হরতাল নয়, উন্নয়ন অনুকূল কর্মসূচি চাই by মোহাম্মদ কায়কোবাদ
বেশ কিছুদিন আগে একটি জরিপের ফলাফল জেনে বুক এক বিঘত বেড়ে গিয়েছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী নাকি বাংলাদেশের মানুষ। যে দেশের মানুষকে রাজধানীতে কিংবা যেকোনো রাজপথে যানজটে সেদ্ধ হতে হয় সময়ে-অসময়ে, সড়কপথে কিংবা নৌপথের দুর্ঘটনা যেখানে নিয়মিত অতিথি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে কথা বলতে পরম আশাবাদী মানুষও যেখানে ঢেকুর গিলবেন, ভেজালবিহীন খাদ্য যে দেশে সোনার হরিণ, তার নাগরিকেরা সারা বিশ্বে সবচেয়ে সুখী! তাহলে কি সাধারণ মানুষ ধরেই নিয়েছে যে তাদের কপালে তো আরও খারাপ কিছুই থাকার কথা ছিল?
আমরা আশাবাদী, আমাদের রাজনীতিবিদেরা আরও আশাবাদী। যে সংসারে আয় থেকে ব্যয় বেশি, সেই সংসার কি কোনো বুদ্ধিমান মানুষ চালাতে চায়? অনেক চাহিদার অল্প আয়ের সংসার কেউ চালাতে না চাইলেও পৃথিবীর গড়ের ২৪ গুণ বেশি জনঘনত্বের দেশে, সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের দেশে, নিয়মিত অতিথি ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের দেশে যেকোনো রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় যেতে চায়, দেশ চালাতে চায়। একটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সীমিত সম্পদ নিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ের প্রকাশকে প্রশংসা না করে পারা যায় না। শুধু তাই-ই নয়, ধ্বংসাত্মক জবরদস্তি হরতালের মাধ্যমে দেশকে অধিকতর দরিদ্র করেও তার নেতৃত্বে আসতে সদা প্রস্তুত আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো। সেনাশাসন, স্বৈরশাসন শেষে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত গণতান্ত্রিক শাসন পরমতসহিষ্ণুতার অভাবে একটি সরু রাস্তায় চলছে। সামান্য বিচ্যুতিতেই যেকোনো মুহূর্তে আমাদের গণতন্ত্রের পথচলা শেষ হয়ে যেতে পারে।
আমরা যত আশাবাদীই হই না কেন, মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার ঢাক যত জোরেই বাজাই না কেন, সম্প্রতি প্রকাশিত অধিকাংশ অর্থনৈতিক সূচকে বিশ্বসভায় আমাদের অবস্থান যারপরনাই দুর্বল। এমনকি সূচকের হর ও লব পরস্পরের স্থানে প্রতিস্থাপিত হলেও আমাদের অবস্থান সম্মানজনক হয় না। বেশ কয়েক বছর আগে একটি ইংরেজি ম্যাগাজিনে লেখা দেখেছিলাম, নেপাল বাংলাদেশের চেয়েও দরিদ্রতর। তাহলে কি আমরা দারিদ্র্যের মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছি?
গণ-আন্দোলনের সাফল্যের পর দুই দশক ধরে গণতন্ত্রের পতাকাবাহী রাজনৈতিক দলগুলো থেকে ধ্বংসাত্মক হরতাল দেখছি। প্রতিটি সরকারই হিসাব দিচ্ছে প্রতিটি হরতালে দেশের ৩০০ কি ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। বিগত দুই দশকের অভিজ্ঞতা হলো, সাধারণ জনগণ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। নিশ্চয়ই প্রতিটি ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি এড়ায়নি এই নির্মম সত্যটি! গণতন্ত্রকামী জনগণ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোকে পরের বার ক্ষমতায় দেখতে চায় না। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আজ যারা হরতাল করছে, আগামী দিনে তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে। শুধু তাই-ই নয়, তাদের ডাকা প্রতিটি হরতালের জন্য ৫০০ কোটি টাকার সমান অধিকতর দরিদ্র বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার সৌভাগ্য তাদের হবে। তাহলে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের আগে যদি ৫০টি হরতাল ডাকতে হয়, তাহলে শুধু হরতালের কারণে প্রত্যেক নাগরিকের গড় আয় আড়াই হাজার টাকা কমে আসবে, অর্থাৎ গড়ে দুই মাস খাদ্যবঞ্চিত থাকায় অর্থনৈতিক যোগ্যতাসম্পন্ন নাগরিকদের ভাগ্য পরিবর্তনের দুরূহ দায়িত্ব তাদের পালন করতে হবে।
এ ছাড়া বিগত দুই দশকে একইভাবে হরতাল পালন করে সাধারণ মানুষের মধ্যেও একঘেয়েমি চলে এসেছে। নতুন সংস্কৃতির প্রয়োজন, নতুন ধারার প্রয়োজন, যা সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করতে পারে। তা ছাড়া হরতাল পালনকারী দলই যখন পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে, হরতালের মাধ্যমে দুর্বল অর্থনীতির দেশকে পরিচালিত করাও একটি কঠিন দায়িত্ব হবে। সুতরাং, নিজের কাজটি কঠিনতর করার মতো বোকামি করাটাও ঠিক হবে না। এ অবস্থায় নতুন সংস্কৃতির সূচনা দরকার, যার দু-একটি প্রস্তাব নিচে দেওয়া হলো—
১. হরতালে গাড়ি কিংবা সরকারি সম্পত্তি অথবা বেসরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করলে হরতালকারীদেরও একটি দরিদ্রতর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে হবে বলে এই ধ্বংসাত্মক কর্মসূচিগুলো পরিহার করা।
২. হরতালের দিন সাধারণ মানুষ যদি কাজ করতে না পারে, তাহলে বাংলাদেশ ৫০০-৬০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ দরিদ্র হবে। তাই সাধারণ মানুষকে কাজ করার স্বাধীনতা দিতে হবে, যাতে দরিদ্রতর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে না হয়।
৩. তবে হরতাল পালনকারী ক্ষুব্ধ রাজনৈতিক দলগুলোর নিবেদিতপ্রাণ নেতা ও কর্মীরা মাতৃভাষা দিবসের ন্যায়, তবে শান্তিপূর্ণভাবে যানবাহন ও যাত্রীদের গমনাগমনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে জাতীয় সংসদ ভবনের মতো উল্লেখযোগ্য স্থানে সারা দিন অনশন পালনসহ অন্যান্য উন্নয়ন অনুকূল কর্মকাণ্ড করে তাদের ক্ষোভের মাত্রা প্রকাশ করতে পারে, যা আমাদের দেশের নানা চ্যানেলের মাধ্যমে প্রচারিত হয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে হরতাল পালনকারী দলগুলোর নির্লোভ, নির্মোহ, নিবেদিতপ্রাণ মানুষের ভাবমূর্তি তৈরি করবে।
৪. জনশ্রুতি আছে, লেনিনের শাসনামলে কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা লেনিনের জন্মদিন পালন করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। লেনিন শুধু তাঁর সম্মতিই দেননি, সঙ্গে বলেছেন, তাঁর জন্মদিনের কাছাকাছি ছুটির দিন শনিবার এলাকায় পার্ক ও রাস্তা পরিষ্কার করে তাঁর জন্মদিন পালন করতে। শাসকগোষ্ঠীর অনাচারে ক্ষুব্ধ হরতালকারী দলগুলোর নেতা ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরাও অনুরূপ কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। শুধু তাই-ই নয়, সরকারি দলও অনুরূপ কর্মসূচি পালন করে সাধারণ জনগণের প্রশংসা ও আস্থা অর্জন করতে পারে।
৫. অন্যের সম্পদ অনিষ্ট করে কোনো বিবেকবান মানুষেরই ক্ষোভ প্রকাশের ভাষা হতে পারে না। ছোটবেলায় ছেলেমেয়েরা না খেয়ে মা-বাবা কিংবা মুরব্বিদের তাদের ক্ষোভের কথা জানায়, অথবা কোনো সুযোগ-সুবিধা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে তার ক্ষোভের যোগ্য বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এমন নির্লোভ, নিষ্পাপ কর্মকাণ্ডের সূচনা হওয়া প্রয়োজন।
৬. এ ছাড়া নানা উপলক্ষে যেমন নেতাদের জন্মদিনে কিংবা মৃত্যুবার্ষিকীতে রাস্তাঘাট পরিষ্কার, মেরামত, বনায়ন কর্মসূচিসহ নানা সামাজিক তৎপরতার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব কিংবা নিবেদিতপ্রাণ কর্মী বাহিনী এ রকম উন্নয়ন অনুকূল সংস্কৃতি চালু করলে সাধারণ মানুষ নিঃসন্দেহে দ্রুতই এমন উদ্যোগে শামিল হবে।
মোটের ওপর যে রাজনৈতিক দলই এমন উন্নয়ন অনুকূল সংস্কৃতির সূচনা করবে, সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ রায় তাদেরই পক্ষে যাবে। কী অসাধারণই না হবে, যখন সরকারি দল এবং বিরোধী দল উভয়েই সাধারণ মানুষকে উন্নয়ন অনুকূল সংস্কৃতিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তাদের সব উদ্ভাবনীশক্তি ব্যবহার করবে।
প্রতিটি সরকারের শাসনকালের পর অনিশ্চয়তায় নিজেদের না ভাসিয়ে, অধিকতর সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিতে যদি নানা রাজনৈতিক দলের মধ্যে উন্নয়ন অনুকূল সংস্কৃতির সূচনার প্রতিযোগিতা হয়, তাহলে নিশ্চয়ই পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম জনবহুল দেশের পক্ষে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়াটা শুধু সময়ের ব্যাপার। সেই প্রত্যাশায় আমরা সাধারণ জনগণ বুক বেঁধে রইলাম।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
আমরা আশাবাদী, আমাদের রাজনীতিবিদেরা আরও আশাবাদী। যে সংসারে আয় থেকে ব্যয় বেশি, সেই সংসার কি কোনো বুদ্ধিমান মানুষ চালাতে চায়? অনেক চাহিদার অল্প আয়ের সংসার কেউ চালাতে না চাইলেও পৃথিবীর গড়ের ২৪ গুণ বেশি জনঘনত্বের দেশে, সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের দেশে, নিয়মিত অতিথি ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের দেশে যেকোনো রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় যেতে চায়, দেশ চালাতে চায়। একটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সীমিত সম্পদ নিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ের প্রকাশকে প্রশংসা না করে পারা যায় না। শুধু তাই-ই নয়, ধ্বংসাত্মক জবরদস্তি হরতালের মাধ্যমে দেশকে অধিকতর দরিদ্র করেও তার নেতৃত্বে আসতে সদা প্রস্তুত আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো। সেনাশাসন, স্বৈরশাসন শেষে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত গণতান্ত্রিক শাসন পরমতসহিষ্ণুতার অভাবে একটি সরু রাস্তায় চলছে। সামান্য বিচ্যুতিতেই যেকোনো মুহূর্তে আমাদের গণতন্ত্রের পথচলা শেষ হয়ে যেতে পারে।
আমরা যত আশাবাদীই হই না কেন, মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার ঢাক যত জোরেই বাজাই না কেন, সম্প্রতি প্রকাশিত অধিকাংশ অর্থনৈতিক সূচকে বিশ্বসভায় আমাদের অবস্থান যারপরনাই দুর্বল। এমনকি সূচকের হর ও লব পরস্পরের স্থানে প্রতিস্থাপিত হলেও আমাদের অবস্থান সম্মানজনক হয় না। বেশ কয়েক বছর আগে একটি ইংরেজি ম্যাগাজিনে লেখা দেখেছিলাম, নেপাল বাংলাদেশের চেয়েও দরিদ্রতর। তাহলে কি আমরা দারিদ্র্যের মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছি?
গণ-আন্দোলনের সাফল্যের পর দুই দশক ধরে গণতন্ত্রের পতাকাবাহী রাজনৈতিক দলগুলো থেকে ধ্বংসাত্মক হরতাল দেখছি। প্রতিটি সরকারই হিসাব দিচ্ছে প্রতিটি হরতালে দেশের ৩০০ কি ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। বিগত দুই দশকের অভিজ্ঞতা হলো, সাধারণ জনগণ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। নিশ্চয়ই প্রতিটি ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি এড়ায়নি এই নির্মম সত্যটি! গণতন্ত্রকামী জনগণ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোকে পরের বার ক্ষমতায় দেখতে চায় না। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আজ যারা হরতাল করছে, আগামী দিনে তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে। শুধু তাই-ই নয়, তাদের ডাকা প্রতিটি হরতালের জন্য ৫০০ কোটি টাকার সমান অধিকতর দরিদ্র বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার সৌভাগ্য তাদের হবে। তাহলে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের আগে যদি ৫০টি হরতাল ডাকতে হয়, তাহলে শুধু হরতালের কারণে প্রত্যেক নাগরিকের গড় আয় আড়াই হাজার টাকা কমে আসবে, অর্থাৎ গড়ে দুই মাস খাদ্যবঞ্চিত থাকায় অর্থনৈতিক যোগ্যতাসম্পন্ন নাগরিকদের ভাগ্য পরিবর্তনের দুরূহ দায়িত্ব তাদের পালন করতে হবে।
এ ছাড়া বিগত দুই দশকে একইভাবে হরতাল পালন করে সাধারণ মানুষের মধ্যেও একঘেয়েমি চলে এসেছে। নতুন সংস্কৃতির প্রয়োজন, নতুন ধারার প্রয়োজন, যা সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করতে পারে। তা ছাড়া হরতাল পালনকারী দলই যখন পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে, হরতালের মাধ্যমে দুর্বল অর্থনীতির দেশকে পরিচালিত করাও একটি কঠিন দায়িত্ব হবে। সুতরাং, নিজের কাজটি কঠিনতর করার মতো বোকামি করাটাও ঠিক হবে না। এ অবস্থায় নতুন সংস্কৃতির সূচনা দরকার, যার দু-একটি প্রস্তাব নিচে দেওয়া হলো—
১. হরতালে গাড়ি কিংবা সরকারি সম্পত্তি অথবা বেসরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করলে হরতালকারীদেরও একটি দরিদ্রতর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে হবে বলে এই ধ্বংসাত্মক কর্মসূচিগুলো পরিহার করা।
২. হরতালের দিন সাধারণ মানুষ যদি কাজ করতে না পারে, তাহলে বাংলাদেশ ৫০০-৬০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ দরিদ্র হবে। তাই সাধারণ মানুষকে কাজ করার স্বাধীনতা দিতে হবে, যাতে দরিদ্রতর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে না হয়।
৩. তবে হরতাল পালনকারী ক্ষুব্ধ রাজনৈতিক দলগুলোর নিবেদিতপ্রাণ নেতা ও কর্মীরা মাতৃভাষা দিবসের ন্যায়, তবে শান্তিপূর্ণভাবে যানবাহন ও যাত্রীদের গমনাগমনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে জাতীয় সংসদ ভবনের মতো উল্লেখযোগ্য স্থানে সারা দিন অনশন পালনসহ অন্যান্য উন্নয়ন অনুকূল কর্মকাণ্ড করে তাদের ক্ষোভের মাত্রা প্রকাশ করতে পারে, যা আমাদের দেশের নানা চ্যানেলের মাধ্যমে প্রচারিত হয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে হরতাল পালনকারী দলগুলোর নির্লোভ, নির্মোহ, নিবেদিতপ্রাণ মানুষের ভাবমূর্তি তৈরি করবে।
৪. জনশ্রুতি আছে, লেনিনের শাসনামলে কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা লেনিনের জন্মদিন পালন করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। লেনিন শুধু তাঁর সম্মতিই দেননি, সঙ্গে বলেছেন, তাঁর জন্মদিনের কাছাকাছি ছুটির দিন শনিবার এলাকায় পার্ক ও রাস্তা পরিষ্কার করে তাঁর জন্মদিন পালন করতে। শাসকগোষ্ঠীর অনাচারে ক্ষুব্ধ হরতালকারী দলগুলোর নেতা ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরাও অনুরূপ কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। শুধু তাই-ই নয়, সরকারি দলও অনুরূপ কর্মসূচি পালন করে সাধারণ জনগণের প্রশংসা ও আস্থা অর্জন করতে পারে।
৫. অন্যের সম্পদ অনিষ্ট করে কোনো বিবেকবান মানুষেরই ক্ষোভ প্রকাশের ভাষা হতে পারে না। ছোটবেলায় ছেলেমেয়েরা না খেয়ে মা-বাবা কিংবা মুরব্বিদের তাদের ক্ষোভের কথা জানায়, অথবা কোনো সুযোগ-সুবিধা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে তার ক্ষোভের যোগ্য বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এমন নির্লোভ, নিষ্পাপ কর্মকাণ্ডের সূচনা হওয়া প্রয়োজন।
৬. এ ছাড়া নানা উপলক্ষে যেমন নেতাদের জন্মদিনে কিংবা মৃত্যুবার্ষিকীতে রাস্তাঘাট পরিষ্কার, মেরামত, বনায়ন কর্মসূচিসহ নানা সামাজিক তৎপরতার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব কিংবা নিবেদিতপ্রাণ কর্মী বাহিনী এ রকম উন্নয়ন অনুকূল সংস্কৃতি চালু করলে সাধারণ মানুষ নিঃসন্দেহে দ্রুতই এমন উদ্যোগে শামিল হবে।
মোটের ওপর যে রাজনৈতিক দলই এমন উন্নয়ন অনুকূল সংস্কৃতির সূচনা করবে, সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ রায় তাদেরই পক্ষে যাবে। কী অসাধারণই না হবে, যখন সরকারি দল এবং বিরোধী দল উভয়েই সাধারণ মানুষকে উন্নয়ন অনুকূল সংস্কৃতিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তাদের সব উদ্ভাবনীশক্তি ব্যবহার করবে।
প্রতিটি সরকারের শাসনকালের পর অনিশ্চয়তায় নিজেদের না ভাসিয়ে, অধিকতর সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিতে যদি নানা রাজনৈতিক দলের মধ্যে উন্নয়ন অনুকূল সংস্কৃতির সূচনার প্রতিযোগিতা হয়, তাহলে নিশ্চয়ই পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম জনবহুল দেশের পক্ষে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়াটা শুধু সময়ের ব্যাপার। সেই প্রত্যাশায় আমরা সাধারণ জনগণ বুক বেঁধে রইলাম।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
No comments