লোভ নয়, লাভের বাজার হোক by আব্দুন নূর তুষার ও হাসান মাহমুদ
২০১০ সালে শেয়ারবাজার রেকর্ড করল। ৮৯১৮ ডিএসইর সাধারণ সূচক। বাজারসংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের কেউ কেউ বলছেন, দেশের দ্রুত আর্থিক উন্নতির লক্ষণ এই বর্ধনশীল বাজার। এ রকম চলতে থাকলে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে। কর্মসংস্থান বাড়বে। জিডিপি বেড়ে দুই অঙ্কের কোঠায় পৌঁছাবে। জানুয়ারি মাসেই তাদের কথার সুর বদলে গেল। সূচক কমে ৬৩২৬-এ ঠেকল। রাস্তায় টায়ার পুড়ল। প্রথমবারের মতো শেয়ারবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে দেশের শেয়াববাজারে লেনদেন বন্ধ করতে হলো। কেন এমন হলো? এ রকম কি আর কোথাও হয়? পৃথিবীতে এমন ঘটনা দেশে দেশে ঘটেছে। কাছের দেশ মালয়েশিয়া থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিমান দেশ যুক্তরাষ্ট্র—এমন ঘটনা সেসব দেশেও ঘটেছিল।
১৯৮০ সাল পর্যন্ত ডাউজোনস ইনডেক্স ছিল এক হাজারের নিচে, যা পরের দুই দশকে বেড়ে ১০ থেকে ১১ হাজারের মধ্যে ওঠানামা করছিল। ২০০৭-এর ৯ অক্টোবর এটি রেকর্ড ১৪১২৬ হয়ে যায়। তারপর হঠাৎ করে লেম্যান ব্রাদার্স নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে এবং ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম ১৫০ ডলার ছুঁতে পারে, এই ভয়ে বাজার বেসামাল আচরণ করতে থাকে এবং কমতে কমতে ৯ মার্চ ২০০৯ সালে এটি ১০ বছরে সর্বনিম্ন ৬৫৪৭ দশমিক ৫ সূচকে নেমে আসে। এখানেই শেষ নয়। নানা রকম সরকারি প্রণোদনা ও বাজার সংস্কারের পর এই সূচক আবার বাড়তে থাকে। তার পরও ৬ মে ২০১০ হঠাৎ এক দিনে ৯৯৮ পয়েন্ট পড়ে যায় এই সূচক। তার মানে এক দিনে এক হাজার পয়েন্ট সূচক পতন শুধু বাংলাদেশে নয়, আমেরিকাতেও হয়। আমেরিকার বিনিয়োগকারীরা কি তখন রাস্তায় নামে, টায়ারে আগুন দেয়? ডাউজোনসের প্রধান নির্বাহী আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের প্রধানকে আক্রমণ করে কথা বলেন? বিরোধী দল একেক দিন হাজার হাজার কোটি ডলার চুরি হয়ে গেছে বলে নানা রকম কাল্পনিক হিসাব দিয়ে সেমিনার বা প্রেস কনফারেন্স করে? দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য যে বাংলাদেশে এই আচরণগুলো আমরা গত কয়েক মাসে দেখেছি।
আমেরিকার বাজারে এমন হয়েছিল, কারণ আশি ও নব্বইয়ের দশকে উচ্চপ্রযুক্তি নির্মাতা ও প্রযুক্তিসেবা প্রদানকারী ডট কম কোম্পানিগুলোতে মানুষ প্রচুর বিনিয়োগ করে একটি অর্থনৈতিক বুদ্বুদ তৈরি করেন। দুর্বল মৌল ভিত্তির এই কোম্পানিগুলোর দাম হঠাৎ ৭৮ শতাংশ কমে গেলে বিনিয়োগকারীরা পথে বসে যান। তখনকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের প্রধান অ্যালান গ্রিনস্প্যান এটি বুঝতে পারেননি। ফলে ২০০১ থেকেই সেখানে মন্দা শুরু হয়। বুশ সাহেব এই সুযোগে বড়লোকদের ওপর কর কমিয়ে দিয়ে বলতে থাকেন, এতে করে বিনিয়োগ বাড়বে। গ্রিনস্প্যান সাহেব সুদের হার কমিয়ে দেন এবং বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে দেন। ফলে প্রযুক্তির বুদ্বুদকে প্রতিস্থাপন করে হাউজিং বুদ্বুদ। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় বিরাট বৃদ্ধি ঘটে এবং এই খাতে লেনদেন ও ঋণপ্রবাহ বেড়ে যায়।
২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৩২ ডলার থেকে বেড়ে ১৩৭ ডলার হয়ে গেলে প্রতিদিন আমেরিকাকে আগের চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি খরচ করে ১৪০ কোটি ডলারের তেল আমদানি করতে হচ্ছিল। অর্থাৎ শুধু তেল বাবদ আমেরিকার এক সপ্তাহের খরচ ছিল আমাদের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সমান। এরপর রিয়েল এস্টেট ব্যবসার ধস এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসামাল সাবপ্রাইম মর্টগেজজনিত মূলধন হারানোর ফলে একে একে এআইজি এবং লেম্যান ব্রাদার্সের মতো নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলো দেউলিয়া হয়ে যেতে থাকে। তারা এমনকি পেনশন ফান্ডের টাকা নিয়েও নানা রকম ফাটকাবাজি করেছিল। বারাক ওবামাকে শেষ পর্যন্ত বুশ সাহেবের বেইল আউট প্ল্যানকে টেনে নিয়ে যেতে হয় এবং জনগণের অর্থ জোগান দিয়ে বাজার বাঁচাতে হয়। এখন ১ ফেব্রুয়ারি ডাউজোনস ইনডেক্স ছিল ১২০৪০। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে ওবামাকে খেসারত দিতে হয়েছে তাঁর জনপ্রিয়তার বিরাট একটি অংশ। তাঁর স্বাস্থ্যসেবা পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাংলাদেশেও আমরা গত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনসমর্থনের এমন একটি আলামত দেখেছি।
আমাদের বক্তব্য খুবই সাধারণ। শেয়ারবাজারের এই সাম্প্রতিক ধস নিয়ে উতলা হওয়ার কিছু নেই। বেশ কিছুদিন ধরেই বাজারে অনেকগুলো শেয়ার অতিমূল্যায়িত ছিল। এর পেছনে একটি বড় কারণ ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মাত্রাতিরিক্ত বিনিয়োগ, বাজারে ভালো শেয়ারের অভাব এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বাজার সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা না থাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল এসইসির সমন্বয়হীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বুকবিল্ডিংয়ের মাধ্যমে শেয়ার বাজারে আসার আগেই তাকে অতিমূল্যায়িত হতে দেওয়া। যেমন—বাজারে আসবে এমআই সিমেন্ট ও মবিল যমুনা, যার মূল্য অনুপাত আয় যথাক্রমে ৫০ ও ৭০। অথচ এসইসি বলে দিয়েছে, ৪০-এর ওপরে কোনো কোম্পানির শেয়ারে ক্রেতাকে ঋণ-সুবিধা দেওয়া যাবে না। তাহলে এই শেয়ারগুলো যাঁরা কিনবেন, তাঁদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা কতটুকু? বাজারে মোট শেয়ার লেনদেনের ৬৫ ভাগ প্রাতিষ্ঠানিক হওয়ার কারণে এই অতিমূল্যায়নের দায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীকেই নিতে হবে। আশার বিষয় এই যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের কর্তা অ্যালান গ্রিনস্প্যানের মতো নন। তিনি এই বিষয়টি বুঝতে পেরে নতুন মুদ্রানীতিতে সংকুলানমুখী বা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে তিনি আবাসন ব্যবসা ও শেয়ার ব্যবসায় মুদ্রা সরবরাহে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছেন। তিনি কারসাজিকারী অর্থলোভীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভবিষ্যৎ প্রপার্টি ক্রাঞ্চ বা আবাসন ব্যবসার বিপদ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করেছেন। তিনি উৎপাদনশীল খাত যেমন—কৃষি, অবকাঠামো, জ্বালানি খাত ও শিল্পে বিনিয়োগকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সব নেতিবাচক ঘটনার সঙ্গে ইতিবাচক বিষয়ও থাকে। এই বাজারধস আমাদের সামনে নতুন কিছু সুযোগ এনে দিয়েছে। সরকার সৎ ও নিরপেক্ষ মানুষদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে এবং ধস রোধে বাজারসংক্রান্ত নানা ধরনের সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ধস না হলে আমাদের এই বাজারে কুচক্রীরা (তদন্তাধীন বলে নাম বললাম না) চিরদিন এভাবে মানুষের পকেট মারত। সংস্কারের পর আমাদের এই বাজার আরও নিরাপদ হবে বলে আমরা মনে করি।
আমরা ভবিষ্যতে বাজারধস এবং এরপর বিক্ষোভ এড়াতে বিবেচনার জন্য কিছু প্রস্তাব করছি।
বাজারে আইপিওসংক্রান্ত সব প্রচারণায় সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ চালু করতে হবে, যাতে বলা থাকবে যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে ঝুঁকি আছে এবং বাজার সম্পর্কে না জেনে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ে লাভক্ষতির দায় বিনিয়োগকারীকে নিতে হবে। সেকেন্ডারি বাজারে বিনিয়োগকারীদের ঠিকানায় তাদের ব্রোকাররা চিঠি দিয়ে এটি জানানোকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
সব বিনিয়োগকারীর জন্য একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশিক্ষণের জন্য বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত এবং প্রশিক্ষণের মান তদারক করতে হবে। মালয়েশিয়ায় এটি রয়েছে।
রেমিট্যান্স কমছে, আমদানি ব্যয় বাড়ছে, খাদ্য ও জ্বালানির দামও বাড়ছে। শেয়ার মার্কেট বাঁচাতে গিয়ে এমন কিছু করা যাবে না, যাতে দেশের সমগ্র অর্থনীতির ওপর চাপ আসে।
আমাদের সনাতনী ব্যাংকব্যবস্থায় ব্যাংকের ক্রেডিট রেটিং আমরা জানি। কিন্তু তাদের সাবসিডিয়ারি মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউস সম্পর্কে কিছুই জানি না। ফলে ব্যাংকগুলো ফাটকাবাজি করতে পেরেছে। আমরা প্রস্তাব করছি, এই সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রেডিট রেটিং বাধ্যতামূলক করা হোক এবং এটি বহুল প্রচারিত গণমাধ্যমে প্রকাশ করার নির্দেশ দেওয়া হোক।
এসইসিকে ঢেলে সাজানো হোক এবং তাকে যথেষ্ট ক্ষমতায়িত করা হোক, যাতে তারা কারসাজিকারীদের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে।
বাজারসংক্রান্ত গুজব রটনাকারী, কারসাজিকারী এবং বাজারধসের পর বিক্ষোভের নামে শান্তি বিনষ্টকারী তৎপরতা রোধে আইন ও শাস্তির বিধান করা হোক। ভারতে যেমন হর্ষদ মেহতাকে শাস্তি পেতে হয়েছে।
কোম্পানিগুলোর অতিমূল্যায়নের সঙ্গে জড়িত এবং ভুয়া হিসাব বিবরণী তৈরি করে, এমন অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান করা হোক। যেমন—আমেরিকায় এনরন কেলেঙ্কারির জন্য অ্যান্ডারসনকে চিরকালের জন্য নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
যত দ্রুত সম্ভব দেশে সরকারি যত লাভজনক প্রতিষ্ঠান আছে, তার শেয়ার বাজারে নিয়ে এসে বাজারে শেয়ারের চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য তৈরি করতে হবে।
বুকবিল্ডিং পদ্ধতির সংস্কারের আগে বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানকে বুকবিল্ডিংয়ের মাধ্যমে বাজারে আসতে দেওয়া যাবে না।
ইনসাইডার বা বাজারে লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত মালিক বা কর্মচারীদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।
সংকট উত্তরণের পর কী করতে হবে, এ বিষয়ে জোসেফ স্টিগলিজ তাঁর ফ্রি ফল বা অনিয়ন্ত্রিত পতন নামের বইটিতে যে সমাধান দিয়েছেন, সেটি বাংলাদেশের উপযোগী করে অনুসরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, বাজারকে একটি আধুনিক বাস্তবসম্মত পদ্ধতির অধীনে নিজের মতো চলতে দেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কেবল রেগুলেটরের ভূমিকা পালন করবে এবং বিনিয়োগকারীর আইনগত নিরাপত্তা প্রদান করবে। তাই প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর বাজারকে তার নিজের গতিতে চলতে দিতে হবে। দেশে বিদ্যুৎ-সংকট কমে গেলে, নতুন কলকারখানা তৈরি হলে এমনিতেই বাজার শক্তিশালী হতে শুরু করবে।
শেয়ারবাজারে যারা কুকীর্তি করেছে, তারা কেবল নিজের ভালো চেয়েছে। তাদের কাছে দেশ, সরকার, জনগণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দল, আদর্শ সবই তুচ্ছ। এদের কাছে প্রভু কেবল লোভ। কে এল, কে গেল, তাতে এদের কিছু আসে-যায় না। টাকা এলেই হলো। তাই সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, তারা শক্ত সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হবে না। বিরোধী দলের কাছে আমাদের চাওয়া, সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা এবং প্রয়োজনে সহযোগিতা। সরকারের তরফ থেকে তাদের সঙ্গে নিয়ে নিলে এটা আরও সহজ হবে। আর গণমাধ্যমগুলোর দায়িত্ব এখানে সবচেয়ে বেশি। কারণ সব পক্ষকে এক জায়গায় নিয়ে আসা সম্ভব না-ও হতে পারে। কিন্তু প্রত্যেকের কথা একে অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে পারে কেবল তারাই।
ডা. আব্দুন নূর তুষার: সভাপতি, প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ ও বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশন।
হাসান মাহমুদ বিপ্লব: আইনজীবী ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশন।
১৯৮০ সাল পর্যন্ত ডাউজোনস ইনডেক্স ছিল এক হাজারের নিচে, যা পরের দুই দশকে বেড়ে ১০ থেকে ১১ হাজারের মধ্যে ওঠানামা করছিল। ২০০৭-এর ৯ অক্টোবর এটি রেকর্ড ১৪১২৬ হয়ে যায়। তারপর হঠাৎ করে লেম্যান ব্রাদার্স নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে এবং ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম ১৫০ ডলার ছুঁতে পারে, এই ভয়ে বাজার বেসামাল আচরণ করতে থাকে এবং কমতে কমতে ৯ মার্চ ২০০৯ সালে এটি ১০ বছরে সর্বনিম্ন ৬৫৪৭ দশমিক ৫ সূচকে নেমে আসে। এখানেই শেষ নয়। নানা রকম সরকারি প্রণোদনা ও বাজার সংস্কারের পর এই সূচক আবার বাড়তে থাকে। তার পরও ৬ মে ২০১০ হঠাৎ এক দিনে ৯৯৮ পয়েন্ট পড়ে যায় এই সূচক। তার মানে এক দিনে এক হাজার পয়েন্ট সূচক পতন শুধু বাংলাদেশে নয়, আমেরিকাতেও হয়। আমেরিকার বিনিয়োগকারীরা কি তখন রাস্তায় নামে, টায়ারে আগুন দেয়? ডাউজোনসের প্রধান নির্বাহী আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের প্রধানকে আক্রমণ করে কথা বলেন? বিরোধী দল একেক দিন হাজার হাজার কোটি ডলার চুরি হয়ে গেছে বলে নানা রকম কাল্পনিক হিসাব দিয়ে সেমিনার বা প্রেস কনফারেন্স করে? দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য যে বাংলাদেশে এই আচরণগুলো আমরা গত কয়েক মাসে দেখেছি।
আমেরিকার বাজারে এমন হয়েছিল, কারণ আশি ও নব্বইয়ের দশকে উচ্চপ্রযুক্তি নির্মাতা ও প্রযুক্তিসেবা প্রদানকারী ডট কম কোম্পানিগুলোতে মানুষ প্রচুর বিনিয়োগ করে একটি অর্থনৈতিক বুদ্বুদ তৈরি করেন। দুর্বল মৌল ভিত্তির এই কোম্পানিগুলোর দাম হঠাৎ ৭৮ শতাংশ কমে গেলে বিনিয়োগকারীরা পথে বসে যান। তখনকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের প্রধান অ্যালান গ্রিনস্প্যান এটি বুঝতে পারেননি। ফলে ২০০১ থেকেই সেখানে মন্দা শুরু হয়। বুশ সাহেব এই সুযোগে বড়লোকদের ওপর কর কমিয়ে দিয়ে বলতে থাকেন, এতে করে বিনিয়োগ বাড়বে। গ্রিনস্প্যান সাহেব সুদের হার কমিয়ে দেন এবং বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে দেন। ফলে প্রযুক্তির বুদ্বুদকে প্রতিস্থাপন করে হাউজিং বুদ্বুদ। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় বিরাট বৃদ্ধি ঘটে এবং এই খাতে লেনদেন ও ঋণপ্রবাহ বেড়ে যায়।
২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৩২ ডলার থেকে বেড়ে ১৩৭ ডলার হয়ে গেলে প্রতিদিন আমেরিকাকে আগের চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি খরচ করে ১৪০ কোটি ডলারের তেল আমদানি করতে হচ্ছিল। অর্থাৎ শুধু তেল বাবদ আমেরিকার এক সপ্তাহের খরচ ছিল আমাদের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সমান। এরপর রিয়েল এস্টেট ব্যবসার ধস এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসামাল সাবপ্রাইম মর্টগেজজনিত মূলধন হারানোর ফলে একে একে এআইজি এবং লেম্যান ব্রাদার্সের মতো নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলো দেউলিয়া হয়ে যেতে থাকে। তারা এমনকি পেনশন ফান্ডের টাকা নিয়েও নানা রকম ফাটকাবাজি করেছিল। বারাক ওবামাকে শেষ পর্যন্ত বুশ সাহেবের বেইল আউট প্ল্যানকে টেনে নিয়ে যেতে হয় এবং জনগণের অর্থ জোগান দিয়ে বাজার বাঁচাতে হয়। এখন ১ ফেব্রুয়ারি ডাউজোনস ইনডেক্স ছিল ১২০৪০। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে ওবামাকে খেসারত দিতে হয়েছে তাঁর জনপ্রিয়তার বিরাট একটি অংশ। তাঁর স্বাস্থ্যসেবা পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাংলাদেশেও আমরা গত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনসমর্থনের এমন একটি আলামত দেখেছি।
আমাদের বক্তব্য খুবই সাধারণ। শেয়ারবাজারের এই সাম্প্রতিক ধস নিয়ে উতলা হওয়ার কিছু নেই। বেশ কিছুদিন ধরেই বাজারে অনেকগুলো শেয়ার অতিমূল্যায়িত ছিল। এর পেছনে একটি বড় কারণ ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মাত্রাতিরিক্ত বিনিয়োগ, বাজারে ভালো শেয়ারের অভাব এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বাজার সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা না থাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল এসইসির সমন্বয়হীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বুকবিল্ডিংয়ের মাধ্যমে শেয়ার বাজারে আসার আগেই তাকে অতিমূল্যায়িত হতে দেওয়া। যেমন—বাজারে আসবে এমআই সিমেন্ট ও মবিল যমুনা, যার মূল্য অনুপাত আয় যথাক্রমে ৫০ ও ৭০। অথচ এসইসি বলে দিয়েছে, ৪০-এর ওপরে কোনো কোম্পানির শেয়ারে ক্রেতাকে ঋণ-সুবিধা দেওয়া যাবে না। তাহলে এই শেয়ারগুলো যাঁরা কিনবেন, তাঁদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা কতটুকু? বাজারে মোট শেয়ার লেনদেনের ৬৫ ভাগ প্রাতিষ্ঠানিক হওয়ার কারণে এই অতিমূল্যায়নের দায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীকেই নিতে হবে। আশার বিষয় এই যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের কর্তা অ্যালান গ্রিনস্প্যানের মতো নন। তিনি এই বিষয়টি বুঝতে পেরে নতুন মুদ্রানীতিতে সংকুলানমুখী বা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে তিনি আবাসন ব্যবসা ও শেয়ার ব্যবসায় মুদ্রা সরবরাহে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছেন। তিনি কারসাজিকারী অর্থলোভীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভবিষ্যৎ প্রপার্টি ক্রাঞ্চ বা আবাসন ব্যবসার বিপদ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করেছেন। তিনি উৎপাদনশীল খাত যেমন—কৃষি, অবকাঠামো, জ্বালানি খাত ও শিল্পে বিনিয়োগকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সব নেতিবাচক ঘটনার সঙ্গে ইতিবাচক বিষয়ও থাকে। এই বাজারধস আমাদের সামনে নতুন কিছু সুযোগ এনে দিয়েছে। সরকার সৎ ও নিরপেক্ষ মানুষদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে এবং ধস রোধে বাজারসংক্রান্ত নানা ধরনের সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ধস না হলে আমাদের এই বাজারে কুচক্রীরা (তদন্তাধীন বলে নাম বললাম না) চিরদিন এভাবে মানুষের পকেট মারত। সংস্কারের পর আমাদের এই বাজার আরও নিরাপদ হবে বলে আমরা মনে করি।
আমরা ভবিষ্যতে বাজারধস এবং এরপর বিক্ষোভ এড়াতে বিবেচনার জন্য কিছু প্রস্তাব করছি।
বাজারে আইপিওসংক্রান্ত সব প্রচারণায় সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ চালু করতে হবে, যাতে বলা থাকবে যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে ঝুঁকি আছে এবং বাজার সম্পর্কে না জেনে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ে লাভক্ষতির দায় বিনিয়োগকারীকে নিতে হবে। সেকেন্ডারি বাজারে বিনিয়োগকারীদের ঠিকানায় তাদের ব্রোকাররা চিঠি দিয়ে এটি জানানোকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
সব বিনিয়োগকারীর জন্য একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশিক্ষণের জন্য বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত এবং প্রশিক্ষণের মান তদারক করতে হবে। মালয়েশিয়ায় এটি রয়েছে।
রেমিট্যান্স কমছে, আমদানি ব্যয় বাড়ছে, খাদ্য ও জ্বালানির দামও বাড়ছে। শেয়ার মার্কেট বাঁচাতে গিয়ে এমন কিছু করা যাবে না, যাতে দেশের সমগ্র অর্থনীতির ওপর চাপ আসে।
আমাদের সনাতনী ব্যাংকব্যবস্থায় ব্যাংকের ক্রেডিট রেটিং আমরা জানি। কিন্তু তাদের সাবসিডিয়ারি মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউস সম্পর্কে কিছুই জানি না। ফলে ব্যাংকগুলো ফাটকাবাজি করতে পেরেছে। আমরা প্রস্তাব করছি, এই সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রেডিট রেটিং বাধ্যতামূলক করা হোক এবং এটি বহুল প্রচারিত গণমাধ্যমে প্রকাশ করার নির্দেশ দেওয়া হোক।
এসইসিকে ঢেলে সাজানো হোক এবং তাকে যথেষ্ট ক্ষমতায়িত করা হোক, যাতে তারা কারসাজিকারীদের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে।
বাজারসংক্রান্ত গুজব রটনাকারী, কারসাজিকারী এবং বাজারধসের পর বিক্ষোভের নামে শান্তি বিনষ্টকারী তৎপরতা রোধে আইন ও শাস্তির বিধান করা হোক। ভারতে যেমন হর্ষদ মেহতাকে শাস্তি পেতে হয়েছে।
কোম্পানিগুলোর অতিমূল্যায়নের সঙ্গে জড়িত এবং ভুয়া হিসাব বিবরণী তৈরি করে, এমন অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান করা হোক। যেমন—আমেরিকায় এনরন কেলেঙ্কারির জন্য অ্যান্ডারসনকে চিরকালের জন্য নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
যত দ্রুত সম্ভব দেশে সরকারি যত লাভজনক প্রতিষ্ঠান আছে, তার শেয়ার বাজারে নিয়ে এসে বাজারে শেয়ারের চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য তৈরি করতে হবে।
বুকবিল্ডিং পদ্ধতির সংস্কারের আগে বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানকে বুকবিল্ডিংয়ের মাধ্যমে বাজারে আসতে দেওয়া যাবে না।
ইনসাইডার বা বাজারে লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত মালিক বা কর্মচারীদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।
সংকট উত্তরণের পর কী করতে হবে, এ বিষয়ে জোসেফ স্টিগলিজ তাঁর ফ্রি ফল বা অনিয়ন্ত্রিত পতন নামের বইটিতে যে সমাধান দিয়েছেন, সেটি বাংলাদেশের উপযোগী করে অনুসরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, বাজারকে একটি আধুনিক বাস্তবসম্মত পদ্ধতির অধীনে নিজের মতো চলতে দেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কেবল রেগুলেটরের ভূমিকা পালন করবে এবং বিনিয়োগকারীর আইনগত নিরাপত্তা প্রদান করবে। তাই প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর বাজারকে তার নিজের গতিতে চলতে দিতে হবে। দেশে বিদ্যুৎ-সংকট কমে গেলে, নতুন কলকারখানা তৈরি হলে এমনিতেই বাজার শক্তিশালী হতে শুরু করবে।
শেয়ারবাজারে যারা কুকীর্তি করেছে, তারা কেবল নিজের ভালো চেয়েছে। তাদের কাছে দেশ, সরকার, জনগণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দল, আদর্শ সবই তুচ্ছ। এদের কাছে প্রভু কেবল লোভ। কে এল, কে গেল, তাতে এদের কিছু আসে-যায় না। টাকা এলেই হলো। তাই সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, তারা শক্ত সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হবে না। বিরোধী দলের কাছে আমাদের চাওয়া, সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা এবং প্রয়োজনে সহযোগিতা। সরকারের তরফ থেকে তাদের সঙ্গে নিয়ে নিলে এটা আরও সহজ হবে। আর গণমাধ্যমগুলোর দায়িত্ব এখানে সবচেয়ে বেশি। কারণ সব পক্ষকে এক জায়গায় নিয়ে আসা সম্ভব না-ও হতে পারে। কিন্তু প্রত্যেকের কথা একে অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে পারে কেবল তারাই।
ডা. আব্দুন নূর তুষার: সভাপতি, প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ ও বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশন।
হাসান মাহমুদ বিপ্লব: আইনজীবী ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশন।
No comments