দমন-পীড়ন-হত্যাকাণ্ড ও নীরব ওবামা by শামুস কুকে
থাইল্যান্ডের রাজপথে যখন বিক্ষোভকারীদের হত্যা করা হচ্ছে, তখন হোয়াইট হাউসের নীরবতায় সন্দেহ জাগে। নীরবতা অনেক সময় ষড়যন্ত্রের সমার্থক। কল্পনা করা যায়, ভেনেজুয়েলার সরকার এ রকম হত্যাকাণ্ড চালালে মার্কিন মিডিয়া ও ওবামা জোরেশোরে এর নিন্দা জানাতেন। অথচ থাইল্যান্ডে রক্তগঙ্গা বয়ে গেলেও তাঁরা নীরব।
এ নীরবতার ব্যাখ্যা মেলে যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ডের সম্পর্কের ইতিহাসে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় থাইল্যান্ডই ছিল এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ‘কমিউনিস্টবিরোধী’ দুর্গ। এখান থেকেই থাইল্যান্ডসহ চীন, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ও পুঁজিবাদবিরোধী অন্য দেশগুলোর বিরুদ্ধে তত্পরতা চালানো হতো। এভাবে থাইল্যান্ড পরিণত হয় যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত রাষ্ট্রে এবং পায় অস্ত্র, অর্থ ও থাইল্যান্ডের কমিউনিস্টদের দমনে মার্কিন সরকারের গোয়েন্দা-সহযোগিতা। এ সম্পর্কের জের ধরেই থাইল্যান্ডে একের পর এক সামরিক সরকার ক্ষমতায় বসে এবং অগণিত প্রতিবাদীকে হত্যা করে যায়। আগে এই প্রতিবাদীদের বলা হতো ‘কমিউনিস্ট’, আর এখন বলা হয় ‘সন্ত্রাসবাদী’।
থাই-যুক্তরাষ্ট্রের এই আঁতাত ক্ষতিগ্রস্ত হয় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট থাকসিন সিনাওয়াত্রার সময়ে। তিনি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার উদ্যোগ নেন, আইএমএফকে ‘না’ বলে দেন। এশিয়ান টাইমস তাঁর এই পদক্ষেপকে বর্ণনা করে, ‘চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা-সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র তাঁর ওপর এমনই নাখোশ হয় যে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে সেনা অভ্যুত্থানে থাকসিনের ক্ষমতাচ্যুত হওয়াকে নীরবে অভিনন্দন জানায়।’ থাকসিন কেবল পররাষ্ট্রনীতিই বদলানোর উদ্যোগ নেননি, দেশের ভেতরে তিনি দরিদ্রবান্ধব অনেক কর্মসূচি হাতে নেন। এটাই চটিয়ে দেয় থাইল্যান্ডের অভিজাত শ্রেণীকে। পরিণামে সেনাবাহিনীর হাতে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন।
প্রায়শই যুক্তরাষ্ট্র তাদের অনুগত নয় এমন সরকারগুলোকে উচ্ছেদ করার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সেনাবাহিনীর কিছু অংশকে ঘুষ দিয়ে রাজি করায়। টিম ওয়েইনারসের সিআইএর ইতিহাস নিয়ে লেখা লিগ্যাসি অব অ্যাশেস বইয়ে এ বিষয়ে বিশদ বিবরণ দেওয়া আছে। যখনই কোথাও যুক্তরাষ্ট্রের মদদে সেনা অভ্যুত্থান হয়, তখনই মার্কিন সরকার ও করপোরেট মিডিয়া অনেকটা নীরবে তাতে সম্মতি জানায়; কিন্তু যখনই যুক্তরাষ্ট্রের কোনো পুতুল সরকার উচ্ছেদ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখনই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রতিহিংসা আর নিন্দার জোয়ার বয়ে যায়।
এশিয়ান টাইমস জানাচ্ছে, ‘২০০৬ সালের অভ্যুত্থানের মূল হোতাদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের লোক বলে পরিচিত। এর মধ্যে আছেন অভ্যুত্থানের নীলনকশাকারী ও সিআইএর প্রশিক্ষিত সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান প্রাসং সুনসিরি এবং প্রিভি কাউন্সিলের সভাপতি প্রেম তিনসুলানন্দা। প্রাসং খোলাখুলি অভ্যুত্থান ঘটানোয় নিজের ভূমিকা স্বীকার করেছেন...।’
থাই প্রেসিডেন্ট থাকসিন সিনাওয়াত্রার বিরুদ্ধে এই সেনা অভ্যুত্থানই হলো বর্তমান সংকটের মূল কারণ। থাইল্যান্ডের গরিব মজুর ও কৃষকদের বড় অংশই থাকসিনকে নিজেদের প্রেসিডেন্ট বলে মনে করে। এখনো তারা তাঁর ফিরে আসার দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। এমনকি তাদের দাবি আদায়ে তারা খুবই কঠিন ও সহিংস পথ নিতেও দ্বিধা করেনি। যদি তারা বিজয়ী হয়, তাহলে থাইল্যান্ডে আবার গণতন্ত্র ফিরে আসবে। থাইল্যান্ড এখন এর ধনিক শ্রেণী ও বঞ্চিত দরিদ্রদের মধ্যে সংঘাতে কাঁপছে। গরিবদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ব্যাংকক কয়েক সপ্তাহ ধরে অচল। সরকার এখন সেনাবাহিনীকে দিয়ে দমন-পীড়ন আর হত্যাকাণ্ড দিয়ে এই বিদ্রোহ দমনের পথ নিয়েছে।
থাইল্যান্ডের এই গরিবদের সমর্থনে প্রেসিডেন্ট ওবামা একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। আর এই নীরবতা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই নীরব ছাড়পত্রের সুযোগে থাইল্যান্ডের ধনিক শ্রেণীর সরকার প্রতিবাদকারীদের নির্দয়ভাবে দমন করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রই হলো থাই রপ্তানিপণ্যের প্রধান ক্রেতা। একই সঙ্গে তারা থাইল্যান্ডে বিরাট আকারের সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। এ অবস্থায় ওবামার একটি জোরালো উচ্চারণ থাই সরকারকে আরও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারত। কিন্তু তিনি নীরব থাকবেন বলেই ঠিক করেছেন।
এ পর্যন্ত ২০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। কিন্তু মার্কিন মদদপুষ্ট এই সরকারকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে শত শত কিংবা হাজারে হাজারে মানুষকে খুন করতে হতে পারে। এমনকি এরই মধ্যে গুপ্তঘাতক দিয়ে বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান এক নেতাকে হত্যা করা হয়েছে।
সেনা সরকারকে সমর্থন করার ধারা বুশ সরকারের মতোই বজায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। থাইল্যান্ডের বর্তমান রক্তপাতের দায় তাই ওবামার ওপরও বর্তায়। প্রধানমন্ত্রী আপিসিত ভেজ্জাজিওয়া ক্ষমতায় টিকে থাকলে উত্তরোত্তর সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হবে। দরিদ্র শ্রেণীগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে থাই অভিজাত শ্রেণী, সেনাবাহিনী ও বিদেশমুখী ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা আরও জোটবদ্ধ হবে। আজ যদি থাইল্যান্ডের জনগণ তাদের খুনে সরকারকে উচ্ছেদ করতে সমর্থ না হয়, তাহলে তার দায় ওবামাকেও নিতে হবে। কেননা এই সরকার তখন দীর্ঘ মেয়াদে দমন-পীড়ন ও হত্যা-নির্যাতন দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা অটুট রাখার চেষ্টা করে যাবে।
থাইল্যান্ডের চলমান বিক্ষোভের পরিণতি যা-ই হোক, থাইল্যান্ডের গ্রামীণ দরিদ্র শ্রেণীগুলোর রাজনৈতিক জাগরণ ঘটেছে। তারাই হয়ে উঠেছে সেনা-সমর্থিত সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ।
কাউন্টারকারেন্টস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত।
শামুস কুকে: ব্রিটিশ লেখক ও সমাজকর্মী।
এ নীরবতার ব্যাখ্যা মেলে যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ডের সম্পর্কের ইতিহাসে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় থাইল্যান্ডই ছিল এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ‘কমিউনিস্টবিরোধী’ দুর্গ। এখান থেকেই থাইল্যান্ডসহ চীন, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ও পুঁজিবাদবিরোধী অন্য দেশগুলোর বিরুদ্ধে তত্পরতা চালানো হতো। এভাবে থাইল্যান্ড পরিণত হয় যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত রাষ্ট্রে এবং পায় অস্ত্র, অর্থ ও থাইল্যান্ডের কমিউনিস্টদের দমনে মার্কিন সরকারের গোয়েন্দা-সহযোগিতা। এ সম্পর্কের জের ধরেই থাইল্যান্ডে একের পর এক সামরিক সরকার ক্ষমতায় বসে এবং অগণিত প্রতিবাদীকে হত্যা করে যায়। আগে এই প্রতিবাদীদের বলা হতো ‘কমিউনিস্ট’, আর এখন বলা হয় ‘সন্ত্রাসবাদী’।
থাই-যুক্তরাষ্ট্রের এই আঁতাত ক্ষতিগ্রস্ত হয় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট থাকসিন সিনাওয়াত্রার সময়ে। তিনি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার উদ্যোগ নেন, আইএমএফকে ‘না’ বলে দেন। এশিয়ান টাইমস তাঁর এই পদক্ষেপকে বর্ণনা করে, ‘চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা-সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র তাঁর ওপর এমনই নাখোশ হয় যে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে সেনা অভ্যুত্থানে থাকসিনের ক্ষমতাচ্যুত হওয়াকে নীরবে অভিনন্দন জানায়।’ থাকসিন কেবল পররাষ্ট্রনীতিই বদলানোর উদ্যোগ নেননি, দেশের ভেতরে তিনি দরিদ্রবান্ধব অনেক কর্মসূচি হাতে নেন। এটাই চটিয়ে দেয় থাইল্যান্ডের অভিজাত শ্রেণীকে। পরিণামে সেনাবাহিনীর হাতে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন।
প্রায়শই যুক্তরাষ্ট্র তাদের অনুগত নয় এমন সরকারগুলোকে উচ্ছেদ করার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সেনাবাহিনীর কিছু অংশকে ঘুষ দিয়ে রাজি করায়। টিম ওয়েইনারসের সিআইএর ইতিহাস নিয়ে লেখা লিগ্যাসি অব অ্যাশেস বইয়ে এ বিষয়ে বিশদ বিবরণ দেওয়া আছে। যখনই কোথাও যুক্তরাষ্ট্রের মদদে সেনা অভ্যুত্থান হয়, তখনই মার্কিন সরকার ও করপোরেট মিডিয়া অনেকটা নীরবে তাতে সম্মতি জানায়; কিন্তু যখনই যুক্তরাষ্ট্রের কোনো পুতুল সরকার উচ্ছেদ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখনই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রতিহিংসা আর নিন্দার জোয়ার বয়ে যায়।
এশিয়ান টাইমস জানাচ্ছে, ‘২০০৬ সালের অভ্যুত্থানের মূল হোতাদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের লোক বলে পরিচিত। এর মধ্যে আছেন অভ্যুত্থানের নীলনকশাকারী ও সিআইএর প্রশিক্ষিত সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান প্রাসং সুনসিরি এবং প্রিভি কাউন্সিলের সভাপতি প্রেম তিনসুলানন্দা। প্রাসং খোলাখুলি অভ্যুত্থান ঘটানোয় নিজের ভূমিকা স্বীকার করেছেন...।’
থাই প্রেসিডেন্ট থাকসিন সিনাওয়াত্রার বিরুদ্ধে এই সেনা অভ্যুত্থানই হলো বর্তমান সংকটের মূল কারণ। থাইল্যান্ডের গরিব মজুর ও কৃষকদের বড় অংশই থাকসিনকে নিজেদের প্রেসিডেন্ট বলে মনে করে। এখনো তারা তাঁর ফিরে আসার দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। এমনকি তাদের দাবি আদায়ে তারা খুবই কঠিন ও সহিংস পথ নিতেও দ্বিধা করেনি। যদি তারা বিজয়ী হয়, তাহলে থাইল্যান্ডে আবার গণতন্ত্র ফিরে আসবে। থাইল্যান্ড এখন এর ধনিক শ্রেণী ও বঞ্চিত দরিদ্রদের মধ্যে সংঘাতে কাঁপছে। গরিবদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ব্যাংকক কয়েক সপ্তাহ ধরে অচল। সরকার এখন সেনাবাহিনীকে দিয়ে দমন-পীড়ন আর হত্যাকাণ্ড দিয়ে এই বিদ্রোহ দমনের পথ নিয়েছে।
থাইল্যান্ডের এই গরিবদের সমর্থনে প্রেসিডেন্ট ওবামা একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। আর এই নীরবতা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই নীরব ছাড়পত্রের সুযোগে থাইল্যান্ডের ধনিক শ্রেণীর সরকার প্রতিবাদকারীদের নির্দয়ভাবে দমন করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রই হলো থাই রপ্তানিপণ্যের প্রধান ক্রেতা। একই সঙ্গে তারা থাইল্যান্ডে বিরাট আকারের সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। এ অবস্থায় ওবামার একটি জোরালো উচ্চারণ থাই সরকারকে আরও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারত। কিন্তু তিনি নীরব থাকবেন বলেই ঠিক করেছেন।
এ পর্যন্ত ২০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। কিন্তু মার্কিন মদদপুষ্ট এই সরকারকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে শত শত কিংবা হাজারে হাজারে মানুষকে খুন করতে হতে পারে। এমনকি এরই মধ্যে গুপ্তঘাতক দিয়ে বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান এক নেতাকে হত্যা করা হয়েছে।
সেনা সরকারকে সমর্থন করার ধারা বুশ সরকারের মতোই বজায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। থাইল্যান্ডের বর্তমান রক্তপাতের দায় তাই ওবামার ওপরও বর্তায়। প্রধানমন্ত্রী আপিসিত ভেজ্জাজিওয়া ক্ষমতায় টিকে থাকলে উত্তরোত্তর সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হবে। দরিদ্র শ্রেণীগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে থাই অভিজাত শ্রেণী, সেনাবাহিনী ও বিদেশমুখী ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা আরও জোটবদ্ধ হবে। আজ যদি থাইল্যান্ডের জনগণ তাদের খুনে সরকারকে উচ্ছেদ করতে সমর্থ না হয়, তাহলে তার দায় ওবামাকেও নিতে হবে। কেননা এই সরকার তখন দীর্ঘ মেয়াদে দমন-পীড়ন ও হত্যা-নির্যাতন দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা অটুট রাখার চেষ্টা করে যাবে।
থাইল্যান্ডের চলমান বিক্ষোভের পরিণতি যা-ই হোক, থাইল্যান্ডের গ্রামীণ দরিদ্র শ্রেণীগুলোর রাজনৈতিক জাগরণ ঘটেছে। তারাই হয়ে উঠেছে সেনা-সমর্থিত সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ।
কাউন্টারকারেন্টস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত।
শামুস কুকে: ব্রিটিশ লেখক ও সমাজকর্মী।
No comments