স্বপ্নের সলিলসমাধি
নাদিমুজ্জামান প্রায়ই বলতেন, তিনি দেশে ফিরবেন। স্বপ্ন দেখতেন দেশের জন্য কাজ করবেন। কিন্তু তাঁর সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। দিন কয়েক আগে মেক্সিকো উপসাগরে আঘাত হানল হারিকেন ন্যাট (hurrican nate)। আর সে আঘাত চিরস্থায়ী যবনিকা টেনে দিল নাদিমের জীবনে।
নাদিম এই বছর খানেক আগের এক উজ্জ্বল বিকেলে শুনেছিলেন ততোধিক উজ্জ্বল এক সংবাদ। তিনি কানাডার দুর্লভ নাগরিকত্ব লাভ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী কোম্পানি জিওকাইনেটিকসের চাকরিটা পাকাপোক্ত হয়েছে বেশ আগেই; এবার পরিবার-পরিজন নিয়ে থিতু হওয়ার বিষয়টাও পোক্ত হলো সরকারিভাবে। চোখের সামনে এখন শুধুই বিলাসী জীবনের হাতছানি। কিন্তু নাদিমের মুখ হাসিহীন। তাঁর ছোট ভাই মামুন জানালেন, কানাডার নাগরিকত্ব পাওয়ার পর তিনি নাকি ম্লান মুখে স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘আমি আমার শেখা বিদ্যা কি সারা জীবন এই বিদেশের মাটিতেই বিলি করব? না, সুলতানা, আমাকে আর কয়েকটা বছর সময় দাও। নিজেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করেই তবে দেশে ফিরব। আর বিশ্বকে জানাব, আমার দেশের মাটির গভীরে রয়েছে কী অমূল্য রত্নভান্ডার!’
সেই মোতাবেকই চলছিল সময়যাপন। জিওকাইনেটিকসের সাইসমিক (seismic) বিশেষজ্ঞ হয়ে লিবিয়া, মরক্কো, ওমান, সিরিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, নাইজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশের মাটির গভীরে খোঁজ করে বেড়াচ্ছিলেন তেল ও গ্যাস। বাড়াচ্ছিলেন অভিজ্ঞতার ঝুলি। বাড়াচ্ছিলেন অধিক বিদ্যার বহর। আর আড্ডায়-অবসরে নিত্যই বন্ধুদের স্মরণ করে দিচ্ছিলেন, ‘প্রস্তুত হও, এবার দেশে ফিরতে হবে। নিজের দেশের মাটির তলায় কত তেল-গ্যাস-কয়লা-হীরা থাকাও অসম্ভব কিছু না—সেসব খুঁজে বের করতে হবে না!’ স্মৃতি থেকে জানালেন তাঁর কাছের এক বন্ধু শামীম। তিনি আরও জানালেন, বন্ধুরা তাঁর কথায় তখন মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেন। বুকের ভেতর এক টুকরো বাংলাদেশ পুষে রেখে তাঁরা দিবস-রজনী কাজ করতেন বিভুঁইয়ের মাটিতে।
অতঃপর একদিন। ৮ সেপ্টেম্বর ২০১১। ১০ সদস্যের এক দলকে জিওকাইটেনিকস পাঠিয়েছে মেক্সিকোর ভূমধ্যসাগরে সাইসমিক সার্ভে কাজের জন্য। সেই দলে একমাত্র বাংলাদেশি ভূতত্ত্ববিদ হিসেবে আছেন নাদিমুজ্জামান খানও।
সেদিন সকাল থেকেই প্রকৃতি ছিল বৈরী। চারজন মার্কিন, চারজন মেক্সিকান আর একজন অস্ট্রেলিয়ান গবেষকের সঙ্গে নাদিম তখন বে অব ক্যাম্পেচে থেকে ৮২ কিলোমিটার দূরে গভীর সমুদ্রে কর্তব্যরত। এদিকে বারবার রেডিও-টেলিভিশনে জানানো হচ্ছিল, ধেয়ে আসছে হারিকেন ন্যাট। নাদিম ও তাঁর সঙ্গীরা ভাবলেন, জিওকাইনেটিকসের পক্ষ থেকে নিশ্চয় তাঁদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, অথবা তাঁদের করণীয় কোনো নির্দেশনা নিশ্চয় আসবে। কিন্তু সময়মতো কিছুই এল না তাঁদের কাছে। না নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাওয়ার বার্তা, না ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস। তাঁদের জাহাজ পড়ল প্রলয়ংকরী ঝড়ের মুখে। ৫০-৬০ ফুট উঁচু উঁচু ঢেউয়ের তোড়ে সবাই হারিয়ে গেলেন মুহূর্তের মধ্যেই।
তার পরের গল্প নাদিমুজ্জামানের স্বজনদের মুখ থেকে: ‘তিন দিন পর ১২ সেপ্টেম্বর ভোর সাড়ে চারটায় জিওকাইনেটিকস ই-মেইলে আমাদের জানাল, নাদিমকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি মেক্সিকোর একটি হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। সেদিনই সকাল সাড়ে আটটায় জিওকাইনেটিকস আরও একটি মেইল করল, নাদিম খান আর নেই...।’ বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলছিলেন নাদিমের বড় ভাই মনিরুজ্জামান খান।
সত্যিই কি নাদিম নেই? তাঁরা বিশ্বাস করতে চান না। ছবির অ্যালবাম বের করে দেখান নাদিমের ছবি। এই তো নাদিম! চার ভাই এক বোনের মাঝে মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন। মুঠোফোনে ভিডিও ক্লিপিং বের করে দেখান। সেখানে নাদিম তাঁর সহকর্মীদের প্রকল্প বুঝিয়ে দিচ্ছেন। নাদিম আছেন ছবিতে, ভিডিওতে, মনের রোদজ্বলা উঠোনে, স্মৃতির বারান্দায়। নাদিম কেবল নেই সশরীরে। নাদিম আর কখনো গাইবেন না রবি ঠাকুরের গান। প্রিয় গিটারের তারে বোলাবেন না আঙুলের পরশ। মাত্র ৪০ বছর বয়সেই জীবন থেকে ‘নেই’ হয়ে গেলেন বাংলাদেশের এক সম্ভাবনাময় ভূতত্ত্ববিদ নাদিমুজ্জামান খান।
এখন নাদিমের মৃতদেহ বুঝে নেওয়ার অপেক্ষায় আছেন নাদিমের স্বজনেরা। ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এসে পৌঁছাবে তাঁর শবদেহ। স্ত্রী সুলতানা খান বয়ে আনবেন এত দিনের জীবনসঙ্গীর লাশ। তারপর চিরতরে ঠাঁই নেবেন মাটির ঘরে।
তার পরও নাদিম খান স্মৃতি হয়েই বেঁচে থাকবেন স্ত্রী, দুই শিশুসন্তান মাঈশা ও নেহার জীবনে। নাদিম তবু বেঁচে থাকবেন বৃদ্ধা মায়ের প্রতিটি অশ্রুবিন্দুতে। আর নাদিমের অসম্পূর্ণ স্বপ্ন বুনে যাবেন তাঁর ভূতত্ত্ববিদ বন্ধুরা, যাঁরা একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠ নিয়েছিলেন ভূতত্ত্বের। তারপর ছড়িয়ে পড়েছেন কর্মের প্রয়োজনে বিশ্বের নানা প্রান্তরে। তাঁদের কানে যে এখনো বাজছে নাদিমের এই দরাজ আহ্বান: ‘চলো বন্ধু, দেশে ফিরে যাই; দেশের জন্য কিছু করি।’
মারুফ ইসলাম
নাদিম এই বছর খানেক আগের এক উজ্জ্বল বিকেলে শুনেছিলেন ততোধিক উজ্জ্বল এক সংবাদ। তিনি কানাডার দুর্লভ নাগরিকত্ব লাভ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী কোম্পানি জিওকাইনেটিকসের চাকরিটা পাকাপোক্ত হয়েছে বেশ আগেই; এবার পরিবার-পরিজন নিয়ে থিতু হওয়ার বিষয়টাও পোক্ত হলো সরকারিভাবে। চোখের সামনে এখন শুধুই বিলাসী জীবনের হাতছানি। কিন্তু নাদিমের মুখ হাসিহীন। তাঁর ছোট ভাই মামুন জানালেন, কানাডার নাগরিকত্ব পাওয়ার পর তিনি নাকি ম্লান মুখে স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘আমি আমার শেখা বিদ্যা কি সারা জীবন এই বিদেশের মাটিতেই বিলি করব? না, সুলতানা, আমাকে আর কয়েকটা বছর সময় দাও। নিজেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করেই তবে দেশে ফিরব। আর বিশ্বকে জানাব, আমার দেশের মাটির গভীরে রয়েছে কী অমূল্য রত্নভান্ডার!’
সেই মোতাবেকই চলছিল সময়যাপন। জিওকাইনেটিকসের সাইসমিক (seismic) বিশেষজ্ঞ হয়ে লিবিয়া, মরক্কো, ওমান, সিরিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, নাইজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশের মাটির গভীরে খোঁজ করে বেড়াচ্ছিলেন তেল ও গ্যাস। বাড়াচ্ছিলেন অভিজ্ঞতার ঝুলি। বাড়াচ্ছিলেন অধিক বিদ্যার বহর। আর আড্ডায়-অবসরে নিত্যই বন্ধুদের স্মরণ করে দিচ্ছিলেন, ‘প্রস্তুত হও, এবার দেশে ফিরতে হবে। নিজের দেশের মাটির তলায় কত তেল-গ্যাস-কয়লা-হীরা থাকাও অসম্ভব কিছু না—সেসব খুঁজে বের করতে হবে না!’ স্মৃতি থেকে জানালেন তাঁর কাছের এক বন্ধু শামীম। তিনি আরও জানালেন, বন্ধুরা তাঁর কথায় তখন মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেন। বুকের ভেতর এক টুকরো বাংলাদেশ পুষে রেখে তাঁরা দিবস-রজনী কাজ করতেন বিভুঁইয়ের মাটিতে।
অতঃপর একদিন। ৮ সেপ্টেম্বর ২০১১। ১০ সদস্যের এক দলকে জিওকাইটেনিকস পাঠিয়েছে মেক্সিকোর ভূমধ্যসাগরে সাইসমিক সার্ভে কাজের জন্য। সেই দলে একমাত্র বাংলাদেশি ভূতত্ত্ববিদ হিসেবে আছেন নাদিমুজ্জামান খানও।
সেদিন সকাল থেকেই প্রকৃতি ছিল বৈরী। চারজন মার্কিন, চারজন মেক্সিকান আর একজন অস্ট্রেলিয়ান গবেষকের সঙ্গে নাদিম তখন বে অব ক্যাম্পেচে থেকে ৮২ কিলোমিটার দূরে গভীর সমুদ্রে কর্তব্যরত। এদিকে বারবার রেডিও-টেলিভিশনে জানানো হচ্ছিল, ধেয়ে আসছে হারিকেন ন্যাট। নাদিম ও তাঁর সঙ্গীরা ভাবলেন, জিওকাইনেটিকসের পক্ষ থেকে নিশ্চয় তাঁদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, অথবা তাঁদের করণীয় কোনো নির্দেশনা নিশ্চয় আসবে। কিন্তু সময়মতো কিছুই এল না তাঁদের কাছে। না নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাওয়ার বার্তা, না ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস। তাঁদের জাহাজ পড়ল প্রলয়ংকরী ঝড়ের মুখে। ৫০-৬০ ফুট উঁচু উঁচু ঢেউয়ের তোড়ে সবাই হারিয়ে গেলেন মুহূর্তের মধ্যেই।
তার পরের গল্প নাদিমুজ্জামানের স্বজনদের মুখ থেকে: ‘তিন দিন পর ১২ সেপ্টেম্বর ভোর সাড়ে চারটায় জিওকাইনেটিকস ই-মেইলে আমাদের জানাল, নাদিমকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি মেক্সিকোর একটি হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। সেদিনই সকাল সাড়ে আটটায় জিওকাইনেটিকস আরও একটি মেইল করল, নাদিম খান আর নেই...।’ বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলছিলেন নাদিমের বড় ভাই মনিরুজ্জামান খান।
সত্যিই কি নাদিম নেই? তাঁরা বিশ্বাস করতে চান না। ছবির অ্যালবাম বের করে দেখান নাদিমের ছবি। এই তো নাদিম! চার ভাই এক বোনের মাঝে মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন। মুঠোফোনে ভিডিও ক্লিপিং বের করে দেখান। সেখানে নাদিম তাঁর সহকর্মীদের প্রকল্প বুঝিয়ে দিচ্ছেন। নাদিম আছেন ছবিতে, ভিডিওতে, মনের রোদজ্বলা উঠোনে, স্মৃতির বারান্দায়। নাদিম কেবল নেই সশরীরে। নাদিম আর কখনো গাইবেন না রবি ঠাকুরের গান। প্রিয় গিটারের তারে বোলাবেন না আঙুলের পরশ। মাত্র ৪০ বছর বয়সেই জীবন থেকে ‘নেই’ হয়ে গেলেন বাংলাদেশের এক সম্ভাবনাময় ভূতত্ত্ববিদ নাদিমুজ্জামান খান।
এখন নাদিমের মৃতদেহ বুঝে নেওয়ার অপেক্ষায় আছেন নাদিমের স্বজনেরা। ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এসে পৌঁছাবে তাঁর শবদেহ। স্ত্রী সুলতানা খান বয়ে আনবেন এত দিনের জীবনসঙ্গীর লাশ। তারপর চিরতরে ঠাঁই নেবেন মাটির ঘরে।
তার পরও নাদিম খান স্মৃতি হয়েই বেঁচে থাকবেন স্ত্রী, দুই শিশুসন্তান মাঈশা ও নেহার জীবনে। নাদিম তবু বেঁচে থাকবেন বৃদ্ধা মায়ের প্রতিটি অশ্রুবিন্দুতে। আর নাদিমের অসম্পূর্ণ স্বপ্ন বুনে যাবেন তাঁর ভূতত্ত্ববিদ বন্ধুরা, যাঁরা একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠ নিয়েছিলেন ভূতত্ত্বের। তারপর ছড়িয়ে পড়েছেন কর্মের প্রয়োজনে বিশ্বের নানা প্রান্তরে। তাঁদের কানে যে এখনো বাজছে নাদিমের এই দরাজ আহ্বান: ‘চলো বন্ধু, দেশে ফিরে যাই; দেশের জন্য কিছু করি।’
মারুফ ইসলাম
No comments