গল্প- 'হাজেরার বাপের দাইক দেনা' by জিয়া হাশান
শিয়রে পাহারায় হাজেরার উপস্থিতিতে কোনো সর্তক সংকেত ছাড়াই তার বাপ মারা গেছেন। সারারাত চোখ দুটোকে এতটুকু নিদ্রা-ছুটি না দিয়ে সার্চ লাইটের মতো জ্বালিয়ে রেখেছিল হাজেরা। কিন্তু তারপরও বাপের চলে যাওয়া টের পায়নি। কারণ শেষ রাতের দিকে উপোসী চোখে তন্দ্রা এসে সহজেই আসন পাতে। চোখের পাতা পরস্পরকে চুম্বনে জড়ায়। এসময় সুযোগ-সন্ধানী জান বাপের দেহ ছেড়ে চিরদিনের জন্যে পালায়।
তন্দ্রা যখন কাটে তখন ঘরের বাইরে আলো এসে দাঁড়িয়েছে। হাজেরা বাপের গায়ে হাত ছুঁইয়ে দেখে তা বরফ ঠাণ্ডার কবলে চলে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে মা মা চিৎকারে গলা ফাটায়। হাজেরার মা চাচের বেড়ার ওপাশ থেকে ছুটে এসে সোয়ামির নিথর দেহের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েন ‘হায় আল্লা গো, তুমি কী করলা, মুই এহন হাজেরারে লইয়্যা কই যামু? তুমি মোরে গাংগে বাসাইয়্যা দিলা।’
কিছুক্ষণ আগে মুর্দা ঘর থেকে উঠানে নামানো হয়েছে। পাড়া-প্রতিবেশিরা তার চারধারে চাক বাধা। পাশের বাড়ির আলিমুদ্দি, হাজেরার বাপের জ্ঞাতি ভাই, কোলার কাম মুলতবি রেখে মুর্দার কামে লেগে পড়েছেন ‘হাজেরা! তুই তোর মায়রে সামাল দে। হ্যায় তো চোহের পানিতে গাংগ বানাইয়্যা ফালাইতাছে। মুই দেহি, দাফনের কী করা যায়। রহমইত্যারে কাপুর আনতে হাডে পাডাইছি।’
তন্দ্রা যখন কাটে তখন ঘরের বাইরে আলো এসে দাঁড়িয়েছে। হাজেরা বাপের গায়ে হাত ছুঁইয়ে দেখে তা বরফ ঠাণ্ডার কবলে চলে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে মা মা চিৎকারে গলা ফাটায়। হাজেরার মা চাচের বেড়ার ওপাশ থেকে ছুটে এসে সোয়ামির নিথর দেহের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েন ‘হায় আল্লা গো, তুমি কী করলা, মুই এহন হাজেরারে লইয়্যা কই যামু? তুমি মোরে গাংগে বাসাইয়্যা দিলা।’
কিছুক্ষণ আগে মুর্দা ঘর থেকে উঠানে নামানো হয়েছে। পাড়া-প্রতিবেশিরা তার চারধারে চাক বাধা। পাশের বাড়ির আলিমুদ্দি, হাজেরার বাপের জ্ঞাতি ভাই, কোলার কাম মুলতবি রেখে মুর্দার কামে লেগে পড়েছেন ‘হাজেরা! তুই তোর মায়রে সামাল দে। হ্যায় তো চোহের পানিতে গাংগ বানাইয়্যা ফালাইতাছে। মুই দেহি, দাফনের কী করা যায়। রহমইত্যারে কাপুর আনতে হাডে পাডাইছি।’
কিন্তু হাজেরা বাপ মানে কফিল মিয়ার কাছে পাওনা টাকার মায়া করিম শেখকে উঠানে ছুটিয়ে আনে। দু’পায়ে তার কুলায় না, তিন পায়ে, বাঁকানো লাঠির গোছায় ভর করে তিনি উঠানে পা দিয়েই হাজেরাকে খোঁজেন ‘কফিলের মাইয়্যা কই? আহা! মাইয়্যাডা এতিম অইয়্যা গ্যালো।’ করিম শেখ ফজরের নামাজের তলানী, দোয়া-দরুদ অজিফা পাঠ, তাতে শেষ চুমুক দিয়ে স্বাস্থ্যোদ্ধারে বের হন। ঢাকাবাসী বড় ছেলে ও তার বউয়ের কাছ থেকে সবক নিয়ে আসার পর এ নতুন অভ্যসে তার হাতেখড়ি হয়েছে। ছেলে-বউ প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই বাসা থেকে বের হয়। দালান-কোটার রাজ্যে ফ্রেশ বাতাসের লোভ তাদেরকে তিন কিলো দূরের পার্কে নিয়ে যায়। ‘হাউস’-এর পাল্লায় পড়ে করিম শেখও একদিন তাদের সঙ্গ নেন। পার্কের দরজায় গাড়ি থেকে নেমে সাত-সকালে মাছের পোনার মতো মানুষে গিজগিজ করা পার্ক দেখে তার চোখ ছানাবড়া। ঢাকা শহরের সব মানুষ তাহলে অসুস্থ। সুস্থ হওয়ার জন্য সকালের ঘুম হারাম করে পার্কের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। তিনি ছেলে ও তার বউয়ের পিছে পিছে পার্কের বুকে আড়ে-দিঘে বিছানো কংক্রীটের ফিতা, সিমেন্ট-বাঁধানো রাস্তায় পা দেন। কিন্তু কয়েক কদম যেতেই শ্বাস তাকে চেপে ধরে। ঘন ঘন শ্বাস ওঠে। শেষে অনভ্যসের কাছে হার মেনে কংক্রীটের চেয়ারে বসে রেস্ট নেন। আর জগিং পড়া না পারা ছাত্রের মতো ছেলে আর তার বউকে পার্কের রাস্তায় রাস্তায় ঘোরায়।
এক মহিলা করিম শেখের সামনে এসে দুটোদিন বেশি বাঁচার জন্য হাজারো রকম কসরত শুরু করে। ডানে বামে শরীর বাঁকালে তার পেন্ডুলাম-বুক দোল খায় কয়েকবার। একবার ডান পা উঁচু করে একবার বাম পা। তখন পোশাক ভেদ করে দু’পায়ের সন্ধিস্থল যেন হা হয়ে করিম শেখের দিকে তাকাতে চায়। শেষে সামনের দিকে ঝুঁকলে ঢিলেঢালা জামা-কাপড়ের ভেতর ওলান দুটো অবাধ্য হয়ে পড়ে। করিম শেখের নাক ছুঁয়ে যায়। আহা! কী সুন্দর সুবাস, নামাজ পড়তে তো সকালে উঠতেই হয়, প্রত্যেক দিন আসতে অসুবিধা কী?
বাসায় ফেরার পথে ছেলেও সায় দেয় ‘বাবা! তুমি তো বাড়িতেও সকালে হাঁটাহাঁটি করতে পারো। গ্রামে সকালে কী ফাইন ক্লীন এয়ার। তোমার হার্ট ভালো থাকবে। দ’ুমাস পরপর ঢাকায় এসে ডাক্তারের পিছে গুচ্ছের টাকা ঢালতে হবে না।’
ছেলে তার দ্বিগুণ উপরিতে সাজানো মোটা মাইনের বড় অফিসার। দুই ছেলেমেয়ের জন্য এখনই আলাদা ফ্লাট কিনে রেখেছে। এ মাসে জাপান তো আগামী মাসে লন্ডনে তার কনফারেন্স-বক্তৃতা লাইন দিয়ে আছে। তার কথা কি হেলায় ফেলানো যায়। তাই এখন ফজরের নামাজের পর গ্রামের রাস্তা করিম শেখের নিয়মিত পদচারণায় ধন্য হয়। বৃষ্টি-বাদলার দিনে অবশ্য সে সুযোগ থাকে না। রাস্তা-ঘাট সব পানি-কাঁদার দখলে চলে যায়। তাই বাড়ি থেকে ইউনিয়ন পরিষদের রাস্তা পর্যন্ত নিজের টাকায় ইট বিছিয়ে কাদা-পানির বসতি গড়ার সব সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন। বর্ষার দিনে তাতে কয়েকটা চক্কর মেরে দুধের স্বাদ তাকে ঘোলে মেটাতে হয়।
হাজেরার বাপের মৃত্যুর খবর আসে আজ প্রথম চক্করে। রহমতের মুখ থেকে। ফলে দ্বিতীয় চক্করের পাল্লায় না পড়ে হাতের বাঁকানো লাঠিটা একমাত্র সঙ্গী করে ছুটে এসেছেন। হাজেরা সামনে এলে তার মাথায় হাত বুলান করিম শেখ ‘আহা! খুব ভালা মানু আছিল তোর বাপ। ময়-মুরব্বিরে খুব মানছে। যহন যা কইছি মুক বুইয্যা হেয়া হুনছে। কোন দিন মুহের উফর কতা কয় নাই। আল্লা হেরে বেহসতো নসিব করবো।’ হাজেরাও বাপের মতো বোজামুখে মাথা নিচু করে করিম শেখের কথা হজম করে। এ সুযোগে করিম শেখের চোখ জোড়া একবার পুরো বাড়ি ঘুরে আসে। কফিল্যার কাছে পাওনা টাকাটার কী হবে? ওর বউ তো আধপাগলা। আবার পোলা তো ভাগ্যে জোটে নাই। যা বলার মেয়েটাকে বলতে হয় ‘শোন দুখ্খো পাইস না। আল্লায় তোর বাপরে ভালা করবে। তয় হুজুররা কয় দাইক-দেনা রাইখা গ্যালে গোর আজাব অয়। তোর বাপের নাহান ভালা মানসের গোর আজাব অইবো, হায়! আল্লা।’
করিম শেখের মুখের দিকে তাকায় হাজেরা। বাপে কার কাছে কী ধার-দেনা রেখে গেছে তার কিছুই তার জানা নেই ‘মুই তো কিছুই জানি না কাহা!’ করিম শেখ সঙ্গে সঙ্গে হাজেরার কথায় সায় দেন ‘তুই জানবি ক্যামনে ক’। খুইব ছবুরঅলা মানু আছিল তোর বাপ। নিজের কতা কাউরে কয় নাই। মোর কাছ থাইতা পাচশো টাহা নিছিল। কতো তকলিফ করছে কিনতুক দিয়া যাইতে পারে নাই। আহা!’ অসহায়তা হাজেরার হাত-পা গুটিয়ে নেওয়া ছাড়া তখন আর কিছু থাকে না ‘গরে তো এ্যাকটা পয়সাও নাই। এহন দিমু কোনহান থন, কাহা।’ করিম শেখ আরো এক পা আগান হাজেরার সহায়তায় ‘হেয়া কী মুই বুজি না বোজ্জো। ব্যারাম তো টাহাগুলা হগোল গিল্যা খাইছে। টাহা থাকপে কোত্থাইকা। তয় তোগো গরে দুইডা পিতলার কলসি আছে না?’
হাজেরা অবাক হয়। বাপের অসুখের ক্ষুধা মেটাতে ঘরে কাসা-পিতলের যে কয়টা বাসন-কোসন ছিল তা অনেক আগেই ফজল মহাজনের দোকানে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে। নিজেদের খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কষ্ট সীমা ছাড়ালেও কলসি দুটো মায় আগলে রেখেছে। আফালের কোণায় ছালার চটের ঘোমটায় আড়াল করা আছে। কিন্তু করিম কাহা তা দেখলেন কীভাবে? তার চোখ ঘরের আঁতিপাঁতির মধ্যে গেল কেমনে? হাজেরা এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পেলেও করিম শেখের কাছে ঠিকই আছে ‘তোর বাপে কইছিল, মাতোব্বর সাব ভাইবেন না, মোর গরে দুইডা পিতলার কলসি আছে। টাহা দিতে না পারলে হেই দুইডা দিয়া উসুল কইর্যা দিমু। হোন, মুই বারি যাইয়্যা আজিজ্জারে পাডাইয়্যা দিতাছি। অর আতে কলসি দুইডা দিয়া দিস, বোজ্জো।’
করিম শেখের কথা শেষ হতেই ভটভট গলায় একটা মটর সাইকেল উঠোনের কোণে এসে দমবন্ধ করে। তার কালে জীন পরানো পিঠ থেকে নামেন খালেক চেয়ারম্যান। করিম শেখ তার বছর ঠিকা কামলা আজিজকে তাড়াতাড়ি পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়ির পথ ধরেন। দু’বছর আগে ইলেকশনে হারার পুরোনো লজ্জাকে আবার উঁকি মারার সুযোগ না দেওয়ার জন্য চেয়ারম্যানের কাছে মুখ লুকাতে তার বাড়ি ফেরার তড়িঘড়ি ভাব হাজেরার চোখও এড়ায় না।
খালেক চেয়ারম্যান চরদখলের মামলায় হাজিরা দিতে সদরে যাচ্ছিলেন। দখলের সঙ্গে একটা খুন থাকায় ফেঁসে গেলে ফাঁসি মাফ করলেও যাবজ্জীবন তা এতটুকু করবে না। তখন জীবনভর জেলে পচতে হবে। তাই দ্বিতীয় বউয়ের নবীন অঙ্গের ওম ছেড়ে সাত-সকালেই সদরের উদ্দেশ্যে তার যাত্রা। কোর্ট বসার আগেই উকিলের সঙ্গে শলা-পরামর্শের ব্যাপার আছে। কিন্তু বাজারে উঠেই রহমতের হাতে সাদা থান দেখে জিজ্ঞেস করেন ‘মরল কেডা, কাফনের কাপুর কার লইগ্যা?’ রহমত হাজেরার বাপের কথা বলতেই চেয়ারম্যান বাকি কথাবার্তায় কোনো গোজামিল ঢোকার সুযোগ গলা টিপে বন্ধ করে দেন। থেমে যায় মটর সাইকেলের ভটভটানি। তখন স্পষ্ট করে জানতে চান, ‘তুই জানোস, কফিল কাহারে গোর দেবে কোনহানে? রহমত শোনা কথা জানায় ‘আলিম কাহায় কইল, বারির উত্তারদারে বাঁশঝাড়ের বগলে গোর দেবে। হেহানে গোর খোরতে কইল।’
এক মহিলা করিম শেখের সামনে এসে দুটোদিন বেশি বাঁচার জন্য হাজারো রকম কসরত শুরু করে। ডানে বামে শরীর বাঁকালে তার পেন্ডুলাম-বুক দোল খায় কয়েকবার। একবার ডান পা উঁচু করে একবার বাম পা। তখন পোশাক ভেদ করে দু’পায়ের সন্ধিস্থল যেন হা হয়ে করিম শেখের দিকে তাকাতে চায়। শেষে সামনের দিকে ঝুঁকলে ঢিলেঢালা জামা-কাপড়ের ভেতর ওলান দুটো অবাধ্য হয়ে পড়ে। করিম শেখের নাক ছুঁয়ে যায়। আহা! কী সুন্দর সুবাস, নামাজ পড়তে তো সকালে উঠতেই হয়, প্রত্যেক দিন আসতে অসুবিধা কী?
বাসায় ফেরার পথে ছেলেও সায় দেয় ‘বাবা! তুমি তো বাড়িতেও সকালে হাঁটাহাঁটি করতে পারো। গ্রামে সকালে কী ফাইন ক্লীন এয়ার। তোমার হার্ট ভালো থাকবে। দ’ুমাস পরপর ঢাকায় এসে ডাক্তারের পিছে গুচ্ছের টাকা ঢালতে হবে না।’
ছেলে তার দ্বিগুণ উপরিতে সাজানো মোটা মাইনের বড় অফিসার। দুই ছেলেমেয়ের জন্য এখনই আলাদা ফ্লাট কিনে রেখেছে। এ মাসে জাপান তো আগামী মাসে লন্ডনে তার কনফারেন্স-বক্তৃতা লাইন দিয়ে আছে। তার কথা কি হেলায় ফেলানো যায়। তাই এখন ফজরের নামাজের পর গ্রামের রাস্তা করিম শেখের নিয়মিত পদচারণায় ধন্য হয়। বৃষ্টি-বাদলার দিনে অবশ্য সে সুযোগ থাকে না। রাস্তা-ঘাট সব পানি-কাঁদার দখলে চলে যায়। তাই বাড়ি থেকে ইউনিয়ন পরিষদের রাস্তা পর্যন্ত নিজের টাকায় ইট বিছিয়ে কাদা-পানির বসতি গড়ার সব সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন। বর্ষার দিনে তাতে কয়েকটা চক্কর মেরে দুধের স্বাদ তাকে ঘোলে মেটাতে হয়।
হাজেরার বাপের মৃত্যুর খবর আসে আজ প্রথম চক্করে। রহমতের মুখ থেকে। ফলে দ্বিতীয় চক্করের পাল্লায় না পড়ে হাতের বাঁকানো লাঠিটা একমাত্র সঙ্গী করে ছুটে এসেছেন। হাজেরা সামনে এলে তার মাথায় হাত বুলান করিম শেখ ‘আহা! খুব ভালা মানু আছিল তোর বাপ। ময়-মুরব্বিরে খুব মানছে। যহন যা কইছি মুক বুইয্যা হেয়া হুনছে। কোন দিন মুহের উফর কতা কয় নাই। আল্লা হেরে বেহসতো নসিব করবো।’ হাজেরাও বাপের মতো বোজামুখে মাথা নিচু করে করিম শেখের কথা হজম করে। এ সুযোগে করিম শেখের চোখ জোড়া একবার পুরো বাড়ি ঘুরে আসে। কফিল্যার কাছে পাওনা টাকাটার কী হবে? ওর বউ তো আধপাগলা। আবার পোলা তো ভাগ্যে জোটে নাই। যা বলার মেয়েটাকে বলতে হয় ‘শোন দুখ্খো পাইস না। আল্লায় তোর বাপরে ভালা করবে। তয় হুজুররা কয় দাইক-দেনা রাইখা গ্যালে গোর আজাব অয়। তোর বাপের নাহান ভালা মানসের গোর আজাব অইবো, হায়! আল্লা।’
করিম শেখের মুখের দিকে তাকায় হাজেরা। বাপে কার কাছে কী ধার-দেনা রেখে গেছে তার কিছুই তার জানা নেই ‘মুই তো কিছুই জানি না কাহা!’ করিম শেখ সঙ্গে সঙ্গে হাজেরার কথায় সায় দেন ‘তুই জানবি ক্যামনে ক’। খুইব ছবুরঅলা মানু আছিল তোর বাপ। নিজের কতা কাউরে কয় নাই। মোর কাছ থাইতা পাচশো টাহা নিছিল। কতো তকলিফ করছে কিনতুক দিয়া যাইতে পারে নাই। আহা!’ অসহায়তা হাজেরার হাত-পা গুটিয়ে নেওয়া ছাড়া তখন আর কিছু থাকে না ‘গরে তো এ্যাকটা পয়সাও নাই। এহন দিমু কোনহান থন, কাহা।’ করিম শেখ আরো এক পা আগান হাজেরার সহায়তায় ‘হেয়া কী মুই বুজি না বোজ্জো। ব্যারাম তো টাহাগুলা হগোল গিল্যা খাইছে। টাহা থাকপে কোত্থাইকা। তয় তোগো গরে দুইডা পিতলার কলসি আছে না?’
হাজেরা অবাক হয়। বাপের অসুখের ক্ষুধা মেটাতে ঘরে কাসা-পিতলের যে কয়টা বাসন-কোসন ছিল তা অনেক আগেই ফজল মহাজনের দোকানে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে। নিজেদের খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কষ্ট সীমা ছাড়ালেও কলসি দুটো মায় আগলে রেখেছে। আফালের কোণায় ছালার চটের ঘোমটায় আড়াল করা আছে। কিন্তু করিম কাহা তা দেখলেন কীভাবে? তার চোখ ঘরের আঁতিপাঁতির মধ্যে গেল কেমনে? হাজেরা এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পেলেও করিম শেখের কাছে ঠিকই আছে ‘তোর বাপে কইছিল, মাতোব্বর সাব ভাইবেন না, মোর গরে দুইডা পিতলার কলসি আছে। টাহা দিতে না পারলে হেই দুইডা দিয়া উসুল কইর্যা দিমু। হোন, মুই বারি যাইয়্যা আজিজ্জারে পাডাইয়্যা দিতাছি। অর আতে কলসি দুইডা দিয়া দিস, বোজ্জো।’
করিম শেখের কথা শেষ হতেই ভটভট গলায় একটা মটর সাইকেল উঠোনের কোণে এসে দমবন্ধ করে। তার কালে জীন পরানো পিঠ থেকে নামেন খালেক চেয়ারম্যান। করিম শেখ তার বছর ঠিকা কামলা আজিজকে তাড়াতাড়ি পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়ির পথ ধরেন। দু’বছর আগে ইলেকশনে হারার পুরোনো লজ্জাকে আবার উঁকি মারার সুযোগ না দেওয়ার জন্য চেয়ারম্যানের কাছে মুখ লুকাতে তার বাড়ি ফেরার তড়িঘড়ি ভাব হাজেরার চোখও এড়ায় না।
খালেক চেয়ারম্যান চরদখলের মামলায় হাজিরা দিতে সদরে যাচ্ছিলেন। দখলের সঙ্গে একটা খুন থাকায় ফেঁসে গেলে ফাঁসি মাফ করলেও যাবজ্জীবন তা এতটুকু করবে না। তখন জীবনভর জেলে পচতে হবে। তাই দ্বিতীয় বউয়ের নবীন অঙ্গের ওম ছেড়ে সাত-সকালেই সদরের উদ্দেশ্যে তার যাত্রা। কোর্ট বসার আগেই উকিলের সঙ্গে শলা-পরামর্শের ব্যাপার আছে। কিন্তু বাজারে উঠেই রহমতের হাতে সাদা থান দেখে জিজ্ঞেস করেন ‘মরল কেডা, কাফনের কাপুর কার লইগ্যা?’ রহমত হাজেরার বাপের কথা বলতেই চেয়ারম্যান বাকি কথাবার্তায় কোনো গোজামিল ঢোকার সুযোগ গলা টিপে বন্ধ করে দেন। থেমে যায় মটর সাইকেলের ভটভটানি। তখন স্পষ্ট করে জানতে চান, ‘তুই জানোস, কফিল কাহারে গোর দেবে কোনহানে? রহমত শোনা কথা জানায় ‘আলিম কাহায় কইল, বারির উত্তারদারে বাঁশঝাড়ের বগলে গোর দেবে। হেহানে গোর খোরতে কইল।’
রহমতের কথা চেয়ারম্যানের সদরে যাওয়া মাথায় ওঠায়। মামলা ভাগ্যে যা লেখে তাই হবে। উকিলকে একটা মোবাইল করে দিলে নতুন ডেট নেবে। কিন্তু কফিল কাহারে বাড়িতে গোর দিলে আর সরানো যাবে না। তা বাড়ির মাঝখানে একটা জঞ্জাল হয়ে থাকবে। বাড়িটাকে ডেভলপ করার পথে একটা ‘আউড়্যা’ বাঁশ হয়ে দাঁড়াবে শেষে। চেয়ারম্যানের ১০০ সিসির যন্ত্রযান মুখ ঘুরিয়ে হাজেরাদের বাড়ির পথ ধরে।
বছর দুই আগে বন্যা হাজেরাদের ঘর-দুয়ার সব হাতিয়ে নেয়। ইউনিয়ন পরিষদে ত্রাণ দেওয়ার খবর পেয়ে হাজেরার বাপ লাইনে দাঁড়ান। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পিড়পিড়ে বৃষ্টির অত্যাচার সহ্যের পর তার পালা এলে চেয়ারম্যান হাত গুটিয়ে নেন ‘কাহা! এ্যাই টিন অইলো গরীব-গুরাগো লাইগ্যা। তোমারে দেই ক্যামনে কও? আর দূরের অইলেও তুমি অইলা মোগো জ্ঞাতি। এহন তোমারে টিন দিলে মাইনসে কী কইবো। তোমার গরের টিন লাগলে কাইল বেয়ানে মোগো বারিতে আইও, মুই টিনের বেবস্তা কইর্যা দিমু আনে। এহন বারি যাও।’
পরদিন সকালে হাজেরার বাপ চেয়ারম্যানের বাড়িতে গেলে মুখের ওপর সান-বাঁধানো সিঁড়ি-চেয়ারে সাজানো কাচারি ঘরে তাকে বসতে দেওয়া হয়। বাড়ির ভেতর থেকে চেয়ারম্যান এসে নিজে হাজেরার বাপকে ডেকে তার টেবিলের সামনের চেয়ারে বসান। তারপর টিনের ব্যবস্থা করেন ‘কাহা এ্যাইহানে একটা সই দাও। হেরপর টিন কেনার লাইগ্যা টাহা যা লাগে লও। টাহা লইতে না চাইলে হায়দাইর্যার আড়ত থাইকা টিন লইয়্যা যাও, মুই কইয়্যা দিমু। দাও সই দাও। এহানে বেশি কিছু লিহি নাই। দ্যাহো, লিকছি, তিন খন্দের মইদ্যে ফেরত দেওনের কতা। হেরপর বারিগরের কতা আচে।’
কফিল কাহা বেঁচে থাকতেই দুই খন্দ পার হয়ে গেছে। আর এক খন্দ পর বাড়িটা হাতে চলে আসবে। ধানের কল বসানোর জন্য একেবারে পারফেক্ট জায়গা হবে তখন। সামনে ইউনিয়ন পরিষদের রাস্তা, হোকনা কাঁচা, ভ্যান-রিক্সা চলে নিয়মিত। চেয়ারম্যান থাকতে থাকতে ইটের বাঁধাই করে দিতে হবে। আবার পেছনে খাল। চর তার দুইপার দখলে নিলেও এখনো গয়নার নৌকা ট্রলার চলে বারোমাস। যার ইচ্ছা ভ্যানের পিঠে চাপিয়ে ধান নিয়ে আসবে, যার ইচ্ছা নৌকা-ট্রলারের পেট পোয়াতি বানিয়ে আনবে। ধানে ধানে সয়লাব হয়ে যাবে পুরো কলবাড়ি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কল বস্তা বস্তা ধান গিলবে আর চাল ওগরাবে ঝুরঝুর করে। তারপরও তার খিদা মেটবে না। বড় মুখঅলা বড় পেটঅলা কলের ব্যবস্থা করতে হবে। দিনমান এতোসব তদারকি করা তো নিজের সম্ভব হবে না। আটটা ওয়ার্ড নিয়ে পেট মোটা ইউনিয়ন, একা একা সামাল দেওয়া চাট্টিখানি কথা। তারপর আবার কলে বসার সময় কোথায়। একজন ম্যানেজার পুষতে হবে। রাতদিন পাহারা দেবে, টালি খাতা আগলাবে। ব্যাটা হয়তো দু’চার টাকা হাতসাফাই করবে। করুক, কতো আর নেবে। তারপরও যা থাকবে বাড়ি ফেরার পথে প্রতিদিন তার হিসেব-নিকেশ বুঝে নিলেই চলবে। কিন্তু সব কিছুর আগে কফিল কাহার বাড়াবাড়ি বন্ধ করতে হবে। দুবছর ধরে এতোগুলো টাকা হজম করে আছে। মরার পর এখনো যদি চিরদিনের জন্য বাড়িতে আসন গাড়ে, যুগ যুগ ধরে পৈত্রিক ভিটার মায়া না ছাড়ে, তাহলে তো টাকাও যাবে বাড়িও যাবে। ভাবতে ভাবতে চেয়ারম্যানের পথ ফুরিয়ে আসে। আম ও ছালা উভয়ই হারানোর লকলকে আশঙ্কায় হাজেরাদের উঠানে নেমেই তিনি আলিমুদ্দিরে খোঁজেন।
মুর্দার গোসল আধাবুধি রেখে আলিমুদ্দি ছুটে আসে ‘আছ্ছালামু আল্কাুম, চেহারমান সাব।’ সালামের উত্তরের পিছে না ছুটে খালেক চেয়ারম্যান মুর্দার বাড়িতে স্বর উঁচু না করার রেওয়াজটুকু মগজে থিতু থাকায় নিচু স্বরে আলিমুদ্দির ওপর ধমকে ওঠেন, ‘তোমরা কী আক্কেল ধুইয়্যা খাইছো অ্যাঁ, কাহায় মরছে কহন, মোরে একটা খবর দিলা না। বাজারে রহমইত্যা কইল, সদরে মামলায় যাওন থুইয়্যা ছুইট্যা আইলাম। হাজেরা কই, হাজেরারে বোলাও।’
হাজেরা সামনে এসে দাঁড়ালে চেয়ারম্যানের মুখে আশ্বাসের ধারা বয়, ‘ভাবিস না, মুই আইয়্যা পরছি। আহা! কী শান্তো আছিল কাহা, রাগ-ঝালের বালাই আছিল না মোডে। পরিষদের দরজায় দেকছি খাড়াইয়্যা রইছেন, মুই কতা কওনের সোময় পাই নাই। পরদিন দেহি আবার খাড়াইছেন। মুহে এ্যাকটু রাগ নাই।’ আলিমুদ্দির দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন, ‘কাহায় আছিল গাজীগুষ্টির মইদ্যে সেরা মানু। হ্যারে বাঁশবোনের তলে গোর দিলে হ্যার ইজ্জত থাহে কও। হ্যারে গোর দিমু গাজীগুষ্টির গোরসতানে। বাঁশঝারে গোর খোরতে মানা হরো।’
চেয়ারম্যান আদি গাজীবাড়ির লাগোয়া মজগুনি কবরখানার দিকে ছোটেন। গোরের ব্যবস্থা যত তাড়াতাড়ি করা যায় তত ভালো। কে আবার কোন ফ্যাকড়া খাড়া করে, গ্রামে তো হালি-হালি আবজা-গোবজা মাতুব্বার ঘুরে বেড়ায়। করিম শেখরে দেখলাম হাজেরার পিঠেপিঠে ঘুরঘুর করছে। কখন কোন কান ভাঙ্গানি দেয় বলা যায় না। ইলেকশনে নাস্তানাবুদ হয়ে এখন পাছদুয়ারে পাছদুয়ারে ঘাপটি মেরে থাকে। চান্স পেলেই ল্যাং মারার তালে আছে।
হাজেরা আবার বাড়ির ভেতরে ঢোকে। বার্ধক্য রোগের সূক্ষ্মশলায় বিদ্ধ হয়ে হাজেরার বাপ বেশ কিছুদিন আগে বিছানা নিয়েছিলেন। জীবন-মৃত্যুর দোলাচল চলেছে তখন, আজ যায় কাল যায় করে করগোনার শেষ দিনও পাড়ি দিয়েছিল। ফলে হাজেরার শোক-কান্না পানসে হতে হতে আমানিতে এসে ঠেকেছে। তাও সকালে মা মা চিৎকারে তার পাতে তুলে দেয়। তাই শোক-তাপে কাতর চাচী-ফুফুদের মুখে মুখে ফেরে, ‘দ্যাখছো! কী রহম শকতো ম্ইায়্যা, বাপ চইল্যা গ্যালো হ্যার পরও চোহে এ্যাক ফোডা পানি নাই।’
কিন্তু মার কান্নাকাটিতে ভাটির কোনো লক্ষণ নাই। একটানা গুনগুনের স্রোত চলছে তো চলছেই। বিছানা নেওয়ার পর হাজেরার মা-ই সোয়ামির শিয়রে থাকতেন। অনেকদিন ধরে ঘুমকে ফাঁকি দেওয়ায় গতরাতে সে ঝাপটে ধরে। চোখ ভেঙে ঘুম আসে। মেয়েকে ডেকে বলেন, ‘আইজ রাইতটা তুই তোর বাজানের লগে থাক। মোর শরীলডা ভালো ঠ্যাকতাছে না।’ মেয়েকে সোয়মির কাছে রেখে তিনি পাশের ঘরে হোগলাপাতার চাটাইয়ে শরীর এলিয়ে দিয়েছিলেন। সোয়মির চলে যাওয়ার সময় তার কাছে ছিলেন না। তাই কিছুক্ষণ পরপর তার বিলাপের পদ বদল হয়, ‘যাওনের সোমায় মুহে এ্যাক ফোডা পানি দিতে পারলাম না। মুই ক্যান মরনের গুম গুমাইতে গ্যালাম। হায় আল্লা! মোরে রহম হরো।’
এখনো তার বিলাপ চলছে। হাজেরা দু’একবার তা বন্ধ করার চেষ্টা করেছে, ‘মা তুমি কী শুরু হরলা? কানলে কি বাজান ফিইরা আইবো? থামো, কানলে বাজানের রুহু কষটো পাইবে।’ হাজেরার কথায় বিলাপ কিছু সময়ের জন্য ফোতফোত কিংবা গুনগুনে রূপান্তরিত হলেও এখন আবার যে-ইকে সে-ই। ঘরের কোণে বসে ঘোমটায় নাক-চোখ ঢেকে বিলাপ করে চলছেন।
তার কাছে বসে দুটো সান্ত্বনার কথা বলারও কেই নেই। সে দায়িত্ব হাজেরা নিজের কাছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আগায়। কিন্তু উঠান থেকে ভেতরে পা দিয়ে এনজিও আপাকে ওঁৎ পেতে থাকা দেখে মনে শঙ্কা ফাল দেয়। মহিলা ঝোলা সঙ্গী করে সপ্তাহে সপ্তাহে আসেন। তার ঝোলায় পোড়া থাকে সুন্দর সুন্দর কথা, আয়-উন্নতির ফুলঝুড়ি, একটা রুইলে দুইটা গজাবে। কিন্তু কিস্তিতে মাফ নাই। বাজান কোলায় থাকলে কিংবা দিতে দেরি হলে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষার পর কিস্তি নিয়ে তারপর বাড়ি ছাড়েন। আজ আবার কেন এসেছেন। বাজান বিছানা নেওয়ার পর কিস্তি দেওয়া হয় নাই। অনেকগুলো বকেয়ার খাতায় তোলা। আজ কি সবগুলো একত্রে নিতে এসেছেন? বাজানকে গোর দেওয়ার আগে তার সব ধার দেনা বকেয়া শোধ করতে হবে? হাজেরা এনজিও আপাকে না দেখার ভানের আশ্রয়ে ঘরে ঢোকার জন্য পা বাড়ায়। কিন্তু আপা এগিয়ে এসে হাজেরাকেই পাকড়াও করেন।
বছর দুই আগে বন্যা হাজেরাদের ঘর-দুয়ার সব হাতিয়ে নেয়। ইউনিয়ন পরিষদে ত্রাণ দেওয়ার খবর পেয়ে হাজেরার বাপ লাইনে দাঁড়ান। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পিড়পিড়ে বৃষ্টির অত্যাচার সহ্যের পর তার পালা এলে চেয়ারম্যান হাত গুটিয়ে নেন ‘কাহা! এ্যাই টিন অইলো গরীব-গুরাগো লাইগ্যা। তোমারে দেই ক্যামনে কও? আর দূরের অইলেও তুমি অইলা মোগো জ্ঞাতি। এহন তোমারে টিন দিলে মাইনসে কী কইবো। তোমার গরের টিন লাগলে কাইল বেয়ানে মোগো বারিতে আইও, মুই টিনের বেবস্তা কইর্যা দিমু আনে। এহন বারি যাও।’
পরদিন সকালে হাজেরার বাপ চেয়ারম্যানের বাড়িতে গেলে মুখের ওপর সান-বাঁধানো সিঁড়ি-চেয়ারে সাজানো কাচারি ঘরে তাকে বসতে দেওয়া হয়। বাড়ির ভেতর থেকে চেয়ারম্যান এসে নিজে হাজেরার বাপকে ডেকে তার টেবিলের সামনের চেয়ারে বসান। তারপর টিনের ব্যবস্থা করেন ‘কাহা এ্যাইহানে একটা সই দাও। হেরপর টিন কেনার লাইগ্যা টাহা যা লাগে লও। টাহা লইতে না চাইলে হায়দাইর্যার আড়ত থাইকা টিন লইয়্যা যাও, মুই কইয়্যা দিমু। দাও সই দাও। এহানে বেশি কিছু লিহি নাই। দ্যাহো, লিকছি, তিন খন্দের মইদ্যে ফেরত দেওনের কতা। হেরপর বারিগরের কতা আচে।’
কফিল কাহা বেঁচে থাকতেই দুই খন্দ পার হয়ে গেছে। আর এক খন্দ পর বাড়িটা হাতে চলে আসবে। ধানের কল বসানোর জন্য একেবারে পারফেক্ট জায়গা হবে তখন। সামনে ইউনিয়ন পরিষদের রাস্তা, হোকনা কাঁচা, ভ্যান-রিক্সা চলে নিয়মিত। চেয়ারম্যান থাকতে থাকতে ইটের বাঁধাই করে দিতে হবে। আবার পেছনে খাল। চর তার দুইপার দখলে নিলেও এখনো গয়নার নৌকা ট্রলার চলে বারোমাস। যার ইচ্ছা ভ্যানের পিঠে চাপিয়ে ধান নিয়ে আসবে, যার ইচ্ছা নৌকা-ট্রলারের পেট পোয়াতি বানিয়ে আনবে। ধানে ধানে সয়লাব হয়ে যাবে পুরো কলবাড়ি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কল বস্তা বস্তা ধান গিলবে আর চাল ওগরাবে ঝুরঝুর করে। তারপরও তার খিদা মেটবে না। বড় মুখঅলা বড় পেটঅলা কলের ব্যবস্থা করতে হবে। দিনমান এতোসব তদারকি করা তো নিজের সম্ভব হবে না। আটটা ওয়ার্ড নিয়ে পেট মোটা ইউনিয়ন, একা একা সামাল দেওয়া চাট্টিখানি কথা। তারপর আবার কলে বসার সময় কোথায়। একজন ম্যানেজার পুষতে হবে। রাতদিন পাহারা দেবে, টালি খাতা আগলাবে। ব্যাটা হয়তো দু’চার টাকা হাতসাফাই করবে। করুক, কতো আর নেবে। তারপরও যা থাকবে বাড়ি ফেরার পথে প্রতিদিন তার হিসেব-নিকেশ বুঝে নিলেই চলবে। কিন্তু সব কিছুর আগে কফিল কাহার বাড়াবাড়ি বন্ধ করতে হবে। দুবছর ধরে এতোগুলো টাকা হজম করে আছে। মরার পর এখনো যদি চিরদিনের জন্য বাড়িতে আসন গাড়ে, যুগ যুগ ধরে পৈত্রিক ভিটার মায়া না ছাড়ে, তাহলে তো টাকাও যাবে বাড়িও যাবে। ভাবতে ভাবতে চেয়ারম্যানের পথ ফুরিয়ে আসে। আম ও ছালা উভয়ই হারানোর লকলকে আশঙ্কায় হাজেরাদের উঠানে নেমেই তিনি আলিমুদ্দিরে খোঁজেন।
মুর্দার গোসল আধাবুধি রেখে আলিমুদ্দি ছুটে আসে ‘আছ্ছালামু আল্কাুম, চেহারমান সাব।’ সালামের উত্তরের পিছে না ছুটে খালেক চেয়ারম্যান মুর্দার বাড়িতে স্বর উঁচু না করার রেওয়াজটুকু মগজে থিতু থাকায় নিচু স্বরে আলিমুদ্দির ওপর ধমকে ওঠেন, ‘তোমরা কী আক্কেল ধুইয়্যা খাইছো অ্যাঁ, কাহায় মরছে কহন, মোরে একটা খবর দিলা না। বাজারে রহমইত্যা কইল, সদরে মামলায় যাওন থুইয়্যা ছুইট্যা আইলাম। হাজেরা কই, হাজেরারে বোলাও।’
হাজেরা সামনে এসে দাঁড়ালে চেয়ারম্যানের মুখে আশ্বাসের ধারা বয়, ‘ভাবিস না, মুই আইয়্যা পরছি। আহা! কী শান্তো আছিল কাহা, রাগ-ঝালের বালাই আছিল না মোডে। পরিষদের দরজায় দেকছি খাড়াইয়্যা রইছেন, মুই কতা কওনের সোময় পাই নাই। পরদিন দেহি আবার খাড়াইছেন। মুহে এ্যাকটু রাগ নাই।’ আলিমুদ্দির দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন, ‘কাহায় আছিল গাজীগুষ্টির মইদ্যে সেরা মানু। হ্যারে বাঁশবোনের তলে গোর দিলে হ্যার ইজ্জত থাহে কও। হ্যারে গোর দিমু গাজীগুষ্টির গোরসতানে। বাঁশঝারে গোর খোরতে মানা হরো।’
চেয়ারম্যান আদি গাজীবাড়ির লাগোয়া মজগুনি কবরখানার দিকে ছোটেন। গোরের ব্যবস্থা যত তাড়াতাড়ি করা যায় তত ভালো। কে আবার কোন ফ্যাকড়া খাড়া করে, গ্রামে তো হালি-হালি আবজা-গোবজা মাতুব্বার ঘুরে বেড়ায়। করিম শেখরে দেখলাম হাজেরার পিঠেপিঠে ঘুরঘুর করছে। কখন কোন কান ভাঙ্গানি দেয় বলা যায় না। ইলেকশনে নাস্তানাবুদ হয়ে এখন পাছদুয়ারে পাছদুয়ারে ঘাপটি মেরে থাকে। চান্স পেলেই ল্যাং মারার তালে আছে।
হাজেরা আবার বাড়ির ভেতরে ঢোকে। বার্ধক্য রোগের সূক্ষ্মশলায় বিদ্ধ হয়ে হাজেরার বাপ বেশ কিছুদিন আগে বিছানা নিয়েছিলেন। জীবন-মৃত্যুর দোলাচল চলেছে তখন, আজ যায় কাল যায় করে করগোনার শেষ দিনও পাড়ি দিয়েছিল। ফলে হাজেরার শোক-কান্না পানসে হতে হতে আমানিতে এসে ঠেকেছে। তাও সকালে মা মা চিৎকারে তার পাতে তুলে দেয়। তাই শোক-তাপে কাতর চাচী-ফুফুদের মুখে মুখে ফেরে, ‘দ্যাখছো! কী রহম শকতো ম্ইায়্যা, বাপ চইল্যা গ্যালো হ্যার পরও চোহে এ্যাক ফোডা পানি নাই।’
কিন্তু মার কান্নাকাটিতে ভাটির কোনো লক্ষণ নাই। একটানা গুনগুনের স্রোত চলছে তো চলছেই। বিছানা নেওয়ার পর হাজেরার মা-ই সোয়ামির শিয়রে থাকতেন। অনেকদিন ধরে ঘুমকে ফাঁকি দেওয়ায় গতরাতে সে ঝাপটে ধরে। চোখ ভেঙে ঘুম আসে। মেয়েকে ডেকে বলেন, ‘আইজ রাইতটা তুই তোর বাজানের লগে থাক। মোর শরীলডা ভালো ঠ্যাকতাছে না।’ মেয়েকে সোয়মির কাছে রেখে তিনি পাশের ঘরে হোগলাপাতার চাটাইয়ে শরীর এলিয়ে দিয়েছিলেন। সোয়মির চলে যাওয়ার সময় তার কাছে ছিলেন না। তাই কিছুক্ষণ পরপর তার বিলাপের পদ বদল হয়, ‘যাওনের সোমায় মুহে এ্যাক ফোডা পানি দিতে পারলাম না। মুই ক্যান মরনের গুম গুমাইতে গ্যালাম। হায় আল্লা! মোরে রহম হরো।’
এখনো তার বিলাপ চলছে। হাজেরা দু’একবার তা বন্ধ করার চেষ্টা করেছে, ‘মা তুমি কী শুরু হরলা? কানলে কি বাজান ফিইরা আইবো? থামো, কানলে বাজানের রুহু কষটো পাইবে।’ হাজেরার কথায় বিলাপ কিছু সময়ের জন্য ফোতফোত কিংবা গুনগুনে রূপান্তরিত হলেও এখন আবার যে-ইকে সে-ই। ঘরের কোণে বসে ঘোমটায় নাক-চোখ ঢেকে বিলাপ করে চলছেন।
তার কাছে বসে দুটো সান্ত্বনার কথা বলারও কেই নেই। সে দায়িত্ব হাজেরা নিজের কাছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আগায়। কিন্তু উঠান থেকে ভেতরে পা দিয়ে এনজিও আপাকে ওঁৎ পেতে থাকা দেখে মনে শঙ্কা ফাল দেয়। মহিলা ঝোলা সঙ্গী করে সপ্তাহে সপ্তাহে আসেন। তার ঝোলায় পোড়া থাকে সুন্দর সুন্দর কথা, আয়-উন্নতির ফুলঝুড়ি, একটা রুইলে দুইটা গজাবে। কিন্তু কিস্তিতে মাফ নাই। বাজান কোলায় থাকলে কিংবা দিতে দেরি হলে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষার পর কিস্তি নিয়ে তারপর বাড়ি ছাড়েন। আজ আবার কেন এসেছেন। বাজান বিছানা নেওয়ার পর কিস্তি দেওয়া হয় নাই। অনেকগুলো বকেয়ার খাতায় তোলা। আজ কি সবগুলো একত্রে নিতে এসেছেন? বাজানকে গোর দেওয়ার আগে তার সব ধার দেনা বকেয়া শোধ করতে হবে? হাজেরা এনজিও আপাকে না দেখার ভানের আশ্রয়ে ঘরে ঢোকার জন্য পা বাড়ায়। কিন্তু আপা এগিয়ে এসে হাজেরাকেই পাকড়াও করেন।
এসডব্লিউ সোসাইটির প্রোগ্রাম অর্গানাইজার সাদিয়া অনেকক্ষণ আগেই এসেছেন। শোকের বাড়ি, তার মতিগতির সঙ্গে তাল রেখে কোন পদ্ধতিতে কথা বলবেন তার কোন ট্রেনিং তার নেই। মৃত্যুসংবাদ শোনার পর তাই ম্যানেজার ভাইকে সঙ্গী করতে চেয়েছিলেন। ম্যানেজার ভাই ফাইল গোছাতে গোছাতে খ্যাক খ্যাক করে ওঠেন, ‘এ্যাইটুকু সামলাতে পারবেন না, আবার প্রোমোশন চাইবেন। যান একাই সামলে আসেন। আমার যাওয়ার সময় হবে না।’ তবে প্রতি সপ্তাহে আসেন টাকা নিতে, তখন শুকনো মাটি কোপানোর মতো কিস্তি আদায়ের কঠিন কাজটি করতে হয়। আজ তার বালাই নেই। এতটুকু ভার লাঘবের ওপর ভরসা করে তার একা একাই আসা।
পলাশপুর বাজারের ডান হাতায় দারিদ্র হটিয়ে সোনার চাদরে দেশ মোড়ার শ্লোগানে শ্লোগানে মুখে ফেনা তোলা এসডব্লিউ সোসাইটির শাখা অফিস। দেড় কিলো পথ হেঁটে তাতে ঢুকতেই কফিল মিয়ার মৃত্যু সংবাদ সাদিয়ার সঙ্গী হয়। সঙ্গে সঙ্গে কালেকশন, রিপোর্ট তৈরি, বিল-ভাউচারের কাজ শিকায় তুলে রেখে কফিল মিয়ার পাসবইয়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েন। শুরু হয় আদায় কিস্তি, বাকি কিস্তি ও সঞ্চয়ের সঙ্গে বোঝাপড়া। সাত সকালেও সাদিয়ার কপালে ঘাম দানা বাঁধে। কফিল মিয়া তার মেম্বর, তার রেখে যাওয়া এতোগুলো কিস্তি আদায় হবে কীভাবে? মর্টগেজের বালাই তো নেই-ই, কোন ছেলেও নেই, যার ঘাড় ধরা যাবে। ভুই-কোলা যা আছে তা দিয়ে কিস্তি দেবে না আস্তো দুটো মুখ ভরাবে। অফিস তো তখন চোখ কান বুজে সাদিয়ার বেতনের দিকে হাত বাড়াবে। দরকার হলে পুরো মাসেরটাও হাতের মুঠোয় পুরে নিতে এতটুকু কার্পণ্য করবে না। ঘর-সংসার রেখে চাকরী করার সুফল নির্ঘাত পটল তুলবে।
যোগ-বিয়োগের কসরত শেষ হলে সাদিয়ার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। কফিল মিয়া পুরনো মেম্বর, তার সঞ্চয় সপ্তাহে সপ্তাহে একটু একটু করে মোটা হতে হতে বাকি-বকেয়া সবাইকে হারিয়ে দিয়েছে। ম্যানেজারের কাছে হিসাব দাখিল করেন ‘বকেয়া কিস্তিগুলো অ্যাডজাস্ট করার পরও সঞ্চয় কিছু থাকবে।’ ম্যানেজার হিসাবটার নাড়ী-নক্ষত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন, ‘বকেয়া কিস্তিগুলো অ্যাডজাস্ট করার পর সঞ্চয়ের যে টাকা আছে তা প্রোফিট ফান্ডে তুলে দেন। আর নমিনির ফরমটা নিয়ে যান। একটা সই নিয়ে আসুন। শোক-টোকের মইদ্যে কিস্তি মাফের কথা বলে সইটা নিয়ে আসবেন। যান তাড়াতাড়ি যান। অফিসে বসে তা দিলে আপনার বেতন থেকে কিস্তি কাটা শুরু হবে।’
এখানে এসেই তাই সাদিয়া হাজেরাকে খোঁজেন। কফিল মিয়ার বউটা তো ঘরের মধ্যে গুনগুনিয়ে মরছে। লোকে বলে আধপাগলা গোছের। কিস্তি আদায় করতে এসে সাদিয়া নিজেও দেখেছে। দুপুরে একথাল শাক-ভাত গেলার পর একটা চক্কর দিয়ে এসেই ভুলে যায়। আবার খাওয়ার জন্য হাজেরার কাছে পীড়াপীড়ি করে, ‘হাজু, দুফুরের ভাত কই, ভাত দে খিদায় প্যাট জ্বইল্যা যাইতাছে।’ কিন্তু এখন দেখো সোয়ামীর জন্য শোকগাঁথায় তার তাল-লয়ে কোনো ভুল নাই। মেয়ে হাজেরাটা মায়ের একেবারে ওপিঠ। সাংঘাতিক টাডি। খাওয়া না-খাওয়ার অত্যাচার সত্ত্বেও মুখের লগইতটা ধরে রেখেছে, কালোর দিকে কান্নি খাওয়া শ্যামল দেহ, তবে তার আটোসাটো বাঁধন পুরুষদের মাথা খারাপ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু বিয়ের নাম নাই, চার হাত পায়ে বাবার সংসার সামলাতে সামলাতে বিয়ের কথা ভুলেই গেছে। নাকি একমাত্র মেয়ে বলে বাবা হাতে তুলে বিদায় করতে পারছে না। নিজের শেষ সম্বল সঞ্চয়ের নমিনি করে রেখেছেন মেয়েকে। সাদিয়া তাই ভেতর বাড়ির এককোণে দাঁড়িয়ে হাজেরার জন্য ওঁৎ পেতে ছিল। উঠান থেকে হাজেরা ভেতরে পা দিতেই সাদিয়া এগিয়ে গিয়ে সান্ত্বনা ছাড়ে ‘আহা! তোমার বাজান খুব হিসাবি মানুষ আছিলেন। ব্যারামে পড়ার আগে এ্যাকটা কিস্তিও বাদ দ্যান নাই। হের বকেয়া কিস্তিগুলা আর দিতে অইবো না। তুমি এহানে এ্যাকটা সই দিয়া দ্যাও, তা অইলেই অইবো।’
এনজিও স্কুলে দুই বছর আসা-যাওয়ার সুফলে টিপসইয়ের শরনাপন্ন না হয়ে নিজের নাম সই দিয়ে বাপের ধার-দেনা-বকেয়ার ভার থেকে মুক্ত হয় হাজেরা। তারপর মায়ের কাছে গিয়ে বসে। সহজেই তখন তার ইনানো বিনানো কান্না মেয়ের ভেতর বংশ বিস্তার করে। তবে তা শব্দ তুলতে পারে না বরং অশ্র“র ধারা পর্যন্ত আগায়। কারণ বরফজমা শোক-কান্নাও সুযোগ পেয়ে গলে গলে স্রোত বইয়ে দেয়।
মুর্দার গোসল শেষ, এখন জানাজার পালা। কিন্তু আলফি হুজুর বাগড়া বাঁধিয়েছেন। আলিমুদ্দি উঠান থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন ‘হাজু! হোন, আলফি হুজুর জানাজা পড়াইতে চায় না। হাজেরা বিস্ময়ে ফেটে পড়ে, ‘ক্যান পড়াইবো না? বাজানে তো জুমাবারে মজজিদে গেছে। রোজার সোময় রোজা রাখছে। বাজানে তো হুজুরের লগে কহনো বেয়াদপি করে নাই। তয় ক্যান জানাজা পড়াইবো না?’ আলফি হুজুর জাদরেল আলেম। আমল-আখলাকে ছিঁটেফোটা কালিমা তিনি সহ্য করেন না। আলিমুদ্দি তার ফিরিস্তি দেন, ‘মুই গেছিলাম হেরে বোলইতে। হেয় কয়, কফিল মিয়া ভালা মানুষ আছিল, তয় হের আওলাদ-ফরজন্দ দেহি পরদা করে না। রাস্তা-ঘাডে ঘুইরা বেরায়। হের আওলাদের তোবা করতে অইবে। তোবা হইর্যা হের দেল ছাপ করতে অইব। হেরপর জানাজ দিলে মুরদার রহম অইব, গোরে আরাম পাইবে।’
হাজেরা বেঁকে বসে ‘হেয় না আইলে গেরামে আর মুন্সি নাই? হাতেম মুন্সিরে বোলাও।’
আলিমুদ্দি তার ভাতিজিকে বোঝান, ‘আলফি হুজুর মস্তো আলেম মানু। জীনগো লগে হের দেহা অয়। হেয় এ্যাকটু দোয়া কইর্যা দিলে কফিল কাহায় গোরে শান্তি পাইবে। তুই হুজুরের বারি যা, তোবা কইর্যা হেরে বোলাইয়্যা আন। হের কতা মাইন্য করিস, বেয়াদপি করিস না আবার। একটু পাক-ছাপ অইয়্যা যা। মুই গোর খোরার কদ্দুর অইলো দেইখা আহি।’
যোগ-বিয়োগের কসরত শেষ হলে সাদিয়ার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। কফিল মিয়া পুরনো মেম্বর, তার সঞ্চয় সপ্তাহে সপ্তাহে একটু একটু করে মোটা হতে হতে বাকি-বকেয়া সবাইকে হারিয়ে দিয়েছে। ম্যানেজারের কাছে হিসাব দাখিল করেন ‘বকেয়া কিস্তিগুলো অ্যাডজাস্ট করার পরও সঞ্চয় কিছু থাকবে।’ ম্যানেজার হিসাবটার নাড়ী-নক্ষত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন, ‘বকেয়া কিস্তিগুলো অ্যাডজাস্ট করার পর সঞ্চয়ের যে টাকা আছে তা প্রোফিট ফান্ডে তুলে দেন। আর নমিনির ফরমটা নিয়ে যান। একটা সই নিয়ে আসুন। শোক-টোকের মইদ্যে কিস্তি মাফের কথা বলে সইটা নিয়ে আসবেন। যান তাড়াতাড়ি যান। অফিসে বসে তা দিলে আপনার বেতন থেকে কিস্তি কাটা শুরু হবে।’
এখানে এসেই তাই সাদিয়া হাজেরাকে খোঁজেন। কফিল মিয়ার বউটা তো ঘরের মধ্যে গুনগুনিয়ে মরছে। লোকে বলে আধপাগলা গোছের। কিস্তি আদায় করতে এসে সাদিয়া নিজেও দেখেছে। দুপুরে একথাল শাক-ভাত গেলার পর একটা চক্কর দিয়ে এসেই ভুলে যায়। আবার খাওয়ার জন্য হাজেরার কাছে পীড়াপীড়ি করে, ‘হাজু, দুফুরের ভাত কই, ভাত দে খিদায় প্যাট জ্বইল্যা যাইতাছে।’ কিন্তু এখন দেখো সোয়ামীর জন্য শোকগাঁথায় তার তাল-লয়ে কোনো ভুল নাই। মেয়ে হাজেরাটা মায়ের একেবারে ওপিঠ। সাংঘাতিক টাডি। খাওয়া না-খাওয়ার অত্যাচার সত্ত্বেও মুখের লগইতটা ধরে রেখেছে, কালোর দিকে কান্নি খাওয়া শ্যামল দেহ, তবে তার আটোসাটো বাঁধন পুরুষদের মাথা খারাপ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু বিয়ের নাম নাই, চার হাত পায়ে বাবার সংসার সামলাতে সামলাতে বিয়ের কথা ভুলেই গেছে। নাকি একমাত্র মেয়ে বলে বাবা হাতে তুলে বিদায় করতে পারছে না। নিজের শেষ সম্বল সঞ্চয়ের নমিনি করে রেখেছেন মেয়েকে। সাদিয়া তাই ভেতর বাড়ির এককোণে দাঁড়িয়ে হাজেরার জন্য ওঁৎ পেতে ছিল। উঠান থেকে হাজেরা ভেতরে পা দিতেই সাদিয়া এগিয়ে গিয়ে সান্ত্বনা ছাড়ে ‘আহা! তোমার বাজান খুব হিসাবি মানুষ আছিলেন। ব্যারামে পড়ার আগে এ্যাকটা কিস্তিও বাদ দ্যান নাই। হের বকেয়া কিস্তিগুলা আর দিতে অইবো না। তুমি এহানে এ্যাকটা সই দিয়া দ্যাও, তা অইলেই অইবো।’
এনজিও স্কুলে দুই বছর আসা-যাওয়ার সুফলে টিপসইয়ের শরনাপন্ন না হয়ে নিজের নাম সই দিয়ে বাপের ধার-দেনা-বকেয়ার ভার থেকে মুক্ত হয় হাজেরা। তারপর মায়ের কাছে গিয়ে বসে। সহজেই তখন তার ইনানো বিনানো কান্না মেয়ের ভেতর বংশ বিস্তার করে। তবে তা শব্দ তুলতে পারে না বরং অশ্র“র ধারা পর্যন্ত আগায়। কারণ বরফজমা শোক-কান্নাও সুযোগ পেয়ে গলে গলে স্রোত বইয়ে দেয়।
মুর্দার গোসল শেষ, এখন জানাজার পালা। কিন্তু আলফি হুজুর বাগড়া বাঁধিয়েছেন। আলিমুদ্দি উঠান থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন ‘হাজু! হোন, আলফি হুজুর জানাজা পড়াইতে চায় না। হাজেরা বিস্ময়ে ফেটে পড়ে, ‘ক্যান পড়াইবো না? বাজানে তো জুমাবারে মজজিদে গেছে। রোজার সোময় রোজা রাখছে। বাজানে তো হুজুরের লগে কহনো বেয়াদপি করে নাই। তয় ক্যান জানাজা পড়াইবো না?’ আলফি হুজুর জাদরেল আলেম। আমল-আখলাকে ছিঁটেফোটা কালিমা তিনি সহ্য করেন না। আলিমুদ্দি তার ফিরিস্তি দেন, ‘মুই গেছিলাম হেরে বোলইতে। হেয় কয়, কফিল মিয়া ভালা মানুষ আছিল, তয় হের আওলাদ-ফরজন্দ দেহি পরদা করে না। রাস্তা-ঘাডে ঘুইরা বেরায়। হের আওলাদের তোবা করতে অইবে। তোবা হইর্যা হের দেল ছাপ করতে অইব। হেরপর জানাজ দিলে মুরদার রহম অইব, গোরে আরাম পাইবে।’
হাজেরা বেঁকে বসে ‘হেয় না আইলে গেরামে আর মুন্সি নাই? হাতেম মুন্সিরে বোলাও।’
আলিমুদ্দি তার ভাতিজিকে বোঝান, ‘আলফি হুজুর মস্তো আলেম মানু। জীনগো লগে হের দেহা অয়। হেয় এ্যাকটু দোয়া কইর্যা দিলে কফিল কাহায় গোরে শান্তি পাইবে। তুই হুজুরের বারি যা, তোবা কইর্যা হেরে বোলাইয়্যা আন। হের কতা মাইন্য করিস, বেয়াদপি করিস না আবার। একটু পাক-ছাপ অইয়্যা যা। মুই গোর খোরার কদ্দুর অইলো দেইখা আহি।’
হাজেরা তোলা শাড়ি নামিয়ে গায়ে জড়ায়, পাছদুয়ারের পুকুরে অজু দিয়ে আলফি হুজুরের বাড়ির পথ ধরে। বাজান সারা জীবনে কত না কষ্ট করছে। নিজের হাতে হাল-হালুডি করে সংসার চালিয়েছে। কার্তিক মাসের অভাবের কালে একবেলা খাইছে তো আরেক বেলা জোটে নাই। তারপর বন্যা ক্ষরা তো বছর বছর জীবনভর তার পিছু পিছু ঘুরেছে। দুটো ছেলেমেয়ে বাজানকে চোখের জলে ভাসিয়ে অকালে চলে গেছে। সে তো জীবনে সুখের কোনো মুখ দেখতে পায় নাই। তওবা করলে, হুজুরের দোয়া নিলে ওপাড়ে গিয়ে যদি তার একটু ছোঁয়া পায়। একটু আরাম করতে পারে। এতটুকু করা মেয়ে হিসেবে হাজেরারই তো দায়িত্ব।
আরব বংশের লোক আলফি হুজুর। ইসলামের রাহে দূরদেশ থেকে এ গ্রামে এসে আসন পেতেছেন। উঁচা-লম্বা দেহ, আর লালচে চেহারায় সব সময় নূরানী জ্যোতি খেলা করে। হাজেরা অনেকবার দেখেছে। বাবার পেটব্যথার পানিপড়া আর মায়ের মাথা ধরার তাবিজ নিতে এসে অন্দর মহলেও ঘোরাফেরা করেছে। দুই বউয়ের কাছে হুজুরে পালা করে থাকেন। উপরে উপরে বউদের মধ্যে গলায় গলায় ভাব, চওড়া মিল খাতির। তবে পালার ছন্দে পতন হলে, একজনের পালায় আরেকজনের ঘরে ঢুকে পড়লে ভাব-মিল সব শিকায় ওঠে। দুজনই গাল ফুলায়, দরজায় খিল আঁটে। সপ্তাহ ধরে, কখনো কখনো নাকি মাসে গড়ায়। তখন হুজরা ঘরে বিনা বউয়ে হুজুরের উপোসী রাত কাটে।
গ্রামের মাতব্বর-মহাজনদের বাড়ির কাচারি এ বাড়িতে এসে ‘হুজরা’ নাম নিয়েছে। হাজেরা গিয়ে সে ঘরের বারান্দায় পা দেয়। কিন্তু এ রকম ফাঁকা কেন? বারান্দায় তো লোকজনের লাইন থাকে। হুজুরের পানি পড়া, তাবিজ-কবজ ধন্বন্তরির মতো। একফোঁটা গলায় পড়লে পেট ব্যথা, বুক জ্বলা লেজ তুলে পালায়। তাগায় বাধা মাধুলি দ‘ুদিন ঝুলালে ভাঙা বিয়ে সপ্তাহ না ঘুরতে আবার গলাগলি ধরে। তাই চার গ্রামের লোকজনে হুজরার বারান্দা টইটুম্বুর থাকে বারোমাস। মনে হয় এতো সকাল দেখে কেউ এসে সারে নাই ।
আরব বংশের লোক আলফি হুজুর। ইসলামের রাহে দূরদেশ থেকে এ গ্রামে এসে আসন পেতেছেন। উঁচা-লম্বা দেহ, আর লালচে চেহারায় সব সময় নূরানী জ্যোতি খেলা করে। হাজেরা অনেকবার দেখেছে। বাবার পেটব্যথার পানিপড়া আর মায়ের মাথা ধরার তাবিজ নিতে এসে অন্দর মহলেও ঘোরাফেরা করেছে। দুই বউয়ের কাছে হুজুরে পালা করে থাকেন। উপরে উপরে বউদের মধ্যে গলায় গলায় ভাব, চওড়া মিল খাতির। তবে পালার ছন্দে পতন হলে, একজনের পালায় আরেকজনের ঘরে ঢুকে পড়লে ভাব-মিল সব শিকায় ওঠে। দুজনই গাল ফুলায়, দরজায় খিল আঁটে। সপ্তাহ ধরে, কখনো কখনো নাকি মাসে গড়ায়। তখন হুজরা ঘরে বিনা বউয়ে হুজুরের উপোসী রাত কাটে।
গ্রামের মাতব্বর-মহাজনদের বাড়ির কাচারি এ বাড়িতে এসে ‘হুজরা’ নাম নিয়েছে। হাজেরা গিয়ে সে ঘরের বারান্দায় পা দেয়। কিন্তু এ রকম ফাঁকা কেন? বারান্দায় তো লোকজনের লাইন থাকে। হুজুরের পানি পড়া, তাবিজ-কবজ ধন্বন্তরির মতো। একফোঁটা গলায় পড়লে পেট ব্যথা, বুক জ্বলা লেজ তুলে পালায়। তাগায় বাধা মাধুলি দ‘ুদিন ঝুলালে ভাঙা বিয়ে সপ্তাহ না ঘুরতে আবার গলাগলি ধরে। তাই চার গ্রামের লোকজনে হুজরার বারান্দা টইটুম্বুর থাকে বারোমাস। মনে হয় এতো সকাল দেখে কেউ এসে সারে নাই ।
‘তুমি কফিল মিয়ার আওলাদ, আও, গরের মইদ্যে আও।’ হুজুর যেন হাজেরার অপেক্ষাতেই ছিলেন। ডেকে নিয়ে একবারে তার খাস কামরায় বসান। একটা খাট আর দুটো চেয়ারে সাজানো কামরা জুড়ে পুত-পবিত্র ভাব আর আতর-লোবানের গন্ধ জড়াজড়ি ধরে মুখ বুজে পড়ে আছে। হাজেরা পা দিয়েই কেঁপে ওঠে। কিন্তু তওবা, বাজানের জন্য দোয়া যন্ত্র চালিতের মতো চালিয়ে নেয়। খাটের এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে। ঘোমটাটা টেনে মুখটা আরো আড়াল করে। তবে হুজুরের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে, ‘তোমার বাপজী ইমানদার মানুষ আছিলেন। জুমাগরে পহেলা কাতারে জাগা পাইতেন না। গেরামের ময়-মুরব্বিরা থাকতেন। তয় পরের কাতারে তোমার বাপজী নিয়ত বানতেন। আবার নমাজ শ্যাষ করে ওয়াজ-নসিহত শুনতে পছনদো করতেন। পরহেজগার আছিলেন। তোমারে লইয়্যা হের ফিকির আছিল। কইতেন, হুজুর, মাইয়্যাডা বেয়াংরা অইয়্যা গ্যাচে। অরে আফনার আতে তুইল্যা দিমু। অর ইমান-আমান কেতা দুরসতো কইর্যা দিবেন। আইজ হেয় নাই, আল্লা তুমি হেরে বেহেসতো নসিব কইরো। আসো তোমারে কেতা-দুরসতো কইর্যা লই।’
আলফি হুজুর চেয়ার ছেড়ে খাটে বিছানো ধবধবে সাদা চাদরের ওপর আসন পেতে বসেন। হাজেরাকেও পা তুলে মুখোমুখি বসতে বলেন। আলফি হুজুর তখন বলেন, ‘নিয়ামতপুর নিবাসী সৈয়দ মোহাম্মদ হায়াতউদ্দিনের কনিষ্ঠপুত্র সৈয়দ আলাফউদ্দিনের সঙ্গে একই গ্রামের কফিল মিয়ার কন্যা হাজেরা বেগমের … টাকা দেনমোহরে নিকাহ। বলো কবুল।’ হাজেরার মাথাটা একটা চক্কর দিয়ে ওঠে। এটা কী তওবা? এ রকম তো হালিমাবু, আয়শা খালার বিয়ের সময় হয়েছিল। এখানে তা কেন? কিন্তু আলফি হুজুর বার দুয়েক বলেন, ‘বলো কবুল।’ হাজেরা তার হুকুমে ঘাড় কাত করল কিনা সেদিকে আর না তাকিয়ে আলফি হুজুর তাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করেন, ‘এখন তুমি নয়াবিবি, আও, সহবত করি।’ তার দুহাতের বেষ্টনির মধ্যে প্রশস্ত বুকের ওপর খাঁচায় পোরা কবুতরের মতো ছটফট করতে করতে হাজেরা শুধু বলতে পারে ‘বাজানের জানাজা।’
হুজুর যেন তারও ব্যবস্থা করে রেখেছেন, ‘গোর খোড়া শ্যাষ অইলে আলিমুদ্দি খবর দিবো।’
আলফি হুজুর চেয়ার ছেড়ে খাটে বিছানো ধবধবে সাদা চাদরের ওপর আসন পেতে বসেন। হাজেরাকেও পা তুলে মুখোমুখি বসতে বলেন। আলফি হুজুর তখন বলেন, ‘নিয়ামতপুর নিবাসী সৈয়দ মোহাম্মদ হায়াতউদ্দিনের কনিষ্ঠপুত্র সৈয়দ আলাফউদ্দিনের সঙ্গে একই গ্রামের কফিল মিয়ার কন্যা হাজেরা বেগমের … টাকা দেনমোহরে নিকাহ। বলো কবুল।’ হাজেরার মাথাটা একটা চক্কর দিয়ে ওঠে। এটা কী তওবা? এ রকম তো হালিমাবু, আয়শা খালার বিয়ের সময় হয়েছিল। এখানে তা কেন? কিন্তু আলফি হুজুর বার দুয়েক বলেন, ‘বলো কবুল।’ হাজেরা তার হুকুমে ঘাড় কাত করল কিনা সেদিকে আর না তাকিয়ে আলফি হুজুর তাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করেন, ‘এখন তুমি নয়াবিবি, আও, সহবত করি।’ তার দুহাতের বেষ্টনির মধ্যে প্রশস্ত বুকের ওপর খাঁচায় পোরা কবুতরের মতো ছটফট করতে করতে হাজেরা শুধু বলতে পারে ‘বাজানের জানাজা।’
হুজুর যেন তারও ব্যবস্থা করে রেখেছেন, ‘গোর খোড়া শ্যাষ অইলে আলিমুদ্দি খবর দিবো।’
=========================
গল্প- আলিমের নিভৃতিচর্চা by রাশিদা সুলতানা গল্প- প্রত্যাবর্তন: আমার ‘ফেরা’ নিয়ে যে কাহিনী না ..মানষ চৌঃ গল্প- 'বীচিকলায় ঢেকে যায় মুখ ও শিরোনাম' by আনোয়ার ... গল্প- 'প্রীত পরায়া' by সিউতি সবুর গল্প- 'চলিতেছে' by মাহবুব মোর্শেদ গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা গল্প- 'রূপকথা' by লুনা রুশদী সঞ্জীব চৌধুরীর কয়েকটি গল্প গল্প- 'অস্বস্তির সঙ্গে বসবাস' by ফাহমিদুল হক গল্প- 'মঙ্গামনস্ক শরীরীমুদ্রা' by ইমতিয়ার শামীম
bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ জিয়া হাশান
এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
লেখকঃ জিয়া হাশান
এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
No comments