প্রার্থীরা নিজেদের সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছেন by বদিউল আলম মজুমদার
আগামীকাল ১৭ জুন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। সাংবিধানিক নির্দেশনা (অনুচ্ছেদ ৫৯) অনুযায়ী, রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তথা গণতান্ত্রিক শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে এই নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হতে হবে। একইসঙ্গে এটি হতে হবে অর্থবহ। সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিদের নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমেই নির্বাচন হবে অর্থবহ। আর তা হলেই চট্টগ্রাম মহানগরে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা ও জন-অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা কায়েম এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে।
বহু দিন থেকেই ‘সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক’ অর্থবহ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষে প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্য দিয়ে ক্ষমতায়িত করার কাজ করে আসছে, যাতে তারা জেনে-শুনে-বুঝে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। বহু লড়াই-সংগ্রাম এবং উচ্চ আদালতে আবু সাফা গংদের জালিয়াতি প্রতিহতের পর নাগরিকদের তথ্য প্রাপ্তির এ অধিকার এখন আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আদালত ভোটারদের এ অধিকারকে বাক্স্বাধীনতা তথা তাদের মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কারণ ভোটাররা তাদের বাক্স্বাধীনতা প্রয়োগ করে ভোট প্রদানের মাধ্যমে।
নির্বাচনী বিধিবিধান অনুযায়ী, আসন্ন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সাত ধরনের তথ্য হলফনামা আকারে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রদান করতে হয়েছে। তথ্যগুলো হলো: প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, তাঁদের বিরুদ্ধে অতীত ও বর্তমান মামলা, পেশা, আয়ের উৎস, প্রার্থীদের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক এবং তাঁদের ওপর নির্ভরশীলদের সম্পদ ও দায়-দেনা ইত্যাদি। একইসঙ্গে তাদের আয়কর রিটার্নের কপিও জমা দিতে হয়েছে।
এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে আটজন, সাধারণ আসনে কাউন্সিলর পদে ২৫৩ জন এবং নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর পদে ৫৯ জন চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। যদিও মেয়র পদে ১৮ জন, সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ৬৮ জন এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ৩২২ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। উল্লেখ্য, মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী মো. সোলায়মান আলম শেঠ সম্প্রতি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। যেহেতু প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময়সীমা পার হওয়ার পর তিনি এ ঘোষণা দিয়েছেন এবং তাঁর নাম ব্যালটে থাকবে, তাই আমাদের বিশ্লেষণে তাঁর প্রদত্ত তথ্যও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমরা সব চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীর তথ্য নির্বাচন কমিশন ও কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করেছি।
আমাদের প্রাথমিক বিশ্লেষণে মোটা দাগে কয়েকটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। বিষয়গুলো হলো: প্রার্থীদের শিক্ষাগতযোগ্যতা, পেশা, অতীত ও বর্তমান মামলা, আয়, সম্পদ ও দায়দেনা এবং করসংক্রান্ত তথ্য। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী আটজন মেয়র পদপ্রার্থীর মধ্যে পাঁচজনই (৬৩%) স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির অধিকারী। তিনজনের শিক্ষাগতযোগ্যতা এইচএসসি পাস। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের মধ্যে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর শিক্ষাগতযোগ্যতা স্নাতক এবং মোহাম্মদ মন্জুর আলমের এইচএসসি।
সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ২৫৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীর মধ্যে এসএসসির নিচে ৮৫ জন (৩৪%), ৪৯ জন (২০%) এসএসসি, ৫৮ জন (২৩%) এইচএসসি এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী যথাক্রমে ৪২ ও ১৭ জন (১৭% ও ৭%)। সংরক্ষিত নারী আসনের কাউন্সিলরদের মধ্যে ৪৮ জনেরই (৮১%) শিক্ষাগতযোগ্যতা এসএসসির নিচে এবং বাকি ১১ জন (১৯%) স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। অর্থাৎ সাধারণ আসনের কাউন্সিলরদের সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীদের অধিকাংশই অপেক্ষাকৃত স্বল্পশিক্ষিত।
প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী আটজন মেয়র পদপ্রার্থীর মধ্যে পাঁচজনই (৬৩%) পেশা হিসেবে ব্যবসা উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া একজন চাকরিজীবী, একজন আইনজীবী এবং একজন (মহিউদ্দিন চৌধুরী) পেশা হিসেবে অন্যান্য উল্লেখ করেছেন। মন্জুর আলমের পেশা ব্যবসা। পেশাগতভাবে সাধারণ আসন থেকে কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের ১৯৪ জনই (৭৭%) ব্যবসায়ী। অর্থাৎ জাতীয় সংসদ ও অন্যান্য নির্বাচনের মতো চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যেও ব্যবসায়ীদেরই প্রাধান্য।
লক্ষণীয় যে সংরক্ষিত নারী আসনের ৫৯ জন প্রার্থীর মধ্যে ৩২ জনই (৫৪%) গৃহিণী। তাঁদের মধ্যে মাত্র ছয়জন (১০%) ব্যবসায়ী বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ প্রায় সব সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীদের নিজস্ব কোনো আয়ের উৎস নেই এবং সম্ভবত তাঁদের পেছনে হয় কোনো ক্ষমতাধর অথবা বিত্তশালী রয়েছেন।
মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের মধ্যে দুজনের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল এবং বর্তমানে একজনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, তার মধ্যে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তাঁর বিরুদ্ধে বর্তমানে ১৪টি মামলা রয়েছে, যার মধ্যে ১০টি স্থগিত, তিনটি বিচারাধীন ও একটি তদন্তাধীন। তাঁর বিরুদ্ধে অতীতে আটটি মামলা ছিল, যার সবগুলোই তাঁর পক্ষে নিষ্পত্তি হয়েছে। মন্জুর আলমের বিরুদ্ধে অতীতে কোনো মামলা ছিল না, বর্তমানেও নেই।
সাধারণ আসন থেকে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের মধ্যে ৫১ জনের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল এবং বর্তমানে ৪২ জনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় অর্থাৎ হত্যা মামলা রয়েছে। সংরক্ষিত নারী আসনের প্রার্থীদের মধ্যে দুজনের বিরুদ্ধে বর্তমানে ও দুজনের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল।
হলফনামায় প্রদত্ত সম্পদ ও দায়দেনার বিবরণী বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে দুজনের সম্পদের পরিমাণ পাঁচ লাখ টাকার নিচে, তিনজনের ১৫ লাখ টাকার মধ্যে এবং তাঁদের দুজন কোটিপতি। মহিউদ্দিন চৌধুরী আয়কর রিটার্নে তাঁর নিট সম্পদের মূল্য প্রায় এক কোটি ২৮ লাখ টাকা দেখিয়েছেন, যদিও হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী তাঁর নিজের এবং তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের মোট সম্পদের পরিমাণ (স্থাবর সম্পদের মূল্য বাদে) প্রায় ৯৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা।
উল্লেখ্য, মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁর হলফনামায় নিজের এবং তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের অস্থাবর সম্পদের মূল্য প্রদান করলেও স্থাবর সম্পদের মূল্য দেননি। তাঁর এবং তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের কোনো দায়দেনা নেই। তাঁর কোনো ব্যবসায়িক ঋণও নেই। হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, তাঁর এবং তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের নিট সম্পদ প্রায় ৯৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। তবে স্থাবর সম্পদের মূল্য যোগ করলে নিট সম্পদের পরিমাণ আরও বেশি হতে বাধ্য। মন্জুর আলম ও তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের স্থাবর ও অস্থাবর সব সম্পদের মূল্য তাঁর প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী প্রায় ২৫ কোটি ছয় লাখ টাকা। তাঁর ব্যক্তিগত দায়দেনা ৪১ লাখ ছয় হাজার টাকা। তাই হলফনামা অনুযায়ী, তাঁর ও তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের নিট সম্পদ প্রায় সাড় ২৪ কোটি টাকা, যদিও আয়কর রিটার্নের তথ্যানুযায়ী তাঁর নিট সম্পদ প্রায় ১৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। মন্জুর আলমের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়—তাঁর ব্যবসায়িক ঋণ ১৬৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। হলফনামা এবং আয়কর রিটার্নে প্রদত্ত সম্পদের মূল্য থেকে যা বহুগুণ বেশি।
সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে প্রার্থীর মধ্যে অনেকেই সম্পদের মূল্য উল্লেখ করেননি। তবে ১৬৩ জন (৬৪%) প্রার্থীর সম্পদ পাঁচ লাখ এবং অন্য ৪২ জনের (১৭%) ১৫ লাখ টাকার মধ্যে। এদের মধ্যে পাঁচজন কোটিপতি রয়েছেন। সংরক্ষিত নারী আসনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে ৪১ জনের (৬৯%) সম্পদ পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে এবং দুজনের এক কোটি টাকার ওপরে সম্পদ রয়েছে। সাধারণ আসনের প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে ১৪ জনের (৬%) দায়দেনা ও ঋণের পরিমাণ পাঁচ লাখ, অন্য ১০ জনের (৪%) ১৫ লাখ এবং ২২ জনের (৯%) ২৫ লাখ টাকার মধ্যে। সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীদের মধ্যে মাত্র ছয়জনের দায়দেনা ও ঋণ রয়েছে, যাঁদের মধ্যে পাঁচজনেরই দায়দেনা ও ঋণের পরিমাণ পাঁচ লাখ টাকার নিচে।
প্রধান দুই মেয়র পদপ্রার্থীর আয়ের উৎস পর্যালোচনা থেকে দেখা যায় যে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মোট আয় দুই লাখ ৭৪ হাজার টাকা। তাঁর ওপর নির্ভলশীলদের কোনো আয় নেই। তিনি আয়কর দিয়েছেন ১০ হাজার ৯০০ টাকা।
পক্ষান্তরে হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, মন্জুর আলমের মোট আয় ৭০ লাখ ৩৯ হাজার টাকা, যার মধ্যে ব্যবসায়িক সূত্র থেকে আয় মাত্র ১৬ লাখ ৫৬ হাজার টাকা এবং তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের আয়ের পরিমাণ প্রায় ১৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। তবে আয়কর রিটার্ন অনুযায়ী, তাঁর করযোগ্য আয় প্রায় ৫৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা এবং তাঁর প্রদত্ত করের পরিমাণ প্রায় ১২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। লক্ষণীয় যে অর্জিত আয়ের ওপর তাঁর প্রায় ১৬৩ কোটি টাকার ব্যবসায়িক ঋণের কোনোরূপ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব দেখা যায় না।
মেয়র পদে দুই মূল প্রতিদ্বন্দ্বীর আয়কর রিটার্নে প্রদত্ত তাঁদের জীবনযাত্রা প্রণালির তথ্য থেকে দেখা যায় যে মহিউদ্দিন চৌধুরী বাৎসরিকভাবে মোট এক লাখ ৪৫ হাজার টাকা ব্যক্তিগত ও ভরণপোষণের জন্য ব্যয় করেন। অর্থাৎ ব্যক্তিগত ও ভরণপোষণের জন্য তাঁর গড় মাসিক ব্যয় মাত্র ১২ হাজার টাকার একটু বেশি, যা বিশ্বাস করা দুরূহ। অন্যদিকে মো. মন্জুর আলমের বাৎসরিক ব্যক্তিগত ও ভরণপোষণ ব্যয় প্রায় ২১ লাখ টাকা এবং মাসিক প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার টাকা, যা অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য।
পরিশেষে, বিখ্যাত আমেরিকান বিচারপতি লুইস ব্রেন্ডাইস বলেছিলেন, সূর্যের আলোই সর্বোত্তম জীবাণুনাশক। অর্থাৎ তথ্যের অবাধ প্রবাহ, যা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পূর্বশর্ত, সমাজকে কলুষমুক্ত করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্য প্রদান করলে তাঁরা সজ্ঞানে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যার ফলে সজ্জনেরা নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পান এবং সমাজ থেকে পঙ্কিলতা দূরীকরণের পথ সুগম হয়। সুজনের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা এবং আদালতের নির্দেশে আমাদের জন্যও এ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আশা করি, চট্টগ্রাম মহানগরের সন্মানিত ভোটাররা প্রার্থীদের প্রদত্ত তথ্যগুলো —যা আমরা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে ওয়েবসাইটে (www.votebd.org) প্রকাশ ও গণমাধ্যমের কাছে বিতরণ করেছি—বিবেচনায় নিয়ে এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করবেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, ‘সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক’।
বহু দিন থেকেই ‘সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক’ অর্থবহ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষে প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্য দিয়ে ক্ষমতায়িত করার কাজ করে আসছে, যাতে তারা জেনে-শুনে-বুঝে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। বহু লড়াই-সংগ্রাম এবং উচ্চ আদালতে আবু সাফা গংদের জালিয়াতি প্রতিহতের পর নাগরিকদের তথ্য প্রাপ্তির এ অধিকার এখন আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আদালত ভোটারদের এ অধিকারকে বাক্স্বাধীনতা তথা তাদের মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কারণ ভোটাররা তাদের বাক্স্বাধীনতা প্রয়োগ করে ভোট প্রদানের মাধ্যমে।
নির্বাচনী বিধিবিধান অনুযায়ী, আসন্ন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সাত ধরনের তথ্য হলফনামা আকারে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রদান করতে হয়েছে। তথ্যগুলো হলো: প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, তাঁদের বিরুদ্ধে অতীত ও বর্তমান মামলা, পেশা, আয়ের উৎস, প্রার্থীদের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক এবং তাঁদের ওপর নির্ভরশীলদের সম্পদ ও দায়-দেনা ইত্যাদি। একইসঙ্গে তাদের আয়কর রিটার্নের কপিও জমা দিতে হয়েছে।
এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে আটজন, সাধারণ আসনে কাউন্সিলর পদে ২৫৩ জন এবং নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর পদে ৫৯ জন চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। যদিও মেয়র পদে ১৮ জন, সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ৬৮ জন এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ৩২২ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। উল্লেখ্য, মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী মো. সোলায়মান আলম শেঠ সম্প্রতি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। যেহেতু প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময়সীমা পার হওয়ার পর তিনি এ ঘোষণা দিয়েছেন এবং তাঁর নাম ব্যালটে থাকবে, তাই আমাদের বিশ্লেষণে তাঁর প্রদত্ত তথ্যও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমরা সব চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীর তথ্য নির্বাচন কমিশন ও কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করেছি।
আমাদের প্রাথমিক বিশ্লেষণে মোটা দাগে কয়েকটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। বিষয়গুলো হলো: প্রার্থীদের শিক্ষাগতযোগ্যতা, পেশা, অতীত ও বর্তমান মামলা, আয়, সম্পদ ও দায়দেনা এবং করসংক্রান্ত তথ্য। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী আটজন মেয়র পদপ্রার্থীর মধ্যে পাঁচজনই (৬৩%) স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির অধিকারী। তিনজনের শিক্ষাগতযোগ্যতা এইচএসসি পাস। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের মধ্যে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর শিক্ষাগতযোগ্যতা স্নাতক এবং মোহাম্মদ মন্জুর আলমের এইচএসসি।
সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ২৫৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীর মধ্যে এসএসসির নিচে ৮৫ জন (৩৪%), ৪৯ জন (২০%) এসএসসি, ৫৮ জন (২৩%) এইচএসসি এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী যথাক্রমে ৪২ ও ১৭ জন (১৭% ও ৭%)। সংরক্ষিত নারী আসনের কাউন্সিলরদের মধ্যে ৪৮ জনেরই (৮১%) শিক্ষাগতযোগ্যতা এসএসসির নিচে এবং বাকি ১১ জন (১৯%) স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। অর্থাৎ সাধারণ আসনের কাউন্সিলরদের সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীদের অধিকাংশই অপেক্ষাকৃত স্বল্পশিক্ষিত।
প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী আটজন মেয়র পদপ্রার্থীর মধ্যে পাঁচজনই (৬৩%) পেশা হিসেবে ব্যবসা উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া একজন চাকরিজীবী, একজন আইনজীবী এবং একজন (মহিউদ্দিন চৌধুরী) পেশা হিসেবে অন্যান্য উল্লেখ করেছেন। মন্জুর আলমের পেশা ব্যবসা। পেশাগতভাবে সাধারণ আসন থেকে কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের ১৯৪ জনই (৭৭%) ব্যবসায়ী। অর্থাৎ জাতীয় সংসদ ও অন্যান্য নির্বাচনের মতো চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যেও ব্যবসায়ীদেরই প্রাধান্য।
লক্ষণীয় যে সংরক্ষিত নারী আসনের ৫৯ জন প্রার্থীর মধ্যে ৩২ জনই (৫৪%) গৃহিণী। তাঁদের মধ্যে মাত্র ছয়জন (১০%) ব্যবসায়ী বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ প্রায় সব সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীদের নিজস্ব কোনো আয়ের উৎস নেই এবং সম্ভবত তাঁদের পেছনে হয় কোনো ক্ষমতাধর অথবা বিত্তশালী রয়েছেন।
মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের মধ্যে দুজনের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল এবং বর্তমানে একজনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, তার মধ্যে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তাঁর বিরুদ্ধে বর্তমানে ১৪টি মামলা রয়েছে, যার মধ্যে ১০টি স্থগিত, তিনটি বিচারাধীন ও একটি তদন্তাধীন। তাঁর বিরুদ্ধে অতীতে আটটি মামলা ছিল, যার সবগুলোই তাঁর পক্ষে নিষ্পত্তি হয়েছে। মন্জুর আলমের বিরুদ্ধে অতীতে কোনো মামলা ছিল না, বর্তমানেও নেই।
সাধারণ আসন থেকে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের মধ্যে ৫১ জনের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল এবং বর্তমানে ৪২ জনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় অর্থাৎ হত্যা মামলা রয়েছে। সংরক্ষিত নারী আসনের প্রার্থীদের মধ্যে দুজনের বিরুদ্ধে বর্তমানে ও দুজনের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল।
হলফনামায় প্রদত্ত সম্পদ ও দায়দেনার বিবরণী বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে দুজনের সম্পদের পরিমাণ পাঁচ লাখ টাকার নিচে, তিনজনের ১৫ লাখ টাকার মধ্যে এবং তাঁদের দুজন কোটিপতি। মহিউদ্দিন চৌধুরী আয়কর রিটার্নে তাঁর নিট সম্পদের মূল্য প্রায় এক কোটি ২৮ লাখ টাকা দেখিয়েছেন, যদিও হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী তাঁর নিজের এবং তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের মোট সম্পদের পরিমাণ (স্থাবর সম্পদের মূল্য বাদে) প্রায় ৯৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা।
উল্লেখ্য, মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁর হলফনামায় নিজের এবং তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের অস্থাবর সম্পদের মূল্য প্রদান করলেও স্থাবর সম্পদের মূল্য দেননি। তাঁর এবং তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের কোনো দায়দেনা নেই। তাঁর কোনো ব্যবসায়িক ঋণও নেই। হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, তাঁর এবং তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের নিট সম্পদ প্রায় ৯৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। তবে স্থাবর সম্পদের মূল্য যোগ করলে নিট সম্পদের পরিমাণ আরও বেশি হতে বাধ্য। মন্জুর আলম ও তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের স্থাবর ও অস্থাবর সব সম্পদের মূল্য তাঁর প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী প্রায় ২৫ কোটি ছয় লাখ টাকা। তাঁর ব্যক্তিগত দায়দেনা ৪১ লাখ ছয় হাজার টাকা। তাই হলফনামা অনুযায়ী, তাঁর ও তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের নিট সম্পদ প্রায় সাড় ২৪ কোটি টাকা, যদিও আয়কর রিটার্নের তথ্যানুযায়ী তাঁর নিট সম্পদ প্রায় ১৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। মন্জুর আলমের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়—তাঁর ব্যবসায়িক ঋণ ১৬৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। হলফনামা এবং আয়কর রিটার্নে প্রদত্ত সম্পদের মূল্য থেকে যা বহুগুণ বেশি।
সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে প্রার্থীর মধ্যে অনেকেই সম্পদের মূল্য উল্লেখ করেননি। তবে ১৬৩ জন (৬৪%) প্রার্থীর সম্পদ পাঁচ লাখ এবং অন্য ৪২ জনের (১৭%) ১৫ লাখ টাকার মধ্যে। এদের মধ্যে পাঁচজন কোটিপতি রয়েছেন। সংরক্ষিত নারী আসনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে ৪১ জনের (৬৯%) সম্পদ পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে এবং দুজনের এক কোটি টাকার ওপরে সম্পদ রয়েছে। সাধারণ আসনের প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে ১৪ জনের (৬%) দায়দেনা ও ঋণের পরিমাণ পাঁচ লাখ, অন্য ১০ জনের (৪%) ১৫ লাখ এবং ২২ জনের (৯%) ২৫ লাখ টাকার মধ্যে। সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীদের মধ্যে মাত্র ছয়জনের দায়দেনা ও ঋণ রয়েছে, যাঁদের মধ্যে পাঁচজনেরই দায়দেনা ও ঋণের পরিমাণ পাঁচ লাখ টাকার নিচে।
প্রধান দুই মেয়র পদপ্রার্থীর আয়ের উৎস পর্যালোচনা থেকে দেখা যায় যে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মোট আয় দুই লাখ ৭৪ হাজার টাকা। তাঁর ওপর নির্ভলশীলদের কোনো আয় নেই। তিনি আয়কর দিয়েছেন ১০ হাজার ৯০০ টাকা।
পক্ষান্তরে হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, মন্জুর আলমের মোট আয় ৭০ লাখ ৩৯ হাজার টাকা, যার মধ্যে ব্যবসায়িক সূত্র থেকে আয় মাত্র ১৬ লাখ ৫৬ হাজার টাকা এবং তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের আয়ের পরিমাণ প্রায় ১৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। তবে আয়কর রিটার্ন অনুযায়ী, তাঁর করযোগ্য আয় প্রায় ৫৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা এবং তাঁর প্রদত্ত করের পরিমাণ প্রায় ১২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। লক্ষণীয় যে অর্জিত আয়ের ওপর তাঁর প্রায় ১৬৩ কোটি টাকার ব্যবসায়িক ঋণের কোনোরূপ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব দেখা যায় না।
মেয়র পদে দুই মূল প্রতিদ্বন্দ্বীর আয়কর রিটার্নে প্রদত্ত তাঁদের জীবনযাত্রা প্রণালির তথ্য থেকে দেখা যায় যে মহিউদ্দিন চৌধুরী বাৎসরিকভাবে মোট এক লাখ ৪৫ হাজার টাকা ব্যক্তিগত ও ভরণপোষণের জন্য ব্যয় করেন। অর্থাৎ ব্যক্তিগত ও ভরণপোষণের জন্য তাঁর গড় মাসিক ব্যয় মাত্র ১২ হাজার টাকার একটু বেশি, যা বিশ্বাস করা দুরূহ। অন্যদিকে মো. মন্জুর আলমের বাৎসরিক ব্যক্তিগত ও ভরণপোষণ ব্যয় প্রায় ২১ লাখ টাকা এবং মাসিক প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার টাকা, যা অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য।
পরিশেষে, বিখ্যাত আমেরিকান বিচারপতি লুইস ব্রেন্ডাইস বলেছিলেন, সূর্যের আলোই সর্বোত্তম জীবাণুনাশক। অর্থাৎ তথ্যের অবাধ প্রবাহ, যা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পূর্বশর্ত, সমাজকে কলুষমুক্ত করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্য প্রদান করলে তাঁরা সজ্ঞানে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যার ফলে সজ্জনেরা নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পান এবং সমাজ থেকে পঙ্কিলতা দূরীকরণের পথ সুগম হয়। সুজনের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা এবং আদালতের নির্দেশে আমাদের জন্যও এ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আশা করি, চট্টগ্রাম মহানগরের সন্মানিত ভোটাররা প্রার্থীদের প্রদত্ত তথ্যগুলো —যা আমরা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে ওয়েবসাইটে (www.votebd.org) প্রকাশ ও গণমাধ্যমের কাছে বিতরণ করেছি—বিবেচনায় নিয়ে এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করবেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, ‘সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক’।
No comments