জনগণকে তাঁরা কী দিয়েছেন by সোহরাব হাসান
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে যে ন্যূনতম কর্মসম্পর্ক থাকা দরকার, বাংলাদেশে তা প্রবলভাবে অনুপস্থিত। দুই দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ ঘটে কদাচিৎ। কেউ কারও মুখও দেখতে চান না (যদিও দুই দলের নেতাদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, টেন্ডার ভাগাভাগি, ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিয়েশাদির ঘটনা কম ঘটছে না)। দুই দলেই এমন কিছু নেতা আছেন, যাঁরা নেত্রীকে সন্তুষ্ট রাখতে সদা ব্যস্ত থাকেন। তাঁরা কথা বলেন হিজ মাস্টার্স কিংবা হার মাস্টার্স ভয়েসে। বিএনপির আমলে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা এই কাজটি করতেন, গয়েশ্বরচন্দ্র রায় করতেন, লুত্ফুজ্জামান বাবর করতেন। এখন কি আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সেই দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিয়েছেন? না হলে তিনি এতটা লাগামহীন মন্তব্য করতে পারতেন না।
সম্প্রতি এক সেমিনারে আইন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের চর হিসেবে কাজ করেছেন।’ বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাঁকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, ‘তথ্য-প্রমাণ দিন।’ শেষ পর্যন্ত আইন প্রতিমন্ত্রী তাঁর অবস্থান থেকে সরে এসেছেন, না আগের জায়গায় স্থির আছেন তা স্পষ্ট নয়। একবার তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার সাহসী ভূমিকার প্রশংসাও করেন, আবার তাঁকে পাকিস্তানের অনুচর বানান। এতে সত্যিকার অনুচরেরা আড়ালে পড়ে যায়।
মন্ত্রীদের কাজ মন্ত্রণালয় চালানো, বেশি কথা বলা নয়। কথা বলবে বিরোধী দল। তারা সরকারের সমালোচনা করবে, ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেবে। মন্ত্রীদের দায়িত্ব সঠিক সিদ্ধান্ত ও কাজ দিয়ে সেই সমালোচনার মোক্ষম জবাব দেওয়া।
বাহাস এখানেই শেষ নয়। জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, পাকিস্তানের চোখরাঙানিতে বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করছে। গয়েশ্বরচন্দ্র রায়ের দাবি, সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে চায় না বলেই মন্ত্রীরা আবোল-তাবোল বকে চলেছেন। রাজনীতি থেকে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ উঠে গেছে। এখন সামান্য সৌজন্যবোধের পরিচয় দিতেও তাঁদের মধ্যে সীমাহীন কার্পণ্য দেখা যায়। আমাদের নতুন প্রজন্ম তাঁদের কাছ থেকে কী শিখবে?
ঢাকার মহাসমাবেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একটি কথাও বলেননি। জনজীবনের সমস্যার কথা বললেও মূল টার্গেট ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তাঁর দাবি, বিদেশি প্রভুদের নির্দেশে ফখরুদ্দীন-মইন সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। এ কারণে সরকার এক-এগারোর কুশীলবদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাঁদের সবাইকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। ইতিমধ্যে মওদুদ আহমদ ছয়জনের নামে গণতদন্ত কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে তাতে পালের গোদা ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নাম নেই।
আবারও সেই পুরোনো কাসুন্দি। খালেদা জিয়ার কথা সত্যি হলে এটাও মানতে হবে, বিদেশি প্রভুদের নির্দেশে তাঁকেও জেলখানা থেকে বের করে এনে বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসনে বসানো হয়েছে। খালেদা জিয়া যা বলেছেন তা যদি ভাঁওতাবাজি না হয়, তাহলে তাঁর উচিত হবে সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে পাওয়া বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসনটি ছেড়ে দেওয়া। ২০০১ সালের নির্বাচন নিয়েও একই অভিযোগ করেছিলেন তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি পদত্যাগ করেননি। খালেদা জিয়া কি করবেন? যদি না করেন, তাহলে এসব বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা কেন বলছেন? মানুষকে এতটা আহাম্মক ভাববেন না যে তারা কিছু বোঝে না। যে দল বা নেতাই পরাজিত হন, নির্বাচনকে সাজানো বলেন, আবার সাজানো নির্বাচনের সুযোগ-সুবিধাটুকু পুরো হাতিয়ে নেন।
দেশে যখন হাজারটা সমস্যা, তখন নেতা-নেত্রীরা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। মনে রাখবেন, অতীত বা বর্তমান কারোরই শতভাগ নিষ্কলুষ নয়। আজ বিরোধীদলীয় নেত্রী যেসব অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে এনেছেন, এর একটি অভিযোগ থেকেও কি তাঁর সরকার মুক্ত ছিল? বিএনপির সমর্থক একটা পত্রিকা কার্টুন এঁকে সরকারের নানা রোগের লক্ষণ চিহ্নিত করেছে: দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির সংকট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-শিক্ষক লাঞ্ছনা, মহাদলীয়করণ, চাকরিচ্যুতি ও ওএসডি, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, বিরোধী দল দমন, সাংবাদিক নির্যাতন, পক্ষপাতমূলক নির্বাচন কমিশন, চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন, টিভি চ্যানেল বন্ধ করা।
এখন জনগণ যদি বিরোধীদলীয় নেত্রীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলে, এই তালিকায় একটি শব্দও কি তিনি দেখাতে পারবেন যা তাঁর শাসনামলে ছিল না? আমরা নিশ্চিত বলতে পারি, তিনি পারবেন না। তবে তাঁর শাসনামলে আরও কিছু উপসর্গ ছিল, যা এখন অনেকটাই নেই। যেমন জঙ্গিবাদ তোষণ, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন ও তাদের ঘরবাড়ি-ছাড়া করে উদ্বাস্তু শিবিরে যেতে বাধ্য করা। মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী, আমরা রামশীলের কথা ভুলে যাইনি, ভুলে যাইনি ভোলা বা বাগেরহাটের কথাও। এসব পুরোনো প্রসঙ্গ তুলে আমরা আওয়ামী লীগের, যুবলীগের, ছাত্রলীগের মাস্তানি-সন্ত্রাসকে জায়েজ করতে চাই না। চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি তখন খারাপ হলে এখনো খারাপ। দলীয়করণ, আত্মীয়করণ তখন মন্দ হলে এখনো মন্দ। প্রধানমন্ত্রী যখন দেশের মরে যাওয়া নদী বাঁচাতে টাস্কফোর্স গঠন করেন, তখন তাঁরই দলের সাংসদ রনি পটুয়াখালীতে নদী ভরাট করে মার্কেট বানান। অন্য নদী বাঁচানোর আগে দলীয় সাংসদের দখল করা নদীটি বাঁচানো প্রয়োজন।
২.
প্রধান দুই দলের নেতা-নেত্রীরা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জান কোরবান করতে প্রস্তুত। কিন্তু তাঁদের বক্তব্য-বিবৃতি ও আচরণে এর প্রতিফলন নেই। এই দুই দলের নেতারা যখন একে অপরকে ভারতের দালাল বা পাকিস্তানের চর বলে আখ্যায়িত করেন, তখন মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা কোথায় আছি? বাংলাদেশের রাজনীতি আর বাংলাদেশে নেই। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে গেছে, সেখান থেকে ট্রেনযোগে পাকিস্তানে। আমাদের মনে আরও প্রশ্ন জাগে, এর চেয়ে যোগ্য নেতৃত্বের যোগ্য কি আমরা কখনো হব না? বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে শেখ হাসিনা বলতেন, বিদেশে গ্যাস রপ্তানি করতে রাজি হননি বলেই তাঁকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হয়নি। বিএনপি গ্যাস রপ্তানির মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। এখন খালেদা জিয়া দাবি করছেন, আওয়ামী লীগ বিদেশি প্রভুদের কাছে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়ার শর্তে গদিতে বসেছে। এসব নালিশের মধ্যেও আবার রকমফের আছে।
প্রতি পাঁচ বছর পর যদি বিদেশি প্রভুরা দুই দলকে পালাক্রমে ক্ষমতায় বসিয়ে যান, তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব থাকে কোথায়? আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বাংলাদেশের শুধু প্রধান দুটি দলই নয়, দুই দশক ধরে পালাক্রমে তারা দেশ শাসন করে আসছে। এক দল ক্ষমতায় থাকলে অন্যটি বিরোধী দলে। খালেদা জিয়া দুবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এর আগে একবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এর আগে তাঁরা দুজনই রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করে স্বৈরাচারকে হটিয়েছেন। এর বিনিময়ে জনগণও তাঁদের অনেক কিছু দিয়েছে। পালাক্রমে তাঁরা দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রী হচ্ছেন। যে প্রশ্নটি তাঁদের করা জরুরি তা হলো, তাঁরা জনগণকে কী দিয়েছেন?
বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগ তাকে স্বৈরাচার বলত। এখন আওয়ামী লীগকে বিএনপি স্বৈরাচার বলে, বিদেশের দালাল বলে। গত নির্বাচনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী তারা দেশের ৭৯ শতাংশ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করে। আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৪৬ শতাংশ, বিএনপি ৩৩ শতাংশ। এরা যদি বিদেশের দালাল ও সেবাদাস হয়, তাহলে দেশের স্বাধীনতা থাকে কোথায়?
মাঝেমধ্যে আমাদের সন্দেহ হয়, তারা কি সত্যি সত্যি পরস্পরকে শত্রু ভাবে, না অলিখিত বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে আগ্রহী? তারা নিজ দলের দুর্নীতিবাজের বিচার তো করেইনি, বিরোধী দলের কজন দুর্নীতিবাজের বিচার করেছে? হয় তারা যা বলে তা বিশ্বাস করে না, জনগণকে ধোঁকা দিতে এসব কথা বলে; অথবা বিচার করার ক্ষমতাই তাদের নেই।
যদি তারা খেয়োখেয়িতে ব্যস্ত না থাকত, যদি তারা গুন্ডা-মাস্তান, গডফাদার, গডব্রাদার না পুষত, যদি তারা সিভিল ও নন-সিভিল আমলাদের দলীয়করণ না করত! বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে এক দল মোসাহেব তৈরি করেছে, আওয়ামী লীগ আরেক দল মোসাহেব বানাচ্ছে। বিএনপি এক দল গুন্ডা-মাস্তান পুষেছে, আওয়ামী লীগ আরেক দল পুষছে। বিএনপির আমলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জাতীয়তাবাদী শিক্ষকদের দৌরাত্ম্য ছিল, ছাত্রদল হলে হলে মাস্তানি চালাত; এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আওয়ামী শিক্ষকদের দৌরাত্ম্য চলছে, ছাত্রলীগ হলে হলে মাস্তানি, চাঁদাবাজি করে বেড়াচ্ছে। এর শেষ কোথায়?
দুই দলের নেতাদের কথা ও বক্তব্য-বিবৃতিতে যতই পার্থক্য থাকুক, কর্ম ও আচরণে পার্থক্যটি ধীরে ধীরে ঘুচে যাচ্ছে। বিএনপির আমলে যেসব অপকর্ম হয়েছে, এখনো যদি তা-ই চলতে থাকে, তাহলে ক্ষমতার হাতবদলে আমজনতার কী লাভ হলো? অনেকেই বিশ্বাস করে, আসলে দুই দলই বুঝে গেছে যে তাদের কোনো বিকল্প নেই। পালা করে তারা ক্ষমতায় আসবে এবং বিরোধী দলের আসনে বসবে। মানুষ যে অন্ধকারে ছিল, সেই অন্ধকারেই থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী যখন এক-এগারোর কুশীলবদের নিয়ে বাহাস করছিলেন, কারা জরুরি সরকারকে এনেছে তার পক্ষে যুক্তি উত্থাপন করছিলেন, তখনই টেলিভিশনগুলো আইলায় আক্রান্ত মানুষের আহাজারি দেখাচ্ছিল। আইলায় লাখ লাখ লোক ঘরবাড়ি হারিয়েছে, খেতের শস্য, গবাদিপশু হারিয়েছে। সেই সর্বহারা মানুষগুলোর জন্য কী করেছে সরকার? কী করেছে বিরোধী দল? রাজধানীর মহাসমাবেশ বা টঙ্গীর বিশাল জনসভায় দেওয়া নেত্রীদের বুলন্দ আওয়াজ আইলায় আক্রান্ত মানুষকে কোনো সান্ত্বনা দিতে পারেনি, পারবে না। অতীতের বড় বড় দুর্নীতির কথা বাদই দিলাম; আইলা আঘাত হেনেছে এই সরকারের আমলেই, সেখানে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ নিয়ে যে দুর্নীতি-অনিয়ম হয়েছে তার দায় তো সরকার এড়াতে পারে না।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়, ‘দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ’।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
সম্প্রতি এক সেমিনারে আইন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের চর হিসেবে কাজ করেছেন।’ বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাঁকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, ‘তথ্য-প্রমাণ দিন।’ শেষ পর্যন্ত আইন প্রতিমন্ত্রী তাঁর অবস্থান থেকে সরে এসেছেন, না আগের জায়গায় স্থির আছেন তা স্পষ্ট নয়। একবার তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার সাহসী ভূমিকার প্রশংসাও করেন, আবার তাঁকে পাকিস্তানের অনুচর বানান। এতে সত্যিকার অনুচরেরা আড়ালে পড়ে যায়।
মন্ত্রীদের কাজ মন্ত্রণালয় চালানো, বেশি কথা বলা নয়। কথা বলবে বিরোধী দল। তারা সরকারের সমালোচনা করবে, ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেবে। মন্ত্রীদের দায়িত্ব সঠিক সিদ্ধান্ত ও কাজ দিয়ে সেই সমালোচনার মোক্ষম জবাব দেওয়া।
বাহাস এখানেই শেষ নয়। জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, পাকিস্তানের চোখরাঙানিতে বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করছে। গয়েশ্বরচন্দ্র রায়ের দাবি, সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে চায় না বলেই মন্ত্রীরা আবোল-তাবোল বকে চলেছেন। রাজনীতি থেকে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ উঠে গেছে। এখন সামান্য সৌজন্যবোধের পরিচয় দিতেও তাঁদের মধ্যে সীমাহীন কার্পণ্য দেখা যায়। আমাদের নতুন প্রজন্ম তাঁদের কাছ থেকে কী শিখবে?
ঢাকার মহাসমাবেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একটি কথাও বলেননি। জনজীবনের সমস্যার কথা বললেও মূল টার্গেট ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তাঁর দাবি, বিদেশি প্রভুদের নির্দেশে ফখরুদ্দীন-মইন সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। এ কারণে সরকার এক-এগারোর কুশীলবদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাঁদের সবাইকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। ইতিমধ্যে মওদুদ আহমদ ছয়জনের নামে গণতদন্ত কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে তাতে পালের গোদা ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নাম নেই।
আবারও সেই পুরোনো কাসুন্দি। খালেদা জিয়ার কথা সত্যি হলে এটাও মানতে হবে, বিদেশি প্রভুদের নির্দেশে তাঁকেও জেলখানা থেকে বের করে এনে বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসনে বসানো হয়েছে। খালেদা জিয়া যা বলেছেন তা যদি ভাঁওতাবাজি না হয়, তাহলে তাঁর উচিত হবে সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে পাওয়া বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসনটি ছেড়ে দেওয়া। ২০০১ সালের নির্বাচন নিয়েও একই অভিযোগ করেছিলেন তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি পদত্যাগ করেননি। খালেদা জিয়া কি করবেন? যদি না করেন, তাহলে এসব বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা কেন বলছেন? মানুষকে এতটা আহাম্মক ভাববেন না যে তারা কিছু বোঝে না। যে দল বা নেতাই পরাজিত হন, নির্বাচনকে সাজানো বলেন, আবার সাজানো নির্বাচনের সুযোগ-সুবিধাটুকু পুরো হাতিয়ে নেন।
দেশে যখন হাজারটা সমস্যা, তখন নেতা-নেত্রীরা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। মনে রাখবেন, অতীত বা বর্তমান কারোরই শতভাগ নিষ্কলুষ নয়। আজ বিরোধীদলীয় নেত্রী যেসব অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে এনেছেন, এর একটি অভিযোগ থেকেও কি তাঁর সরকার মুক্ত ছিল? বিএনপির সমর্থক একটা পত্রিকা কার্টুন এঁকে সরকারের নানা রোগের লক্ষণ চিহ্নিত করেছে: দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির সংকট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-শিক্ষক লাঞ্ছনা, মহাদলীয়করণ, চাকরিচ্যুতি ও ওএসডি, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, বিরোধী দল দমন, সাংবাদিক নির্যাতন, পক্ষপাতমূলক নির্বাচন কমিশন, চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন, টিভি চ্যানেল বন্ধ করা।
এখন জনগণ যদি বিরোধীদলীয় নেত্রীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলে, এই তালিকায় একটি শব্দও কি তিনি দেখাতে পারবেন যা তাঁর শাসনামলে ছিল না? আমরা নিশ্চিত বলতে পারি, তিনি পারবেন না। তবে তাঁর শাসনামলে আরও কিছু উপসর্গ ছিল, যা এখন অনেকটাই নেই। যেমন জঙ্গিবাদ তোষণ, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন ও তাদের ঘরবাড়ি-ছাড়া করে উদ্বাস্তু শিবিরে যেতে বাধ্য করা। মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী, আমরা রামশীলের কথা ভুলে যাইনি, ভুলে যাইনি ভোলা বা বাগেরহাটের কথাও। এসব পুরোনো প্রসঙ্গ তুলে আমরা আওয়ামী লীগের, যুবলীগের, ছাত্রলীগের মাস্তানি-সন্ত্রাসকে জায়েজ করতে চাই না। চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি তখন খারাপ হলে এখনো খারাপ। দলীয়করণ, আত্মীয়করণ তখন মন্দ হলে এখনো মন্দ। প্রধানমন্ত্রী যখন দেশের মরে যাওয়া নদী বাঁচাতে টাস্কফোর্স গঠন করেন, তখন তাঁরই দলের সাংসদ রনি পটুয়াখালীতে নদী ভরাট করে মার্কেট বানান। অন্য নদী বাঁচানোর আগে দলীয় সাংসদের দখল করা নদীটি বাঁচানো প্রয়োজন।
২.
প্রধান দুই দলের নেতা-নেত্রীরা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জান কোরবান করতে প্রস্তুত। কিন্তু তাঁদের বক্তব্য-বিবৃতি ও আচরণে এর প্রতিফলন নেই। এই দুই দলের নেতারা যখন একে অপরকে ভারতের দালাল বা পাকিস্তানের চর বলে আখ্যায়িত করেন, তখন মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা কোথায় আছি? বাংলাদেশের রাজনীতি আর বাংলাদেশে নেই। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে গেছে, সেখান থেকে ট্রেনযোগে পাকিস্তানে। আমাদের মনে আরও প্রশ্ন জাগে, এর চেয়ে যোগ্য নেতৃত্বের যোগ্য কি আমরা কখনো হব না? বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে শেখ হাসিনা বলতেন, বিদেশে গ্যাস রপ্তানি করতে রাজি হননি বলেই তাঁকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হয়নি। বিএনপি গ্যাস রপ্তানির মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। এখন খালেদা জিয়া দাবি করছেন, আওয়ামী লীগ বিদেশি প্রভুদের কাছে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়ার শর্তে গদিতে বসেছে। এসব নালিশের মধ্যেও আবার রকমফের আছে।
প্রতি পাঁচ বছর পর যদি বিদেশি প্রভুরা দুই দলকে পালাক্রমে ক্ষমতায় বসিয়ে যান, তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব থাকে কোথায়? আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বাংলাদেশের শুধু প্রধান দুটি দলই নয়, দুই দশক ধরে পালাক্রমে তারা দেশ শাসন করে আসছে। এক দল ক্ষমতায় থাকলে অন্যটি বিরোধী দলে। খালেদা জিয়া দুবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এর আগে একবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এর আগে তাঁরা দুজনই রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করে স্বৈরাচারকে হটিয়েছেন। এর বিনিময়ে জনগণও তাঁদের অনেক কিছু দিয়েছে। পালাক্রমে তাঁরা দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রী হচ্ছেন। যে প্রশ্নটি তাঁদের করা জরুরি তা হলো, তাঁরা জনগণকে কী দিয়েছেন?
বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগ তাকে স্বৈরাচার বলত। এখন আওয়ামী লীগকে বিএনপি স্বৈরাচার বলে, বিদেশের দালাল বলে। গত নির্বাচনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী তারা দেশের ৭৯ শতাংশ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করে। আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৪৬ শতাংশ, বিএনপি ৩৩ শতাংশ। এরা যদি বিদেশের দালাল ও সেবাদাস হয়, তাহলে দেশের স্বাধীনতা থাকে কোথায়?
মাঝেমধ্যে আমাদের সন্দেহ হয়, তারা কি সত্যি সত্যি পরস্পরকে শত্রু ভাবে, না অলিখিত বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে আগ্রহী? তারা নিজ দলের দুর্নীতিবাজের বিচার তো করেইনি, বিরোধী দলের কজন দুর্নীতিবাজের বিচার করেছে? হয় তারা যা বলে তা বিশ্বাস করে না, জনগণকে ধোঁকা দিতে এসব কথা বলে; অথবা বিচার করার ক্ষমতাই তাদের নেই।
যদি তারা খেয়োখেয়িতে ব্যস্ত না থাকত, যদি তারা গুন্ডা-মাস্তান, গডফাদার, গডব্রাদার না পুষত, যদি তারা সিভিল ও নন-সিভিল আমলাদের দলীয়করণ না করত! বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে এক দল মোসাহেব তৈরি করেছে, আওয়ামী লীগ আরেক দল মোসাহেব বানাচ্ছে। বিএনপি এক দল গুন্ডা-মাস্তান পুষেছে, আওয়ামী লীগ আরেক দল পুষছে। বিএনপির আমলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জাতীয়তাবাদী শিক্ষকদের দৌরাত্ম্য ছিল, ছাত্রদল হলে হলে মাস্তানি চালাত; এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আওয়ামী শিক্ষকদের দৌরাত্ম্য চলছে, ছাত্রলীগ হলে হলে মাস্তানি, চাঁদাবাজি করে বেড়াচ্ছে। এর শেষ কোথায়?
দুই দলের নেতাদের কথা ও বক্তব্য-বিবৃতিতে যতই পার্থক্য থাকুক, কর্ম ও আচরণে পার্থক্যটি ধীরে ধীরে ঘুচে যাচ্ছে। বিএনপির আমলে যেসব অপকর্ম হয়েছে, এখনো যদি তা-ই চলতে থাকে, তাহলে ক্ষমতার হাতবদলে আমজনতার কী লাভ হলো? অনেকেই বিশ্বাস করে, আসলে দুই দলই বুঝে গেছে যে তাদের কোনো বিকল্প নেই। পালা করে তারা ক্ষমতায় আসবে এবং বিরোধী দলের আসনে বসবে। মানুষ যে অন্ধকারে ছিল, সেই অন্ধকারেই থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী যখন এক-এগারোর কুশীলবদের নিয়ে বাহাস করছিলেন, কারা জরুরি সরকারকে এনেছে তার পক্ষে যুক্তি উত্থাপন করছিলেন, তখনই টেলিভিশনগুলো আইলায় আক্রান্ত মানুষের আহাজারি দেখাচ্ছিল। আইলায় লাখ লাখ লোক ঘরবাড়ি হারিয়েছে, খেতের শস্য, গবাদিপশু হারিয়েছে। সেই সর্বহারা মানুষগুলোর জন্য কী করেছে সরকার? কী করেছে বিরোধী দল? রাজধানীর মহাসমাবেশ বা টঙ্গীর বিশাল জনসভায় দেওয়া নেত্রীদের বুলন্দ আওয়াজ আইলায় আক্রান্ত মানুষকে কোনো সান্ত্বনা দিতে পারেনি, পারবে না। অতীতের বড় বড় দুর্নীতির কথা বাদই দিলাম; আইলা আঘাত হেনেছে এই সরকারের আমলেই, সেখানে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ নিয়ে যে দুর্নীতি-অনিয়ম হয়েছে তার দায় তো সরকার এড়াতে পারে না।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়, ‘দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ’।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments