আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি: দ্বন্দ্ব নিরসনের পথ কী -রাজনীতি by এম এম আকাশ
শিরোনামের প্রশ্নটির উত্তরদানের আগে আমাদের প্রথমে একটু আধুনিক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। উন্নত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে বর্তমানে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থাই প্রধান ধরন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এসব রাষ্ট্রে প্রধান দুই দলই মৌলিক ধনতান্ত্রিক আদর্শের অনুসারী হয়েও রাষ্ট্রক্ষমতার প্রশ্নে বিভক্ত অবস্থান গ্রহণ করে। ফলে একটি দল নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা গ্রহণ করলে অন্য দলটি থাকে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায়। বুর্জোয়া শাসকশ্রেণীর জন্য এই ব্যবস্থাটি বেশ পছন্দনীয়। কারণ, এতে ক্ষমতার বা গদির পরিবর্তন হলেও ধনতান্ত্রিক নীতির পরিবর্তন হয় না। তবে এসব ক্ষেত্রে দুটি দলের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা নানা পার্থক্য থাকাই স্বাভাবিক। নয়তো বুর্জোয়াদের দুটি দল তৈরি হলো কীভাবে? সচরাচর ‘ধনতন্ত্রের’ আদর্শের মধ্যেই দুটি প্রবণতার অস্তিত্ব সম্ভব—একটিকে বলা যেতে পারে ‘রক্ষণশীল’ প্রবণতা, অন্যটিকে তুলনামূলকভাবে ‘উদারনৈতিক’ প্রবণতা। আমেরিকায় যে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা, তার মূলে রয়েছে এই বিষয়টি। সে জন্যই সেখানে একদিকে তৈরি হয়েছে রক্ষণশীল ‘রিপাবলিকান’ দল, অন্যদিকে রয়েছে অপেক্ষাকৃত উদার ‘ডেমোক্রেটিক’ দল। তবে এই বিরোধ বিচারের সময় শাসকশ্রেণীর অন্যতম প্রতিনিধি ‘হেনরি ফোর্ড’-এর কথাটিও আমাদের মনে রাখা উচিত। আমেরিকান পুঁজিপতি হেনরি ফোর্ড বলেছিলেন, ‘আমি এই দুই ঘোড়ার ওপরই বাজি রাখি। সে জন্য যে-ই জিতুক, আমি কখনো হারি না।’ এ জন্যই উন্নত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সহজে কোনো তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব হয় না।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে আমরা আজ আওয়ামী লীগ-বিএনপির যে দুর্বল বিস্তীর্ণ দ্বিদলীয় ব্যবস্থাটি ১৯৯০ সালের পর থেকে দেখে আসছি, সেটি কি অনুরূপ স্থীতিশীলতা অর্জনে সক্ষম হবে, নাকি বাংলাদেশের ইতিহাস একটু ভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান? হলে সেই ভিন্ন সম্ভাবনার সম্ভাব্য চেহারাটা কী রকম হতে পারে?
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আমরা যে বিভেদ দেখছি, এটা এক দিনে তৈরি হয়নি। এই বিভেদ তৈরি হওয়ার পেছনে একটি ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। এই ঐতিহাসিক পটভূমি না বুঝলে বিভেদটা বোঝা যাবে না এবং এই ঐতিহাসিক পটভূমি আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম একটি ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছে। এ সত্যটাকে আগে আমাদের প্রথম স্বীকার করে নিতে হবে। মুসলমানদের জন্য এক দেশ হবে আর হিন্দু হলে আরেক দেশ হবে—এই মত সঠিক হলে পাকিস্তান ভাঙার প্রয়োজন ছিল না। এই মত সঠিক নয় বলেই পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ হবে সব ধর্ম-মতনির্বিশেষে বাঙালি জাতির দেশ। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই এই জাতির সদস্য হবে।
কোনো দেশে স্বাধীনতার পর স্বাধীনতা সংহত করার জন্য দেশের অভ্যন্তরে অবস্থানরত পরাজিত শক্তির মোকাবিলা করতে হয়। এদের মধ্যে কেউ ছদ্মবেশে আবার কেউ মুখোশ পরা অবস্থায় থাকে। দুই ক্ষেত্রেই শত্রুকে দমনে বঙ্গবন্ধু ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থতার মূল কারণ, তিনি সবাইকে বিশ্বাস করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, সবাই পরিবর্তিত হয়েছে। তিনি একটি উদার অবস্থান নিয়েছিলেন। সেই উদার অবস্থান নেওয়ার কারণে শত্রুরা তাঁর আশপাশে থেকে গিয়েছিল। তারা পরিবর্তিত হয়নি। অথচ তিনি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেননি। শত্রুরা তাদের নীতিকে বিসর্জন দেয়নি। এ জন্য তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ছিল, ছিল জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলো। অর্থাত্ পরাজিত শক্তি। মার্কিনপন্থীরা খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে প্রথম থেকেই শত্রুর অবস্থানে ছিল। স্বাধীনতাসংগ্রামের সময়ও তিনি শত্রু ছিলেন। তাঁর প্রস্তাব ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে একটি কনফেডারেশন করার। স্বাধীনতার পক্ষে তাঁর প্রস্তাব ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমান এটি জানতেন। জানতেন কারা তাঁর শত্রু। কিন্তু তিনি তাদের বিরুদ্ধে অনমনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। এই শত্রুরা সময় ঠিক করল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দেওয়ার পর দেশ দক্ষিণ পন্থার দিকে চলে গেল।
শুধু দেশ চলে গেল না, আওয়ামী লীগও নতুন দল হয়ে গেল। এর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নে আমলাতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পতন ঘটল। এর ফলে আওয়ামী লীগের আর কোনো বামপন্থী টান থাকল না। আওয়ামী লীগ প্রথমে সমাজতন্ত্রের পক্ষে এসেছিল, সমাজতন্ত্রের সুবিধা বেশি হবে বলে। যখন অনুকূল হাওয়া তারা পেল না, তখন তারা মনে করল, সমাজতন্ত্রে থাকার আর কোনো কারণ নেই। এদিকে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর মৃত বঙ্গবন্ধুর শক্তি আরও বেড়ে গেল। দলের কিছু নেতা ভাবলেন, শেখ হাসিনাকে নিয়ে আসতে পারলে কাজ হবে। এভাবে আওয়ামী লীগ বিকশিত হতে থাকল।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে যারা বেশি লাভবান হয়েছে, তারা তৈরি করল নতুন বিএনপি। লাভবানদের লক্ষ্য হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন নীতিমালার বিরোধিতা। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এবং স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করলেন বিএনপি। কারণ, তাঁরা জানতেন, পরাজিত শক্তির সঙ্গে হাত না মেলালে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা যাবে না। আওয়ামী লীগের যাঁরা চাইলেন আগের নীতিতে থাকতে, তাঁরা একত্রে মিলে প্রথমে বাকশাল করলেন। আর বাকি যাঁরা বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর পিছু হটে গিয়েছিলেন, তাঁরা সোভিয়েত ভাঙার পর নিশ্চিত হলেন যে, এখন ধনতন্ত্রই করতে হবে। এখন আমরা সেই পরিবর্তিত দক্ষিণপন্থী আওয়ামী লীগকে দেখতে পাচ্ছি। এই যে পরিবর্তন হলো, তা মূলত হলো নেতা পর্যায়ে। তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের একেক নেতা একেকভাবে আছেন। সর্বশেষ যাঁরা আওয়ামী লীগে থাকলেন, তাঁদের পরে আর একটু অবনতি হলো। তাঁরা মনে করলেন, যে ভোটের রাজনীতি বর্তমানে চালু আছে, তাতে বিএনপির হাতে ৪০ ভাগ ভোট আর আওয়ামী লীগের হাতে ৪০ ভাগ ভোট। আর ২০ ভাগ ভোট বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এই ২০ ভাগের মধ্যে অবশ্য ১০ ভাগ রয়েছে মৌলবাদী ভোট। তাঁরা ভাবলেন, ১০ ভাগ ইসলামি ভোট আমাদের সঙ্গে রাখতে পারলে আমরা জিতব। এই ভোটের জন্য কখনো আমিনীর সঙ্গে আবার কখনো এরশাদের সঙ্গে তাঁদের যেতে হয়।
আর উল্টো দিকে বিএনপিরও একই অবস্থা। এই ভোটের জন্য তাদের কখনো জামায়াতের সঙ্গে আবার কখনো এরশাদের সঙ্গে যেতে হয়। এ জন্য এই দুই প্রধান বুর্জোয়া শক্তির মধ্যে ক্ষমতার প্রশ্ন ছাড়া মৌলিক কোনো দ্বন্দ্ব নেই। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যে দ্বন্দ্বটুকু আছে, তাও ধীরে ধীরে কমে যাবে। অর্থাত্ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে শেষাবধি উপরিকাঠামোর কিছু ইস্যু বাদ দিলে মৌলিক কোনো পার্থক্য থাকবে না। এর পরও অবশ্য ইতিহাসের এবং উত্তরাধিকারের পার্থক্য থাকবে। আর একটি পার্থক্য থাকবে তা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর পদ একটি, দুটি নয়। এ জন্য দুজনই প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।
বর্তমানে জিয়াউর রহমান ও বিএনপি ১৯৭৫-পরবর্তী দক্ষিণ পন্থার প্রতীক হিসেবে বিরাজমান। শেখ হাসিনা অবশ্য দক্ষিণ পন্থা ও অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের একটি মিশ্র প্রতীক হিসেবে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বাদ দিয়ে দক্ষিণপন্থী একটি দল হয়ে গেছে।
এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বন্দ্ব মেটানোর সম্ভাব্য রাস্তা দুটি। একটি হচ্ছে দেশের সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরাচারী শক্তিগুলো থেকে মুক্ত হয়ে দেশে একটি ভদ্র দ্বিদলীয় বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আর দ্বিতীয় রাস্তাটি হচ্ছে জামায়াত ও স্বৈরাচারের বিচ্ছিন্নতা এবং পরাজয়ের কারণে বিএনপির শক্তিহানি, ক্রমবিলুপ্তি ও খণ্ডায়ন। তখন দেশে একমাত্র দক্ষিণপন্থী দল হবে আওয়ামী লীগ এবং প্রধান বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেরই কোনো না কোনো অপেক্ষাকৃত রেডিক্যাল একটি রাজনৈতিক দল।
আমার প্রস্তাবিত এই দুই সমাধানের যুক্তি-ভিত্তি আরেকটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আমাদের দেশে যে দুটি অপশক্তি বুর্জোয়া গণতন্ত্রের প্রধান শত্রু, তারা হচ্ছে মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী এবং ‘সামরিক বাহিনীর মধ্যে উচ্চাভিলাষী জেনারেলরা’। বামপন্থীরা যে গণবিপ্লবের কথা বলে, তা বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যেই তারা এযাবত্ পরিচালনা করছে বলে তাদের বর্তমানে শাসকশ্রেণীও ‘গণতন্ত্রের’ শত্রু হিসেবে মনে করছে না। কিন্তু অন্যদিকে মৌলবাদীরা এখনো জিহাদের মাধ্যমে ইসলামি শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে এবং তাদের জঙ্গি-সম্পৃক্ততার অনেক প্রমাণও রয়েছে, যেহেতু তারা বর্তমানে গণতন্ত্রের ১ নম্বর বৈরী শক্তি। এ ছাড়া সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিপদ হিসেবে নিকট অতীতে একাধিকবার আবির্ভূত হয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে সামরিক বাহিনী ও ‘মৌলবাদের’ সঙ্গে আমাদের দেশে অপেক্ষাকৃত বেশি ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে রক্ষণশীল বিএনপি দলটির। তবে উদারনৈতিক আওয়ামী লীগও যে এই শত্রুদের সঙ্গে কখনো কখনো খেলেছে এবং কৌশলগত ঐক্যের মাধ্যমে বিএনপিকে ভোটযুদ্ধে পরাজিত করার প্রয়াস পেয়েছে, সেটিও আমাদের স্বীকার করতে হবে।
এই অবস্থায় এ দেশের বুর্জোয়া শাসকশ্রেণী যারা দুই দলেই আছে, তারা যদি একটি পরিষ্কার ভদ্র ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’ চায়, তাহলে তাদের চিরতরে ‘মৌলবাদী-জঙ্গি’ শক্তির বিষদাঁত ভেঙে ফেলতে হবে এবং সামরিক বাহিনীকেও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির অনুগত বাহিনীতে পরিণত করার জন্য দৃঢ়ভাবে চেষ্টা করতে হবে।
ভালো খবর হচ্ছে, বর্তমান আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্য বাংলাদেশে এই দুটি ক্ষেত্রে আগের চেয়ে অনেক বেশি অনুকূল! ইউরোপ ও ভারতের অবস্থান এ প্রশ্নে কিছুটা ইতিবাচক এবং খোলামেলা বলেই মনে হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়টি এখনো অত পরিষ্কার নয়। জামায়াতে ইসলামীর মতো মৌলবাদী দলকে তারা এখনো পরিত্যাগ করেছে বলে মনে হয় না। আর চীনকে দমানোর কৌশল হিসেবে ভারত-বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির কৌশল যুক্তরাষ্ট্র ছাড়বে বলেও মনে হয় না। ফলে ‘সামরিক বাহিনী’ ও মৌলবাদকে এখনো নাকচ করে দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। যা-ই হোক, সব মিলিয়ে ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’ যদি দেশীয় শাসকদের মূল কথা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে মৌলবাদী শক্তি ও সামরিক ষড়যন্ত্রকারীদের অবশ্যই পরাজিত করতে হবে। সেটা করার পরিণতি আপাত বিচারে দুই রকম হতে পারে।
শাসকশ্রেণীর জন্য সবচেয়ে কাম্য হচ্ছে ‘মৌলবাদ’ ও ‘উচ্চাভিলাষী’ জেনারেলদের থেকে মুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই একটি অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল দ্বিদলীয় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্ম দেবে এবং শাসকশ্রেণীর স্থিতিশীলতা অক্ষুণ্ন থাকবে।
অথবা এই প্রক্রিয়ায় রক্ষণশীল বিএনপি নিজেকে পরিবর্তন করতে অক্ষম হবে বিধায় ক্রমবর্ধমান বিভক্তি ও খণ্ডীকরণের মাধ্যমে ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাবে। তখন সেই শূন্য জায়গায় প্রধান বিরোধী দল হিসেবে অপেক্ষাকৃত রেডিক্যাল বামপন্থীদের আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে। অবশ্য এই দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি অনেকখানি নির্ভর করবে বর্তমান শাসক দল আওয়ামী লীগ ‘মৌলবাদ’ ও ‘জেনারেলদের’ বিরুদ্ধে কতখানি আপসহীন অদোদুল্যমান ভূমিকা গ্রহণ করে, তার ওপর।
তৃতীয় একটি সম্ভাবনার কথা না বললেই নয়। বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব (ক্যাওস থিওরি) অনুযায়ী বলা যায়, অসংখ্য পরস্পরবিরোধী শক্তির টালমাটাল ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মাধ্যমে আবার বিশৃঙ্খলাও ফিরে আসতে পারে।
[এই লেখার ওপর আপনার মতামত ও প্রতিক্রিয়া ছাপাতে আমরা আগ্রহী। বি. স ]
এম এম আকাশ : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
akash92@hotmail.com
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে আমরা আজ আওয়ামী লীগ-বিএনপির যে দুর্বল বিস্তীর্ণ দ্বিদলীয় ব্যবস্থাটি ১৯৯০ সালের পর থেকে দেখে আসছি, সেটি কি অনুরূপ স্থীতিশীলতা অর্জনে সক্ষম হবে, নাকি বাংলাদেশের ইতিহাস একটু ভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান? হলে সেই ভিন্ন সম্ভাবনার সম্ভাব্য চেহারাটা কী রকম হতে পারে?
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আমরা যে বিভেদ দেখছি, এটা এক দিনে তৈরি হয়নি। এই বিভেদ তৈরি হওয়ার পেছনে একটি ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। এই ঐতিহাসিক পটভূমি না বুঝলে বিভেদটা বোঝা যাবে না এবং এই ঐতিহাসিক পটভূমি আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম একটি ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছে। এ সত্যটাকে আগে আমাদের প্রথম স্বীকার করে নিতে হবে। মুসলমানদের জন্য এক দেশ হবে আর হিন্দু হলে আরেক দেশ হবে—এই মত সঠিক হলে পাকিস্তান ভাঙার প্রয়োজন ছিল না। এই মত সঠিক নয় বলেই পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ হবে সব ধর্ম-মতনির্বিশেষে বাঙালি জাতির দেশ। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই এই জাতির সদস্য হবে।
কোনো দেশে স্বাধীনতার পর স্বাধীনতা সংহত করার জন্য দেশের অভ্যন্তরে অবস্থানরত পরাজিত শক্তির মোকাবিলা করতে হয়। এদের মধ্যে কেউ ছদ্মবেশে আবার কেউ মুখোশ পরা অবস্থায় থাকে। দুই ক্ষেত্রেই শত্রুকে দমনে বঙ্গবন্ধু ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থতার মূল কারণ, তিনি সবাইকে বিশ্বাস করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, সবাই পরিবর্তিত হয়েছে। তিনি একটি উদার অবস্থান নিয়েছিলেন। সেই উদার অবস্থান নেওয়ার কারণে শত্রুরা তাঁর আশপাশে থেকে গিয়েছিল। তারা পরিবর্তিত হয়নি। অথচ তিনি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেননি। শত্রুরা তাদের নীতিকে বিসর্জন দেয়নি। এ জন্য তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ছিল, ছিল জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলো। অর্থাত্ পরাজিত শক্তি। মার্কিনপন্থীরা খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে প্রথম থেকেই শত্রুর অবস্থানে ছিল। স্বাধীনতাসংগ্রামের সময়ও তিনি শত্রু ছিলেন। তাঁর প্রস্তাব ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে একটি কনফেডারেশন করার। স্বাধীনতার পক্ষে তাঁর প্রস্তাব ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমান এটি জানতেন। জানতেন কারা তাঁর শত্রু। কিন্তু তিনি তাদের বিরুদ্ধে অনমনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। এই শত্রুরা সময় ঠিক করল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দেওয়ার পর দেশ দক্ষিণ পন্থার দিকে চলে গেল।
শুধু দেশ চলে গেল না, আওয়ামী লীগও নতুন দল হয়ে গেল। এর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নে আমলাতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পতন ঘটল। এর ফলে আওয়ামী লীগের আর কোনো বামপন্থী টান থাকল না। আওয়ামী লীগ প্রথমে সমাজতন্ত্রের পক্ষে এসেছিল, সমাজতন্ত্রের সুবিধা বেশি হবে বলে। যখন অনুকূল হাওয়া তারা পেল না, তখন তারা মনে করল, সমাজতন্ত্রে থাকার আর কোনো কারণ নেই। এদিকে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর মৃত বঙ্গবন্ধুর শক্তি আরও বেড়ে গেল। দলের কিছু নেতা ভাবলেন, শেখ হাসিনাকে নিয়ে আসতে পারলে কাজ হবে। এভাবে আওয়ামী লীগ বিকশিত হতে থাকল।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে যারা বেশি লাভবান হয়েছে, তারা তৈরি করল নতুন বিএনপি। লাভবানদের লক্ষ্য হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন নীতিমালার বিরোধিতা। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এবং স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করলেন বিএনপি। কারণ, তাঁরা জানতেন, পরাজিত শক্তির সঙ্গে হাত না মেলালে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা যাবে না। আওয়ামী লীগের যাঁরা চাইলেন আগের নীতিতে থাকতে, তাঁরা একত্রে মিলে প্রথমে বাকশাল করলেন। আর বাকি যাঁরা বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর পিছু হটে গিয়েছিলেন, তাঁরা সোভিয়েত ভাঙার পর নিশ্চিত হলেন যে, এখন ধনতন্ত্রই করতে হবে। এখন আমরা সেই পরিবর্তিত দক্ষিণপন্থী আওয়ামী লীগকে দেখতে পাচ্ছি। এই যে পরিবর্তন হলো, তা মূলত হলো নেতা পর্যায়ে। তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের একেক নেতা একেকভাবে আছেন। সর্বশেষ যাঁরা আওয়ামী লীগে থাকলেন, তাঁদের পরে আর একটু অবনতি হলো। তাঁরা মনে করলেন, যে ভোটের রাজনীতি বর্তমানে চালু আছে, তাতে বিএনপির হাতে ৪০ ভাগ ভোট আর আওয়ামী লীগের হাতে ৪০ ভাগ ভোট। আর ২০ ভাগ ভোট বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এই ২০ ভাগের মধ্যে অবশ্য ১০ ভাগ রয়েছে মৌলবাদী ভোট। তাঁরা ভাবলেন, ১০ ভাগ ইসলামি ভোট আমাদের সঙ্গে রাখতে পারলে আমরা জিতব। এই ভোটের জন্য কখনো আমিনীর সঙ্গে আবার কখনো এরশাদের সঙ্গে তাঁদের যেতে হয়।
আর উল্টো দিকে বিএনপিরও একই অবস্থা। এই ভোটের জন্য তাদের কখনো জামায়াতের সঙ্গে আবার কখনো এরশাদের সঙ্গে যেতে হয়। এ জন্য এই দুই প্রধান বুর্জোয়া শক্তির মধ্যে ক্ষমতার প্রশ্ন ছাড়া মৌলিক কোনো দ্বন্দ্ব নেই। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যে দ্বন্দ্বটুকু আছে, তাও ধীরে ধীরে কমে যাবে। অর্থাত্ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে শেষাবধি উপরিকাঠামোর কিছু ইস্যু বাদ দিলে মৌলিক কোনো পার্থক্য থাকবে না। এর পরও অবশ্য ইতিহাসের এবং উত্তরাধিকারের পার্থক্য থাকবে। আর একটি পার্থক্য থাকবে তা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর পদ একটি, দুটি নয়। এ জন্য দুজনই প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।
বর্তমানে জিয়াউর রহমান ও বিএনপি ১৯৭৫-পরবর্তী দক্ষিণ পন্থার প্রতীক হিসেবে বিরাজমান। শেখ হাসিনা অবশ্য দক্ষিণ পন্থা ও অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের একটি মিশ্র প্রতীক হিসেবে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বাদ দিয়ে দক্ষিণপন্থী একটি দল হয়ে গেছে।
এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বন্দ্ব মেটানোর সম্ভাব্য রাস্তা দুটি। একটি হচ্ছে দেশের সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরাচারী শক্তিগুলো থেকে মুক্ত হয়ে দেশে একটি ভদ্র দ্বিদলীয় বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আর দ্বিতীয় রাস্তাটি হচ্ছে জামায়াত ও স্বৈরাচারের বিচ্ছিন্নতা এবং পরাজয়ের কারণে বিএনপির শক্তিহানি, ক্রমবিলুপ্তি ও খণ্ডায়ন। তখন দেশে একমাত্র দক্ষিণপন্থী দল হবে আওয়ামী লীগ এবং প্রধান বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেরই কোনো না কোনো অপেক্ষাকৃত রেডিক্যাল একটি রাজনৈতিক দল।
আমার প্রস্তাবিত এই দুই সমাধানের যুক্তি-ভিত্তি আরেকটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আমাদের দেশে যে দুটি অপশক্তি বুর্জোয়া গণতন্ত্রের প্রধান শত্রু, তারা হচ্ছে মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী এবং ‘সামরিক বাহিনীর মধ্যে উচ্চাভিলাষী জেনারেলরা’। বামপন্থীরা যে গণবিপ্লবের কথা বলে, তা বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যেই তারা এযাবত্ পরিচালনা করছে বলে তাদের বর্তমানে শাসকশ্রেণীও ‘গণতন্ত্রের’ শত্রু হিসেবে মনে করছে না। কিন্তু অন্যদিকে মৌলবাদীরা এখনো জিহাদের মাধ্যমে ইসলামি শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে এবং তাদের জঙ্গি-সম্পৃক্ততার অনেক প্রমাণও রয়েছে, যেহেতু তারা বর্তমানে গণতন্ত্রের ১ নম্বর বৈরী শক্তি। এ ছাড়া সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিপদ হিসেবে নিকট অতীতে একাধিকবার আবির্ভূত হয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে সামরিক বাহিনী ও ‘মৌলবাদের’ সঙ্গে আমাদের দেশে অপেক্ষাকৃত বেশি ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে রক্ষণশীল বিএনপি দলটির। তবে উদারনৈতিক আওয়ামী লীগও যে এই শত্রুদের সঙ্গে কখনো কখনো খেলেছে এবং কৌশলগত ঐক্যের মাধ্যমে বিএনপিকে ভোটযুদ্ধে পরাজিত করার প্রয়াস পেয়েছে, সেটিও আমাদের স্বীকার করতে হবে।
এই অবস্থায় এ দেশের বুর্জোয়া শাসকশ্রেণী যারা দুই দলেই আছে, তারা যদি একটি পরিষ্কার ভদ্র ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’ চায়, তাহলে তাদের চিরতরে ‘মৌলবাদী-জঙ্গি’ শক্তির বিষদাঁত ভেঙে ফেলতে হবে এবং সামরিক বাহিনীকেও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির অনুগত বাহিনীতে পরিণত করার জন্য দৃঢ়ভাবে চেষ্টা করতে হবে।
ভালো খবর হচ্ছে, বর্তমান আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্য বাংলাদেশে এই দুটি ক্ষেত্রে আগের চেয়ে অনেক বেশি অনুকূল! ইউরোপ ও ভারতের অবস্থান এ প্রশ্নে কিছুটা ইতিবাচক এবং খোলামেলা বলেই মনে হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়টি এখনো অত পরিষ্কার নয়। জামায়াতে ইসলামীর মতো মৌলবাদী দলকে তারা এখনো পরিত্যাগ করেছে বলে মনে হয় না। আর চীনকে দমানোর কৌশল হিসেবে ভারত-বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির কৌশল যুক্তরাষ্ট্র ছাড়বে বলেও মনে হয় না। ফলে ‘সামরিক বাহিনী’ ও মৌলবাদকে এখনো নাকচ করে দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। যা-ই হোক, সব মিলিয়ে ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’ যদি দেশীয় শাসকদের মূল কথা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে মৌলবাদী শক্তি ও সামরিক ষড়যন্ত্রকারীদের অবশ্যই পরাজিত করতে হবে। সেটা করার পরিণতি আপাত বিচারে দুই রকম হতে পারে।
শাসকশ্রেণীর জন্য সবচেয়ে কাম্য হচ্ছে ‘মৌলবাদ’ ও ‘উচ্চাভিলাষী’ জেনারেলদের থেকে মুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই একটি অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল দ্বিদলীয় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্ম দেবে এবং শাসকশ্রেণীর স্থিতিশীলতা অক্ষুণ্ন থাকবে।
অথবা এই প্রক্রিয়ায় রক্ষণশীল বিএনপি নিজেকে পরিবর্তন করতে অক্ষম হবে বিধায় ক্রমবর্ধমান বিভক্তি ও খণ্ডীকরণের মাধ্যমে ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাবে। তখন সেই শূন্য জায়গায় প্রধান বিরোধী দল হিসেবে অপেক্ষাকৃত রেডিক্যাল বামপন্থীদের আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে। অবশ্য এই দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি অনেকখানি নির্ভর করবে বর্তমান শাসক দল আওয়ামী লীগ ‘মৌলবাদ’ ও ‘জেনারেলদের’ বিরুদ্ধে কতখানি আপসহীন অদোদুল্যমান ভূমিকা গ্রহণ করে, তার ওপর।
তৃতীয় একটি সম্ভাবনার কথা না বললেই নয়। বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব (ক্যাওস থিওরি) অনুযায়ী বলা যায়, অসংখ্য পরস্পরবিরোধী শক্তির টালমাটাল ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মাধ্যমে আবার বিশৃঙ্খলাও ফিরে আসতে পারে।
[এই লেখার ওপর আপনার মতামত ও প্রতিক্রিয়া ছাপাতে আমরা আগ্রহী। বি. স ]
এম এম আকাশ : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
akash92@hotmail.com
No comments