সরকারের আস্থার সংকট by কুলদীপ নায়ার
ভারতে মনমোহন সিং সরকারকে বিশ্বাসযোগ্যতার প্রলেপ জুগিয়েছিল বামপন্থীরা। কিন্তু তাদের সমর্থন প্রত্যাহারের পর মনমোহন সরকার আর আগের মতো আস্থায় থাকেনি। ইউপিএ জোটের প্রথম পর্যায়ে ধনীদের স্বার্থে অর্থনৈতিক সংস্কার করা সত্ত্বেও বলা যায়, সরকারের নানা নীতি ছিল মোটা দাগে উদারপন্থী। দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে ইউপিএ সরকারকে একদিকে বামপন্থীদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে না, অন্যদিকে কংগ্রেস পার্টির অপশাসনের প্রতিকারও খুঁজতে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সরকারের অবস্থা কাহিল। আর সরকারের সাফল্যের দাবি তো বারবার বাজতে থাকা গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো।
ইউপিএ জোটের শীর্ষদল কংগ্রেসের আশা-ভরসা হয়ে ওঠা রাহুল গান্ধী নিজেই নিজের ক্ষতি সাধন করেছেন। কখনোই তিনি ঝানু রাজনীতিক ছিলেন না, তবে কথা বলতেন কম। নির্বাচনে কংগ্রেস তাঁর থেকে ফায়দা পেতে হলে নিজেকে নতুন মোড়কে অথবা নবশক্তিযোগে হাজির করতে হবে তাঁকে। এত দিনে তাঁর বুঝতে পারা উচিত, জনসমক্ষে কথা বলতে হবে কীভাবে আর কেমন হতে হবে আচরণ।
ইউপিএর সাড়ে সাত বছরের শাসনামলে সবচেয়ে বাজেভাবে আক্রান্ত ব্যক্তিটি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার আগে তিনি ছিলেন পেছনের সারিতে। সোনিয়া গান্ধীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পদে বসেছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি নিজের জায়গা গড়ে নিতে সক্ষম হন। ইউপিএ জোট যখন দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন হয়, তখন মনমোহনের বিরাট এক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে। লোকসভায় কংগ্রেসকে বৃহত্তম দল হয়ে ওঠার পেছনে তিনি ভূমিকা রেখেছেন।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভারত সফরকালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের হাওয়া ছিল তুঙ্গে। মনমোহনের শাসনের ফলে সবচেয়ে সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত তাঁর প্রতি সমর্থন দিয়েছিল। কংগ্রেস যদিও তখনো সোনিয়া গান্ধীর একান্ত জায়গা, তবু তিনি দলের কাছ থেকেও সম্মান পেলেন তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে তাঁর পরিপক্বতার কারণে।
এরপর ভাগ্য আর প্রসন্ন থাকল না মনমোহন সিংয়ের। সরকারের আলমারি থেকে বেরোতে থাকল একের পর এক কেলেঙ্কারি। সরকারি কোষাগার কোটি কোটি টাকা বঞ্চিত হওয়ার খবর প্রকাশিত হতে থাকল। তিনি মোর্চাধর্মে অবিচল থেকে ডিএমকের মতো কলুষিত দলের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করায় তাঁর ও তাঁর সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হলো।
সন্দেহজনক নানা অপকর্ম আড়াল করা কিংবা অন্যায় ঢাকার চেষ্টার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরও জড়িত থাকার কথা শুনে জনগণ ধাক্কা খেয়েছে। মনমোহনের নিজের সুনাম নষ্ট করেছে টু-জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি। তাঁর টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এ রাজার সংশ্লিষ্টতার কথা মনমোহন জানতেন। কিন্তু বিরোধীদের চাপ এবং সংসদে তাঁকে সদয় হতে বাধ্য করার আগ পর্যন্ত রাজার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। রাজা এখন জেলে। সরকারের সরাসরি অধীন সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) সবুজ বাতি পাওয়ার পরই সক্রিয় হয়। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ঘোড়া ছুটে যাওয়ার পর আস্তাবল বন্ধ করার মতো ব্যাপার এটি।
মনমোহন সিংয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার পেছনে আরেকটি কেলেঙ্কারি কম দায়ী নয়, সেটা কমনওয়েলথ গেমসের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুরেশ কালমাদির ব্যাপক দুর্নীতি। কালমাদি কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেতা। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে অত্যন্ত ধীরগতিতে আর তাতে উদ্যমের ঘাটতি ছিল। কালমাদি তখন কিছুদিনের জন্য সার্বক্ষণিক টিভি চ্যানেলগুলোর আলোচনার মজাদার বিষয় হয়ে থাকেন। তাঁর বিরুদ্ধে মনমোহন যদি দ্রুত ব্যবস্থা নিতেন, তাহলে হয়তো প্রধানমন্ত্রীর মান কিছুটা বাঁচত।
এখনো কেউ মনমোহন সিংয়ের ব্যক্তিগত নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। তবে তিনি গুচ্ছ লোকের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যাদের গা থেকে দুর্নীতির পচা গন্ধ বেরোয়—এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। তার ওপর মূল্যস্ফীতি বাড়ছে তো বাড়ছেই। কীভাবে মূল্যস্ফীতি কমানো যায়, সে ব্যাপারে সরকার কোনো দিশা পাচ্ছে না বলে মনে হয়। খাদ্যপণ্যের ১৭ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি অন্যায়। অথচ কর্তৃপক্ষের কোনো নড়াচড়া নেই। পরিস্থিতি অত্যন্ত অন্ধকার। পরিবর্তনের সম্ভাবনাও নেই।
ক্ষমতায় থাকার প্রথম পাঁচ বছর অতিক্রম করার পর মনমোহন সিং নিজেকে ১০ নম্বরের মধ্যে ৬ নম্বর দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেই নম্বর কমিয়ে ৬ থেকে ৩-এ নামিয়ে আনবেন। অল্পের জন্য তাঁর দল আঞ্চলিক নির্বাচনে জিতছে। কিন্তু এ থেকে প্রকৃত অবস্থা বোঝা যায় না।
ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে কংগ্রেস দল ও মনমোহন সরকারকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম যথার্থই বলেছেন, ‘আরও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হয়।’ তবে শুধু এ দিয়ে কাজ হবে না। মনমোহন সিং সরকারকে নতুন করে জয় করতে হবে মানুষের আস্থা এবং তৈরি করতে হবে এমন পরিস্থিতি, যেখানে সাধারণ মানুষ ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আঁচ পেতে পারে। এখন পর্যন্ত ধনীরাই লাভের ফসল তুলে নিয়েছেন। প্রথমবারের মতো এ কথা স্বীকার করার সাহস দেখাতে পেরেছেন রতন টাটা।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।
ইউপিএ জোটের শীর্ষদল কংগ্রেসের আশা-ভরসা হয়ে ওঠা রাহুল গান্ধী নিজেই নিজের ক্ষতি সাধন করেছেন। কখনোই তিনি ঝানু রাজনীতিক ছিলেন না, তবে কথা বলতেন কম। নির্বাচনে কংগ্রেস তাঁর থেকে ফায়দা পেতে হলে নিজেকে নতুন মোড়কে অথবা নবশক্তিযোগে হাজির করতে হবে তাঁকে। এত দিনে তাঁর বুঝতে পারা উচিত, জনসমক্ষে কথা বলতে হবে কীভাবে আর কেমন হতে হবে আচরণ।
ইউপিএর সাড়ে সাত বছরের শাসনামলে সবচেয়ে বাজেভাবে আক্রান্ত ব্যক্তিটি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার আগে তিনি ছিলেন পেছনের সারিতে। সোনিয়া গান্ধীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পদে বসেছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি নিজের জায়গা গড়ে নিতে সক্ষম হন। ইউপিএ জোট যখন দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন হয়, তখন মনমোহনের বিরাট এক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে। লোকসভায় কংগ্রেসকে বৃহত্তম দল হয়ে ওঠার পেছনে তিনি ভূমিকা রেখেছেন।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভারত সফরকালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের হাওয়া ছিল তুঙ্গে। মনমোহনের শাসনের ফলে সবচেয়ে সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত তাঁর প্রতি সমর্থন দিয়েছিল। কংগ্রেস যদিও তখনো সোনিয়া গান্ধীর একান্ত জায়গা, তবু তিনি দলের কাছ থেকেও সম্মান পেলেন তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে তাঁর পরিপক্বতার কারণে।
এরপর ভাগ্য আর প্রসন্ন থাকল না মনমোহন সিংয়ের। সরকারের আলমারি থেকে বেরোতে থাকল একের পর এক কেলেঙ্কারি। সরকারি কোষাগার কোটি কোটি টাকা বঞ্চিত হওয়ার খবর প্রকাশিত হতে থাকল। তিনি মোর্চাধর্মে অবিচল থেকে ডিএমকের মতো কলুষিত দলের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করায় তাঁর ও তাঁর সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হলো।
সন্দেহজনক নানা অপকর্ম আড়াল করা কিংবা অন্যায় ঢাকার চেষ্টার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরও জড়িত থাকার কথা শুনে জনগণ ধাক্কা খেয়েছে। মনমোহনের নিজের সুনাম নষ্ট করেছে টু-জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি। তাঁর টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এ রাজার সংশ্লিষ্টতার কথা মনমোহন জানতেন। কিন্তু বিরোধীদের চাপ এবং সংসদে তাঁকে সদয় হতে বাধ্য করার আগ পর্যন্ত রাজার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। রাজা এখন জেলে। সরকারের সরাসরি অধীন সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) সবুজ বাতি পাওয়ার পরই সক্রিয় হয়। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ঘোড়া ছুটে যাওয়ার পর আস্তাবল বন্ধ করার মতো ব্যাপার এটি।
মনমোহন সিংয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার পেছনে আরেকটি কেলেঙ্কারি কম দায়ী নয়, সেটা কমনওয়েলথ গেমসের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুরেশ কালমাদির ব্যাপক দুর্নীতি। কালমাদি কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেতা। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে অত্যন্ত ধীরগতিতে আর তাতে উদ্যমের ঘাটতি ছিল। কালমাদি তখন কিছুদিনের জন্য সার্বক্ষণিক টিভি চ্যানেলগুলোর আলোচনার মজাদার বিষয় হয়ে থাকেন। তাঁর বিরুদ্ধে মনমোহন যদি দ্রুত ব্যবস্থা নিতেন, তাহলে হয়তো প্রধানমন্ত্রীর মান কিছুটা বাঁচত।
এখনো কেউ মনমোহন সিংয়ের ব্যক্তিগত নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। তবে তিনি গুচ্ছ লোকের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যাদের গা থেকে দুর্নীতির পচা গন্ধ বেরোয়—এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। তার ওপর মূল্যস্ফীতি বাড়ছে তো বাড়ছেই। কীভাবে মূল্যস্ফীতি কমানো যায়, সে ব্যাপারে সরকার কোনো দিশা পাচ্ছে না বলে মনে হয়। খাদ্যপণ্যের ১৭ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি অন্যায়। অথচ কর্তৃপক্ষের কোনো নড়াচড়া নেই। পরিস্থিতি অত্যন্ত অন্ধকার। পরিবর্তনের সম্ভাবনাও নেই।
ক্ষমতায় থাকার প্রথম পাঁচ বছর অতিক্রম করার পর মনমোহন সিং নিজেকে ১০ নম্বরের মধ্যে ৬ নম্বর দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেই নম্বর কমিয়ে ৬ থেকে ৩-এ নামিয়ে আনবেন। অল্পের জন্য তাঁর দল আঞ্চলিক নির্বাচনে জিতছে। কিন্তু এ থেকে প্রকৃত অবস্থা বোঝা যায় না।
ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে কংগ্রেস দল ও মনমোহন সরকারকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম যথার্থই বলেছেন, ‘আরও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হয়।’ তবে শুধু এ দিয়ে কাজ হবে না। মনমোহন সিং সরকারকে নতুন করে জয় করতে হবে মানুষের আস্থা এবং তৈরি করতে হবে এমন পরিস্থিতি, যেখানে সাধারণ মানুষ ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আঁচ পেতে পারে। এখন পর্যন্ত ধনীরাই লাভের ফসল তুলে নিয়েছেন। প্রথমবারের মতো এ কথা স্বীকার করার সাহস দেখাতে পেরেছেন রতন টাটা।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।
No comments