো উত্তর শুনে উনি আবার হো হো করে অট্টহাসি দিয়ে উঠলেন, আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম।
যা-ই হোক, আমার মা-বাবা, বাড়ি কোথায় ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলেন। উত্তর দিলাম। এরপর বললেন, ‘এত কঠিন গান তুমি একা একা তুলেছ। বলো কী, এত মিষ্টি কণ্ঠে মাত্র একটা গান শুনে কি ছাড়া যায়? আমরা কি আরেকটা শুনতে পারি না?’
তাঁর কথায় আমার প্রচণ্ড অস্বস্তি আর বিরক্তি লাগছিল। মাথা নেড়ে বললাম, ‘না।’
কাজী নজরুল ইসলাম বললেন, ‘তুমি হারমোনিয়াম বাজাতে পারো?’
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ।’
তিনি বললেন, ‘বলে কী? সেটাও কি নিজে নিজে শিখেছ?’
আবারও মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললাম।
তিনি বললেন, ‘একটা রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে নিজে নিজে এত সুন্দর গান শিখে ফেলেছে। এত দিন গান করছি, এ রকম প্রতিভা তো এর আগে পাইনি।’ তিনি আবারও বললেন, ‘তুমি আরেকটা গান শোনাও।’ একটা হারমোনিয়াম নিজেই টেনে আমার সামনে দিলেন। আমি খানিকটা বাজানোর পর দেখি একটা রিড উঠলে দূরের আরেকটা উঠে যায়। (পরে জেনেছি, ওটা ছিল স্কেল চেঞ্জার হারমোনিয়াম) আমি বললাম, এই হারমোনিয়াম বাজাব না। এটার আওয়াজ কেমন ভাঙা ভাঙা। আমাদের হারমোনিয়ামটা ভালো। একথা শুনে উনি আরও জোরে হেসে উঠলেন। আমার অস্বস্তিও আরও বেড়ে গেল। বললেন, ‘এ কী দেখছি! এ মেয়ে তো সবই বোঝে। এই কেউ যাও তো। কমলকে (কমল দাশগুপ্ত, পরে যাঁর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়) ডেকে আনো। এ মেয়ের গান ওর শোনা উচিত।’ তাঁর কথা শুনে কেউ একজন বেরিয়ে গেল। একটু পরই বেশ সুদর্শন একজন পুরুষ এলেন। বয়স ২২ কি ২৩। কাজী নজরুল ইসলাম বললেন, ‘কমল, আমরা এই বাচ্চা মেয়ের গান শুনে তো হতবাক হয়ে গেছি। তুমিও একটু শুনে দেখো।’ আমি দ্বিতীয় গান ধরলাম, ‘কালো পাখিটা মোরে কেন করে এত জ্বালাতন।’—ডিএল রায়ের গান এটি। গানটার মধ্যে সূক্ষ্ম কারুকাজ ছিল। ১০-১১ বছরের একটা মেয়ের গলায় ওই গান ওঠার কথা নয়। কখনো হালকা, কখনো ভারী কারুকাজ, ওঠা-নামা।
গানটি অর্ধেক গেয়ে আমার আর গাইতে ইচ্ছে করল না। বললাম, ‘আমি আর গাইতে পারব না।’
কাজী নজরুল ইসলাম বললেন, ‘ঠিক আছে, যা গেয়েছ তাতেই আমরা অবাক। তবে বলে যাও, আবার আমাকে গান শোনাতে আসবে।’
আমি মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললাম। এরপর ওখান থেকে বাইরে এলাম।
ওই ঘর থেকে বের হওয়ার পর আমার দুই চোখ ফেটে পানি ঝরছে। মামা-ভাইয়েরা কেন এখানে নিয়ে এলেন—এই অভিমানে। মামা আমার অবস্থা দেখে বললেন, ‘তুই যে বিরক্ত হচ্ছিস, তুই কি জানিস কার সামনে আজ গান করেছিস? ওই যে তোকে ডেকে পাশে বসালেন, তাঁর নাম হচ্ছে কাজী নজরুল ইসলাম।’
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, কোন কাজী নজরুল ইসলাম? ‘বল বীর’? (বাবার মুখে ‘বল বীর’ কবিতাটা অনেকবার শুনেছিলাম। ওই কবিতা দিয়েই কবির নামটি আমার কাছে পরিচিত।) পরে শুনেছিলাম, সেদিন আমি চলে আসার পর কাজী সাহেব মহড়াকক্ষে সবার উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘এই মেয়ে গান না শিখেই এত ভালো গায়। শেখালে না জানি কী গাইবে। আমি হয়তো সেদিন থাকব না, কিন্তু তোমরা দেখে নিয়ো, এই মেয়ে অনেক ভালো শিল্পী হবে। এই মেয়েকে গানের ব্যাপারে যা যা সাহায্য করতে হয় তোমরা করো।’
কবি সুস্থ থাকা অবস্থায় এর পরও তাঁর সঙ্গে পাঁচ-ছয়বার দেখা হয়েছে।
১৯৪২-এর ডিসেম্বরে এইচএমভি থেকে আমার প্রথম রেকর্ড বের হয়। মানে কবির কাছে যাওয়ার এক বছর পর। সেভেন্টি এইটে (78 rpm) বের হলো আমার প্রথম রেকর্ড। একদিকে ছিল ‘মোর আঁখিপাতে’, আরেক দিকে ‘মরুর বুকে জীবনধারা কে বহাল’। তখন আমার কতই বা বয়স, ১২-১৩ বছর হবে। কলকাতার কাগজগুলোতে আমাকে নিয়ে লেখা হলো ‘মরুর বুকে জীবনধারা কে বহাল’ সেটা আমরা জানি।
কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম অল্পের জন্য আমার রেকর্ড শুনতে পাননি। কারণ এর মাত্র মাস কয়েক আগেই উনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর একের পর এক রেকর্ড বের হতে লাগল। আধুনিক গান, রবীন্দ্রসংগীত, গীত, গজল, ভজন—সবকিছু করছি। তিনি অসুস্থ হওয়ার ১৮ বছর পর স্বরলিপির কাজে আমি হাত দিই। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আমি কলকাতায় ছিলাম, এর মধ্যে স্বরলিপির তিন তিনটি বই করে আমি কলকাতা থেকে বাংলা একাডেমীতে পাঠাই। কলকাতা থেকে শ্যামাসংগীতের স্বরলিপির বইও বের হলো।
অসুস্থ হওয়ার পরও কবিকে প্রায়ই দেখতে যেতাম। এটা আমার আর কমলের নিয়মিত কাজ ছিল। কমল বলত, ‘কি কাজীদা, চিনতে পারছেন। একসঙ্গে কত গান করলাম।’ তিনি কোনো উত্তর দিতেন না। তাঁর প্রতিটি জন্মদিনে আমরা যেতাম। মনে পড়ে, ‘দৃৃষ্টিতে আর হয় না সৃষ্টি আগের মতো গোলাপ ফুল’—নজরুলের অসাধারণ এই গানটা শুধু আমিই করেছি। কাজী নজরুল ইসলাম তখন অসুস্থ। এই গানটি তখন তাঁকে শুনিয়েছিলাম।
No comments