নজরুলকে আমরা কীভাবে চাই by শান্তনু কায়সার

তাঁর জন্মশতবর্ষের পর আরও এক দশক পার হয়ে এসে এখনো খুব স্বচ্ছভাবে ঠিক করতে পারিনি, নজরুলকে আমরা কীভাবে চাই। কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথায় মুজফ্ফর আহমদ যথার্থই বলেছেন, ‘নজরুলের রচনা পড়লেই চলবে না। আমার মতে, নজরুলকেও অধ্যয়ন করা আবশ্যক।’ কিন্তু সেখানেও সমস্যা। নজরুলের স্মৃতিচিহ্নিত জায়গাগুলো নিয়ে যাঁদের অসম্ভব গর্ব, তাঁরা কবিকে ওই সব জায়গায় আটকে রাখতে চান। ওই আবেগে কবি মাত্র ৩০ বছর বয়সে বাংলার সারস্বত সমাজের পক্ষ থেকে সংবর্ধনালাভের উত্তরে যে বলেছিলেন ‘যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি’—তা ভুলে গিয়ে তাঁকে আমরা আরও সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে চেয়েছি।
অথচ কী ছিলেন নজরুল? একটি অভিভাষণে তিনি যেমন বলেছিলেন, শৈশবে তাঁর কাছে মনে হতো ওই আকাশটা যেন ঝুড়ি আর তিনি যেন পাখির বাচ্চা। তিনি তাই ঝুড়িচাপা হয়ে থাকতে চাননি। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা যিনি লেখেন, তিনি কোনো চমক থেকে তা করতে পারেন না। অনেক দিন ধরে সেই প্রস্তুতি চলে। যে কিশোর ফার্স্টবয়, প্রধানসহ অন্য শিক্ষকেরা যার কাছে অনেক কিছু আশা করেন। যিনি প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষায়ও প্রথম হন, সেই তিনি ‘ভালো’ ফলাফল ও ‘সুন্দর’ ভবিষ্যতের কোনো তোয়াক্কা না করে শিকল পরে শিকল ভাঙার প্রত্যাশায় ঊনপঞ্চাশের বাঙালি পল্টনে যোগ দেন। তাঁরই ভাষায় ইউনিভার্সের কাছে হাত পাতবেন বলে ‘ইউনিভার্সিটি’কে ত্যাগ করেন। ফলে নিজের পরিণত বয়সে শিশু-কিশোরদের বলতে পারেন, চাপরাশির ওই তকমার চেয়ে তলোয়ার বড় মেনো।
অথচ এই কবিকে নিয়েই আমরা কলহ করি, কোথায় তিনি দুটি বিয়ে করেছেন অথবা কোথায় তার কৈশোর কেটেছে বা কোন কোন জায়গায় তাঁর স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। এ যেন রবীন্দ্রনাথের ‘ভক্তিভাজন’ কবিতার ‘পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,/মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী’র অবস্থা।
দুটি বিয়ে নিয়েও তর্কের অন্ত নেই। যে বিয়ে স্ত্রীর মৃত্যু (এর মধ্যে কবি মূক হয়ে গেছেন) পর্যন্ত নানা সুখ-দুঃখের মধ্যে নিজেদের জীবনকে ঋদ্ধ করেছে, তার পরিবর্তে যে বিয়ে শুরুতেই কার্যত ভেঙে যায় সেই বিয়ে এবং তার স্মৃতি নিয়ে কারও কারও অত্যুৎসাহ। একজন প্রবীণ প্রয়াত ব্যক্তি তাঁর নজরুলবিষয়ক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘নজরুলের বিবাহসংক্রান্ত ব্যাপারটি তাঁর জীবনের একটি বড় অভিশাপ’। তিনি মনে করেন, কবি ‘তাঁর স্ত্রীকে মুসলিম স্বামীর মুসলিম স্ত্রীও বানিয়ে নিতে পারতেন।’ তিনি আমাদের আরও জানাচ্ছেন, কেউ কেউ মনে করতেন, মুসলিম কবির ‘হিন্দুয়ানি পরিবেশে’ বসবাসের কারণেই নাকি তাঁর রোগের কোনো নিরাময় হয়নি।
প্রথম স্ত্রী তথা কবির ব্যর্থ বিয়ের প্রসঙ্গে অনেকেই মনে করেন, মুজফ্ফর আহমদ তাতে ‘ভাংচি’ দিয়েছিলেন এবং নজরুল-কাব্যের উৎসভূমি হচ্ছে তাঁর প্রথম স্ত্রীর স্মৃতিচিহ্নিত দৌলতপুর। কাব্য নিশ্চয়ই কবির জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, উপলক্ষ ও উপলব্ধির দ্বারাই সমৃদ্ধ হয়, কিন্তু তাকে পরিশ্রুত ও নান্দনিকতায় উত্তীর্ণ করতে না পারলে তা কখনো সাহিত্য হয় না। মূল বিষয়কে বাদ দিয়ে এভাবে উপলক্ষকে যাঁরা লক্ষ্য করে তোলেন, তাঁরা আসলে কবি ও কাব্যকেই অস্বীকার করেন। আর যিনি প্রথম বিয়ের প্রথম প্রভাতেই দৌলতপুর ত্যাগ করেন এবং সে বিষয়ে সারা জীবন প্রায় সম্পূর্ণ নীরব থাকেন, সে বিষয়টিকে প্রয়োজনাতিরিক্ত গুরুত্ব দিলে তাতে তথ্যগত ভ্রান্তি ও বিচ্যুতি ঘটে। এ ‘বিয়ে’র কয়েক মাসের মধ্যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখা থেকে প্রমাণিত হয়, অতীতকে ঝেড়ে ফেলে তিনি কতটা সামনের দিকে তাকিয়েছিলেন।
আর যে মুজফ্ফর আহমদের মেয়েকে তিনিই বিয়ে দেন এবং তাঁর সন্তানদের কারও কারও নাম রাখেন, তাতে কবির সঙ্গে শত্রুতা করলে মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে নিশ্চয়ই তাঁর সেই সম্পর্ক থাকত না। ১৩২৮-এর আষাঢ়ের শুরুতে মুজফ্ফর তথাকথিত ভাংচি দিয়েছেন আর ১৩৩৩-এর ৮ ভাদ্র নজরুল তাঁকে মৌন কর্মী, সুন্দর প্রাণ ও উজ্জ্বল প্রতিভা হিসেবে উল্লেখ করে লিখছেন, ‘এমন উদার বিরাট বিপুল মন নিয়ে সে কি করে জন্মাল গোঁড়া মৌলভির দেশ নোয়াখালীতে। এই মোল্লা-মৌলভির দেশ বাংলায়, তা ভেবে পাইনে।’ প্রথম ‘বিয়ে’র প্রায় ছয় বছর পরও নজরুল তাঁর ‘শত্রু’কে চিনতে পারলেন না। এতটাই বোকা ছিলেন কবি!
তা-ই শুধু নয়, পাকিস্তানোত্তরকালে একটি গোষ্ঠী কুফর-বর্জিত নজরুলকে পরিশুদ্ধ করে পাকিস্তানে ‘গ্রহণ’ করতে চেয়েছেন। তামদ্দুনিক প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথকে বর্জনের মতো নজরুলকে ‘গ্রহণ’ করার এই প্রস্তাবও ছিল বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, কিন্তু উভয় প্রস্তাবই ইতিহাস ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রত্যাখ্যান করেছে।
কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, ‘লীগ-কংগ্রেস’ সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, তার প্রাসঙ্গিকতা আমাদের জন্য এখনো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ‘ভাববার কথায়’ তিনি কংগ্রেসকে দেখেছেন আমলাতন্ত্রের অঙ্গ হিসেবে। বলেছেন, কংগ্রেস যদি ‘এক মূর্তি’তে ‘ব্যুরোক্রেসিকে সেবা’ করে, তবে ‘আর এক মূর্তি’তে সেবা করে কংগ্রেসের অর্থাৎ দলতন্ত্রের। অতএব ‘আমার লীগ-কংগ্রেস’-এ তাঁর স্পষ্ট কথা, ‘আমি “লীগ”, “কংগেস” কিছুই মানি না, মানি শুধু সত্যকে, মানি সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বকে, মানি সর্বজনগণের মুক্তিকে?’ ‘এক খুঁটিতে বাঁধা রামছাগল, এক খুঁটিতে বাঁধা খোদার খাসি, কারুর গলার বাঁধন টুটল না, কেউ খুঁটিমুক্ত হল না, অথচ তারা তাল ঠুকে এ ওকে ঢুঁস মারে।’

দুই
কবিতা পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু নজরুলকে বলেছিলেন, ‘প্রতিভাবান বালক।’ তাঁর ধারণা হয়েছিল, নজরুল ‘পঁচিশ বছর ধরে’ একইভাবে লিখেছেন, ‘কখনো বাড়েননি’, ‘বয়স্ক হননি’। এতে অজ্ঞতা, অবজ্ঞা অথবা উন্মাসিকতা যা-ই থাক, কাল তা মিথ্যে প্রমাণ করেছে।
রবীন্দ্রনাথ যখন নজরুলকে বসন্ত নাটিকা উৎসর্গ করেন, তখনো অতিবুদ্ধিমানদের এই প্রবণতা প্রকাশ পায়। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’য় প্রকাশিত কথিত রাজদ্রোহিতার কারণে কবি তখন জেলে। এই মামলা চলার সময়ই তিনি তাঁর বিখ্যাত রাজবন্দীর জবানবন্দী দিয়েছিলেন। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে ডেকে তাঁকে ওই বইয়ের দুটি কপি দিয়ে নজরুলকে জেলে পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ জানানোর সময় রবীন্দ্র-অনুরক্তরা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণা থেকে তাঁদের ওই মনোভঙ্গি ও রবীন্দ্রনাথের তাঁর বিরুদ্ধ মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ যে এ উপলক্ষে নজরুলকে ‘কবি’ বলে অভিহিত করেছেন উপস্থিত তাঁর অনুরক্তদের তা সমর্থন না করা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, তোমরা নজরুলের কবিতা না পড়েই এ মনোভাব পোষণ করেছ। আর পড়ে থাকলেও তার রূপ ও রসের সন্ধান করনি, অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র।’ নজরুলকে ‘হুজুগে’ ও ‘উচ্চকণ্ঠ’ ভাবা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য, ‘কাব্যে অসির ঝনঝনা থাকতে পারে না, এও তোমাদের আবদার বটে। সমগ্র জাতির অন্তর যখন সে সুরে বাঁধা, অসির ঝনঝনায় সেখানে ঝংকার তুলে ঐকতান সৃষ্টি হয় তখন তা কাব্যে প্রকাশ করবে বৈকি। আমি যদি আজ তরুণ হতাম তাহলে আমার কলমেও ওই সুর বাজতো।’ নজরুল প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘জনপ্রিয়তা কাব্যবিচারের স্থায়ী নিরিখ নয়। কিন্তু যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে, তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য।’
তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যে যখন রক্ত তথা খুনের ‘মামলা’ অর্থাৎ এ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়, তখনো রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুলের শ্রদ্ধার অভাব ঘটেনি। বরং নিজের যুক্তি দেখাতে গিয়ে তিনি তাঁকেই সাক্ষ্য মানেন, ‘...আরবি-ফার্সি শব্দ প্রয়োগ কবিতায় শুধু আমিই করিনি। আমার বহু আগে ভারতচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ প্রভৃতি করেছেন।’ বঙ্গসাহিত্যে খুনের মামলা লিখে প্রমথ চৌধুরী এই বিতর্কে অংশ নিয়ে জানান, রবীন্দ্রনাথের বাল্মিকী প্রতিভায় কবি নিজেই ‘খুন’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তবে তিনি বলেন, শব্দ ব্যবহারের রীতি ও প্রথা রয়েছে। সে কারণে ‘খুনের মামলা’কে যেমন ‘রক্তের মামলা’ তেমনি ‘রক্তজবা’কেও ‘খুনজবা’ বলা যায় না।
এই কাণ্ড ও মর্মজ্ঞান এবং সাহিত্যবোধ নজরুলের ছিল। তা না হলে তিনি কবি বা লেখক হতে পারতেন না। তবে তাঁকে বিষয়টি অন্যদের বোঝাতে হয়েছিল। ‘মাথার উপরে’ রবি জ্বললেও এবং ‘সোনার শত ছেলে’ থাকলেও সাহিত্যে প্রবেশের এক দশকের মধ্যেই তাঁকে নিজের ভূমিকার ‘কৈফিয়ত’ দিতে হয়েছিল:
প্রার্থনা করো—যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ।
তিন
প্রকৃত কবিরা যেমন নজরুলও তেমনি সময়কে অতিক্রম করে বেঁচে আছেন ও থাকবেন। কবি নিজেও সেটা জানতেন। ফলে ‘রাজনীতি’র আলোচনা করতে গিয়ে তিনি যা বলেছেন তা তাঁর ও তাঁর সাহিত্য সম্পর্কেও প্রযোজ্য: ‘সে কঠিন সাধনার তারিখ নাই; ৩১শে ডিসেম্বর, ১৯২৩ বা ফেব্রুয়ারির শেষ, ১৯২৬-এর ভিতর তাকে সীমাবদ্ধ করে রাখলে চলবে না।’
এ কথাও অবশ্য বলাই বাহুল্য যে, শিল্পোত্তীর্ণ ও নান্দনিকতায় ঋদ্ধ না হলে শিল্প ও তার কর্মেরও মৃত্যু ঘটে। কিন্তু নজরুল তার ‘সুন্দর’কে যেভাবে জীবনের নানা পর্বে ‘প্রেম-সুন্দর’-এর সঙ্গে ‘শোক-সুন্দর’ হিসেবে উপলব্ধি ও তাঁর রচনায় প্রকাশ করেছেন, তাতে নতুনতর পাঠের মধ্য দিয়ে তার আয়ু বৃদ্ধি পাবে। ‘গোকুল নাগ’ কবিতায় এই দেশপ্রেমিকের উদ্দেশে তিনি যা বলেছেন তা প্রথমে ও অধিকতরভাবে কবির সম্পর্কেই প্রযোজ্য:
আজটাই সত্য নয়, ক’টা দিন তাহা?
ইতিহাস আছে, আছে ভবিষ্যৎ...

No comments

Powered by Blogger.