গল্প- 'মঙ্গামনস্ক শরীরীমুদ্রা' by ইমতিয়ার শামীম
সন্ধ্যা হওয়ার একটু আগে পুবচড়া থেকে বাড়ি ফেরার সময় রফিক এ কথা জানতে পারে: রাশেদার বিয়ে হবে সামনের জুম্মাবারে। খবরটা তাকে দেয় রায়েকবন্দরের জমির আলী সরকার, সে সময় তার চোখ দুটো ঘন ঘন পিটপিটায়, ঠোঁটটায় ঢেউ ওঠে আলতো করে, আর কোনও সন্দেহজনক ঘ্রাণ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে নিঃশ্বাস টানতে থাকা মানুষের ধৈর্যহীনতাসমেত দীর্ঘ অথচ ঘন নিঃশ্বাস টেনে নেয় নাকের ভেতর। তা ছাড়া নিজের বাম কাঁধের ওপর অনেক পুরানো মইষা দাউদ চুলকানোর জন্যে সবসময় সঙ্গে রাখা পুরনো ভোঁতা ব্লেডটা সে প্রতিস্থাপন করে ডান হাতের দু আঙুলের মধ্যে, ঘাড় ডিঙিয়ে কাঁধটাকে ব্লেডটার ঘর্ষণে ঘর্ষণে তছনছ করে চলে।
মইষা দাউদউপদ্রুত পিঠের প্রায় শুকিয়ে ওঠা অঞ্চলটুকুর মরা মিহি চামড়া এই ঘষাঘষিতে কখনও বিন্দু বিন্দু হয়, কখনওবা হয় চূর্ণবিচূর্ণ সেমাইয়ের টুকরো, তারপর সেগুলো লুটোপুটি খায় পিঠের ওপর অথবা দু’চারটে উঠে আসে আঙুলের সঙ্গে। এইভাবে তার কাঁধের চামড়া প্রথমে রোমওঠা কুকুরের খসখসে ত্বক হয়ে যায়, তারপর একটু একটু করে ফাটতে থাকে এবং তাতে হালকা রক্তও উঠে আসতে শুরু করে। সেই রক্ত দেখে জমির আলী সরকার উল্লসিত হয়, কেননা রক্তের এই উদ্ভাসনের সঙ্গে রাশেদার অতর্কিতে বিয়ে হওয়ার ঘটনাটা মিশে-মিশে তার মনে পুরনো জিঘাংসা চরিতার্থ হওয়ার আনন্দ জাগিয়ে তোলে; অথবা এমনও হতে পারে, সে তখন বেদনার্ত ও কাতর হয়ে ওঠে পুরনো মইষা দাউদের কারণে নিষিদ্ধ চিংড়ি, গরুর মাংস ও চাক চাক করে কাটা বেগুনভাজা খাওয়ার তামাদি স্মৃতি তাকে অকস্মাৎ ব্যতিব্যস্ত করে তোলায়।
মইষা দাউদউপদ্রুত পিঠের প্রায় শুকিয়ে ওঠা অঞ্চলটুকুর মরা মিহি চামড়া এই ঘষাঘষিতে কখনও বিন্দু বিন্দু হয়, কখনওবা হয় চূর্ণবিচূর্ণ সেমাইয়ের টুকরো, তারপর সেগুলো লুটোপুটি খায় পিঠের ওপর অথবা দু’চারটে উঠে আসে আঙুলের সঙ্গে। এইভাবে তার কাঁধের চামড়া প্রথমে রোমওঠা কুকুরের খসখসে ত্বক হয়ে যায়, তারপর একটু একটু করে ফাটতে থাকে এবং তাতে হালকা রক্তও উঠে আসতে শুরু করে। সেই রক্ত দেখে জমির আলী সরকার উল্লসিত হয়, কেননা রক্তের এই উদ্ভাসনের সঙ্গে রাশেদার অতর্কিতে বিয়ে হওয়ার ঘটনাটা মিশে-মিশে তার মনে পুরনো জিঘাংসা চরিতার্থ হওয়ার আনন্দ জাগিয়ে তোলে; অথবা এমনও হতে পারে, সে তখন বেদনার্ত ও কাতর হয়ে ওঠে পুরনো মইষা দাউদের কারণে নিষিদ্ধ চিংড়ি, গরুর মাংস ও চাক চাক করে কাটা বেগুনভাজা খাওয়ার তামাদি স্মৃতি তাকে অকস্মাৎ ব্যতিব্যস্ত করে তোলায়।
সামনের জুম্মাবার আসতে হাতের কড়ায় এখনও দিনপাঁচেক গড়াগড়ি খাচ্ছে। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। মিয়াবাড়ির মেয়েদের বিয়ে হয় একেবারে কাটায় কাটায়, বিয়ের ওয়াক্তে বিয়ে না হলে বুঝতে হবে কাজী এবার বিয়ের বদলে জানাজা পরিয়ে সেই মেয়েকে কবর দেবে। এ অনেক পুরানো রেওয়াজ, রফিকের দাদার দাদা না কি তার ছোটবেলায় দেখেছিল, মিয়াবাড়ির মেয়ে, পাড়াগাঁয়ের সম্পর্ক ধরে তার আয়েশা খালা আত্মহত্যা করেছিল কাঠাল গাছে দোলনার দড়ি ঝুলিয়ে, ঘন্টাতিনেক বাদে সেটা চোখে পড়ে বাড়ির কামলাদের এবং তখন দড়ি খুলে আয়েশা খালাকে মাটিতে নামানো হয়, তখন তার গলা টিপে ধরে আয়েশার মৃত জিভটাকে মুখের আরও একটু বাইরে নিয়ে আসার চেষ্টাতদবির চালিয়ে আতপ আলী মিয়া মেয়ের মৃত্যুকে হালাল করে; কেননা তা না হলে তার ফাঁস নেয়া মেয়ের আত্মাকে অনন্তকাল আকাশে ভেসে ভেসে বেড়াতে হবে। এই হালালিকরণকে আরও পাকাপোক্ত করার অভিপ্রায়ে আতপ আলী মিয়া আত্মহননের অন্যতম সাক্ষী কাঠাল গাছটিকেও শিকড়শুদ্ধ আমূল তুলে ফেলে। তেইশজন জোয়ান কামলা সাড়ে ৪ দিন ধরে কাঠাল গাছটির চারদিক খনন করে, অনেকখানি জায়গা জুড়ে অর্ধগোলকের আকারে গাছটির চারদিকে কোদাল চালিয়ে মাটি তুলতে থাকে। খানিকবাদে কাণ্ডমূলসহ কাঠালগাছটি ঝাকড়াচুলো বাউলের উন্মাদনা কব্জা করে এবং আচমকা দুলুনি লেগে তেইশজন কামলার চারজন চাপা পড়ে অর্ধগোলক খাদের ভেতর। উনিশজন কামলা এবার গাছের মাথার দিককার ডালে দড়ি বেঁধে টানতে থাকে, গাছটি ক্রমেই হেলে পড়তে থাকে এবং গাছের ডালপালা ও পাতার আড়ালে লুকানো অজস্র চুড়ুই ও বাবুই পাখি, অনেক না হলেও বেশ কিছু চিল ও শকুন আকাশ কিংবা তিস্তা নদীর দিকে উড়ে চলে যায়। আতপ আলী কাঠালগাছটিকেও মাটিতে কবর দেন। কিন্তু অজস্র চড়ুই ও বাবুই পাখিকে, বেশ কিছু চিল ও শকুনকে কবর দিতে না পেরে মন ভেঙে যায় তার। তিনি তো জানতেন, গাছে পাখি থাকে, আর এই পাখি ধরতেও অসুবিধা হতো না কোনও, পাখির হাত থেকে লিচু বাঁচানোর জন্যে প্রতি বছরই তো তিনি গোটা গাছ বড় জাল দিয়ে পেঁচিয়ে ফেলেন; কায়দা করে সেই জাল রাতের বেলা গাছের ওপর ফেলে দিলে পাখিদের বাপেরও কি সাধ্য ছিল যে টের পায় মূল ঘটনা? এত কিছু জানার পরও পাখি ধরার কোনও ব্যবস্থা আগে থেকে করা যায় নি বলে নিজেকে মহাপাতক মনে হয় তার। নিজেকে বিশুদ্ধ করে তোলার জন্যে আতপ আলী সরকার সে বছরের শীতে পাখি শিকারে যান চলনবিলে। আতপ আলী মিয়ার নাতনিও না কি বিয়ের বেলা পালাতে না পেরে আত্মহত্যার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু এই নাতনি, আতপ আলী মিয়া যার নাম অনেক-অনেক আরবি ফার্সি আর উর্দু বই ঘেটে সুমাইয়া রেখেছিলেন, শেষ মুহূর্তে সে আয়েশার মতো আত্মহত্যা করতে ব্যর্থ হয় এবং তাকে আতপ আলী মিয়ার সুযোগ্য সন্তান মতলব আলী মিয়া বাবার পথ অনুসরণ করে আরও সফলভাবে জীবিতাবস্থাতেই গলা টিপে মেরে ফেলে পিতার মৃত আত্মাকে সন্তুষ্ট করে।
কিন্তু আয়েশা কিংবা সুমাইয়ার মতো রাশেদা অত উশ্খুশ করে না, আত্মহত্যা করার চেষ্টা চালায় না কিংবা কেউ তাকে গলা টিপে হত্যাও করে না। সে বরং বিয়ের শাড়িটা যে লালের বদলে গোলাপীরঙা কিনতে হবে সেটা তার ভাবীকে গাইবান্ধা টাউনে কেনাকাটা করতে যাওয়ার আগে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। আর বরযাত্রী আসে, ক্ষেতে মই দিতে দিতে রফিক তাদের আসতে দেখে, কিন্তু গাইতে ভুলে যায় ‘আমারই বধুয়া আনবাড়ি যায়, আমারই আঙিনা দিয়া।’ ফলে ‘আমি তাকে গ্রহণ করলাম’ থেকে ‘কবুল’ পর্যন্ত সবকিছুই ঠিকমতো হয়ে যায়। এবং রাশেদা যে একদিন তাকে হাতের ঝাটা দিয়ে বারি দিয়েছিল সে কথা বিস্মৃত হয়ে জমির আলী সরকার বিয়ের দিন নিজেই ঢোল বাজানোর চেষ্টা করে। ঢোল বাজাতে ব্যর্থ হয়ে মাইক্রোফোনটা হাতে তুলে নিয়ে গান ধরে ‘হলুদিয়া পাখি সোনালী বরণ, পাখিটি ছাড়িল কে’। বিয়ের মতো আনন্দউল্লাসের দিনে এরকম একটি ব্যথাবেদনার গান গাওয়ায় বরযাত্রীরা খুবই অসন্তুষ্ট হয় এবং তাদের মন ভাল করার জন্যে রাশেদার ছোটভাই জমির আলী সরকারের হাত থেকে মাইক্রোফোন কেড়ে নেয়। রায়েকবন্দরের কেউই বলতে পারবে না ওইদিন রাশেদা মরে যেতে চেয়েছিল কি না কিংবা কলমিদহের কেউই বলতে পারবে না ওইদিন রফিকও মরে যেতে চেয়েছিল কি না। তবে এ তো দিনের সূর্যের মতো সত্যি রাশেদা আত্মহত্যা করে নি, আত্মহত্যার চেষ্টাও করে নি, তার বাবা তাকে গলা টিপে হত্যাও করে নি। বরপক্ষ যে বিয়ের আসরে ‘হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ’ গান শুনে অসন্তুষ্ট হলেও রাশেদার চরিত্র নিয়ে কোনও সন্দেহ করে না, তার কারণও তো মিয়াবাড়ির বংশপরম্পরায় ঘটা ওইসব ঘটনা। বরপক্ষ তাই চলে যাওয়ার আগে মাইকওয়ালাকে দশটাকা বখশিশ দেয় এবং বলে আরও টানা আধাঘন্টা মাইকে ‘হলদি বাটো, মেহদি বাটো, বাটো ফুলের মৌ’ গানটা বারবার বাজাতে, যাতে মাইকের আওয়াজ যতক্ষণ পাওয়া যায় ততক্ষণ পালকিতে চড়ে যেতে যেতে বরকনে এই একই গান শোনে এবং তার মর্মোদ্ধার করার চেষ্টা করে।
কিন্তু রায়েকবন্দরে যে গানই বাজানো হোক না কেন, কলমিদহ থেকে সে গান স্পষ্ট শোনা যায়। রফিক তাই হলুদিয়া পাখি ছেড়ে দেয়ার তত্ত্বতালাশ করতে থাকা জমির আলী সরকারের গলা শোনে, আবার বারবার বাজতে থাকা সেই ‘হলদি বাটো, মেন্দি বাটো’ও শোনে। তবে এইসব শুনে তার কোনও ক্রিয়া হয় না, প্রতিক্রিয়াও না। অবশ্য একটি শক্ত মাটির ঢেলাকে অনেক সময় ধরে সে পাচন দিয়ে আস্তে আস্তে চাঁছতে থাকে। কিন্তু এ কাজটিকে তো আর ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া বলা যায় না। বাইরের জল হাওয়া মাটির ঢেলায় যে অমসৃনতা তৈরি করেছিল রফিকের ধারালো পাচন সেই ঢেলার বিভিন্ন দিক ক্রমশ মসৃন করে তুলতে থাকে এবং ঢেলাটি মসৃন হতে হতে একসময় ছোট হয়ে যায়।
কিন্তু রায়েকবন্দরে যে গানই বাজানো হোক না কেন, কলমিদহ থেকে সে গান স্পষ্ট শোনা যায়। রফিক তাই হলুদিয়া পাখি ছেড়ে দেয়ার তত্ত্বতালাশ করতে থাকা জমির আলী সরকারের গলা শোনে, আবার বারবার বাজতে থাকা সেই ‘হলদি বাটো, মেন্দি বাটো’ও শোনে। তবে এইসব শুনে তার কোনও ক্রিয়া হয় না, প্রতিক্রিয়াও না। অবশ্য একটি শক্ত মাটির ঢেলাকে অনেক সময় ধরে সে পাচন দিয়ে আস্তে আস্তে চাঁছতে থাকে। কিন্তু এ কাজটিকে তো আর ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া বলা যায় না। বাইরের জল হাওয়া মাটির ঢেলায় যে অমসৃনতা তৈরি করেছিল রফিকের ধারালো পাচন সেই ঢেলার বিভিন্ন দিক ক্রমশ মসৃন করে তুলতে থাকে এবং ঢেলাটি মসৃন হতে হতে একসময় ছোট হয়ে যায়।
প্রতিদিন রফিক এরকমভাবে একটি ঢেলা মসৃন করতে থাকে। এরকম সে কয়দিন করে জানা যায় না। কেননা মসৃন ঢেলাটি সে যত্ন করে প্রতিদিন ক্ষেতের উত্তর শিয়রে রেখে আসে এবং পরদিন সেই ঢেলাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। রাশেদার বিয়ে রফিকের জীবনে আর কোনও ছাপ রাখে কি না তা জানার জন্যে কলমিদহ কিংবা রায়েকবন্দরের লোকজনকে অপেক্ষা করতে হয় আরও চারমাস। এই চারমাসে রফিকের বাবা-মা আর পাড়াপ্রতিবেশী সবাই রফিকের ওপর ক্রমশ খুশি হতে শুরু করে। কারণ আগের মতো সে আর ক্ষেতে যাওয়ার কাজে ফাঁকি দেয় না, নিখুঁত দায়িত্ববোধ থেকে সে প্রতিটি কাজ করতে থাকে, পাড়াপ্রতিবেশীরা তার আচরণ আর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে যায়, তাদের মনে হতে থাকে খোদার ফেরেশতাদের মতো দশ হাত দশ পা নিয়ে রফিক তাদের সবাইকে উদ্ধার করার জন্যে এ জগতে নেমে এসেছে সৌরজগতের অজানা কোনও গ্রহ থেকে। এমনকি গ্রামে যখন বাইদানিরা দাঁতের ব্যথা, শুলের ব্যথা, মাজার ব্যথা, হাড়ের ব্যথা দূর করতে আসে, পোকা ফেলতে আসে তখনও সে তাদের চেহারা দেখার ছুঁতায় মেয়েদের সঙ্গে হাসাহাসি করে না। এসবের বদলে সে তাদের মাটির বড়ঘরটার একেবারে মধ্যের কোঠায় চলে যায়। দুপুরেও সেই ঘরে আলো ঢোকে না। আর মাটির দেয়াল থেকে খুব-খুব সুশীতল শান্তি উঠে আসে। মন্দিরের মতো কক্ষটা সুশীলতা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে কী এক নৈবেদ্যর জন্যে। মাঝখানের এ কোঠায় ঢোকা যায় দু দিক থেকে। যদিও অন্য দু দিক থেকেও অনায়াসে এ কোঠায় ঢোকার ব্যবস্থা করা যেত এবং তাতে কোঠাটা খানিকটা আলো ঝলমল হয়ে উঠত। এ কোঠার একদিকে থাকে রফিকের বাবা-মা, আরেকদিকে থাকে বড়ভাই আর ভাবী। রাত নেমে এলে আর ঘুম হারালে তারা এতই অসচেতন হয়ে পড়ে যে যে মাঝখানের আর দু পাশের কোঠাগুলো থেকে রফিক ও তার ভাইবোনরা বেশ ভালভাবেই বিবিধ শিৎকার ধ্বনি শুনে চলে। ঘর বানানোর এই অদ্ভুত নকশা রফিকের দাদার দাদার মাথায় কী করে এসেছিল সে কথা কেউ জানে না। রফিকের দাদা শুধু বলতে পারে, ঘরের একেবারে মধ্যেকার ওই গোলাকার কোঠা আর জয়কালি বাড়ির মন্দির হুবহু একই রকম। তবে তার সেই কথা সত্যি কি না তাও আর নিশ্চিত করা যায় না, জয়কালি বাড়ির মন্দিরটা এই বছর কয়েক আগে এক সামরিক জান্তার উল্লসিত নেতাকর্মীরা একরাতে ভেঙে ফেলেছে বলে।
রফিকের দাদার দাদা কোন আক্কেলে মাঝের এই গোল কোঠাটা বানিয়েছিল? এই কোঠার জন্যে তো আর সব কোঠাও বদছিরি হয়ে গেছে! একদিন দুপুরবেলা রফিকের আত্মীয়স্বজন আর পাড়াপ্রতিবেশী সবাই আবিষ্কার করে ঘরটার এই মারাত্মক ত্রুটিটাকে। তার আগের দিন রফিক হঠাৎ সেই কোঠায় গিয়ে ঢোকে, কিন্তু কেউ তা টের পায় না, কেননা তার মা তখন রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তার ভাবীও মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে মাছ আর তরিতরকারি কাটাছেঁড়া করে এবং মাঝেমধ্যে উঠোনে গিয়ে দেখে উঠোনে মেলে দেয়া ধান শুকালো কি না। বাড়ির ছোট ছোট ছেলেপেলেরা তখন স্কুলে গেলেও ক্লাস নেয়ার মতো কোনও শিক্ষক না থাকায় সড়কের ধারে এসে গাছটার নিচে গোল হয়ে ফিসফিসিয়ে মাপজোক করে দেখতে থাকে, কার নুনু কত বড়। আর পিচ্চি পিচ্চি মেয়েদের চোখ হঠাৎ সেদিকে আটকে গেলে তারা ‘এ-মা-আ-কী ব্যাদ্দপ’ বলতে বলতে ঘুরে হাসতে হাসতে দৌড়ে খানিক দূরে চলে যায়। তারপর তারাও গোল হয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে কথাবার্তা বলে, বার বার পিছু ফিরে তাকায় আর হাসাহাসি করে। এরই মধ্যে রফিক তাদের মাটির ঘরের মধ্যের কোঠায় ঢুকে বন্ধ করে দেয় দু দিকের দরজা দুটো। তারপর অনেক সময় পার হয়ে যায়। রফিকের ভাবী বিকেলের দিকে সেই দরোজায় ঠক ঠক আওয়াজ তোলে আর রফিককে উঠে এসে খেতে বলে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। তার ভাবী খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে, তারপর আবারও তর্জনীর উল্টো দিক দিয়ে দরোজায় ঠক ঠক আওয়াজ করতে থাকে। এইভাবে তার ভাবী কতবার তর্জনী ঠোকে তা কেউ গুণে রাখে নি, তবে ভেতর থেকে রফিকের ফ্যাঁসফেঁসে অস্পষ্ট স্বর শোনা গেলে তার ভাবী কান পাতে তা স্পষ্ট করে শুনতে। সে শুনতে পায়, রফিক বলছে যে, মুই আর কুনুদিনও ঘরের বাইরত যাবার নয়। মুই আর আলোবাতাস দেইখবার নয়। এ্যাংখাই জীবন দিম্। মোর এই জীবনের কী দাম আছে কও?
রফিকের ভাবীর দম আটকে আসে। জীবন সম্পর্কিত এরকম ভাবগম্ভীর কথাবার্তার মুখোমুখি তাকে এ পর্যন্ত কোনওদিন হতে হয় নি। স্বামীর সঙ্গে সঙ্গমের সময় তার অবশ্য দু’চারবার মনে হয়েছে, সারাটা জীবন যদি এরকম চিৎ-উপুর হয়ে থাকা যেত, তা হলে কতই না ভাল হতো! কিন্তু তাই বলে কখনও তো মনে হয় নি, ওইভাবে সবসময় কাটাতে না পারলে জীবনটাই মূল্যহীন হয়ে পড়বে। অতএব রফিক কেন জীবনটাই দিয়ে দিতে চায়, রফিক কেন জীবনের কোনও দাম খুঁজে পায় না তা তার মাথায় ঢোকে না। মহাফাঁপড়ে পড়ে সে। তারপর খুব কষ্ট করে একটু দম ফিরিয়ে আনে এবং বিকট স্বরে চিৎকার করে ‘ও মা, রফিক এ্যাংখা কী কয়’ বলতে বলতে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে বসে। এই চিৎকার রফিকের বাবা-মাকে সচকিত করে, পাড়াপড়শিকে সচকিত করে এবং তারা ছুটে এসে সব শুনে ব্যাক্কেল হয়ে যায়। রফিকের বাবার মনে পড়ে, আজ সকালেও এই ছেলে তাকে ক্ষেতে যেতে দেয় নি, বলেছে এই বয়সে খাটাখাটনি একটু কম করতে; আর এখন সেই ছেলে ঘরে ঢুকে ঘরের দরোজাই খোলে না! তা হলে কি সেই পুরানো জিন-পরীরা আবার এ বাড়িতে ঢোকার তালা খুলে ফেলেছে? অনেক বছর আগে, তার দাদার জন্মেরও বছর ত্রিশেক আগে না কি এই বাড়ির চারদিক ঘুরতে ঘুরতে দোয়াদরুদ পড়ে এক মৌলানা তাদের বাড়িতে অদৃশ্য এক তালা ঝুলিয়ে চাবিটা নিয়ে চলে গেছে। এখন আর তাই এ বাড়িতে কোনও জিনপরী আর ভূতপ্রেত ঢুকতে পারে না। কিন্তু সেই মৌলানার কাছে থেকে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই অদৃশ্য তালার অদৃশ্য চাবিটা লুট করে নিয়েছে! না হলে তার এমন ভাল ছেলে এমন কথা বলে কী করে! কে জানে কোন পরীর কোন নখরামিতে ছেলে তার এরকম বেয়াদপি করছে! আর নখরামিরও তো সীমা থাকা দরকার। এই কোঠায় মাচার ওপর থরে থরে সাজানো আছে এ বাড়ির বড় বড় হাড়িকোলা, একেক হাড়িতে একেক ধানের বীজ, একেক পাটের বীজ, কয়েক পদের ডাল আর তিল-কাউন এইসব ফসলের বীজ। মেঝেতে আছে দিনকয়েক আগের সিদ্ধ করা ধান। এককোণে একটা ছোট জলচৌকি আছে, কোনও কাজে লাগে না সেটা, মাঝেমধ্যে বাড়ির কারও গরম লাগলে এ ঘরে ঢুকে ওই জলচৌকির ওপরে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে সে; এখন বোঝা যাচ্ছে জলচৌকিটার ওপরেই রফিককে জেঁকে বসেছে শয়তানি পরীটা। পরীই যদি ধরবে, তবে রফিককে ধরতে গেল কেন? তার বদলে সে ছোটটাকে ধরলেই পারত, সেইটা তো রাজ্যের বেয়াদপ, পরী যদি ওই শফিক্ক্যাকে উড়িয়ে নিজেদের দেশে নিয়ে যেত তাতেও কোনও আপত্তি থাকত না রফিকের বাপ-ভাইদের। কিন্তু রফিক হলো হীরের টুকরো ছেলে, তাই রফিকের বাবা বারবার আয়াতুল কুরসী পড়ে আর অদৃশ্য জ্বিনের উদ্দেশ্যে ধমক ঝাড়তে থাকে। রফিককে বেরিয়ে আসার জন্যে বারবার ডাকতে থাকে সবাই। কিন্তু রফিক মা বাবা ভাই ভাবী সবাইকে চমকে দিয়ে একবার গলাখাঁকারি দিয়ে আশান্বিত করলেও বের হয় না। জমির আলী সরকার পর্যন্ত কী করে যেন এ খবর পেয়ে যায় এবং সে এখানে এসে দাঁড়িয়ে স্বগতোক্তি করতে থাকে, ‘এই জইন্যে ব্যাটাছাওয়া ঠিক সোময়ে বিয়া দ্যাওন লাগে। ঠিক সোময়ে বিয়া হইলে আর পাগল হইত না।’ এই উক্তিতে রফিকের মা ছাড়া সবাই বিরক্ত হয় আর রফিকের মা ডুকরে কেঁদে ওঠে। রফিকের ভাবী এরকম কোনও এক মাহেন্দ্রক্ষণের জন্যেই এতদিন অপেক্ষা করছিল, সে এবার প্রাণ খুলে তার শাশুড়ির সঙ্গে গলা মিলিয়ে কাঁদে আর বলতে থাকে, ‘মুই ম্যালা আগেই কইছিলাম, মোর বড়ভাবীর খালাতো বইনের কতা…।’
রফিকের বাবা আবারও আয়াতুল কুরসি পড়তে পড়তে পরীর উদ্দেশে ধমক ছাড়ে। এই ধমকে পরী ভয় পায় কি না জানা যায় না, তবে ধমকের ওজনে রফিকের মা ও ভাবীর কান্না থেমে যায়। তারা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আশ্বস্ত হয়, ধমকটা তাদের উদ্দেশে দেয়া হয় নি; তখন তারা আবারও একটু একটু করে কাঁদার চেষ্টা করতে থাকে। রফিক কিছুতেই দরোজা খোলে না দেখে তার বাবা কিছুক্ষণের জন্যে আয়াতুল কুরসি জোরে জোরে পড়া বন্ধ রাখে এবং কী করে ঘরের দরোজাটা খোলার ব্যবস্থা করা যায় সে বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতে থাকে। বাঁশ দিয়ে বানানো এই খিড়কিদুয়ার ভেঙে ফেলা তেমন কঠিন নয়। কিন্তু মুশকিল হলো, দরোজা ভাঙতে গেলে রফিক ঠিক কী করবে তা তারা আন্দাজ করতে পারে না। এমনও তো হতে পারে কুড়াল মেরে দরোজা ভাঙা হচ্ছে দেখে সে দরোজার সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে থাকবে। আবার বলা তো যায় না, রায়েকবন্দরের ওই রাশেদার বোনদের মতো আত্মহত্যা করার প্রস্তুতিও নিতে পারে। কেউ কেউ বলে, আগে ঘর থেকে ভূত তাড়াতে হবে। কী করা হবে, কী করা হবে না নিয়ে সন্দেহ আর অবিশ্বাসে চেঁচামেচি করতে থাকে তারা। শেষমেশ ঠিক হয়, সবাই মিলে ঢেকি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরোজাটা ভেঙে ফেলবে। তারপর সহজ এই সমাধান খুঁজে পেয়ে তারা নিজেরাই বিস্মিত হয়ে যায়।
এইসময় ভেতর থেকে রফিক খুব স্পষ্টস্বরে বলে, দরোজা ভাইঙ্গে কোনো লাভ হবার নয়, মু ঘরত থন বারাবার নয়। এ ঘরত মোর মিত্যু হবে।
নিজের মৃত্যু সম্পর্কে রফিকের এরকম নিশ্চিত ঘোষণায় বাড়ির লোকজনের পরিকল্পনা নিমিষে ভেস্তে যায়। আর আবারও রফিকের মা আর ভাবীর কান্নাকাটির সুর উপচে উঠতে থাকে কণ্ঠনালীর গহ্বর ছাপিয়ে। রফিকের বাবা আয়াতুল কুরসি পড়তে থাকে দিশেহারার মতো। তখন হঠাৎ করেই সবার নজরে আসে রফিকও তার বাবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে আয়াতুল কুরসি পড়ে চলেছে। রফিকের বাবার কণ্ঠ বুজে আসে, তখন সে তার স্বরের পাশে আরও একটি স্বরের অস্তিত্ব অনুভব করে, তার আয়াতুল কুরসি পড়া বন্ধ হয়ে যায় এবং সবাই শুনতে পায়, রফিক একা-একাই পড়ে চলেছে ‘আয়াতুল কুরসি’। পরীধরা ছেলে কেন আয়াতুল কুরসী পড়তে যাবে? রফিকের বাবার মনে এবার স্বস্তি ফিরে আসে এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজের আদি অকৃত্রিম চেহারা আর স্বভাবও ফিরে পায় সে, চিৎকার করে বলতে থাকে, ফাইজলামি করিস না, বুঝলি, ফাইজলামি করিস না। ঢং ধইরছে! মুই আগেই মনত করছিলাম, এই ছাওয়া ঢং করে। যে ছাওয়া লাঠি দিয়া ডাঙালিও খ্যাতে যায় না হে পত্যেকদিন শ্যাষ রাতত উইঠা খ্যাতে যায় কোন কামে! জমির ঠিক কইছে! এই হারামজাদা, বারায়া আয়, তোক মুই আইজক্যাই বিয়া দেম। দেহি তোর কত খাড়ায়।
এইভাবে পিতা তার পুত্রের যৌনক্ষমতা নিরীক্ষণ কিংবা পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়ার কথা ঘোষণা করলে সমবেত লোকজনের মধ্যে অস্বস্তি নেমে আসে, নেমে আসে নীরবতা, যদিও কারও কারও মুখে কিংবা বুকের মধ্যে হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু রফিক কোনও উত্তর দেয় না। রফিকের বাবা সরোষে টানাটানি শুরু করে দরজার পাল্লার অপ্রশস্ত বাটাম ধরে। উপস্থিত সকলে রফিকের বাবার এই ক্রুদ্ধ টানাটানিতে কেবল দরোজা নয়, মাটির দেয়ালও ভেঙে পড়ার বিরল এক দৃশ্য দেখার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু দরজা ভেঙে পড়ে না, কেননা রফিকের বড়ভাই এসে তাকে টেনে থামায়। বাড়িতে এইভাবে লোকজন জমে ওঠায় রফিকের ভাই বাস্তবিকই বিরক্ত, তাই আগে নিজের বাবাকে ঘরের মধ্যে থেকে বের করে আনে সে। কেউ কেউ তাদের পিছু পিছু বেরিয়ে আসে, বাদবাকি সবাইকেও রফিকের ভাই বের করে আনে দ্বিতীয় দফায়। তারপর তার বাবাকে শান্ত হতে বলে, মোড়ার ওপর বসতে বলে এবং নিজেও তার মুখোমুখি বসে। এবার সে প্রশ্ন করে, কী হচ্যে?
দুফুরে ওই ঘরত ঢুইকছে। তারপরত আর বাড়ায় না।
টাইম হইলেই বারাবে। তুই তা নিয়া এ্যাংখা চেঁচামেচি কর ক্যা?
চেঁচামেচি করমু না? ঘরের ডাশা তুইলা দিছে, তারপরত মুই চুপ থাকমু?
চুপ থাহো না, দ্যাহো, প্যাটে যহন গরম নাগবে তহন একলাই বাইর হইবে।
এই কথাটা এতক্ষণ কেন মনে আসে নি? এই ভেবে রফিকের বাবার নিজের মনেই শ্লাঘা জমে। নিজেই তো কতদিন কত মানুষকে বলে এসেছে সে, মানুষ দুইদিনের জইন্যে দুনিয়ায় আইসাও এত কিছু করে খালি প্যাট আর চ্যাটটার জইন্যে। অথচ এই সময় সেই গুরুত্বপূর্ণ কথাটাই তার মনে আসে নি? থাহো, দরোজা বন্ধ কইরা, দেহি কয়দিন থাইকবার পারো! কয়দিন না খায়া থাইকবো? য্যাংখা ক্ষিধা লাইগবো স্যাংখা দৌড়াদোড়ি শুরু কইরব। দেহি, কয়দিন না খায়া ঘরত বইসা বইসা হাত মাইরবার পারো। এইভাবে মনে মনে একটা বোঝাপড়া করে ফেলতে পারলে রফিকের বাবা একটা হাঁফছাড়ানো বড় নিঃশ্বাস ফেলে এবং নিজের নির্বুদ্ধিতায় হাঁকাহাকি করতে গিয়ে গাঁয়ের সব লোককে নিজের বাড়ির উঠানে এনে জড়ো করেছে বলে আফসোস করতে থাকে।
তবে বিস্ময়কর হলেও সত্যি, রফিক তার বাপ ও ভাইয়ের ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে ওই ছোটকোঠার মধ্যেই নিজেকে গুটিয়ে রাখতে থাকে নিজের ‘প্যাট আর চ্যাট’কে সামাল দিয়ে। এইভাবে দেড়দিন কাটলে বাড়ির সবাই খানিকটা চিন্তিত হয়। তবে তাদের চিন্তাকে আরও ত্বরান্বিত করে পাড়াপ্রতিবেশীরা। বারবার তারা যাত্রায় গিয়ে জীবনের প্রথম কোনও মেয়ের বুকের খাঁজ আর উরু দেখার উত্তেজনা নিয়ে রফিকের খোঁজখবর নিতে বাড়ির মধ্যে উঁকিঝুকি দিতে থাকে। যতবারই তারা জানতে চায়, ক্যা রে বাবা, রফিক ক্যাংখা আছে? ততবারই তাদের বাপ-ভাইদের বুকে খোঁচা লাগে, তাদের মনে হতে থাকে, রফিক বোধ হয় সত্যিই পাগল হয়ে গেছে! রফিকের বাপের বিশ্বাসের ভিত নড়েচড়ে উঠতে শুরু করে, কিন্তু তারপরও রফিকের বড়ভাই দরোজা ভাঙার ব্যাপারে তার আপত্তি বহাল রাখে। আর জমির আলী সরকারকে দেখলে মনে হয় না, তার অন্য কোনও কাজকর্ম আছে, কেননা বলতে গেলে প্রায় সারাদিনই রফিকদের বাড়িতে পড়ে থাকে সে। যে যা বলে তা সে শোনে মনযোগ দিয়ে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সবই আল্লার ইচ্ছা…ক্যান যে রফিকের ভাবগতিক এব্যা হলো…। এইভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলা আর স্বগত সংলাপ দেয়া তার বয়সের সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না বলে আশপাশের লোকজন তাকে ভালভাবে খেয়াল করতে শুরু করে এবং জমির তখন আবারও ‘ক্যান যে রফিকের ভাবসাব এব্যা হলো…’ বলে রফিকের এরকম হওয়ার কারণ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটানোর চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু প্রতিবারই কোনও না কোনও অলৌকিক কারণে তার আলোচনার উদ্যোগ নষ্ট হয়ে যায়। অবশেষে দেড়দিন পেরুনো বিকেল এলে, মাঝপাড়ার অতশী বুড়ি রফিকের মায়ের লাগানো বিচাকলা গাছের ঝোপ থেকে একটা কন্দ কেটে নিয়ে যায়। আর মফিজ আলীর মুখে হাসি ফোটে। কেননা তখন মৌলবী এনায়েত রসুল আসেন এবং আবারও দোয়া পড়ে তাবিজ পুঁতে বাড়ির চারপাশ ঘুরে ভূত-জ্বিন-পরী-পেত্নীর আসাযাওয়া বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়ার আগে ভাল করে জানতে চান গত এক বছরে তার ছেলের মতিগতি কেমন ছিল। মৌলবী এনায়েত রসুলের কাছে কেউ রফিকের বদনাম করে না। তারা তার প্রশংসা করতে থাকে, যেন তার মৃত্যু ঘটেছে, এখন সে কবরে যাচ্ছে এবং এই মুহূর্তে তার বিরুদ্ধে কোনও জাগতিক অভিযোগ নেই তাদের। তবে জমির আলী সরকারের মুখের হাসি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে, কী এক অস্থিরতায় তার চোখের ভ্রু কুঁচকে উঠতে থাকে এবং যখন পাড়াপ্রতিবেশীদের আরও একজন বলে, পত্যেকদিন হামাগারে খোঁজখবর নিতো, তখন সে আর চুপ থাকতে পারে না। নিজের শরীরটাকে একটু বাঁকা করে সে বলে ওঠে, খোঁজখবর ন্যাওয়া শুরু কইরলো তো রাশেদার বিয়ার পরত থাকি।
কিন্তু মৌলবী এনায়েত রসুল কিংবা আর কারও কানে এ কথা আটকায় না। রাশেদার সঙ্গে রফিকের একটু ‘ইটিশপিটিশ’ হওয়ার কথা তাদের কারও কারও জানা আছে, কিন্তু সেটা কি তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার? তেমন হলে তো রাশেদার বিয়ের আগেই রফিকের মাথা গড়বড়িয়ে যাওয়ার কথা। এ হিসাব তো জমির আলীই ভাল জানে, রফিক তো তার কাছ থেকেই রাশেদার বিয়ে ঠিক হওয়ার খবর পেয়েছে বিয়ের দিনতিনেক আগে। খবর শুনতে শুনতে সে অবশ্য একবার তার কাঁধ থেকে মইটা মাটির ওপর নামিয়ে রেখে দিয়েছিল; কিন্তু তার খানিকপরই আবার কাঁধে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়েছিল। ‘রাশেদার বিয়ে হওয়ার পর থেকে’ শব্দগুলো তাই তাদের কাছে সময়ের হিসাব ছাড়া অন্য কোনও তাৎপর্য বয়ে আনে না। কিন্তু কথাটা বলতে বলতে জমির আলী নিজের অজান্তেই কোমরটা পেছনে সরিয়ে নেয় অণ্ডকোষ রক্ষা করার ভঙ্গিমায়। কেননা একদিন রাশেদা যখন যোগেনবাবুর ভিটার গড়ান বেয়ে নেমে আসছে তখন সে ত্বরিৎগতিতে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল এবং বলেছিল, রাশেদা, খালি আরাক পাড়ার ব্যাটাকই দিবি? মুই তোর পাড়ার পোলা, মোক একবার দিয়া দ্যাহ না! চোখ দুটো প্রেম নিতে শিখেছে বলে রাশেদা তখন বাপমায়ের চোখ বাঁচিয়ে যোগেন বাবুর ভিটার জঙ্গলে একটুআধটু আসতে শিখেছে, তখনও তার শরীর প্রেম নিতে শেখে নি, অতএব তার চোখে আগুন জ্বলে এবং সে জমির আলীর অণ্ডকোষ বরাবর একটা লাথি মারে। তীব্র যন্ত্রণায় জমির আলী বসে পড়ে এবং রাশেদা, ‘এ্যাংখা কতা ফের যদি কস তাইলে তোক ভাইগর দিয়া পিটায়া মাইরমু’ বলে চলে যায়। রাশেদা এত আস্থার সঙ্গে ভাইদের কথা উল্লেখ করে যে জমির আলী হতবাক হয়ে যায়, তা হলে কি রাশেদার সঙ্গে রফিকের কোনও ইটিশপিটিশ নেই, তা হলে কি তারা দুইজন এই যোগেন বাবুর ভুতুড়ে ভিটায় দেখা করে না? তার মনে ভয় জেগে ওঠে, যে পরিবারের মেয়েরা প্রেমের টানে অনায়াসে আত্মহত্যা করে আর ছেলেরা মেয়েদের গলা টিপে মেরে ফেলে সেই পরিবারের কোনও ছেলে সত্যিই যদি তাকে মারতে আসে তা হলে কী হবে ভেবে শিউরে ওঠে। এইভাবে বহুদিন কেটে যায়, সে ভীত এক ভেড়ার ছানার মতো চলাফেরা করে, তার সামনে কত কিছুই না ঘটে, তার ভয় কেটে যেতে থাকে, আবারও এক রাগ জেগে উঠতে থাকে। সে ঠিক করে, রাশেদার না পারুক, রফিকের জীবন সে ছারখার করে দেবে, সে দেখিয়ে দেবে জীবন আর মৃত্যু নয়, প্রেম আর মৃত্যু পাশাপাশি শুয়ে থাকে, প্রেম আর মৃত্যু খেলা করে জীবন আর মৃত্যুর মতো মুখোশ পরে। অতএব সেই দিন থেকে জমির আলী সরকার একটি ধুতুরা আর একটি ডুমুর গাছ লাগিয়ে তাদের পরিচর্যা করতে থাকে। কোনও কোনও সকালে সে গিয়ে দাঁড়ায় ধুতুরা আর ডুমুর গাছের কাছে, বদনা থেকে গাছের গোড়ায় পানি ঢালে, মনে হয় এখানে পানি ঢালার কোনও ইচ্ছেই নেই তার; কিন্তু পায়খানা করার পরও খানিকটা পানি বদনায় রয়ে গেছে এবং সেই পানিটুকু সে এইখানে ঢেলে দিচ্ছে। কখনও পানি ঢালতে ঢালতে, কখনও বিড়ি টানতে টানতে সে এইসব গাছদের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কথা বলে এবং কেউই জানতে পারে না তাদের শলাপরামর্শ। ঠিক একই রকম ফিসফিসানি তুলে জমির আলী আবারও বলে মৌলবী এনায়েত রসুলের পাশে দাঁড়িয়ে, হামাগারে রায়েকবন্দরের রাশেদার বিয়ার পরত থাকিই তো রফিক ভাল হল।
এবারও তার এই কথা কারও কানে দাগ কাটে না। কিন্তু মৌলবী এনায়েত রসুল ‘রাশেদা’ সম্পর্কে আগ্রহী হন, জমির আলী তখন খুবই নিস্পৃহকণ্ঠে রাশেদার পরিচিতি বয়ান করে। বলে, রাশেদা মিয়াবাড়ির মেয়ে, খুবই ভাল মেয়ে, মাসচারেক আগে তার বিয়ে হয়েছে। রফিকের বড়ভাই এবার সোজা হয়ে দাঁড়ায় এবং এগিয়ে এসে জমির আলীর ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বলে, এই হারামজাদা, তুই কি মনে কর যে রাশেদার বিয়া হইছে বইলাই রফিক ভাল হয়্যা গ্যাছে? আগে ভাল আছিল না?
তা ক্যান কমু? আগেও ভাল আছিল। রাশেদার বিয়ার পরত থাকি আরো ভাল হবার নাগছে।
খালি রাশেদা-রাশেদা কস ক্যা? এইর মইধ্যে আবার রাশেদাক জড়াস ক্যান?
রাশেদাক ক্যান জড়ামু। টাইম হিসাব করবার নাগছি। ও সময় তোমাগারে কারু কলেরা হইলে কত্যাম, ওই কলেরা হওয়ার পরথন রফিক ভাল হবার নাগছে…।
বলে সে পুরানো ব্লেড দিয়ে একবার পুরানো মইষা দাউদ চুলকাতে গিয়েও এত মান্যগণ্য লোকজন থাকায় ব্লেডটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে ফেললে সবাই হেসে ফেলে। কোঠার ভেতরে রফিক তখন জলচৌকির ওপর শুয়ে আছে নির্বিবাদে, তার কোনও উত্তেজনা নেই, পৃথিবীর সব যুদ্ধের নিরসন ঘটিয়ে শুয়ে পড়ার পরিতৃপ্তি তার শোয়ার ভঙ্গিমায়। সে কি কোনও স্বপ্ন দেখে? তাও বোঝা যায় না। তবে তার ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি অনবরত দুলে দুলে ওঠে। নিরিবিলি ঘরের মধ্যেকার অন্ধকারে আশ্রয় নেয়া দু চারটে বাদুর পাহারা দেয়ার মতো দ্রুত ওড়াওড়ি করতে থাকে। এদিকে মৌলবী এনায়েত রসুল ঘন ঘন সবার দিকে তাকান খুবই দ্বিধান্বিত, সংশয়মাখা চোখে। তারপর বলেন, সত্য ঘটনা জানা দরকার। তালি ওষুধ ঠিকমতো দ্যাওন যায় আর দোয়াও ঠিক কইরা পড়ন যায়। অসুখবিসুখ জানা থাইকলে দাওয়াই আর দোয়ায় কাজ হয় তাড়াতাড়ি। না হইলে মোক এ্যাকাকবার এ্যাকাক দোয়া পইড়তে পইড়তে টেস্ট করার নাগবে কোনটা খাপত নাগে। না-জানা অসুখে ওষুধ আর দোয়ায় কাজ হয় ম্যালা দেরিত্। মৌলবী এনায়েত রসুল এ কথা বলে উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকেন। রফিকের বাপ মা আর বড়ভাই-ভাবীকে তখন খুব বিস্মিত ও বিপর্যস্ত লাগে, কেননা চার মাস আগে থেকে রফিক ভাল হয়ে গিয়েছিল এ সত্যের চেয়েও বিস্ময়কর, রফিক কারও সঙ্গে প্রেম করেছিল।
এনায়েত রসুলের এরকম একটি উপদেশনামা শোনার পরও কেউ রফিক সম্পর্কে কোনও অন্যরকম কথা বলে না, এমনকি কামারপাড়ার যাদব কামারও না; অথচ এই যাদবকে মাসপাঁচেক আগে রফিক সতেরটা পাচন বানানোর বায়না দিয়েছিল, তারপর পাঁচনগুলো বানানো হয়ে গেলে বলেছিল, অত পাচুন দিয়া মুই কী করমু? যাদব তার হাত ঘসটাতে ঘসটাতে অনেক সাহস করে বলেছিল, তুমি না বানানের কথা কইলেন? রফিক তখন রহস্যময় হাসি দিয়ে বলেছিল, দেইখলাম তুই কীরহম তাড়াতাড়ি কাজকাম করিস। বানাইছিস বালই হ’চ্যে। এহন যা, হাটে হাটে গিয়া ঘুরবার লাগ, দ্যাখ, কেউ কেনে না কি। তখন যাদব কেঁদে ফেলেছিল, এক পাচন দিয়ে এক চাষার বলতে গেলে সারা জীবন কাটে, মাঝেমধ্যে একটু বালি দিয়ে ধার দিয়ে নিলেই সেটা নতুন হয়ে যায়। এই যখন অবস্থা তখন এরকম অজপাড়াগাঁয়ে সতেরটা পাচন সে বেচবে কেমন করে! তাও এই অকামের মৌসুমে? কাঁদতে কাঁদতে যাদব তাই চেঁচামেচি করে আর রফিক তখন হাসাহাসি করে। কাঁদতে কাঁদতে যাদব সারা পাড়া মাথায় তোলে, হাসতে হাসতে রফিক সারা গাঁ মাথায় তোলে। তাদের হাসিকান্না শুনে বাইরের লোকজন এগিয়ে আসে, পাড়ার লোকজনও এগিয়ে আসে। আর একটা পাচন হাতে নিয়ে রফিকের বাবা রফিককে প্রচণ্ড দাবড়ানি দিলেও সতেরটা পাচনের ভাগ্য পালটায় না।
রফিকের দাদার দাদা কোন আক্কেলে মাঝের এই গোল কোঠাটা বানিয়েছিল? এই কোঠার জন্যে তো আর সব কোঠাও বদছিরি হয়ে গেছে! একদিন দুপুরবেলা রফিকের আত্মীয়স্বজন আর পাড়াপ্রতিবেশী সবাই আবিষ্কার করে ঘরটার এই মারাত্মক ত্রুটিটাকে। তার আগের দিন রফিক হঠাৎ সেই কোঠায় গিয়ে ঢোকে, কিন্তু কেউ তা টের পায় না, কেননা তার মা তখন রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তার ভাবীও মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে মাছ আর তরিতরকারি কাটাছেঁড়া করে এবং মাঝেমধ্যে উঠোনে গিয়ে দেখে উঠোনে মেলে দেয়া ধান শুকালো কি না। বাড়ির ছোট ছোট ছেলেপেলেরা তখন স্কুলে গেলেও ক্লাস নেয়ার মতো কোনও শিক্ষক না থাকায় সড়কের ধারে এসে গাছটার নিচে গোল হয়ে ফিসফিসিয়ে মাপজোক করে দেখতে থাকে, কার নুনু কত বড়। আর পিচ্চি পিচ্চি মেয়েদের চোখ হঠাৎ সেদিকে আটকে গেলে তারা ‘এ-মা-আ-কী ব্যাদ্দপ’ বলতে বলতে ঘুরে হাসতে হাসতে দৌড়ে খানিক দূরে চলে যায়। তারপর তারাও গোল হয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে কথাবার্তা বলে, বার বার পিছু ফিরে তাকায় আর হাসাহাসি করে। এরই মধ্যে রফিক তাদের মাটির ঘরের মধ্যের কোঠায় ঢুকে বন্ধ করে দেয় দু দিকের দরজা দুটো। তারপর অনেক সময় পার হয়ে যায়। রফিকের ভাবী বিকেলের দিকে সেই দরোজায় ঠক ঠক আওয়াজ তোলে আর রফিককে উঠে এসে খেতে বলে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। তার ভাবী খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে, তারপর আবারও তর্জনীর উল্টো দিক দিয়ে দরোজায় ঠক ঠক আওয়াজ করতে থাকে। এইভাবে তার ভাবী কতবার তর্জনী ঠোকে তা কেউ গুণে রাখে নি, তবে ভেতর থেকে রফিকের ফ্যাঁসফেঁসে অস্পষ্ট স্বর শোনা গেলে তার ভাবী কান পাতে তা স্পষ্ট করে শুনতে। সে শুনতে পায়, রফিক বলছে যে, মুই আর কুনুদিনও ঘরের বাইরত যাবার নয়। মুই আর আলোবাতাস দেইখবার নয়। এ্যাংখাই জীবন দিম্। মোর এই জীবনের কী দাম আছে কও?
রফিকের ভাবীর দম আটকে আসে। জীবন সম্পর্কিত এরকম ভাবগম্ভীর কথাবার্তার মুখোমুখি তাকে এ পর্যন্ত কোনওদিন হতে হয় নি। স্বামীর সঙ্গে সঙ্গমের সময় তার অবশ্য দু’চারবার মনে হয়েছে, সারাটা জীবন যদি এরকম চিৎ-উপুর হয়ে থাকা যেত, তা হলে কতই না ভাল হতো! কিন্তু তাই বলে কখনও তো মনে হয় নি, ওইভাবে সবসময় কাটাতে না পারলে জীবনটাই মূল্যহীন হয়ে পড়বে। অতএব রফিক কেন জীবনটাই দিয়ে দিতে চায়, রফিক কেন জীবনের কোনও দাম খুঁজে পায় না তা তার মাথায় ঢোকে না। মহাফাঁপড়ে পড়ে সে। তারপর খুব কষ্ট করে একটু দম ফিরিয়ে আনে এবং বিকট স্বরে চিৎকার করে ‘ও মা, রফিক এ্যাংখা কী কয়’ বলতে বলতে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে বসে। এই চিৎকার রফিকের বাবা-মাকে সচকিত করে, পাড়াপড়শিকে সচকিত করে এবং তারা ছুটে এসে সব শুনে ব্যাক্কেল হয়ে যায়। রফিকের বাবার মনে পড়ে, আজ সকালেও এই ছেলে তাকে ক্ষেতে যেতে দেয় নি, বলেছে এই বয়সে খাটাখাটনি একটু কম করতে; আর এখন সেই ছেলে ঘরে ঢুকে ঘরের দরোজাই খোলে না! তা হলে কি সেই পুরানো জিন-পরীরা আবার এ বাড়িতে ঢোকার তালা খুলে ফেলেছে? অনেক বছর আগে, তার দাদার জন্মেরও বছর ত্রিশেক আগে না কি এই বাড়ির চারদিক ঘুরতে ঘুরতে দোয়াদরুদ পড়ে এক মৌলানা তাদের বাড়িতে অদৃশ্য এক তালা ঝুলিয়ে চাবিটা নিয়ে চলে গেছে। এখন আর তাই এ বাড়িতে কোনও জিনপরী আর ভূতপ্রেত ঢুকতে পারে না। কিন্তু সেই মৌলানার কাছে থেকে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই অদৃশ্য তালার অদৃশ্য চাবিটা লুট করে নিয়েছে! না হলে তার এমন ভাল ছেলে এমন কথা বলে কী করে! কে জানে কোন পরীর কোন নখরামিতে ছেলে তার এরকম বেয়াদপি করছে! আর নখরামিরও তো সীমা থাকা দরকার। এই কোঠায় মাচার ওপর থরে থরে সাজানো আছে এ বাড়ির বড় বড় হাড়িকোলা, একেক হাড়িতে একেক ধানের বীজ, একেক পাটের বীজ, কয়েক পদের ডাল আর তিল-কাউন এইসব ফসলের বীজ। মেঝেতে আছে দিনকয়েক আগের সিদ্ধ করা ধান। এককোণে একটা ছোট জলচৌকি আছে, কোনও কাজে লাগে না সেটা, মাঝেমধ্যে বাড়ির কারও গরম লাগলে এ ঘরে ঢুকে ওই জলচৌকির ওপরে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে সে; এখন বোঝা যাচ্ছে জলচৌকিটার ওপরেই রফিককে জেঁকে বসেছে শয়তানি পরীটা। পরীই যদি ধরবে, তবে রফিককে ধরতে গেল কেন? তার বদলে সে ছোটটাকে ধরলেই পারত, সেইটা তো রাজ্যের বেয়াদপ, পরী যদি ওই শফিক্ক্যাকে উড়িয়ে নিজেদের দেশে নিয়ে যেত তাতেও কোনও আপত্তি থাকত না রফিকের বাপ-ভাইদের। কিন্তু রফিক হলো হীরের টুকরো ছেলে, তাই রফিকের বাবা বারবার আয়াতুল কুরসী পড়ে আর অদৃশ্য জ্বিনের উদ্দেশ্যে ধমক ঝাড়তে থাকে। রফিককে বেরিয়ে আসার জন্যে বারবার ডাকতে থাকে সবাই। কিন্তু রফিক মা বাবা ভাই ভাবী সবাইকে চমকে দিয়ে একবার গলাখাঁকারি দিয়ে আশান্বিত করলেও বের হয় না। জমির আলী সরকার পর্যন্ত কী করে যেন এ খবর পেয়ে যায় এবং সে এখানে এসে দাঁড়িয়ে স্বগতোক্তি করতে থাকে, ‘এই জইন্যে ব্যাটাছাওয়া ঠিক সোময়ে বিয়া দ্যাওন লাগে। ঠিক সোময়ে বিয়া হইলে আর পাগল হইত না।’ এই উক্তিতে রফিকের মা ছাড়া সবাই বিরক্ত হয় আর রফিকের মা ডুকরে কেঁদে ওঠে। রফিকের ভাবী এরকম কোনও এক মাহেন্দ্রক্ষণের জন্যেই এতদিন অপেক্ষা করছিল, সে এবার প্রাণ খুলে তার শাশুড়ির সঙ্গে গলা মিলিয়ে কাঁদে আর বলতে থাকে, ‘মুই ম্যালা আগেই কইছিলাম, মোর বড়ভাবীর খালাতো বইনের কতা…।’
রফিকের বাবা আবারও আয়াতুল কুরসি পড়তে পড়তে পরীর উদ্দেশে ধমক ছাড়ে। এই ধমকে পরী ভয় পায় কি না জানা যায় না, তবে ধমকের ওজনে রফিকের মা ও ভাবীর কান্না থেমে যায়। তারা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আশ্বস্ত হয়, ধমকটা তাদের উদ্দেশে দেয়া হয় নি; তখন তারা আবারও একটু একটু করে কাঁদার চেষ্টা করতে থাকে। রফিক কিছুতেই দরোজা খোলে না দেখে তার বাবা কিছুক্ষণের জন্যে আয়াতুল কুরসি জোরে জোরে পড়া বন্ধ রাখে এবং কী করে ঘরের দরোজাটা খোলার ব্যবস্থা করা যায় সে বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতে থাকে। বাঁশ দিয়ে বানানো এই খিড়কিদুয়ার ভেঙে ফেলা তেমন কঠিন নয়। কিন্তু মুশকিল হলো, দরোজা ভাঙতে গেলে রফিক ঠিক কী করবে তা তারা আন্দাজ করতে পারে না। এমনও তো হতে পারে কুড়াল মেরে দরোজা ভাঙা হচ্ছে দেখে সে দরোজার সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে থাকবে। আবার বলা তো যায় না, রায়েকবন্দরের ওই রাশেদার বোনদের মতো আত্মহত্যা করার প্রস্তুতিও নিতে পারে। কেউ কেউ বলে, আগে ঘর থেকে ভূত তাড়াতে হবে। কী করা হবে, কী করা হবে না নিয়ে সন্দেহ আর অবিশ্বাসে চেঁচামেচি করতে থাকে তারা। শেষমেশ ঠিক হয়, সবাই মিলে ঢেকি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরোজাটা ভেঙে ফেলবে। তারপর সহজ এই সমাধান খুঁজে পেয়ে তারা নিজেরাই বিস্মিত হয়ে যায়।
এইসময় ভেতর থেকে রফিক খুব স্পষ্টস্বরে বলে, দরোজা ভাইঙ্গে কোনো লাভ হবার নয়, মু ঘরত থন বারাবার নয়। এ ঘরত মোর মিত্যু হবে।
নিজের মৃত্যু সম্পর্কে রফিকের এরকম নিশ্চিত ঘোষণায় বাড়ির লোকজনের পরিকল্পনা নিমিষে ভেস্তে যায়। আর আবারও রফিকের মা আর ভাবীর কান্নাকাটির সুর উপচে উঠতে থাকে কণ্ঠনালীর গহ্বর ছাপিয়ে। রফিকের বাবা আয়াতুল কুরসি পড়তে থাকে দিশেহারার মতো। তখন হঠাৎ করেই সবার নজরে আসে রফিকও তার বাবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে আয়াতুল কুরসি পড়ে চলেছে। রফিকের বাবার কণ্ঠ বুজে আসে, তখন সে তার স্বরের পাশে আরও একটি স্বরের অস্তিত্ব অনুভব করে, তার আয়াতুল কুরসি পড়া বন্ধ হয়ে যায় এবং সবাই শুনতে পায়, রফিক একা-একাই পড়ে চলেছে ‘আয়াতুল কুরসি’। পরীধরা ছেলে কেন আয়াতুল কুরসী পড়তে যাবে? রফিকের বাবার মনে এবার স্বস্তি ফিরে আসে এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজের আদি অকৃত্রিম চেহারা আর স্বভাবও ফিরে পায় সে, চিৎকার করে বলতে থাকে, ফাইজলামি করিস না, বুঝলি, ফাইজলামি করিস না। ঢং ধইরছে! মুই আগেই মনত করছিলাম, এই ছাওয়া ঢং করে। যে ছাওয়া লাঠি দিয়া ডাঙালিও খ্যাতে যায় না হে পত্যেকদিন শ্যাষ রাতত উইঠা খ্যাতে যায় কোন কামে! জমির ঠিক কইছে! এই হারামজাদা, বারায়া আয়, তোক মুই আইজক্যাই বিয়া দেম। দেহি তোর কত খাড়ায়।
এইভাবে পিতা তার পুত্রের যৌনক্ষমতা নিরীক্ষণ কিংবা পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়ার কথা ঘোষণা করলে সমবেত লোকজনের মধ্যে অস্বস্তি নেমে আসে, নেমে আসে নীরবতা, যদিও কারও কারও মুখে কিংবা বুকের মধ্যে হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু রফিক কোনও উত্তর দেয় না। রফিকের বাবা সরোষে টানাটানি শুরু করে দরজার পাল্লার অপ্রশস্ত বাটাম ধরে। উপস্থিত সকলে রফিকের বাবার এই ক্রুদ্ধ টানাটানিতে কেবল দরোজা নয়, মাটির দেয়ালও ভেঙে পড়ার বিরল এক দৃশ্য দেখার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু দরজা ভেঙে পড়ে না, কেননা রফিকের বড়ভাই এসে তাকে টেনে থামায়। বাড়িতে এইভাবে লোকজন জমে ওঠায় রফিকের ভাই বাস্তবিকই বিরক্ত, তাই আগে নিজের বাবাকে ঘরের মধ্যে থেকে বের করে আনে সে। কেউ কেউ তাদের পিছু পিছু বেরিয়ে আসে, বাদবাকি সবাইকেও রফিকের ভাই বের করে আনে দ্বিতীয় দফায়। তারপর তার বাবাকে শান্ত হতে বলে, মোড়ার ওপর বসতে বলে এবং নিজেও তার মুখোমুখি বসে। এবার সে প্রশ্ন করে, কী হচ্যে?
দুফুরে ওই ঘরত ঢুইকছে। তারপরত আর বাড়ায় না।
টাইম হইলেই বারাবে। তুই তা নিয়া এ্যাংখা চেঁচামেচি কর ক্যা?
চেঁচামেচি করমু না? ঘরের ডাশা তুইলা দিছে, তারপরত মুই চুপ থাকমু?
চুপ থাহো না, দ্যাহো, প্যাটে যহন গরম নাগবে তহন একলাই বাইর হইবে।
এই কথাটা এতক্ষণ কেন মনে আসে নি? এই ভেবে রফিকের বাবার নিজের মনেই শ্লাঘা জমে। নিজেই তো কতদিন কত মানুষকে বলে এসেছে সে, মানুষ দুইদিনের জইন্যে দুনিয়ায় আইসাও এত কিছু করে খালি প্যাট আর চ্যাটটার জইন্যে। অথচ এই সময় সেই গুরুত্বপূর্ণ কথাটাই তার মনে আসে নি? থাহো, দরোজা বন্ধ কইরা, দেহি কয়দিন থাইকবার পারো! কয়দিন না খায়া থাইকবো? য্যাংখা ক্ষিধা লাইগবো স্যাংখা দৌড়াদোড়ি শুরু কইরব। দেহি, কয়দিন না খায়া ঘরত বইসা বইসা হাত মাইরবার পারো। এইভাবে মনে মনে একটা বোঝাপড়া করে ফেলতে পারলে রফিকের বাবা একটা হাঁফছাড়ানো বড় নিঃশ্বাস ফেলে এবং নিজের নির্বুদ্ধিতায় হাঁকাহাকি করতে গিয়ে গাঁয়ের সব লোককে নিজের বাড়ির উঠানে এনে জড়ো করেছে বলে আফসোস করতে থাকে।
তবে বিস্ময়কর হলেও সত্যি, রফিক তার বাপ ও ভাইয়ের ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে ওই ছোটকোঠার মধ্যেই নিজেকে গুটিয়ে রাখতে থাকে নিজের ‘প্যাট আর চ্যাট’কে সামাল দিয়ে। এইভাবে দেড়দিন কাটলে বাড়ির সবাই খানিকটা চিন্তিত হয়। তবে তাদের চিন্তাকে আরও ত্বরান্বিত করে পাড়াপ্রতিবেশীরা। বারবার তারা যাত্রায় গিয়ে জীবনের প্রথম কোনও মেয়ের বুকের খাঁজ আর উরু দেখার উত্তেজনা নিয়ে রফিকের খোঁজখবর নিতে বাড়ির মধ্যে উঁকিঝুকি দিতে থাকে। যতবারই তারা জানতে চায়, ক্যা রে বাবা, রফিক ক্যাংখা আছে? ততবারই তাদের বাপ-ভাইদের বুকে খোঁচা লাগে, তাদের মনে হতে থাকে, রফিক বোধ হয় সত্যিই পাগল হয়ে গেছে! রফিকের বাপের বিশ্বাসের ভিত নড়েচড়ে উঠতে শুরু করে, কিন্তু তারপরও রফিকের বড়ভাই দরোজা ভাঙার ব্যাপারে তার আপত্তি বহাল রাখে। আর জমির আলী সরকারকে দেখলে মনে হয় না, তার অন্য কোনও কাজকর্ম আছে, কেননা বলতে গেলে প্রায় সারাদিনই রফিকদের বাড়িতে পড়ে থাকে সে। যে যা বলে তা সে শোনে মনযোগ দিয়ে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সবই আল্লার ইচ্ছা…ক্যান যে রফিকের ভাবগতিক এব্যা হলো…। এইভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলা আর স্বগত সংলাপ দেয়া তার বয়সের সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না বলে আশপাশের লোকজন তাকে ভালভাবে খেয়াল করতে শুরু করে এবং জমির তখন আবারও ‘ক্যান যে রফিকের ভাবসাব এব্যা হলো…’ বলে রফিকের এরকম হওয়ার কারণ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটানোর চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু প্রতিবারই কোনও না কোনও অলৌকিক কারণে তার আলোচনার উদ্যোগ নষ্ট হয়ে যায়। অবশেষে দেড়দিন পেরুনো বিকেল এলে, মাঝপাড়ার অতশী বুড়ি রফিকের মায়ের লাগানো বিচাকলা গাছের ঝোপ থেকে একটা কন্দ কেটে নিয়ে যায়। আর মফিজ আলীর মুখে হাসি ফোটে। কেননা তখন মৌলবী এনায়েত রসুল আসেন এবং আবারও দোয়া পড়ে তাবিজ পুঁতে বাড়ির চারপাশ ঘুরে ভূত-জ্বিন-পরী-পেত্নীর আসাযাওয়া বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়ার আগে ভাল করে জানতে চান গত এক বছরে তার ছেলের মতিগতি কেমন ছিল। মৌলবী এনায়েত রসুলের কাছে কেউ রফিকের বদনাম করে না। তারা তার প্রশংসা করতে থাকে, যেন তার মৃত্যু ঘটেছে, এখন সে কবরে যাচ্ছে এবং এই মুহূর্তে তার বিরুদ্ধে কোনও জাগতিক অভিযোগ নেই তাদের। তবে জমির আলী সরকারের মুখের হাসি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে, কী এক অস্থিরতায় তার চোখের ভ্রু কুঁচকে উঠতে থাকে এবং যখন পাড়াপ্রতিবেশীদের আরও একজন বলে, পত্যেকদিন হামাগারে খোঁজখবর নিতো, তখন সে আর চুপ থাকতে পারে না। নিজের শরীরটাকে একটু বাঁকা করে সে বলে ওঠে, খোঁজখবর ন্যাওয়া শুরু কইরলো তো রাশেদার বিয়ার পরত থাকি।
কিন্তু মৌলবী এনায়েত রসুল কিংবা আর কারও কানে এ কথা আটকায় না। রাশেদার সঙ্গে রফিকের একটু ‘ইটিশপিটিশ’ হওয়ার কথা তাদের কারও কারও জানা আছে, কিন্তু সেটা কি তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার? তেমন হলে তো রাশেদার বিয়ের আগেই রফিকের মাথা গড়বড়িয়ে যাওয়ার কথা। এ হিসাব তো জমির আলীই ভাল জানে, রফিক তো তার কাছ থেকেই রাশেদার বিয়ে ঠিক হওয়ার খবর পেয়েছে বিয়ের দিনতিনেক আগে। খবর শুনতে শুনতে সে অবশ্য একবার তার কাঁধ থেকে মইটা মাটির ওপর নামিয়ে রেখে দিয়েছিল; কিন্তু তার খানিকপরই আবার কাঁধে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়েছিল। ‘রাশেদার বিয়ে হওয়ার পর থেকে’ শব্দগুলো তাই তাদের কাছে সময়ের হিসাব ছাড়া অন্য কোনও তাৎপর্য বয়ে আনে না। কিন্তু কথাটা বলতে বলতে জমির আলী নিজের অজান্তেই কোমরটা পেছনে সরিয়ে নেয় অণ্ডকোষ রক্ষা করার ভঙ্গিমায়। কেননা একদিন রাশেদা যখন যোগেনবাবুর ভিটার গড়ান বেয়ে নেমে আসছে তখন সে ত্বরিৎগতিতে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল এবং বলেছিল, রাশেদা, খালি আরাক পাড়ার ব্যাটাকই দিবি? মুই তোর পাড়ার পোলা, মোক একবার দিয়া দ্যাহ না! চোখ দুটো প্রেম নিতে শিখেছে বলে রাশেদা তখন বাপমায়ের চোখ বাঁচিয়ে যোগেন বাবুর ভিটার জঙ্গলে একটুআধটু আসতে শিখেছে, তখনও তার শরীর প্রেম নিতে শেখে নি, অতএব তার চোখে আগুন জ্বলে এবং সে জমির আলীর অণ্ডকোষ বরাবর একটা লাথি মারে। তীব্র যন্ত্রণায় জমির আলী বসে পড়ে এবং রাশেদা, ‘এ্যাংখা কতা ফের যদি কস তাইলে তোক ভাইগর দিয়া পিটায়া মাইরমু’ বলে চলে যায়। রাশেদা এত আস্থার সঙ্গে ভাইদের কথা উল্লেখ করে যে জমির আলী হতবাক হয়ে যায়, তা হলে কি রাশেদার সঙ্গে রফিকের কোনও ইটিশপিটিশ নেই, তা হলে কি তারা দুইজন এই যোগেন বাবুর ভুতুড়ে ভিটায় দেখা করে না? তার মনে ভয় জেগে ওঠে, যে পরিবারের মেয়েরা প্রেমের টানে অনায়াসে আত্মহত্যা করে আর ছেলেরা মেয়েদের গলা টিপে মেরে ফেলে সেই পরিবারের কোনও ছেলে সত্যিই যদি তাকে মারতে আসে তা হলে কী হবে ভেবে শিউরে ওঠে। এইভাবে বহুদিন কেটে যায়, সে ভীত এক ভেড়ার ছানার মতো চলাফেরা করে, তার সামনে কত কিছুই না ঘটে, তার ভয় কেটে যেতে থাকে, আবারও এক রাগ জেগে উঠতে থাকে। সে ঠিক করে, রাশেদার না পারুক, রফিকের জীবন সে ছারখার করে দেবে, সে দেখিয়ে দেবে জীবন আর মৃত্যু নয়, প্রেম আর মৃত্যু পাশাপাশি শুয়ে থাকে, প্রেম আর মৃত্যু খেলা করে জীবন আর মৃত্যুর মতো মুখোশ পরে। অতএব সেই দিন থেকে জমির আলী সরকার একটি ধুতুরা আর একটি ডুমুর গাছ লাগিয়ে তাদের পরিচর্যা করতে থাকে। কোনও কোনও সকালে সে গিয়ে দাঁড়ায় ধুতুরা আর ডুমুর গাছের কাছে, বদনা থেকে গাছের গোড়ায় পানি ঢালে, মনে হয় এখানে পানি ঢালার কোনও ইচ্ছেই নেই তার; কিন্তু পায়খানা করার পরও খানিকটা পানি বদনায় রয়ে গেছে এবং সেই পানিটুকু সে এইখানে ঢেলে দিচ্ছে। কখনও পানি ঢালতে ঢালতে, কখনও বিড়ি টানতে টানতে সে এইসব গাছদের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কথা বলে এবং কেউই জানতে পারে না তাদের শলাপরামর্শ। ঠিক একই রকম ফিসফিসানি তুলে জমির আলী আবারও বলে মৌলবী এনায়েত রসুলের পাশে দাঁড়িয়ে, হামাগারে রায়েকবন্দরের রাশেদার বিয়ার পরত থাকিই তো রফিক ভাল হল।
এবারও তার এই কথা কারও কানে দাগ কাটে না। কিন্তু মৌলবী এনায়েত রসুল ‘রাশেদা’ সম্পর্কে আগ্রহী হন, জমির আলী তখন খুবই নিস্পৃহকণ্ঠে রাশেদার পরিচিতি বয়ান করে। বলে, রাশেদা মিয়াবাড়ির মেয়ে, খুবই ভাল মেয়ে, মাসচারেক আগে তার বিয়ে হয়েছে। রফিকের বড়ভাই এবার সোজা হয়ে দাঁড়ায় এবং এগিয়ে এসে জমির আলীর ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বলে, এই হারামজাদা, তুই কি মনে কর যে রাশেদার বিয়া হইছে বইলাই রফিক ভাল হয়্যা গ্যাছে? আগে ভাল আছিল না?
তা ক্যান কমু? আগেও ভাল আছিল। রাশেদার বিয়ার পরত থাকি আরো ভাল হবার নাগছে।
খালি রাশেদা-রাশেদা কস ক্যা? এইর মইধ্যে আবার রাশেদাক জড়াস ক্যান?
রাশেদাক ক্যান জড়ামু। টাইম হিসাব করবার নাগছি। ও সময় তোমাগারে কারু কলেরা হইলে কত্যাম, ওই কলেরা হওয়ার পরথন রফিক ভাল হবার নাগছে…।
বলে সে পুরানো ব্লেড দিয়ে একবার পুরানো মইষা দাউদ চুলকাতে গিয়েও এত মান্যগণ্য লোকজন থাকায় ব্লেডটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে ফেললে সবাই হেসে ফেলে। কোঠার ভেতরে রফিক তখন জলচৌকির ওপর শুয়ে আছে নির্বিবাদে, তার কোনও উত্তেজনা নেই, পৃথিবীর সব যুদ্ধের নিরসন ঘটিয়ে শুয়ে পড়ার পরিতৃপ্তি তার শোয়ার ভঙ্গিমায়। সে কি কোনও স্বপ্ন দেখে? তাও বোঝা যায় না। তবে তার ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি অনবরত দুলে দুলে ওঠে। নিরিবিলি ঘরের মধ্যেকার অন্ধকারে আশ্রয় নেয়া দু চারটে বাদুর পাহারা দেয়ার মতো দ্রুত ওড়াওড়ি করতে থাকে। এদিকে মৌলবী এনায়েত রসুল ঘন ঘন সবার দিকে তাকান খুবই দ্বিধান্বিত, সংশয়মাখা চোখে। তারপর বলেন, সত্য ঘটনা জানা দরকার। তালি ওষুধ ঠিকমতো দ্যাওন যায় আর দোয়াও ঠিক কইরা পড়ন যায়। অসুখবিসুখ জানা থাইকলে দাওয়াই আর দোয়ায় কাজ হয় তাড়াতাড়ি। না হইলে মোক এ্যাকাকবার এ্যাকাক দোয়া পইড়তে পইড়তে টেস্ট করার নাগবে কোনটা খাপত নাগে। না-জানা অসুখে ওষুধ আর দোয়ায় কাজ হয় ম্যালা দেরিত্। মৌলবী এনায়েত রসুল এ কথা বলে উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকেন। রফিকের বাপ মা আর বড়ভাই-ভাবীকে তখন খুব বিস্মিত ও বিপর্যস্ত লাগে, কেননা চার মাস আগে থেকে রফিক ভাল হয়ে গিয়েছিল এ সত্যের চেয়েও বিস্ময়কর, রফিক কারও সঙ্গে প্রেম করেছিল।
এনায়েত রসুলের এরকম একটি উপদেশনামা শোনার পরও কেউ রফিক সম্পর্কে কোনও অন্যরকম কথা বলে না, এমনকি কামারপাড়ার যাদব কামারও না; অথচ এই যাদবকে মাসপাঁচেক আগে রফিক সতেরটা পাচন বানানোর বায়না দিয়েছিল, তারপর পাঁচনগুলো বানানো হয়ে গেলে বলেছিল, অত পাচুন দিয়া মুই কী করমু? যাদব তার হাত ঘসটাতে ঘসটাতে অনেক সাহস করে বলেছিল, তুমি না বানানের কথা কইলেন? রফিক তখন রহস্যময় হাসি দিয়ে বলেছিল, দেইখলাম তুই কীরহম তাড়াতাড়ি কাজকাম করিস। বানাইছিস বালই হ’চ্যে। এহন যা, হাটে হাটে গিয়া ঘুরবার লাগ, দ্যাখ, কেউ কেনে না কি। তখন যাদব কেঁদে ফেলেছিল, এক পাচন দিয়ে এক চাষার বলতে গেলে সারা জীবন কাটে, মাঝেমধ্যে একটু বালি দিয়ে ধার দিয়ে নিলেই সেটা নতুন হয়ে যায়। এই যখন অবস্থা তখন এরকম অজপাড়াগাঁয়ে সতেরটা পাচন সে বেচবে কেমন করে! তাও এই অকামের মৌসুমে? কাঁদতে কাঁদতে যাদব তাই চেঁচামেচি করে আর রফিক তখন হাসাহাসি করে। কাঁদতে কাঁদতে যাদব সারা পাড়া মাথায় তোলে, হাসতে হাসতে রফিক সারা গাঁ মাথায় তোলে। তাদের হাসিকান্না শুনে বাইরের লোকজন এগিয়ে আসে, পাড়ার লোকজনও এগিয়ে আসে। আর একটা পাচন হাতে নিয়ে রফিকের বাবা রফিককে প্রচণ্ড দাবড়ানি দিলেও সতেরটা পাচনের ভাগ্য পালটায় না।
অতএব জমির আলী অপেক্ষা করতে থাকে, অন্তত যাদব একটা কিছু বলবে রফিকের বিরুদ্ধে, কিন্তু সেও কোনও কথা বলে না। এইসব আলাপ হতে হতে আসরের নামাজের ওয়াক্ত গড়িয়ে মাগরিবের দিকে চলে যায় এবং মৌলবী এনায়েত রসুল তখন বলে, আগে আপনেরা খোঁজখবর নিয়া দ্যাহেন, পোলা কোনখানে কী কইরছে, হেরপর আমাক জানান। বলে সে নামাজ পড়তে যেতে উদ্যত হয় দেখে পেছন থেকে রফিকের বাবা বলে, খোঁজ নয় নেম, অ্যাহন পোলা যে মোর না খায়া থাহে তার কী হয়? কিন্তু মৌলবী এনায়েত রসুল এই কথার কোনও উত্তর না দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যান মসজিদের দিকে।
মৌলবী এনায়েত রসুল এইভাবে নামাজ পড়তে চলে গেলে রফিক আর রাশেদার কথা জানা যায় একটু একটু করে। কেননা রফিকের ভাবীর মনে পড়ে রফিক একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, মেয়েদের কোন ধরণের টিপ দিলে ভাল দেখা যায়? লম্বা টিপ দিলে না কি গোল টিপ দিলে? আর রফিকের ভাইয়েরও মনে পড়ে, একদিন তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে সাড়ে তিন শ টাকা খোয়া গেছে। এইভাবে ধীরে ধীরে রফিক ও রাশেদার প্রেমের বিষয়টা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে এবং রাত গভীর হওয়ার আগেই সে খবর গিয়ে আবার রাশেদাদের বাড়িতে পৌঁছায়। রাশেদার বাবা আর ভাইরা এ ঘটনায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়, তাদের মনে হয় শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগে রাশেদা তাদের জাতসম্মান, ধনসম্পদ সব কিছুতে ঘোড়ার চোনা ঢেলে দিয়ে গেছে। রাশেদা যদি আত্মহত্যা করত, অথবা পালিয়ে যেত অথবা ভালবাসার কথা বলে নির্ঘাৎ মরণের পথ বেছে নিতো তাও এর চেয়ে ভাল হতো। ভালবেসে মিয়াবাড়ির মেয়েরা আত্মহত্যা করতে কিংবা খুন হয়ে যেতে দ্বিধা করে না, এর চেয়ে বড় গৌরব আর কী হতে পারে? অথচ রাশেদা কী না সেই গৌরবের মুখে ছাই ফেলল! অতএব রাশেদার ভাইরা সিদ্ধান্ত নেয়, রাশেদা যখনই বাপের বাড়িতে ফিরে আসবে তখনই তাকে হত্যা করা হবে। এরকম একটি সিদ্ধান্ত সম্মিলিতভাবে নিতে পেরে খুশি হয় তারা। যদিও রাশেদার বাবা খুঁতখুতাতে থাকে।
এদিকে নামাজ থেকে ফিরে মৌলবী এনায়েত রসুল সিদ্ধান্ত নেয়, আগামীকাল বাড়ি বন্ধ করার পর জোহরের নামাজ পড়ে যাবেন তিনি। লোকজন তাই তাড়াতাড়ি ঘুম দিতে বিছানায় চলে যায়, যাতে সকাল-সকাল ক্ষেতে গিয়ে একপ্রহরের সময় বাড়ি ফিরে খানিকটা বাড়তি সময় কাটানো যায় কাজীবাড়িতে। কাজীবাড়ি ফাঁকা হয়ে যায়, রাত বাড়তে থাকে, কিন্তু পরিস্থিতি আগের মতোই থাকে। দেখা যায় রফিকের মা আগের দিনের মতোই গালে হাত দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে কী যেন বলতে বলতে কেঁদে কেটে একাকার হচ্ছে। আর রফিকের বাবা না কাঁদলেও তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, বরং কান্নাকাটি করলেই তার ভাল হতো। তবে রফিকের বড়ভাই আর ভাবীর অবস্থা ঠিক বোঝা যায় না, কেননা গতরাতে এই হুড়হাঙ্গামায় ডাঙ্গুলি খেলা হয় নি বলে রফিকের বড়ভাই আজ রাতে সকাল-সকালই শুয়ে পড়ে বিছানায় বউকে নিয়ে। রফিকের বাবা ঘরের বাইরে ঝিমুতে থাকে আর বড়ছেলের এই নির্লজ্জতায় মনে মনে তাকে গালিগালাজ করতে থাকে, অন্যদিকে রফিকের প্রশংসাও করে প্যাট আর চ্যাটকে সামাল দিয়ে এখনও ঘরের দরোজা আটকে পড়ে থাকায়। এইসব শাপশাপান্ত ও প্রশংসায় সে এত বেশি নিমগ্ন হয়ে পড়ে যে রাতের ক্রমবৃদ্ধি তার চোখে পড়ে না, এও আর মনে থাকে না সে কেন না-ঘুমিয়ে এইভাবে জেগে রয়েছে। একবার তার মনে হয়, রফিক তার মাকে ডাক দিচ্ছে, তাও অস্পষ্ট স্বরে, ঘুমের ঘোরে। কিন্তু সেই ডাকে কোনও ক্লান্তি নেই, কোনও অবসাদও নেই। আবারও এই ছেলেকে নিয়ে রফিকের বাবার বুকের ছাতি ফুলে ওঠে, দেখ, কেমন বাপকা ব্যাটা, প্যাট আর চ্যাটকে সামাল দিয়ে ঠিকই আরও একটা দিন পার করে দিল! আহ্, এরকম জোয়ান ছেলে, প্যাট আর চ্যাটকে সামাল দেয় কেমন করে!
ভাবতে ভাবতে রফিকের বাবা ঘরের ডোয়ার কাছাকাছি চলে আসে, আর ঠিক তখনই খুঁট করে মধ্যের কোঠার দরোজা খোলার শব্দ হয়। তারপর তার চোখে পড়ে প্যাট আর চ্যাটকে সামাল দিয়ে এখনও বুক চিতিয়ে থাকা রফিক দ্রুত পা ফেলে কোথায় যেন চলে গেল। দিশেহারা রফিকের বাপ সামনের দিকে এগোয়, চোখ ঘষে ঘষে জানার চেষ্টা করে, এই শয়তানের বাচ্চা শয়তানটা কোনখানে গেল আবার। কিন্তু অন্ধকার আর আকাশ থেকে নেমে আসা সামান্য আলো, এর কোনওকিছুই সাহায্য করে না তাকে। একটু দম নিয়ে রফিকের বাবা সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা চালায়, রাত হওয়ায় সে ভুল দেখেছে, আসলে রফিক ঘরেই আছে। কিন্তু এইবার একটু দূরে প্রস্রাবের শব্দ শোনা যায় এবং তাতে সে বেশ আস্বস্ত হয়। প্যাট আর চ্যাটের জ্বালা ঠেকিয়ে রাখতে পারলেও ছেলে যে পায়খানা পেচ্ছাব ত্যাগ করার মায়া ও আনন্দ কাটিয়ে উঠতে পারে নি তাতেই তার কাঁধের ওপর থেকে বিরাট এক বোঝা নেমে যায়। একবার সে চিন্তা করে, দৌড়ে মধ্যের কোঠার খোলা দরোজা চৌকাঠ ডিঙিয়ে সে নিজেই জলচৌকিটার ওপর শুয়ে পড়বে। কিন্তু এই ছেলের জিদ ভীষণ, একেবারে নিরুদ্দেশে চলে যেতে পারে; অতএব সে সেই চিন্তা বাদ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রস্রাব শেষ করে রফিক আবারও লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢোকে। রফিকের বাবা তার পিছে পিছে যায়, যায় আর বলে, এ বাপ, ঘর থাইকা না-বার হইলি, কেউ এহন দেইখবো না বাপ, দুইডা ভাত মুখে দে, মুই কাউক কিচ্ছু কমু না, তুই দরোজা আটকাইস না, মুই আইনা দিতেছি…
রফিক খানিকক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে তার বাবার এই আকুল আহ্বান শোনে, তারপর কোনও কিছু না বলে আবারও ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং দরোজা আটকে দেয়।
রফিকের বাপ রান্নাঘর থেকে তাড়াহুড়ো করে একটু ভাততরকারি নিয়ে সেই ঘরের দরোজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তাকে এইভাবে ছোটাছুটি করতে দেখে তার বউয়েরও ঘুমকান্না সব ছুটে যায়। সেও রফিকের বাবার পিছে পিছে ছুটে আসতে থাকে। আর হাত দিয়ে ঠেলা দিয়ে ঘরের দরোজা বন্ধ দেখে রফিকের বাবা খুব হতাশ হয়ে বলে ওঠে, এ্যাংখা দুঃখ পাইলাম রে বাপ। তোর মনে যে এত কিছু আছিল তা তো তুই কুনুদিন কইস নাই। এহন তোক বিনা আহারে রাইখা মোর মুখ দিয়া ভাত নামে কেব্যা কইরা, ক তুই দেহি। বলতে বলতে নিজের এই অনুতাপ মেশানো গলা অনুভব করে নিজের ওপরেই খেপে ওঠে সে এবং আরও একটু গলা চড়িয়ে রাগী রাগী স্বরে বলে, ভাততরকারির থাল দরোজার থন রাইখা দিলাম। বালো লাইগলে খায়্যা নিস।
বলে সে ঠক করে টিনের থালাটা মেঝের ওপরে রাখলেও একটা ভোঁতা ঘর্ষণের ছাড়া অন্য কোনও আওয়াজ শোনা যায় না। রফিকের বাবা এবার আরও একটু উঁচানো গলায় তার বউকে বলে, এই নবাবজাদার লাইগা বইসা থাইকা আর কী করবার নাগছো? চলো, ঘুমাইগা। হামাগারে টাইমের দাম নাই?
বলে সে বউকে নিয়ে ঘরে চলে যায়। তারপর সকালে উঠে দেখে ভাতের থালার ভাত তরকারি সব উধাও হয়ে গেছে। কেউ তা চেটেপুটে একেবারে পরিষ্কার করে খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু ঘরের দরোজা আগের মতোই বন্ধ রয়েছে।
একটু বেলা হলে মৌলবী এনায়েত রসুল আবার আসেন। তাকে এই ঘটনা বলে রফিকের বাবা। শুনে এনায়েত রসুল গম্ভীর মুখে শুধু বলেন, সাবধানের মাইর নাই। মুই আবারও ঘর বন্ধ কইরা দিবার চাই।
মৌলবী এনায়েত রসুল তার বাড়ি বন্ধ করার কাজ শুরু করেন। মনে হয় না, আশপাশে জমে ওঠা লোকজনের ভিড়ের দিকে কোনও খেয়াল রয়েছে তার। একমনে চোখ বুজে দোয়া পড়তে পড়তে দশটি জলন্ত তপ্ত পেরেক নিয়ে তিনি তার যাত্রা শুরু করে। একেকটি কোণে পৌঁছায় আর একেকটি পেরেক কমতে থাকে। এইভাবে যখন তিনি ঠিক মধ্যের কোঠার কাছাকাছি আসেন তখন একটিও জলন্ত পেরেক আর তার হাতে থাকে না। নিঃস্ব হয়ে তিনি তার দু চোখ খুলে ফেলেন এবং বলেন, আসল জায়গায়ই পোঁতাইতে পাইরলাম না। বলে তিনি আবারও নতুন করে দোয়াদরুদ পড়তে থাকেন, নতুন ১১টি পেরেক নিয়ে নকশা করেন এবং বাড়ি বন্ধ করে দিয়ে নগদ বিশটা টাকা নিয়ে চলে যান কাজী বাড়ি থেকে।
কিন্তু রফিক তবুও ঘর থেকে বের হয় না। অনেক কিছু বলেও ঘর থেকে তাকে আর বের করা যায় না। অনেক রাতে তার ঘরের দরোজার সামনে ভাত রাখতে রাখতে রফিকের মা গজগজায়। আর তারপরদিন সকালে উঠে দেখে খালি থালাবাসন দরোজার সামনে পড়ে রয়েছে। তার মানে রাতে দরোজা খুলে বেরিয়ে রফিক সব কিছু সাবাড় করে আবারও শুয়ে পড়েছে।
এইভাবে বাড়ি বন্ধ করার পরও, হয়ত বা জীন-পরী-ভূত-পেত্নী সব কিছু আসার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও রফিক আর সেই মধ্যের কোঠা থেকে বের হয় না, কারও সঙ্গে দেখা করে না, কিছু বলে না। শুধু চুপচাপ গভীর রাতে খাওয়াদাওয়া করে। প্রতিদিন রাতে তার জন্যে ঘরের দরোজার সামনে খাবারদাবার রাখা হয় ঢাকনা দিয়ে এবং প্রতিদিন সকালেই দেখা যায় সেসব সাবাড় হয়ে গেছে। এবং এভাবেই চলতে থাকে, কী বর্ষায়, কী গ্রীষ্মে, কী মাসের পয়লাতে কী মাসের একেবারে শুরুতে, এমনকি মঙ্গার সময়েও। এইসব ঋতুবদলের দাপট রফিক টের পায় কি না বোঝা যায় না, এমনকি মঙ্গাও তাকে স্পর্শ করে বলে মনে হয় না। প্রায়ান্ধকার একটি ঘরের মধ্যে সে কারও সঙ্গে কথাবার্তা না বলে দিব্যি সময় কাটিয়ে দিতে থাকে, এমনকি কোনও কোনও রাতের ভাতও পড়ে থাকে দরোজার সামনে। দিন যত যায়, থালাভর্তি ভাত পড়ে থাকার ঘটনাও তত বাড়তে থাকে।
নয় বছর পর মঙ্গার মতো মঙ্গা আসে। সে আসে হাড় কাঁপিয়ে, শূন্য থালায় মাংসশূন্য হাড় বাজিয়ে। খুব সংগোপনে কেউ একজন কার্তিকের মঙ্গা নিয়ে থিসিস করেছিল। তার সেই থিসিস পড়েছিল কোনও এক প্রজেক্টের অংশ হয়ে অসংখ্য ফাইলের ভিড়ে। এইবার তার লালফিতা আপনাআপনিই খুলে পড়ে। কেননা মঙ্গার মানুষ কোনওরকমে বাহাদুরাবাদ ঘাট পাড়ি দিয়ে ট্রেনে চড়ে অথবা না-চড়েই রাস্তাঘাটে পড়ে থাকতে শুরু করে। তাদের গা থেকে শীতের ভ্যাঁপসা ঘ্রাণ উঠে এলে প্রথমে বোঝা যায় না কেউ মারা গেছে। কিন্তু ঘ্রাণটা ক্রমাগত মরা ছুঁচো হয়ে উঠলে লোকজন অস্থির হয়ে ওঠে, বুঝতে পারে মৃত মানুষ আর মৃত ছুঁচোর মধ্যে কোনও তফাৎ নেই, তফাৎ কেবল জীবদ্দশায়। বুকের কোথাও দুঃখ পুষে রাখা একদা কবিতা লেখা এক ফটোগ্রাফারের প্রায় প্রতিটি ছবিই ঝাপসা হয়ে যেতে শুরু করে, কখনও বা ফোকাস ঠিকমতো হয় না, কখনও অ্যাপারচার এমন এক জায়গায় টিউন করা থাকে যে মূল সাবজেক্ট একেবারে কালো হয়ে যায়। শীতের কুয়াশায় কখনও কখনও এরকম সব পাশাপাশি শুয়ে থাকা মানুষগুলোকে মনে হয় কালো ও অশুভ প্রেতচ্ছায়ার মতো আর তাই সরকারের তরফ থেকে খুব হম্বিতম্বি শুরু হয়ে যায় জেলা আর উপজেলার কর্মকর্তাদের ওপরে, খুব দ্র্রুত এই মঙ্গাকে সামাল দেয়ার দাপ্তরিক নির্দেশ নিয়ে অফিসে বসে বসে হাসাহাসি করে তারা, সিগারেট টানে আর চা পান করতে করতে বলে, হে-হ্, ঢাল নাই, তলোয়ার নাই, নিধিরাম সর্দার…মঙ্গা সামাল দিব! এই সুযোগে নবীন এক কলামিস্ট তার সামাজিক ভাবনা প্রকাশের সুযোগ পেয়ে লিখতে থাকে, মঙ্গার সময় যেহেতু কোনও কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকে না সেহেতু আমরা আগে থেকেই এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারি। যেমন, এই সময় কলা চাষ করা যেতে পারে। কর্মকর্তারা কলা খেতে খেতে কলাচাষের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করে এবং পত্রিকাগুলোয় ঢাকা বা বিভিন্ন শহরের পাঠকদের কাছে এই মঙ্গাক্রান্ত মানুষদের জন্যে শীততাড়ানিয়া কাপড়চোপড় ও টাকাপয়সা চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়।
রফিক ঘরের মধ্যে আশপাশে চায়, অন্ধকারে একটু শীত কি লাগে? অথচ কতদিন হয়ে গেছে, শীত কিংবা গরম কোনওটাই তার শরীরে আর কোনও সাড়া জাগায় না। শীত আসি-আসি হেমন্তে রাশেদার বিয়ে হওয়ার পর থেকে সে শীত আসার সংবাদ পায়, কিন্তু তার শরীরে কোনও বোধ জাগে না। হেমন্ত ফুরিয়ে সেবার প্রথম শীতেই একদিন অনেক রাতে দরোজা খুলে একটি কম্বল দেখে সে। চৌকাঠের ওপর পড়ে আছে, বোঝাই যায় মা তার জন্যে এখানে সেটা ফেলে রেখেছে। মা’র কথা এইভাবে মনে পড়ায় তার কোনও আক্ষেপ জাগে না; আবার রাগও হয় না। কোনও প্রয়োজন ছিল না, তবু সে কম্বলটি নিয়ে আসে, কেননা তার মনে পড়ে এটি কিনে শহর থেকে ফেরার পথে রাশেদাকে সে দেখেছিল তাদের বাড়ির গোয়ালঘরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কম্বলের সূত্রে তার রাশেদাকে মাঝেমাঝে মনে পড়ে এই বিছানার ওপরে। তা ছাড়া তার মনে হয় না তেমন কোনও স্মৃতি রয়েছে যার কারণে সে রাশেদার কথা ভাববে। অথচ নিশ্চয়ই এর চেয়ে অনেক অনেক গভীর স্মৃতি রয়েছে তাদের। কিন্তু সেই যোগেনবাবুর ভুতুড়ে ভিটে সারাদিন হাতড়ে বেড়ালেও কি সেসবের কোনও একটির চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে? চিহ্ন তো আসলে মানুষ রচনা করে তার মস্তিষ্কের খাদে এবং তারপর সেই খাদের কিনারে আজীবন দাঁড়িয়ে থাকে খুব বিপজ্জনক ভঙ্গিমাতে। কখনও কখনও হঠাৎ সে খাদের মধ্যে পড়ে যায় এবং তখন তার ফেরার আর কোনও পথ খোলা থাকে না। যেমন রফিকের সামনেও ফেরার মতো কোনও পথ খোলা নেই। সে আর মনে করতে পারবে না, কেন সে এই কোঠার মধ্যে সেদিন দুপুরে হঠাৎ এসে শুয়ে পড়েছিল, দরোজার খিড়কি বন্ধ করে দিয়েছিল এবং কেনই বা কেউ তাকে এতদিন অনেক সাধাসাধি করেও ঘরের বাইরে খোলা দুনিয়ায় আর নিয়ে যেতে পারে নি। একটি ঘর বিশাল এক প্রান্তর হয়ে তার সামনে পড়ে থাকে এই ঘরের মধ্যে, সেই প্রান্তর সে আর কিছুতেই অতিক্রম করতে পারে না। এতদিন পর তার কেন যে শীত-শীত লাগে তাও সে বুঝতে পারে না, শীত তাড়ানিয়া কম্বলটা গায়ে চাপিয়ে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে দেয়ালের দিকে।
একেকটি দিন পেরোয়, মানুষের উদ্বেগ বাড়ে, মানুষের স্মৃতিচারণ বাড়ে, তারপর উদ্বেগ আর স্মৃতিচারণের বিলাসিতা ছাপিয়ে ক্ষুধার মাত্রা তীব্র হয়ে উঠতে থাকে। এবং মানুষ স্মৃতিচারণের শক্তি হারিয়ে ফেলে, কথা বলার বদলে তাদের চোখেমুখে ফুটে ওঠে এবং চিরস্থায়ী হয়ে পড়ে আকুলতার এক চিরকালীন ভাষা, দে না বাহে…। আর সারাটা রাত, রাত পেরুনো ভোর আর ধলপহর এই ক্ষুধার শরীরকে জাপটে ধরে শুয়ে থাকে ঘোর কুয়াশা ও বিন্দু বিন্দু শিশির। তারপর একটু সূর্য ওঠে, তীব্র সূর্য ওঠে; এক প্রচণ্ড বুভুক্ষতা নিয়ে তারাও জাপটে ধরে ক্ষুধার শরীর। এইভাবে ক্ষুধার শরীর ডুবে যায় অতল কুয়াশার মধ্যে, শিশিরের মধ্যে, মিশে যায় সূর্যালোকে। ক্ষুধা তার অবয়ব ও শক্তি হারিয়ে আরও শক্তিমান হয়ে ওঠে, কিংবা তার আরও ভয়ানক স্খলন ঘটে। ক্ষুধা হয়ে ওঠে অবয়বহীন আদিম পাথর। আর এরকম অজস্র অবয়বহীন আদিম পাথর তখন রায়েকবন্দর, হরিণাচিলা, পাথরদিয়া হয়ে সবখানে ছড়িয়ে পড়ে, একটির সঙ্গে আরেকটি ঠোকাঠুকি খায়, কিন্তু কোথাও কোনও আগুন জ্বলে ওঠে না। রফিক এসবের কোনও কিছু টের পায় না, কোনও কিছু বুঝতেও পারে না, এমনকি এখন যে দিনের পর দিন কেউই আর তার জন্যে ঘরের দরোজার বাইরে কোনও থালাভর্তি খাবার রেখে যাচ্ছে না, তাও সে ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। তবে কোনওখানেই এ ক্ষুধা প্রশ্রয় পায় না, অতএব তা এক প্রান্তর থেকে উন্মূল হয়ে ছুটে যায় আরেক প্রান্তরে, যদিও পেছনে রেখে যায় পদচিহ্ন। প্রান্তরের ক্ষেতগুলোয় নেতিয়ে পড়া সামান্য একটু কাপড়পরা মানুষগুলো তাকিয়ে থাকে, যেন উন্মত্ত এক ফ্যাশনপ্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে গার্মেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের জোর উদ্যোগে, কিন্তু প্রতিটি মডেলই অকৃতকার্য হচ্ছে বিড়ালের মতো পায়ের আঙুল বাঁকিয়ে আর পাছা নাড়িয়ে হাঁটতে পারে না বলে। শীত তাদের গায়ে লাগে না, অথবা লাগে কিন্তু তারা তা উপেক্ষা করে মোহনীয় এক জগতের হাতছানিতে, তবে তাদের মোহনীয় সেই জগতে খ্যাতি নয়, খেলা করে ধোয়া ওঠা একটু ভাতের ঘ্রাণ। তারা প্রান্তরের ক্ষেতের দিকে তাকায়, ধানকাটা শুরু হবে কবে? কিন্তু এখনও ধান উঠতে দিনবিশেক দেরি, মরে যাওয়ার জন্যে এ কটা দিন খুবই যথেষ্ট। কেউ কেউ তাই ঘন ঘন ক্ষেতে যায়, দাত দিয়ে ধান কামড়ে ভেতরের দুধেল ধানের আস্বাদ নেয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের হিমশরীর আতংকে আরও এক প্রস্থ হিম হয়ে যায়, কেননা তারা টের পায় সব ধান চিটে হয়ে যাচ্ছে। খুব তাড়াতাড়িই এ খবর সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষ পাগলের মতো ক্ষেতের মধ্যে নেমে পড়ে। সেই খবর অথবা আতংক দূর করার জন্যে তারা খুব যত্ন করে চামড়া ফুটে বেরিয়ে আসা শীর্ণ রগওয়ালা হাতে ধানের ছড়া তুলে নেয়, যেন হাতের সামান্য ছোঁয়াতেই সব ধান ঝরে পড়বে ক্ষেতের ওপর, তারপর আরও যত্ন করে ধানে দাঁত ফুটায়, তাদের মুখে হতাশা ও আতংক ছড়িয়ে পড়ে, তারা আরও একটি ধান তুলে নেয় এবং তাতে আবারও যত্ন করে দাঁত ফুটায়। তারা ধানের শরীরে দাঁত ফুটিয়ে চলে। কুয়াশা সরিয়ে একটু একটু করে রোদ উঠতে থাকে, সেই রোদে চোখে পড়ে অগ্রহায়ণের জন্যে অপেক্ষারত ধানক্ষেতে কেবলই মানুষের মাথা কিলবিল করছে, ধানের শরীর তারা এতক্ষণ রক্ষা করেছে শীত আর শিশিরের হাত থেকে। কিন্তু একদিনের এই আত্মত্যাগে কোনও কিছু আসে যায় না, সব ধানই শীতে-শীতে সিঁটকে যেতে থাকে আগে আর পরে।
আর এই সাময়িক উত্তেজনায় রায়েকবন্দর, হরিণাচিলা কিংবা পাথরদিয়ার মানুষরা বরং আরও অসুস্থ হয়। মাথার ওপর ঝরে পড়া শিশির তাদের জন্যে কোনও মোহনীয় স্মৃতি তৈরি করে না, ঠাণ্ডার ভারে নিচের দিকে নুয়ে আসে তাদের মাথা। চোখের পাতা খুলতে ইচ্ছা করে না তাদের, কেননা চোখের পাতা খুললেই তীব্র এক যন্ত্রণা কপালের পাশ দিয়ে আগুন জ্বালায়, তারপর সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারা কপালে, কানের গোড়ায়, ঘাড়ের দিকে, চোখের কোণে। গলার ভেতর কী যেন দলা পাকায় এবং শরীর কাঁপে তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো। জমির আলী অনুভব করে তার মইষা দাউদের ক্ষত কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেছে, আজকাল আর চুলকায় না, অথচ এ রকম শীতে এই গেল বছরেও একটু কাপড়ের আড়াল পেলেই তীব্র চুলকানি উঠে আসত মাংসের তল থেকে। কিন্তু এখন পাতলা একটা গেঞ্জি আর ওপরের দিকে টেনে তুলে শরীরে পেঁচানো লুঙ্গির নিচেও ওই ভয়ানক মইষা দাউদ কেমন ঠাণ্ডা মেরে আছে! তবু সে অভ্যাসবশে ভোতা ব্লেড দিয়ে কাধের কাছে মাঝেমধ্যেই ঘষতে থাকে। আর দেখে বর্ষাপেরুনো বিলের মধ্যে মানুষজন নেমে পড়েছে এই দারুণ শীতেও। শাপলা খুঁজছে তারা। দেখে জমির আলীর মুখ জলে ভরে যায়। আহ্, দুইচারখান শাপলা জোটাতে পারলেও তো আজ দিনটা পাড়ি দেয়া যেত। দুইদিন সে এই লোভ পাশ কাটিয়ে যায় কিংবা লোভটাকে আগলে রাখে। তারপর তৃতীয় দিনে তার ঠিক গলার কাছ থেকে তীব্র ক্ষুধা সরীসৃপের মতো কিলবিলিয়ে নামতে শুরু করে পেটের দিকে। শাপলার লোভে সে ঘরের দাওয়া থেকে উঠে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এগোয়, বিলের চারদিক পাগলের মতো ঘোরে, বিল ছাড়িয়ে সামনে গিয়ে নদীর দিকে চলে যাওয়া নালার পাড় ধরে এগুতে থাকে, তার পায়ে কত কাটা বেধে, অযত্নে গজিয়ে ওঠা গাছের ডালের খোঁচা লেগে তার গা থেকে একটুআধটু রক্তও ঝরে পড়ে, মাঝেমধ্যে বেখাপ্পা ঘন জঙ্গল তার চলার পথ বন্ধ করে দেয়। সে খুব যত্ন করে আবারও নতুন রাস্তা খুঁজে নেয়। কিন্তু কোনওখানে আর কোনও শাপলাই খুঁজে পায় না। বাঁশঝোপের নিচে দাঁড়িয়ে সে হাঁফায় আর ব্লেড দিয়ে ঘাড় জুড়ে ছড়িয়ে পড়া মইষা দাউদ চুলকে চলে। তখন চোখে পড়ে দল বেধে মিয়াবাড়ির সবাই স্টেশনের দিকে রওনা হয়েছে, হালকা কুয়াশায় তাদের কাউকে চেনা যায় না ভাল করে। সে তাই এগিয়ে যায় এবং চোখে পড়ে যে রাশেদাও সেই দলে আছে।
এতদিন বাদে সে রাশেদাকে দেখতে পেল, জমির আলীর এবার তীব্র ক্ষুধা লাগে! মনে হয় সে মরে যাচ্ছে এবং এও মনে হয় রাশেদাকে ঘিরে যে-সব এলোমেলো ইচ্ছা তার মধ্যে বাইকুড়ানি তুলত একসময়, সে-সব আরও আগে মারা গেছে। তার মনে হয় না এমন কেউ এখনও বেঁচে আছে যে না কি গলা উঁচিয়ে বলতে পারবে, কোনওখানে এখনও ভালবাসা বেঁচে আছে। এবং ভালোবাসা বেঁচে নেই বলেই কি না কে জানে, যান্ত্রিকভাবে তার শরীর জাগতে থাকে। সে খুব ভয় পায়, কেননা এখন ওইটা দু উরুর চাপে কাহিল করে ফেলতে গেলে নরম সুতোর আধখানা লুঙ্গি ছিঁড়ে যাবে। জেগে ওঠা এই শরীর নিয়ে ব্যতিব্যস্ত জমির আর রাশেদার মুখের দিকে তাকাতেই পারে না। তা ছাড়া মনে হয়, আত্মহত্যা করার পর রাশেদাকে দাফন করা হয়েছিল খুব তড়িঘড়ি, পরে খবর পেয়ে পুলিশ এসে কবর থেকে পোস্টমর্টেমের জন্যে মড়া তুলে এই কংকালটুকু খুঁজে পেয়েছে। জমির আলী ভয়ে ভয়ে নিজের গায়ের চামড়ায় চিমটি কাটে, রক্তের স্পন্দন অনুভব করার চেষ্টা চালায়, তারপর ক্ষুধায় আবারও মাটির ওপর বসে পড়ে। আচ্ছা, মিয়াবাড়ির লোকজন এখন যাচ্ছে কোথায়? ওদের বাড়ির গোলা তা হলে ফাঁকা হয়ে গেছে? ওরা যে সারা বছরের জন্যে ঘরের সিলিং-এর ওপর আলু তুলে রাখত, সে আলু কি শেষ হয়ে গেছে? না কি রওনা হওয়ার আগে বেচে দিয়ে গেছে? না কি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে একটু-একটু করে? এই কংকালের মতো রাশেদাকে দেখে জমির আলী আর পুরানো অভ্যাসে মইষা দাউদ চুলকায় না এবং চিন্তা করে, একবার অন্তত তার কাঁদা উচিত। কিন্তু ভেতর থেকে কোনও কান্না উঠে আসে না তার। শুকনো হাড়ের মতো খটখটে হাত দিয়ে সে চোখের পাতা বারবার ছুঁয়ে ছুঁয়ে পরখ করে একটু ভিজে উঠেছে কি না। মড়া পোড়ার গন্ধ তার নাক ছুঁয়ে যায় এবং তার অনুশোচনা হয় যে, কেন গত পরশু একবারে আরেকটু রান্না করে রাখে নি। এই শীতের মধ্যে ওই ফেন্টু তো আর নষ্ট হবে না! তা হলে কী দরকার ছিল খামোকা মাত্র একদিনের মাপে ফেন্টু রাধার? তাতে তো এই হচ্ছে, এখন তাকে আর মাত্র একমুঠো আটা গুলিয়ে জ্বাল করার জন্যে পাগলের মতো খড়ি খুঁজে বেড়াতে হচ্ছে এ গাঁও ও গাঁও! এইবার ক্ষুধার পাশাপাশি তীব্র এক অনুশোচনার মতো তার মনে রফিক আর রাশেদা ফিরে-ফিরে আসে। ঝাঁপসা চোখের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ফিরে আসে যোগেনবাবুর ভিটা। আবার নিজেই নিজের ভেতর হাতড়াতে থাকে, রফিক যেন কে! কিছুতেই সে মনে করতে পারে না রফিকের পরিচয়, রফিকের অবয়ব। এই প্রশ্নোত্তরহীন সময়ে তার সামনে দিয়ে মুচিপাড়ার এক বালিকা হাতের আড়ালে ছোট একটি ছুরি নিয়ে ছুটে যায় কোনওখানে। সে বুঝতে পারে নমশুদ্রদের কেউ কোথাও মৃত গাইয়ের সন্ধান পেয়েছে আর সেই সন্ধান পাওয়ার খবর এই বালিকার কাছেও পৌঁছে গেছে কেন যে কেমন করে। এরকম সময়ে হয় কী, হয় কী…জমির আলীর মাথা দোলে, স্মৃতি দোলে এবং দোলনায় দোল খায় নমশুদ্রদের মধ্যে গরুর দখলিস্বত্ব নিয়ে খুব গোপন লড়াই। এক অলিখিত নিয়ম সেটা, মুচিদের কেউ মরা গরু পাওয়ার পর ছাল ছিলে ফেলতে পারলে গরুটা পুরোপুরিই তার হয়ে যায়; কিন্তু ছাল তোলার মাত্র এক সেকেন্ড বাকি থাকা অবস্থায়ও যদি কেউ গিয়ে সে গরুর গায়ে ঘা বসাতে পারে, তা হলে মাংস তো মাংস, গরুর চামড়া বিক্রির দামের ভাগও তাকে দিতে হবে। হাজার হোক গো-দেবতা, এ দুনিয়ার সকলেরই হক আছে তার ওপরে, সেই হক না মানলে তো গো-দেবতাকেই অপমান করা হয়। জমির আলীর মনে হয়, মুচি দেবু কী যেন ঘাড়ে করে নিয়ে দৌড়ে লুকিয়ে পড়ল যোগেনবাবুর ভিটায়। খালি দেবু কেন, যোগেনবাবুর যে ভিটায় এখন ঘুঘু চড়ে, সেই ভিটায় দেবুর মতো আরও হাজার হাজার দেবু গিয়ে যা খুশি তাই করতে পারে। বাধা যে দেবে সেই যোগেনবাবুই তো কত আগে ফুট মেরেছে ইন্ডিয়াতে! আর এখনও কারও অত সখ হয় নি যে হাগা বাদ দিয়ে যোগেনবাবুর ভিটায় ঘরবাড়ি বানাবে, লাঙল দাবাবে মাটির ভেতর। অতএব দেবু প্রাণপনে চেষ্টা করছে যোগেনবাবুর ভিটার ঝোপঝাড়ের গভীর থেকে আরও গভীরে হারিয়ে যাওয়ার, যেন কেউ আর খুঁজে না পায় তার ঘাড়ের ওপর ঝুলে থাকা গরুটাকে। ক্ষুধার ভারে আগে থেকেই নুয়ে ছিল, এখন একটা আস্ত মরা গরুর ভারে দেবু প্রায় শুয়ে পড়েছে। তারপরও সে দৌড়াচ্ছে প্রাণপনে।
জমির আলী দেখে, যদিও অত তলিয়ে দেখে না সে; তখনও তার সামনে সেই রাশেদা, যে রাশেদা একদিন পা তুলে তাকে লাথি মারতে চেয়েছিল আর এখন কবর থেকে তোলা তিনমাসের একটা কংকাল হয়ে গেছে। কিন্তু তখনও কাঁচা বীজ, শুকনো বীজ আর বীজ বপনের ঘ্রাণ আলাদা করতে অনভ্যস্ত বাচ্চা-বাচ্চা মেয়েরা কী করে যেন এসবই টের পেয়ে যায় এবং ছুরি হাতে বেরিয়ে পড়ে গরুর চামড়ার ওপর দখলিস্বত্ব প্রতিষ্ঠার দারুণ আকাক্সক্ষাতে। তারা রায়েকবন্দর তছনছ করে ফেলে, হরিণাচিল এলোমেলো করে ফেলে। যদিও এসবের কোনওকিছুই তেমন বোঝা যায় না কুয়াশার দাপটে। আর জমির দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে ন্যাটা দিয়ে বসে একটা গাছের গুঁড়ির ওপর। তারপর চিন্তা করে, গাঁ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, যদিও প্রতিদিনই একটু রোদ এসে কুয়াশাকে উত্যক্ত করতে শুরু করলে একটা না একটা গাড়ি আসছে এবং সেই গাড়িতে আসছে কয়েক প্যাকেট বিস্কুট, কয়েক ছড়া কলা ইত্যাদি। কলাবিস্কুট, পুরানো জামাকাপড় ইত্যাদি দিতে দিতে কেউ প্রচণ্ড সমালোচনা করছে সামরিক জান্তার। কেউ আবার উল্টে গালি দিচ্ছে সামরিক জান্তাবিরোধীদের। পুরানো কাপড়চোপড়ের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকা একটুআধটু উত্তাপ আর কলাবিস্কুটের এই আস্বাদ দিয়েও আগামী নির্বাচনের সময় বক্তৃতা দেয়ার প্র্যাকটিস করার নির্মল আনন্দে উল্লসিত শহুরে মানুষদের স্বপ্ন কেমন মিইয়ে আসছে মাঠের ওপর। শহরমুখী মানুষের স্রোত হালকা হয়ে আসছে, কারণ গাঁ-ও ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এমনকি কুয়াশার আস্তরণও পারছে না তার সেই ফাঁকা হওয়ার হাহাকার ঢেকে রাখতে। জমির মাথাটা কাত করে আবারও তাকায়। দেখে শহুরে মানুষদের কাছ থেকে বিনা পয়সায় পাওয়া একটা কালো স্কার্ফ গলায় ঝুলানো এক মেয়ে এবার দা হাতে ছুটে গেল না-জানি কোন দিকে। জমির মাথাটা কাত করে তার মিলিয়ে যাওয়া দেখে। হয়তো মেয়েটা এতক্ষণে দেবুকে খুঁজে পেয়েছে। আ-আরে, দেবু, মুই দেহি তোর কুনু লাভই হবার নয়। সে আবারও দেখতে পায়, না-খাওয়া দেবুর মুখটা কত উজ্জ্বল একটা আস্ত গরুর চামড়া পাওয়ার আনন্দে! সে তার কাঁধটা আরও সোজা করে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু বারবারই বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, একটা গরুর গায়ে কতটুকু মাংস ছিল? কিংবা একটা গরুর গায়ে কতটুকু মাংস থাকে? আবারও সে দেখতে পায়, কালো স্কার্ফ গলায় বাঁধা মুচিবাড়ির মেয়েটা এবার দায়ের দাঁত বসালো গরুর গায়ে আর দেবু যেন হাহাকার করে উঠল। মেয়েটা এখন খনখনে গলায় হাসছে, যেন তার গলার মধ্যে এক কলস গরুর দুধ খলবল করছে। জমির আলী বসে থেকে এইসব দেখে আর হাতের এপিঠ ও পিঠ নেড়েচেড়ে দু’জনকেই দূর-দূর করে চলে, তারপর হঠাৎ করেই তার হাত দুটো থেমে যায়, চোখটা শকুনের মতো হয় এবং সে তখন মনে করতে শেখে, আচ্ছা, এই দেবু আর খানকি মাগিটা চামড়া নিয়ে কখন কেটে পড়বে? আমিও তো তা হলে মাংসগুলো নিয়ে রওনা হতে পারি! টাটকা গরুর মাংস বলে চালিয়ে দিতে পারি। তাতে ভারি আনন্দ হয়। অনেকদিন পর গরুর মাংস খাওয়া যায়। অনেকদিন পর অনেক মানুষকেও গরুর মাংস খাওয়ানো যায়। মরা গরু তো কী হয়েছে? মানুষ কী আর জ্যান্ত গরুর মাংস খেতে পারে? মানুষ তো মরা গরুর মাংসই খায়!
জমির শ্যেন চোখে তাকিয়ে থাকে। তার কাছে এমনকি এই কুয়াশাতেও সব কিছু একেবারে পরিষ্কার মনে হয়। ওই তো আর্মির দল আসছে! একটু একটু কুয়াশার মধ্যে থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে তাদের জলপাইরঙা পোশাক, তাদের কাধের ওপর আস্ত মেশিনগান আর গুলিভরা ম্যাগাজিন। এই মরার দল আবার আসছে কী করতে? এরা কি তা হলে ঠ্যাং ধরে নিয়ে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবে তাদের, যেমন দেবুরা টেনেহিঁচড়ে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করে আস্ত গরু? জমির আলী এবার প্রাণপণে দৌড়ায়। কিন্তু কোনখানে যাবে টের পায় না। তারপর যা কোনওদিন হয় নি, আজ তাই হয়, তার মনে হয় দুনিয়ার কোনওখানে পালানোর কোনও জায়গা নেই। একমাত্র রফিকের সেই খিড়কি দেয়া ঘরটা ছাড়া আর কোনওখানেই লুকিয়ে থাকা যাবে না। সে তাই তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। দৌড়াতে থাকে। আর সামরিক বাহিনী তাকে অনুসরণ করতে থাকে। অথবা সামরিক বাহিনীই দৌড়াতে থাকে, কিন্তু কুয়াশা তাকে অনুসরণ করতে থাকে। কুয়াশায় অত কিছু বোঝা যায় না। তবে সামরিক বাহিনী চেষ্টা করে সব কাজ দ্রুত সেরে ফেলতে। অনেক কাজ তাদের হাতে। কেউ কি সত্যিই মরে গেছে? যারা মরে গেছে অথচ মড়া পড়ে আছে, তাদের লাশগুলো দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে; আর যারা মরো-মরো তাদের জিপে করে তুলে নিয়ে যেতে হবে আর্মির ক্যান্টনমেন্টে; সুন্দর ছাউনি ফেলা হবে গ্রামের স্কুলের মাঠে, তাবুর মধ্যে থাকবে তারা, বড় বড় ডেকচিতে তাদের জন্যে রান্নাবান্না হবে, রান্নাবান্নার সুন্দর ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়বে শীতের থ মারা বাতাসে এবং খাওয়ার পর প্রসন্ন বিকেলে তারা দেখতে বেরুবে, গাঁয়ের কে কে না খেয়ে আছে। মঙ্গা উপদ্রুত এই অঞ্চল এ ভাবে নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং তখন সামরিক জান্তাও আসবেন, তিনি বিশাল জনসভা করবেন, দেখবেন কেউ না-খেয়ে নেই, সবাই ভরপেটে তার বক্তৃতা শুনে হাততালি দিচ্ছে।
মঙ্গার এরকম সুন্দর এক পরিসমাপ্তির পরও জমির আলী দৌড়াতে থাকে। সেই ভোঁতা ব্লেডটি নিতে ভুলে যায় সে এবং অতএব অভ্যাসবশে আর কখনও মইষা দাউদের ওপর ব্লেড ঘষে আরাম পাওয়ার চেষ্টা চালায় না। ব্লেডটি কুয়াশাঢাকা গাছের নিচে পড়ে থাকতে থাকতে একসময় চেষ্টা করে মরিচা হয়ে যাওয়ার। আর জমির আলী তার অতি সম্প্রতি একেবারেই অনুভূতিশূন্য মইষা দাউদসমেত পৌঁছে যায় রফিকদের বাড়িতে। সে টের পায় না, কোমরে অনেক কষ্ট করে গুঁজে রাখা রফিকের সেইসব মাটির ঢেলা কখন এই নাতিদীর্ঘ পথে পড়ে গেছে। তা ছাড়া তার মনেও পড়ে না প্রতিদিন শেষরাতে কত কষ্টে ঘুম মাটি করে ক্ষেতের উত্তরশিথান থেকে ওই মসৃনতা ও অমৃসনতায় ছাওয়া মাটির ঢেলা সে নিয়ে আসত। তারপর অবিশ্বাস্য নিপুণতায় লুকিয়ে ফেলত তার কোমরের কাপড়ে। একেকটি মাটির ঢেলা রাস্তায় গড়িয়ে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশায় ফাটল ধরে, তারপর কুয়াশা আরও বেশি ঘনীভূত হয় মাটির ঢেলার গায়ে জমে ওঠা প্রেম ও কামের মসৃনতা ও অমৃসনতার বিন্দু দেখতে পেয়ে। এইবার হঠাৎ করেই জমির আলীর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লাগে, তাই সে দ্রুত রফিকদের ঘরের পাল্লা সরায়। তার পায়ের শব্দ শোনার পরও কেউ মুখ বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা চালায় না, কে এসেছে। এমনকি জমির আলী দরোজা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলে, ভোঁতা কিন্তু বিরক্তিকর দরোজা সরানোর আওয়াজ হলেও, কারও কোনও কণ্ঠস্বর শোনা যায় না। শীতের বাতাস খালি বাড়িটায় কী সুন্দর খেলা করে যায়, যেমন বাতাসেরা মনের আনন্দে খেলা করে খোলা প্রান্তরে কোনও প্রজাপতির ডানার সঙ্গী হয়ে। তারপর রফিক ঘরের মধ্যে থেকে ধুপ করে কোনও কিছু পড়ে যাওয়ার প্রচণ্ড শব্দ শুনতে পায়। কিন্তু সে অপলক প্রায়ান্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে আগের মতোই। সে বুঝতে পারে না, কত দিন কত যুগ এইভাবে তাকিয়ে থাকে; কিন্তু অনেক শব্দে আশপাশ কাঁপিয়ে সামরিক বাহিনীর লোকজন মধ্যের কোঠার দরোজা সরিয়ে টর্চ মারলে সে তার দু হাত দিয়ে চোখ ঢাকে, যদিও কোনও কিছুই বলতে পারে না। আর্মির দল তাকে পাঁজাকোলা করে ঘরের মধ্যে থেকে বাইরে বের করে নিয়ে এলে সে অনেকদিন পর অনুভব করে এই বাড়িতে এখন কোনও লোক থাকে না। বোধহয় এ বাড়ির সবাই মারা গেছে, কিংবা অন্য কোথাও চলে গেছে।
মৌলবী এনায়েত রসুল এইভাবে নামাজ পড়তে চলে গেলে রফিক আর রাশেদার কথা জানা যায় একটু একটু করে। কেননা রফিকের ভাবীর মনে পড়ে রফিক একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, মেয়েদের কোন ধরণের টিপ দিলে ভাল দেখা যায়? লম্বা টিপ দিলে না কি গোল টিপ দিলে? আর রফিকের ভাইয়েরও মনে পড়ে, একদিন তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে সাড়ে তিন শ টাকা খোয়া গেছে। এইভাবে ধীরে ধীরে রফিক ও রাশেদার প্রেমের বিষয়টা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে এবং রাত গভীর হওয়ার আগেই সে খবর গিয়ে আবার রাশেদাদের বাড়িতে পৌঁছায়। রাশেদার বাবা আর ভাইরা এ ঘটনায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়, তাদের মনে হয় শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগে রাশেদা তাদের জাতসম্মান, ধনসম্পদ সব কিছুতে ঘোড়ার চোনা ঢেলে দিয়ে গেছে। রাশেদা যদি আত্মহত্যা করত, অথবা পালিয়ে যেত অথবা ভালবাসার কথা বলে নির্ঘাৎ মরণের পথ বেছে নিতো তাও এর চেয়ে ভাল হতো। ভালবেসে মিয়াবাড়ির মেয়েরা আত্মহত্যা করতে কিংবা খুন হয়ে যেতে দ্বিধা করে না, এর চেয়ে বড় গৌরব আর কী হতে পারে? অথচ রাশেদা কী না সেই গৌরবের মুখে ছাই ফেলল! অতএব রাশেদার ভাইরা সিদ্ধান্ত নেয়, রাশেদা যখনই বাপের বাড়িতে ফিরে আসবে তখনই তাকে হত্যা করা হবে। এরকম একটি সিদ্ধান্ত সম্মিলিতভাবে নিতে পেরে খুশি হয় তারা। যদিও রাশেদার বাবা খুঁতখুতাতে থাকে।
এদিকে নামাজ থেকে ফিরে মৌলবী এনায়েত রসুল সিদ্ধান্ত নেয়, আগামীকাল বাড়ি বন্ধ করার পর জোহরের নামাজ পড়ে যাবেন তিনি। লোকজন তাই তাড়াতাড়ি ঘুম দিতে বিছানায় চলে যায়, যাতে সকাল-সকাল ক্ষেতে গিয়ে একপ্রহরের সময় বাড়ি ফিরে খানিকটা বাড়তি সময় কাটানো যায় কাজীবাড়িতে। কাজীবাড়ি ফাঁকা হয়ে যায়, রাত বাড়তে থাকে, কিন্তু পরিস্থিতি আগের মতোই থাকে। দেখা যায় রফিকের মা আগের দিনের মতোই গালে হাত দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে কী যেন বলতে বলতে কেঁদে কেটে একাকার হচ্ছে। আর রফিকের বাবা না কাঁদলেও তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, বরং কান্নাকাটি করলেই তার ভাল হতো। তবে রফিকের বড়ভাই আর ভাবীর অবস্থা ঠিক বোঝা যায় না, কেননা গতরাতে এই হুড়হাঙ্গামায় ডাঙ্গুলি খেলা হয় নি বলে রফিকের বড়ভাই আজ রাতে সকাল-সকালই শুয়ে পড়ে বিছানায় বউকে নিয়ে। রফিকের বাবা ঘরের বাইরে ঝিমুতে থাকে আর বড়ছেলের এই নির্লজ্জতায় মনে মনে তাকে গালিগালাজ করতে থাকে, অন্যদিকে রফিকের প্রশংসাও করে প্যাট আর চ্যাটকে সামাল দিয়ে এখনও ঘরের দরোজা আটকে পড়ে থাকায়। এইসব শাপশাপান্ত ও প্রশংসায় সে এত বেশি নিমগ্ন হয়ে পড়ে যে রাতের ক্রমবৃদ্ধি তার চোখে পড়ে না, এও আর মনে থাকে না সে কেন না-ঘুমিয়ে এইভাবে জেগে রয়েছে। একবার তার মনে হয়, রফিক তার মাকে ডাক দিচ্ছে, তাও অস্পষ্ট স্বরে, ঘুমের ঘোরে। কিন্তু সেই ডাকে কোনও ক্লান্তি নেই, কোনও অবসাদও নেই। আবারও এই ছেলেকে নিয়ে রফিকের বাবার বুকের ছাতি ফুলে ওঠে, দেখ, কেমন বাপকা ব্যাটা, প্যাট আর চ্যাটকে সামাল দিয়ে ঠিকই আরও একটা দিন পার করে দিল! আহ্, এরকম জোয়ান ছেলে, প্যাট আর চ্যাটকে সামাল দেয় কেমন করে!
ভাবতে ভাবতে রফিকের বাবা ঘরের ডোয়ার কাছাকাছি চলে আসে, আর ঠিক তখনই খুঁট করে মধ্যের কোঠার দরোজা খোলার শব্দ হয়। তারপর তার চোখে পড়ে প্যাট আর চ্যাটকে সামাল দিয়ে এখনও বুক চিতিয়ে থাকা রফিক দ্রুত পা ফেলে কোথায় যেন চলে গেল। দিশেহারা রফিকের বাপ সামনের দিকে এগোয়, চোখ ঘষে ঘষে জানার চেষ্টা করে, এই শয়তানের বাচ্চা শয়তানটা কোনখানে গেল আবার। কিন্তু অন্ধকার আর আকাশ থেকে নেমে আসা সামান্য আলো, এর কোনওকিছুই সাহায্য করে না তাকে। একটু দম নিয়ে রফিকের বাবা সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা চালায়, রাত হওয়ায় সে ভুল দেখেছে, আসলে রফিক ঘরেই আছে। কিন্তু এইবার একটু দূরে প্রস্রাবের শব্দ শোনা যায় এবং তাতে সে বেশ আস্বস্ত হয়। প্যাট আর চ্যাটের জ্বালা ঠেকিয়ে রাখতে পারলেও ছেলে যে পায়খানা পেচ্ছাব ত্যাগ করার মায়া ও আনন্দ কাটিয়ে উঠতে পারে নি তাতেই তার কাঁধের ওপর থেকে বিরাট এক বোঝা নেমে যায়। একবার সে চিন্তা করে, দৌড়ে মধ্যের কোঠার খোলা দরোজা চৌকাঠ ডিঙিয়ে সে নিজেই জলচৌকিটার ওপর শুয়ে পড়বে। কিন্তু এই ছেলের জিদ ভীষণ, একেবারে নিরুদ্দেশে চলে যেতে পারে; অতএব সে সেই চিন্তা বাদ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রস্রাব শেষ করে রফিক আবারও লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢোকে। রফিকের বাবা তার পিছে পিছে যায়, যায় আর বলে, এ বাপ, ঘর থাইকা না-বার হইলি, কেউ এহন দেইখবো না বাপ, দুইডা ভাত মুখে দে, মুই কাউক কিচ্ছু কমু না, তুই দরোজা আটকাইস না, মুই আইনা দিতেছি…
রফিক খানিকক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে তার বাবার এই আকুল আহ্বান শোনে, তারপর কোনও কিছু না বলে আবারও ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং দরোজা আটকে দেয়।
রফিকের বাপ রান্নাঘর থেকে তাড়াহুড়ো করে একটু ভাততরকারি নিয়ে সেই ঘরের দরোজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তাকে এইভাবে ছোটাছুটি করতে দেখে তার বউয়েরও ঘুমকান্না সব ছুটে যায়। সেও রফিকের বাবার পিছে পিছে ছুটে আসতে থাকে। আর হাত দিয়ে ঠেলা দিয়ে ঘরের দরোজা বন্ধ দেখে রফিকের বাবা খুব হতাশ হয়ে বলে ওঠে, এ্যাংখা দুঃখ পাইলাম রে বাপ। তোর মনে যে এত কিছু আছিল তা তো তুই কুনুদিন কইস নাই। এহন তোক বিনা আহারে রাইখা মোর মুখ দিয়া ভাত নামে কেব্যা কইরা, ক তুই দেহি। বলতে বলতে নিজের এই অনুতাপ মেশানো গলা অনুভব করে নিজের ওপরেই খেপে ওঠে সে এবং আরও একটু গলা চড়িয়ে রাগী রাগী স্বরে বলে, ভাততরকারির থাল দরোজার থন রাইখা দিলাম। বালো লাইগলে খায়্যা নিস।
বলে সে ঠক করে টিনের থালাটা মেঝের ওপরে রাখলেও একটা ভোঁতা ঘর্ষণের ছাড়া অন্য কোনও আওয়াজ শোনা যায় না। রফিকের বাবা এবার আরও একটু উঁচানো গলায় তার বউকে বলে, এই নবাবজাদার লাইগা বইসা থাইকা আর কী করবার নাগছো? চলো, ঘুমাইগা। হামাগারে টাইমের দাম নাই?
বলে সে বউকে নিয়ে ঘরে চলে যায়। তারপর সকালে উঠে দেখে ভাতের থালার ভাত তরকারি সব উধাও হয়ে গেছে। কেউ তা চেটেপুটে একেবারে পরিষ্কার করে খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু ঘরের দরোজা আগের মতোই বন্ধ রয়েছে।
একটু বেলা হলে মৌলবী এনায়েত রসুল আবার আসেন। তাকে এই ঘটনা বলে রফিকের বাবা। শুনে এনায়েত রসুল গম্ভীর মুখে শুধু বলেন, সাবধানের মাইর নাই। মুই আবারও ঘর বন্ধ কইরা দিবার চাই।
মৌলবী এনায়েত রসুল তার বাড়ি বন্ধ করার কাজ শুরু করেন। মনে হয় না, আশপাশে জমে ওঠা লোকজনের ভিড়ের দিকে কোনও খেয়াল রয়েছে তার। একমনে চোখ বুজে দোয়া পড়তে পড়তে দশটি জলন্ত তপ্ত পেরেক নিয়ে তিনি তার যাত্রা শুরু করে। একেকটি কোণে পৌঁছায় আর একেকটি পেরেক কমতে থাকে। এইভাবে যখন তিনি ঠিক মধ্যের কোঠার কাছাকাছি আসেন তখন একটিও জলন্ত পেরেক আর তার হাতে থাকে না। নিঃস্ব হয়ে তিনি তার দু চোখ খুলে ফেলেন এবং বলেন, আসল জায়গায়ই পোঁতাইতে পাইরলাম না। বলে তিনি আবারও নতুন করে দোয়াদরুদ পড়তে থাকেন, নতুন ১১টি পেরেক নিয়ে নকশা করেন এবং বাড়ি বন্ধ করে দিয়ে নগদ বিশটা টাকা নিয়ে চলে যান কাজী বাড়ি থেকে।
কিন্তু রফিক তবুও ঘর থেকে বের হয় না। অনেক কিছু বলেও ঘর থেকে তাকে আর বের করা যায় না। অনেক রাতে তার ঘরের দরোজার সামনে ভাত রাখতে রাখতে রফিকের মা গজগজায়। আর তারপরদিন সকালে উঠে দেখে খালি থালাবাসন দরোজার সামনে পড়ে রয়েছে। তার মানে রাতে দরোজা খুলে বেরিয়ে রফিক সব কিছু সাবাড় করে আবারও শুয়ে পড়েছে।
এইভাবে বাড়ি বন্ধ করার পরও, হয়ত বা জীন-পরী-ভূত-পেত্নী সব কিছু আসার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও রফিক আর সেই মধ্যের কোঠা থেকে বের হয় না, কারও সঙ্গে দেখা করে না, কিছু বলে না। শুধু চুপচাপ গভীর রাতে খাওয়াদাওয়া করে। প্রতিদিন রাতে তার জন্যে ঘরের দরোজার সামনে খাবারদাবার রাখা হয় ঢাকনা দিয়ে এবং প্রতিদিন সকালেই দেখা যায় সেসব সাবাড় হয়ে গেছে। এবং এভাবেই চলতে থাকে, কী বর্ষায়, কী গ্রীষ্মে, কী মাসের পয়লাতে কী মাসের একেবারে শুরুতে, এমনকি মঙ্গার সময়েও। এইসব ঋতুবদলের দাপট রফিক টের পায় কি না বোঝা যায় না, এমনকি মঙ্গাও তাকে স্পর্শ করে বলে মনে হয় না। প্রায়ান্ধকার একটি ঘরের মধ্যে সে কারও সঙ্গে কথাবার্তা না বলে দিব্যি সময় কাটিয়ে দিতে থাকে, এমনকি কোনও কোনও রাতের ভাতও পড়ে থাকে দরোজার সামনে। দিন যত যায়, থালাভর্তি ভাত পড়ে থাকার ঘটনাও তত বাড়তে থাকে।
নয় বছর পর মঙ্গার মতো মঙ্গা আসে। সে আসে হাড় কাঁপিয়ে, শূন্য থালায় মাংসশূন্য হাড় বাজিয়ে। খুব সংগোপনে কেউ একজন কার্তিকের মঙ্গা নিয়ে থিসিস করেছিল। তার সেই থিসিস পড়েছিল কোনও এক প্রজেক্টের অংশ হয়ে অসংখ্য ফাইলের ভিড়ে। এইবার তার লালফিতা আপনাআপনিই খুলে পড়ে। কেননা মঙ্গার মানুষ কোনওরকমে বাহাদুরাবাদ ঘাট পাড়ি দিয়ে ট্রেনে চড়ে অথবা না-চড়েই রাস্তাঘাটে পড়ে থাকতে শুরু করে। তাদের গা থেকে শীতের ভ্যাঁপসা ঘ্রাণ উঠে এলে প্রথমে বোঝা যায় না কেউ মারা গেছে। কিন্তু ঘ্রাণটা ক্রমাগত মরা ছুঁচো হয়ে উঠলে লোকজন অস্থির হয়ে ওঠে, বুঝতে পারে মৃত মানুষ আর মৃত ছুঁচোর মধ্যে কোনও তফাৎ নেই, তফাৎ কেবল জীবদ্দশায়। বুকের কোথাও দুঃখ পুষে রাখা একদা কবিতা লেখা এক ফটোগ্রাফারের প্রায় প্রতিটি ছবিই ঝাপসা হয়ে যেতে শুরু করে, কখনও বা ফোকাস ঠিকমতো হয় না, কখনও অ্যাপারচার এমন এক জায়গায় টিউন করা থাকে যে মূল সাবজেক্ট একেবারে কালো হয়ে যায়। শীতের কুয়াশায় কখনও কখনও এরকম সব পাশাপাশি শুয়ে থাকা মানুষগুলোকে মনে হয় কালো ও অশুভ প্রেতচ্ছায়ার মতো আর তাই সরকারের তরফ থেকে খুব হম্বিতম্বি শুরু হয়ে যায় জেলা আর উপজেলার কর্মকর্তাদের ওপরে, খুব দ্র্রুত এই মঙ্গাকে সামাল দেয়ার দাপ্তরিক নির্দেশ নিয়ে অফিসে বসে বসে হাসাহাসি করে তারা, সিগারেট টানে আর চা পান করতে করতে বলে, হে-হ্, ঢাল নাই, তলোয়ার নাই, নিধিরাম সর্দার…মঙ্গা সামাল দিব! এই সুযোগে নবীন এক কলামিস্ট তার সামাজিক ভাবনা প্রকাশের সুযোগ পেয়ে লিখতে থাকে, মঙ্গার সময় যেহেতু কোনও কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকে না সেহেতু আমরা আগে থেকেই এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারি। যেমন, এই সময় কলা চাষ করা যেতে পারে। কর্মকর্তারা কলা খেতে খেতে কলাচাষের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করে এবং পত্রিকাগুলোয় ঢাকা বা বিভিন্ন শহরের পাঠকদের কাছে এই মঙ্গাক্রান্ত মানুষদের জন্যে শীততাড়ানিয়া কাপড়চোপড় ও টাকাপয়সা চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়।
রফিক ঘরের মধ্যে আশপাশে চায়, অন্ধকারে একটু শীত কি লাগে? অথচ কতদিন হয়ে গেছে, শীত কিংবা গরম কোনওটাই তার শরীরে আর কোনও সাড়া জাগায় না। শীত আসি-আসি হেমন্তে রাশেদার বিয়ে হওয়ার পর থেকে সে শীত আসার সংবাদ পায়, কিন্তু তার শরীরে কোনও বোধ জাগে না। হেমন্ত ফুরিয়ে সেবার প্রথম শীতেই একদিন অনেক রাতে দরোজা খুলে একটি কম্বল দেখে সে। চৌকাঠের ওপর পড়ে আছে, বোঝাই যায় মা তার জন্যে এখানে সেটা ফেলে রেখেছে। মা’র কথা এইভাবে মনে পড়ায় তার কোনও আক্ষেপ জাগে না; আবার রাগও হয় না। কোনও প্রয়োজন ছিল না, তবু সে কম্বলটি নিয়ে আসে, কেননা তার মনে পড়ে এটি কিনে শহর থেকে ফেরার পথে রাশেদাকে সে দেখেছিল তাদের বাড়ির গোয়ালঘরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কম্বলের সূত্রে তার রাশেদাকে মাঝেমাঝে মনে পড়ে এই বিছানার ওপরে। তা ছাড়া তার মনে হয় না তেমন কোনও স্মৃতি রয়েছে যার কারণে সে রাশেদার কথা ভাববে। অথচ নিশ্চয়ই এর চেয়ে অনেক অনেক গভীর স্মৃতি রয়েছে তাদের। কিন্তু সেই যোগেনবাবুর ভুতুড়ে ভিটে সারাদিন হাতড়ে বেড়ালেও কি সেসবের কোনও একটির চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে? চিহ্ন তো আসলে মানুষ রচনা করে তার মস্তিষ্কের খাদে এবং তারপর সেই খাদের কিনারে আজীবন দাঁড়িয়ে থাকে খুব বিপজ্জনক ভঙ্গিমাতে। কখনও কখনও হঠাৎ সে খাদের মধ্যে পড়ে যায় এবং তখন তার ফেরার আর কোনও পথ খোলা থাকে না। যেমন রফিকের সামনেও ফেরার মতো কোনও পথ খোলা নেই। সে আর মনে করতে পারবে না, কেন সে এই কোঠার মধ্যে সেদিন দুপুরে হঠাৎ এসে শুয়ে পড়েছিল, দরোজার খিড়কি বন্ধ করে দিয়েছিল এবং কেনই বা কেউ তাকে এতদিন অনেক সাধাসাধি করেও ঘরের বাইরে খোলা দুনিয়ায় আর নিয়ে যেতে পারে নি। একটি ঘর বিশাল এক প্রান্তর হয়ে তার সামনে পড়ে থাকে এই ঘরের মধ্যে, সেই প্রান্তর সে আর কিছুতেই অতিক্রম করতে পারে না। এতদিন পর তার কেন যে শীত-শীত লাগে তাও সে বুঝতে পারে না, শীত তাড়ানিয়া কম্বলটা গায়ে চাপিয়ে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে দেয়ালের দিকে।
একেকটি দিন পেরোয়, মানুষের উদ্বেগ বাড়ে, মানুষের স্মৃতিচারণ বাড়ে, তারপর উদ্বেগ আর স্মৃতিচারণের বিলাসিতা ছাপিয়ে ক্ষুধার মাত্রা তীব্র হয়ে উঠতে থাকে। এবং মানুষ স্মৃতিচারণের শক্তি হারিয়ে ফেলে, কথা বলার বদলে তাদের চোখেমুখে ফুটে ওঠে এবং চিরস্থায়ী হয়ে পড়ে আকুলতার এক চিরকালীন ভাষা, দে না বাহে…। আর সারাটা রাত, রাত পেরুনো ভোর আর ধলপহর এই ক্ষুধার শরীরকে জাপটে ধরে শুয়ে থাকে ঘোর কুয়াশা ও বিন্দু বিন্দু শিশির। তারপর একটু সূর্য ওঠে, তীব্র সূর্য ওঠে; এক প্রচণ্ড বুভুক্ষতা নিয়ে তারাও জাপটে ধরে ক্ষুধার শরীর। এইভাবে ক্ষুধার শরীর ডুবে যায় অতল কুয়াশার মধ্যে, শিশিরের মধ্যে, মিশে যায় সূর্যালোকে। ক্ষুধা তার অবয়ব ও শক্তি হারিয়ে আরও শক্তিমান হয়ে ওঠে, কিংবা তার আরও ভয়ানক স্খলন ঘটে। ক্ষুধা হয়ে ওঠে অবয়বহীন আদিম পাথর। আর এরকম অজস্র অবয়বহীন আদিম পাথর তখন রায়েকবন্দর, হরিণাচিলা, পাথরদিয়া হয়ে সবখানে ছড়িয়ে পড়ে, একটির সঙ্গে আরেকটি ঠোকাঠুকি খায়, কিন্তু কোথাও কোনও আগুন জ্বলে ওঠে না। রফিক এসবের কোনও কিছু টের পায় না, কোনও কিছু বুঝতেও পারে না, এমনকি এখন যে দিনের পর দিন কেউই আর তার জন্যে ঘরের দরোজার বাইরে কোনও থালাভর্তি খাবার রেখে যাচ্ছে না, তাও সে ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। তবে কোনওখানেই এ ক্ষুধা প্রশ্রয় পায় না, অতএব তা এক প্রান্তর থেকে উন্মূল হয়ে ছুটে যায় আরেক প্রান্তরে, যদিও পেছনে রেখে যায় পদচিহ্ন। প্রান্তরের ক্ষেতগুলোয় নেতিয়ে পড়া সামান্য একটু কাপড়পরা মানুষগুলো তাকিয়ে থাকে, যেন উন্মত্ত এক ফ্যাশনপ্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে গার্মেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের জোর উদ্যোগে, কিন্তু প্রতিটি মডেলই অকৃতকার্য হচ্ছে বিড়ালের মতো পায়ের আঙুল বাঁকিয়ে আর পাছা নাড়িয়ে হাঁটতে পারে না বলে। শীত তাদের গায়ে লাগে না, অথবা লাগে কিন্তু তারা তা উপেক্ষা করে মোহনীয় এক জগতের হাতছানিতে, তবে তাদের মোহনীয় সেই জগতে খ্যাতি নয়, খেলা করে ধোয়া ওঠা একটু ভাতের ঘ্রাণ। তারা প্রান্তরের ক্ষেতের দিকে তাকায়, ধানকাটা শুরু হবে কবে? কিন্তু এখনও ধান উঠতে দিনবিশেক দেরি, মরে যাওয়ার জন্যে এ কটা দিন খুবই যথেষ্ট। কেউ কেউ তাই ঘন ঘন ক্ষেতে যায়, দাত দিয়ে ধান কামড়ে ভেতরের দুধেল ধানের আস্বাদ নেয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের হিমশরীর আতংকে আরও এক প্রস্থ হিম হয়ে যায়, কেননা তারা টের পায় সব ধান চিটে হয়ে যাচ্ছে। খুব তাড়াতাড়িই এ খবর সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষ পাগলের মতো ক্ষেতের মধ্যে নেমে পড়ে। সেই খবর অথবা আতংক দূর করার জন্যে তারা খুব যত্ন করে চামড়া ফুটে বেরিয়ে আসা শীর্ণ রগওয়ালা হাতে ধানের ছড়া তুলে নেয়, যেন হাতের সামান্য ছোঁয়াতেই সব ধান ঝরে পড়বে ক্ষেতের ওপর, তারপর আরও যত্ন করে ধানে দাঁত ফুটায়, তাদের মুখে হতাশা ও আতংক ছড়িয়ে পড়ে, তারা আরও একটি ধান তুলে নেয় এবং তাতে আবারও যত্ন করে দাঁত ফুটায়। তারা ধানের শরীরে দাঁত ফুটিয়ে চলে। কুয়াশা সরিয়ে একটু একটু করে রোদ উঠতে থাকে, সেই রোদে চোখে পড়ে অগ্রহায়ণের জন্যে অপেক্ষারত ধানক্ষেতে কেবলই মানুষের মাথা কিলবিল করছে, ধানের শরীর তারা এতক্ষণ রক্ষা করেছে শীত আর শিশিরের হাত থেকে। কিন্তু একদিনের এই আত্মত্যাগে কোনও কিছু আসে যায় না, সব ধানই শীতে-শীতে সিঁটকে যেতে থাকে আগে আর পরে।
আর এই সাময়িক উত্তেজনায় রায়েকবন্দর, হরিণাচিলা কিংবা পাথরদিয়ার মানুষরা বরং আরও অসুস্থ হয়। মাথার ওপর ঝরে পড়া শিশির তাদের জন্যে কোনও মোহনীয় স্মৃতি তৈরি করে না, ঠাণ্ডার ভারে নিচের দিকে নুয়ে আসে তাদের মাথা। চোখের পাতা খুলতে ইচ্ছা করে না তাদের, কেননা চোখের পাতা খুললেই তীব্র এক যন্ত্রণা কপালের পাশ দিয়ে আগুন জ্বালায়, তারপর সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারা কপালে, কানের গোড়ায়, ঘাড়ের দিকে, চোখের কোণে। গলার ভেতর কী যেন দলা পাকায় এবং শরীর কাঁপে তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো। জমির আলী অনুভব করে তার মইষা দাউদের ক্ষত কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেছে, আজকাল আর চুলকায় না, অথচ এ রকম শীতে এই গেল বছরেও একটু কাপড়ের আড়াল পেলেই তীব্র চুলকানি উঠে আসত মাংসের তল থেকে। কিন্তু এখন পাতলা একটা গেঞ্জি আর ওপরের দিকে টেনে তুলে শরীরে পেঁচানো লুঙ্গির নিচেও ওই ভয়ানক মইষা দাউদ কেমন ঠাণ্ডা মেরে আছে! তবু সে অভ্যাসবশে ভোতা ব্লেড দিয়ে কাধের কাছে মাঝেমধ্যেই ঘষতে থাকে। আর দেখে বর্ষাপেরুনো বিলের মধ্যে মানুষজন নেমে পড়েছে এই দারুণ শীতেও। শাপলা খুঁজছে তারা। দেখে জমির আলীর মুখ জলে ভরে যায়। আহ্, দুইচারখান শাপলা জোটাতে পারলেও তো আজ দিনটা পাড়ি দেয়া যেত। দুইদিন সে এই লোভ পাশ কাটিয়ে যায় কিংবা লোভটাকে আগলে রাখে। তারপর তৃতীয় দিনে তার ঠিক গলার কাছ থেকে তীব্র ক্ষুধা সরীসৃপের মতো কিলবিলিয়ে নামতে শুরু করে পেটের দিকে। শাপলার লোভে সে ঘরের দাওয়া থেকে উঠে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এগোয়, বিলের চারদিক পাগলের মতো ঘোরে, বিল ছাড়িয়ে সামনে গিয়ে নদীর দিকে চলে যাওয়া নালার পাড় ধরে এগুতে থাকে, তার পায়ে কত কাটা বেধে, অযত্নে গজিয়ে ওঠা গাছের ডালের খোঁচা লেগে তার গা থেকে একটুআধটু রক্তও ঝরে পড়ে, মাঝেমধ্যে বেখাপ্পা ঘন জঙ্গল তার চলার পথ বন্ধ করে দেয়। সে খুব যত্ন করে আবারও নতুন রাস্তা খুঁজে নেয়। কিন্তু কোনওখানে আর কোনও শাপলাই খুঁজে পায় না। বাঁশঝোপের নিচে দাঁড়িয়ে সে হাঁফায় আর ব্লেড দিয়ে ঘাড় জুড়ে ছড়িয়ে পড়া মইষা দাউদ চুলকে চলে। তখন চোখে পড়ে দল বেধে মিয়াবাড়ির সবাই স্টেশনের দিকে রওনা হয়েছে, হালকা কুয়াশায় তাদের কাউকে চেনা যায় না ভাল করে। সে তাই এগিয়ে যায় এবং চোখে পড়ে যে রাশেদাও সেই দলে আছে।
এতদিন বাদে সে রাশেদাকে দেখতে পেল, জমির আলীর এবার তীব্র ক্ষুধা লাগে! মনে হয় সে মরে যাচ্ছে এবং এও মনে হয় রাশেদাকে ঘিরে যে-সব এলোমেলো ইচ্ছা তার মধ্যে বাইকুড়ানি তুলত একসময়, সে-সব আরও আগে মারা গেছে। তার মনে হয় না এমন কেউ এখনও বেঁচে আছে যে না কি গলা উঁচিয়ে বলতে পারবে, কোনওখানে এখনও ভালবাসা বেঁচে আছে। এবং ভালোবাসা বেঁচে নেই বলেই কি না কে জানে, যান্ত্রিকভাবে তার শরীর জাগতে থাকে। সে খুব ভয় পায়, কেননা এখন ওইটা দু উরুর চাপে কাহিল করে ফেলতে গেলে নরম সুতোর আধখানা লুঙ্গি ছিঁড়ে যাবে। জেগে ওঠা এই শরীর নিয়ে ব্যতিব্যস্ত জমির আর রাশেদার মুখের দিকে তাকাতেই পারে না। তা ছাড়া মনে হয়, আত্মহত্যা করার পর রাশেদাকে দাফন করা হয়েছিল খুব তড়িঘড়ি, পরে খবর পেয়ে পুলিশ এসে কবর থেকে পোস্টমর্টেমের জন্যে মড়া তুলে এই কংকালটুকু খুঁজে পেয়েছে। জমির আলী ভয়ে ভয়ে নিজের গায়ের চামড়ায় চিমটি কাটে, রক্তের স্পন্দন অনুভব করার চেষ্টা চালায়, তারপর ক্ষুধায় আবারও মাটির ওপর বসে পড়ে। আচ্ছা, মিয়াবাড়ির লোকজন এখন যাচ্ছে কোথায়? ওদের বাড়ির গোলা তা হলে ফাঁকা হয়ে গেছে? ওরা যে সারা বছরের জন্যে ঘরের সিলিং-এর ওপর আলু তুলে রাখত, সে আলু কি শেষ হয়ে গেছে? না কি রওনা হওয়ার আগে বেচে দিয়ে গেছে? না কি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে একটু-একটু করে? এই কংকালের মতো রাশেদাকে দেখে জমির আলী আর পুরানো অভ্যাসে মইষা দাউদ চুলকায় না এবং চিন্তা করে, একবার অন্তত তার কাঁদা উচিত। কিন্তু ভেতর থেকে কোনও কান্না উঠে আসে না তার। শুকনো হাড়ের মতো খটখটে হাত দিয়ে সে চোখের পাতা বারবার ছুঁয়ে ছুঁয়ে পরখ করে একটু ভিজে উঠেছে কি না। মড়া পোড়ার গন্ধ তার নাক ছুঁয়ে যায় এবং তার অনুশোচনা হয় যে, কেন গত পরশু একবারে আরেকটু রান্না করে রাখে নি। এই শীতের মধ্যে ওই ফেন্টু তো আর নষ্ট হবে না! তা হলে কী দরকার ছিল খামোকা মাত্র একদিনের মাপে ফেন্টু রাধার? তাতে তো এই হচ্ছে, এখন তাকে আর মাত্র একমুঠো আটা গুলিয়ে জ্বাল করার জন্যে পাগলের মতো খড়ি খুঁজে বেড়াতে হচ্ছে এ গাঁও ও গাঁও! এইবার ক্ষুধার পাশাপাশি তীব্র এক অনুশোচনার মতো তার মনে রফিক আর রাশেদা ফিরে-ফিরে আসে। ঝাঁপসা চোখের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ফিরে আসে যোগেনবাবুর ভিটা। আবার নিজেই নিজের ভেতর হাতড়াতে থাকে, রফিক যেন কে! কিছুতেই সে মনে করতে পারে না রফিকের পরিচয়, রফিকের অবয়ব। এই প্রশ্নোত্তরহীন সময়ে তার সামনে দিয়ে মুচিপাড়ার এক বালিকা হাতের আড়ালে ছোট একটি ছুরি নিয়ে ছুটে যায় কোনওখানে। সে বুঝতে পারে নমশুদ্রদের কেউ কোথাও মৃত গাইয়ের সন্ধান পেয়েছে আর সেই সন্ধান পাওয়ার খবর এই বালিকার কাছেও পৌঁছে গেছে কেন যে কেমন করে। এরকম সময়ে হয় কী, হয় কী…জমির আলীর মাথা দোলে, স্মৃতি দোলে এবং দোলনায় দোল খায় নমশুদ্রদের মধ্যে গরুর দখলিস্বত্ব নিয়ে খুব গোপন লড়াই। এক অলিখিত নিয়ম সেটা, মুচিদের কেউ মরা গরু পাওয়ার পর ছাল ছিলে ফেলতে পারলে গরুটা পুরোপুরিই তার হয়ে যায়; কিন্তু ছাল তোলার মাত্র এক সেকেন্ড বাকি থাকা অবস্থায়ও যদি কেউ গিয়ে সে গরুর গায়ে ঘা বসাতে পারে, তা হলে মাংস তো মাংস, গরুর চামড়া বিক্রির দামের ভাগও তাকে দিতে হবে। হাজার হোক গো-দেবতা, এ দুনিয়ার সকলেরই হক আছে তার ওপরে, সেই হক না মানলে তো গো-দেবতাকেই অপমান করা হয়। জমির আলীর মনে হয়, মুচি দেবু কী যেন ঘাড়ে করে নিয়ে দৌড়ে লুকিয়ে পড়ল যোগেনবাবুর ভিটায়। খালি দেবু কেন, যোগেনবাবুর যে ভিটায় এখন ঘুঘু চড়ে, সেই ভিটায় দেবুর মতো আরও হাজার হাজার দেবু গিয়ে যা খুশি তাই করতে পারে। বাধা যে দেবে সেই যোগেনবাবুই তো কত আগে ফুট মেরেছে ইন্ডিয়াতে! আর এখনও কারও অত সখ হয় নি যে হাগা বাদ দিয়ে যোগেনবাবুর ভিটায় ঘরবাড়ি বানাবে, লাঙল দাবাবে মাটির ভেতর। অতএব দেবু প্রাণপনে চেষ্টা করছে যোগেনবাবুর ভিটার ঝোপঝাড়ের গভীর থেকে আরও গভীরে হারিয়ে যাওয়ার, যেন কেউ আর খুঁজে না পায় তার ঘাড়ের ওপর ঝুলে থাকা গরুটাকে। ক্ষুধার ভারে আগে থেকেই নুয়ে ছিল, এখন একটা আস্ত মরা গরুর ভারে দেবু প্রায় শুয়ে পড়েছে। তারপরও সে দৌড়াচ্ছে প্রাণপনে।
জমির আলী দেখে, যদিও অত তলিয়ে দেখে না সে; তখনও তার সামনে সেই রাশেদা, যে রাশেদা একদিন পা তুলে তাকে লাথি মারতে চেয়েছিল আর এখন কবর থেকে তোলা তিনমাসের একটা কংকাল হয়ে গেছে। কিন্তু তখনও কাঁচা বীজ, শুকনো বীজ আর বীজ বপনের ঘ্রাণ আলাদা করতে অনভ্যস্ত বাচ্চা-বাচ্চা মেয়েরা কী করে যেন এসবই টের পেয়ে যায় এবং ছুরি হাতে বেরিয়ে পড়ে গরুর চামড়ার ওপর দখলিস্বত্ব প্রতিষ্ঠার দারুণ আকাক্সক্ষাতে। তারা রায়েকবন্দর তছনছ করে ফেলে, হরিণাচিল এলোমেলো করে ফেলে। যদিও এসবের কোনওকিছুই তেমন বোঝা যায় না কুয়াশার দাপটে। আর জমির দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে ন্যাটা দিয়ে বসে একটা গাছের গুঁড়ির ওপর। তারপর চিন্তা করে, গাঁ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, যদিও প্রতিদিনই একটু রোদ এসে কুয়াশাকে উত্যক্ত করতে শুরু করলে একটা না একটা গাড়ি আসছে এবং সেই গাড়িতে আসছে কয়েক প্যাকেট বিস্কুট, কয়েক ছড়া কলা ইত্যাদি। কলাবিস্কুট, পুরানো জামাকাপড় ইত্যাদি দিতে দিতে কেউ প্রচণ্ড সমালোচনা করছে সামরিক জান্তার। কেউ আবার উল্টে গালি দিচ্ছে সামরিক জান্তাবিরোধীদের। পুরানো কাপড়চোপড়ের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকা একটুআধটু উত্তাপ আর কলাবিস্কুটের এই আস্বাদ দিয়েও আগামী নির্বাচনের সময় বক্তৃতা দেয়ার প্র্যাকটিস করার নির্মল আনন্দে উল্লসিত শহুরে মানুষদের স্বপ্ন কেমন মিইয়ে আসছে মাঠের ওপর। শহরমুখী মানুষের স্রোত হালকা হয়ে আসছে, কারণ গাঁ-ও ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এমনকি কুয়াশার আস্তরণও পারছে না তার সেই ফাঁকা হওয়ার হাহাকার ঢেকে রাখতে। জমির মাথাটা কাত করে আবারও তাকায়। দেখে শহুরে মানুষদের কাছ থেকে বিনা পয়সায় পাওয়া একটা কালো স্কার্ফ গলায় ঝুলানো এক মেয়ে এবার দা হাতে ছুটে গেল না-জানি কোন দিকে। জমির মাথাটা কাত করে তার মিলিয়ে যাওয়া দেখে। হয়তো মেয়েটা এতক্ষণে দেবুকে খুঁজে পেয়েছে। আ-আরে, দেবু, মুই দেহি তোর কুনু লাভই হবার নয়। সে আবারও দেখতে পায়, না-খাওয়া দেবুর মুখটা কত উজ্জ্বল একটা আস্ত গরুর চামড়া পাওয়ার আনন্দে! সে তার কাঁধটা আরও সোজা করে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু বারবারই বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, একটা গরুর গায়ে কতটুকু মাংস ছিল? কিংবা একটা গরুর গায়ে কতটুকু মাংস থাকে? আবারও সে দেখতে পায়, কালো স্কার্ফ গলায় বাঁধা মুচিবাড়ির মেয়েটা এবার দায়ের দাঁত বসালো গরুর গায়ে আর দেবু যেন হাহাকার করে উঠল। মেয়েটা এখন খনখনে গলায় হাসছে, যেন তার গলার মধ্যে এক কলস গরুর দুধ খলবল করছে। জমির আলী বসে থেকে এইসব দেখে আর হাতের এপিঠ ও পিঠ নেড়েচেড়ে দু’জনকেই দূর-দূর করে চলে, তারপর হঠাৎ করেই তার হাত দুটো থেমে যায়, চোখটা শকুনের মতো হয় এবং সে তখন মনে করতে শেখে, আচ্ছা, এই দেবু আর খানকি মাগিটা চামড়া নিয়ে কখন কেটে পড়বে? আমিও তো তা হলে মাংসগুলো নিয়ে রওনা হতে পারি! টাটকা গরুর মাংস বলে চালিয়ে দিতে পারি। তাতে ভারি আনন্দ হয়। অনেকদিন পর গরুর মাংস খাওয়া যায়। অনেকদিন পর অনেক মানুষকেও গরুর মাংস খাওয়ানো যায়। মরা গরু তো কী হয়েছে? মানুষ কী আর জ্যান্ত গরুর মাংস খেতে পারে? মানুষ তো মরা গরুর মাংসই খায়!
জমির শ্যেন চোখে তাকিয়ে থাকে। তার কাছে এমনকি এই কুয়াশাতেও সব কিছু একেবারে পরিষ্কার মনে হয়। ওই তো আর্মির দল আসছে! একটু একটু কুয়াশার মধ্যে থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে তাদের জলপাইরঙা পোশাক, তাদের কাধের ওপর আস্ত মেশিনগান আর গুলিভরা ম্যাগাজিন। এই মরার দল আবার আসছে কী করতে? এরা কি তা হলে ঠ্যাং ধরে নিয়ে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবে তাদের, যেমন দেবুরা টেনেহিঁচড়ে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করে আস্ত গরু? জমির আলী এবার প্রাণপণে দৌড়ায়। কিন্তু কোনখানে যাবে টের পায় না। তারপর যা কোনওদিন হয় নি, আজ তাই হয়, তার মনে হয় দুনিয়ার কোনওখানে পালানোর কোনও জায়গা নেই। একমাত্র রফিকের সেই খিড়কি দেয়া ঘরটা ছাড়া আর কোনওখানেই লুকিয়ে থাকা যাবে না। সে তাই তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। দৌড়াতে থাকে। আর সামরিক বাহিনী তাকে অনুসরণ করতে থাকে। অথবা সামরিক বাহিনীই দৌড়াতে থাকে, কিন্তু কুয়াশা তাকে অনুসরণ করতে থাকে। কুয়াশায় অত কিছু বোঝা যায় না। তবে সামরিক বাহিনী চেষ্টা করে সব কাজ দ্রুত সেরে ফেলতে। অনেক কাজ তাদের হাতে। কেউ কি সত্যিই মরে গেছে? যারা মরে গেছে অথচ মড়া পড়ে আছে, তাদের লাশগুলো দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে; আর যারা মরো-মরো তাদের জিপে করে তুলে নিয়ে যেতে হবে আর্মির ক্যান্টনমেন্টে; সুন্দর ছাউনি ফেলা হবে গ্রামের স্কুলের মাঠে, তাবুর মধ্যে থাকবে তারা, বড় বড় ডেকচিতে তাদের জন্যে রান্নাবান্না হবে, রান্নাবান্নার সুন্দর ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়বে শীতের থ মারা বাতাসে এবং খাওয়ার পর প্রসন্ন বিকেলে তারা দেখতে বেরুবে, গাঁয়ের কে কে না খেয়ে আছে। মঙ্গা উপদ্রুত এই অঞ্চল এ ভাবে নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং তখন সামরিক জান্তাও আসবেন, তিনি বিশাল জনসভা করবেন, দেখবেন কেউ না-খেয়ে নেই, সবাই ভরপেটে তার বক্তৃতা শুনে হাততালি দিচ্ছে।
মঙ্গার এরকম সুন্দর এক পরিসমাপ্তির পরও জমির আলী দৌড়াতে থাকে। সেই ভোঁতা ব্লেডটি নিতে ভুলে যায় সে এবং অতএব অভ্যাসবশে আর কখনও মইষা দাউদের ওপর ব্লেড ঘষে আরাম পাওয়ার চেষ্টা চালায় না। ব্লেডটি কুয়াশাঢাকা গাছের নিচে পড়ে থাকতে থাকতে একসময় চেষ্টা করে মরিচা হয়ে যাওয়ার। আর জমির আলী তার অতি সম্প্রতি একেবারেই অনুভূতিশূন্য মইষা দাউদসমেত পৌঁছে যায় রফিকদের বাড়িতে। সে টের পায় না, কোমরে অনেক কষ্ট করে গুঁজে রাখা রফিকের সেইসব মাটির ঢেলা কখন এই নাতিদীর্ঘ পথে পড়ে গেছে। তা ছাড়া তার মনেও পড়ে না প্রতিদিন শেষরাতে কত কষ্টে ঘুম মাটি করে ক্ষেতের উত্তরশিথান থেকে ওই মসৃনতা ও অমৃসনতায় ছাওয়া মাটির ঢেলা সে নিয়ে আসত। তারপর অবিশ্বাস্য নিপুণতায় লুকিয়ে ফেলত তার কোমরের কাপড়ে। একেকটি মাটির ঢেলা রাস্তায় গড়িয়ে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশায় ফাটল ধরে, তারপর কুয়াশা আরও বেশি ঘনীভূত হয় মাটির ঢেলার গায়ে জমে ওঠা প্রেম ও কামের মসৃনতা ও অমৃসনতার বিন্দু দেখতে পেয়ে। এইবার হঠাৎ করেই জমির আলীর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লাগে, তাই সে দ্রুত রফিকদের ঘরের পাল্লা সরায়। তার পায়ের শব্দ শোনার পরও কেউ মুখ বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা চালায় না, কে এসেছে। এমনকি জমির আলী দরোজা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলে, ভোঁতা কিন্তু বিরক্তিকর দরোজা সরানোর আওয়াজ হলেও, কারও কোনও কণ্ঠস্বর শোনা যায় না। শীতের বাতাস খালি বাড়িটায় কী সুন্দর খেলা করে যায়, যেমন বাতাসেরা মনের আনন্দে খেলা করে খোলা প্রান্তরে কোনও প্রজাপতির ডানার সঙ্গী হয়ে। তারপর রফিক ঘরের মধ্যে থেকে ধুপ করে কোনও কিছু পড়ে যাওয়ার প্রচণ্ড শব্দ শুনতে পায়। কিন্তু সে অপলক প্রায়ান্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে আগের মতোই। সে বুঝতে পারে না, কত দিন কত যুগ এইভাবে তাকিয়ে থাকে; কিন্তু অনেক শব্দে আশপাশ কাঁপিয়ে সামরিক বাহিনীর লোকজন মধ্যের কোঠার দরোজা সরিয়ে টর্চ মারলে সে তার দু হাত দিয়ে চোখ ঢাকে, যদিও কোনও কিছুই বলতে পারে না। আর্মির দল তাকে পাঁজাকোলা করে ঘরের মধ্যে থেকে বাইরে বের করে নিয়ে এলে সে অনেকদিন পর অনুভব করে এই বাড়িতে এখন কোনও লোক থাকে না। বোধহয় এ বাড়ির সবাই মারা গেছে, কিংবা অন্য কোথাও চলে গেছে।
সে অনুভব করে, অল্প একজন হোক আর দুজন হোক, যে-সব লোকজন এ পাড়ায় আছে, তাদের সবাই এ বাড়ির দিকে আসতে চেয়েও আর্মির ভয়ে অনেক দূর থেকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কুয়াশা ঠিকই ধেয়ে আসছে, বাড়িটাকে ঘিরে ফেলছে, মাটির ঢেলা থেকে কুয়াশার মধ্যে বাষ্পীভূত প্রেম আর কাম এখন মেঘ জমাচ্ছে, আর একটু পরেই বৃষ্টি হবে, বৃষ্টিতে পৃথিবীটা ফরসা হয়ে যাবে, হাড়বেরুনো মানুষগুলো তাদের হাড় নিয়ে তাড়া করবে দূর-শহর থেকে গাড়িবিস্কুট নিয়ে আসা মানুষগুলোকে। আর, রফিকের অনেকদিন পর এ-ও মনে হয়, জঙ্গল থেকে রাশেদা বের হয়ে যাচ্ছে, যাওয়ার আগে তার দিকে তাকিয়ে বলছে, বাড়িত যাম, বড় ভুগ লাইগছে…।
রচনাকাল মে-ডিসেম্বর ২০০৭
রচনাকাল মে-ডিসেম্বর ২০০৭
=============================
গল্প- আলিমের নিভৃতিচর্চা by রাশিদা সুলতানা গল্প- প্রত্যাবর্তন: আমার ‘ফেরা’ নিয়ে যে কাহিনী না ..মানষ চৌঃ গল্প- 'বীচিকলায় ঢেকে যায় মুখ ও শিরোনাম' by আনোয়ার ... গল্প- 'প্রীত পরায়া' by সিউতি সবুর গল্প- 'চলিতেছে' by মাহবুব মোর্শেদ গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা গল্প- 'রূপকথা' by লুনা রুশদী সঞ্জীব চৌধুরীর কয়েকটি গল্প গল্প- 'অস্বস্তির সঙ্গে বসবাস' by ফাহমিদুল হক
bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ ইমতিয়ার শামীম
এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
লেখকঃ ইমতিয়ার শামীম
এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
No comments