প্রতিরক্ষাবিষয়ক এই নীতিমালা কার জন্য by মশিউল আলম
গত
২৩ নভেম্বর সোমবার ঢাকা সেনানিবাসে সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরের সম্মেলনকক্ষে
ফরমেশন কমান্ডারদের বার্ষিক সম্মেলনে ভাষণের একাংশে প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা জানিয়েছেন, ‘সরকার শিগগিরই সেনাবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা বিষয়ে প্রচার
সম্পর্কিত একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করবে।’ সংবাদমাধ্যমে কর্মরত ও
এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহলের এ নিয়ে কিছু প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
ফরমেশন কমান্ডারদের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর ওই ভাষণের খুবই সামান্য অংশজুড়ে ছিল সংবাদমাধ্যম প্রসঙ্গ। কিন্তু এই একটি আগাম খবরের কারণে কোনো কোনো পত্রিকায় তাঁর ওই ভাষণ-সম্পর্কিত প্রতিবেদনের শিরোনামে স্থান পেয়েছে সংবাদমাধ্যমের জন্য নীতিমালার বিষয়টি। ২৬ নভেম্বর ডেইলি স্টার পত্রিকায় এ বিষয়ে একটি সম্পাদকীয়তে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণায় বিস্ময় প্রকাশ করে লেখা হয়: ‘...আমরা জানি না, প্রধানমন্ত্রীর এমন একটি ঘোষণা দেওয়ার কারণ কী এবং কী পটভূমিতে তিনি এই ঘোষণা দিলেন।’ খুব প্রাসঙ্গিক ও যৌক্তিক জিজ্ঞাসা। সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের জন্য একটি পৃথক সুস্পষ্ট নীতিমালার প্রয়োজন—এটা কেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মনে হলো এবং কেন ‘শিগগিরই’ সে রকম একটা জিনিস প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো এ বিষয়ে কিছু ব্যাখ্যা, অন্তত সরকারের চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানার আগ্রহ জাগা খুব স্বাভাবিক। পৃথিবীর কোনো দেশে শুধু সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বিভাগ/ব্যবস্থা সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমের জন্য অনুসরণযোগ্য পৃথক নীতিমালা সরকারের পক্ষ থেকে তৈরি করে দেওয়া হয় বলে আমাদের জানা নেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি মেজর নিদাল মালিক হাসান নামে এক সেনা কর্মকর্তা গুলি করে ১৩ জন সহকর্মীকে হত্যা ও ২৯ জনকে জখম করার ঘটনা সে দেশের সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে, সরকার বা মার্কিন সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো বাধা-নিষেধের খবর পাওয়া যায়নি। শুধু তা-ই নয়, তাঁর আমেরিকাবিরোধী অবস্থান ও সন্ত্রাসবাদী যোগাযোগ সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য থাকার পরও তিনি কীভাবে মার্কিন সেনাবাহিনীতে পদোন্নতি পেয়েছিলেন, এমনকি মার্কিন সেনাবাহিনীতে মুসলমান সদস্যদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের যেসব অভিযোগ তিনি বিভিন্ন সময়ে করেছেন, সেগুলোও ছাপা হচ্ছে। এ ছাড়া ইরাকে যুদ্ধ করে ঘরে ফেরা মার্কিন সেনাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও নানা খবর সে দেশের সংবাদমাধ্যমে মাঝেমধ্যেই প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি এমন খবরও দেখলাম যে আফগানিস্তানের রণাঙ্গনে আল-কায়েদা আর তালেবানদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্রিটিশ ও মার্কিন সেনারা নাস্তানাবুদ হওয়ার অনেক কারণের একটি হচ্ছে তাদের ব্যবহূত আগ্নেয়াস্ত্রের কারিগরি কিছু দিক। তালেবান ও আল-কায়েদা যোদ্ধাদের ব্যবহূত আগ্নেয়াস্ত্রের সঙ্গে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর সেনাদের ব্যবহূত আগ্নেয়াস্ত্রের কারিগরি পার্থক্য, আফগানিস্তানের ধুলাবালুময় পরিবেশে সেগুলোর সুবিধা-অসুবিধাগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণের খবর শুধু বিশেষায়িত সামরিক জার্নালে বা ওয়েবসাইটে নয়, গণসংবাদমাধ্যমে খোঁজ করলেই পাওয়া যায়। সুতরাং কী খবর প্রকাশ করা যাবে আর কী যাবে না—এটা কোনো নীতিমালা বা বিধিনিষেধ আরোপ করে নিশ্চিত করার দিন আর নেই।
এ রকম যুগে আমাদের দেশে সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের জন্য একটি পৃথক নীতিমালার প্রয়োজন কেন দেখা দিল বা আদৌ কোনো প্রয়োজন দেখা দিয়েছে কি না—এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সেদিনের ওই ভাষণে নীতিমালা প্রণয়নের ঘোষণা দেওয়ার আগে-পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন। প্রথম আলোয় বাসস, ইউএনবি ও আইএসপিআরের বরাত দিয়ে লেখা হয়েছে, ‘দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সেনাবাহিনী সম্পর্কে প্রকাশিত বিভিন্ন খবরের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, নেতিবাচক প্রচার সেনাসদস্যদের মনোবলে আঘাত করে। তিনি এসব প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থে সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে সেনাসদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান।’ দৈনিক নয়া দিগন্তে লেখা হয়: “সেনাবাহিনী নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল যেসব প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে সে সম্পর্কে আমি অবগত আছি। সেনাবাহিনী সংক্রান্ত যেকোনো নেতিবাচক মন্তব্য বা আলোচনা সেনাসদস্যদের মনোবলের ওপর আঘাত করে। এ ধরনের অপপ্রচারে আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না।’” আমার দেশও প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ উক্তি উদ্ধৃত করে একই খবর পরিবেশন করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে ‘সম্প্রতি সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে পত্রপত্রিকা ও বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল যেসব প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে’ বলে জানানো হলো, সেগুলো কী? কোন কোন পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল কী সব প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে বা চালাচ্ছে? ‘প্রচার-প্রচারণা’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? যা ঘটে না, যা সত্য নয়, তা তথ্য নয়, সেটা খবর হতে পারে না। কোনো সংবাদপত্র কি এ রকম কিছু ছেপেছে? কোনো টেলিভিশন চ্যানেল কি এ রকম কিছু প্রচার করেছে? করে থাকলে সরকারের পক্ষ থেকে কি সেসব ভিত্তিহীন প্রচারের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে? সংবাদমাধ্যম ইচ্ছামতো ভিত্তিহীন খবর (যা ভিত্তিহীন তাকে খবর বলা যায় না, সেটা গুজব, আর সে রকম কিছু নিয়ে আলোচনাকে বলা হয় জল্পনা-কল্পনা) এবং সে রকম কিছুর ভিত্তিতে কোনো প্রচারণা চালাতে পারে না। কেউ তেমন কিছু করলে তার আইনি প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে; প্রেস কাউন্সিল আছে, আদালত আছে। শুধু সেনাবাহিনী বা প্রতিরক্ষা বিভাগ/গোয়েন্দা সংস্থা সম্পর্কে নয়, কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বিষয় নিয়েই অসত্য, অবাস্তব, ভিত্তিহীন কিছুই প্রচার করার অধিকার কারোর নেই। তাই সেনাবাহিনী বা প্রতিরক্ষা বিষয়ে আলাদা সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালার প্রয়োজন থাকার কথা নয়।
এমন নয় যে সংবাদমাধ্যমে ভিত্তিহীন বা আংশিক ভিত্তি আছে এমন অর্ধসত্য, গুজব, জল্পনা-কল্পনা প্রকাশিত/প্রচারিত হচ্ছে না। অনেক হচ্ছে, ব্যক্তি সম্পর্কে, প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা সম্পর্কেও। এগুলো হচ্ছে প্রধানত নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্যের অভাবে এবং অংশত কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের অসাধুতায়। কোনো বিষয়ে ভিত্তিহীন প্রচারণা, গুজব, জল্পনা-কল্পনা বা সরকারের ভাষায় ‘নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা’ বন্ধ করার সর্বোত্তম উপায় ওই বিষয়ে সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা, গোপন করা নয়, কোনো কিছু এড়িয়ে যাওয়া নয়। আর ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে কুত্সামূলক ভিত্তিহীন প্রচারণা বন্ধ করার উপায় প্রথমত এই পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের নিজেদের পেশার মান-মর্যাদা, দায়িত্বশীলতা, নৈতিকতার বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া। তথাকথিত হলুদ সাংবাদিকতা রোধের লক্ষ্যে সংবাদমাধ্যমের কর্মী, ব্যবস্থাপক ও মালিক-প্রকাশকদের মধ্যে আলোচনা-পরামর্শ ও বোঝাপড়া একান্ত প্রয়োজন। তারপর আছে আইন প্রয়োগে তত্পর হওয়া, আইন প্রয়োগব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করা। মিডিয়ার বিরুদ্ধে কিছু বলা বা করা করা যাবে না, তাহলে হইচই শুরু হয়ে যাবে যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে—এই মানসিকতা ঠিক নয়। সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকেরা আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
প্রধানমন্ত্রীর ওই ভাষণের খবরগুলো থেকে পরিষ্কার নয় ‘সেনাবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা বিষয় সম্পর্কিত একটি সুস্পষ্ট গণমাধ্যম নীতিমালা’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে। সেটা কি একটি নির্দেশনা-জাতীয় কিছু হবে এবং তা কি গণমাধ্যমকে মেনে চলতে হবে? নাকি গণমাধ্যম বা সংবাদমাধ্যমকে সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে কী কী জানানো হবে, কী কী জানানো হবে না—এ সম্পর্কিত একটি নির্দেশিকা, যেটা প্রযোজ্য হবে সরকারের আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বা আইএসপিআরের জন্য? গণমাধ্যমকে মেনে চলতে হবে—এমন নীতিমালা, শুধু সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা বিভাগ সম্পর্কে—নিষ্প্রোয়জনীয়। সংবাদমাধ্যমের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এমন অন্তত পাঁচটি আইন ও বিধিবিধান বলবত্ আছে। তথ্য অধিকার আইনের আওতায় যেসব বিষয়ে তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক, প্রতিরক্ষা বিভাগ ও বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে তার বাইরে রাখা হয়েছে। এর চেয়ে বড় সুরক্ষা আর কী হতে পারে। (যদিও এ নিয়ে মতভেদ আছে, কিন্তু সে ভিন্ন প্রসঙ্গ)।
আর উল্লিখিত গণমাধ্যম নীতিমালাটি যদি পালনীয় বা প্রযোজ্য হয় আইএসপিআরের জন্য, তাহলে সেটা নিয়ে আপত্তি তোলার কিছু থাকবে না। সশস্ত্র বাহিনী, প্রতিরক্ষা, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাবিষয়ক যেসব তথ্য জনগণকে জানানো প্রয়োজন বা জানালে ক্ষতি নেই বরং গুজব-জল্পনা-কল্পনার পথ রুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে, সরকার আইএসপিআরের মাধ্যমে তা সংবাদমাধ্যমকে জানাবে। অর্থাত্ সশস্ত্র বাহিনী ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে তথ্যপ্রদানের ক্ষেত্রে আইএসপিআরকে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বশীল তথ্যসূত্র হিসেবে আরও কার্যকর করাই হওয়া উচিত উল্লিখিত গণমাধ্যম নীতিমালার মূল লক্ষ্য। তবে এই সুবিবেচনাটা থাকা দরকার যে তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে চিরাচরিত রক্ষণশীল মনোভাব, গোপনীয়তা রক্ষার প্রবণতা যত কাটিয়ে ওঠা যায়, ততই মঙ্গল। সম্প্রতি সাংসদ ফজলে নূর তাপসের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা তদন্তের প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীতে কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা, তাদের আটক, জিজ্ঞাসাবাদ ইত্যাদি সম্পর্কে আইএসপিআর থেকে যে তথ্য ও বক্তব্য আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়া হয়েছে, তা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এর ফলে আরও জল্পনা-কল্পনার পথ রুদ্ধ হয়েছে। আইএসপিআরের সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠন করে একে আরও কার্যকর ও সময়োপযোগী করার যে কথা প্রধানমন্ত্রীর সেদিনের ভাষণে বলা হয়েছে, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পুনর্গঠন-প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই যদি এ প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে সেটাই হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। এবং তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে ওই নীতিমালাটি যত কম রক্ষণশীল হবে ততই উত্তম। সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বিভাগকে জনগণের থেকে দূরের অজানা দ্বীপের মতো করে রাখা উচিত নয়। সিভিল-মিলিটারি সম্পর্কোন্নয়নের জন্য সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণাকে স্বচ্ছ রাখা প্রয়োজন।
>>>মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
ফরমেশন কমান্ডারদের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর ওই ভাষণের খুবই সামান্য অংশজুড়ে ছিল সংবাদমাধ্যম প্রসঙ্গ। কিন্তু এই একটি আগাম খবরের কারণে কোনো কোনো পত্রিকায় তাঁর ওই ভাষণ-সম্পর্কিত প্রতিবেদনের শিরোনামে স্থান পেয়েছে সংবাদমাধ্যমের জন্য নীতিমালার বিষয়টি। ২৬ নভেম্বর ডেইলি স্টার পত্রিকায় এ বিষয়ে একটি সম্পাদকীয়তে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণায় বিস্ময় প্রকাশ করে লেখা হয়: ‘...আমরা জানি না, প্রধানমন্ত্রীর এমন একটি ঘোষণা দেওয়ার কারণ কী এবং কী পটভূমিতে তিনি এই ঘোষণা দিলেন।’ খুব প্রাসঙ্গিক ও যৌক্তিক জিজ্ঞাসা। সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের জন্য একটি পৃথক সুস্পষ্ট নীতিমালার প্রয়োজন—এটা কেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মনে হলো এবং কেন ‘শিগগিরই’ সে রকম একটা জিনিস প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো এ বিষয়ে কিছু ব্যাখ্যা, অন্তত সরকারের চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানার আগ্রহ জাগা খুব স্বাভাবিক। পৃথিবীর কোনো দেশে শুধু সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বিভাগ/ব্যবস্থা সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমের জন্য অনুসরণযোগ্য পৃথক নীতিমালা সরকারের পক্ষ থেকে তৈরি করে দেওয়া হয় বলে আমাদের জানা নেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি মেজর নিদাল মালিক হাসান নামে এক সেনা কর্মকর্তা গুলি করে ১৩ জন সহকর্মীকে হত্যা ও ২৯ জনকে জখম করার ঘটনা সে দেশের সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে, সরকার বা মার্কিন সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো বাধা-নিষেধের খবর পাওয়া যায়নি। শুধু তা-ই নয়, তাঁর আমেরিকাবিরোধী অবস্থান ও সন্ত্রাসবাদী যোগাযোগ সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য থাকার পরও তিনি কীভাবে মার্কিন সেনাবাহিনীতে পদোন্নতি পেয়েছিলেন, এমনকি মার্কিন সেনাবাহিনীতে মুসলমান সদস্যদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের যেসব অভিযোগ তিনি বিভিন্ন সময়ে করেছেন, সেগুলোও ছাপা হচ্ছে। এ ছাড়া ইরাকে যুদ্ধ করে ঘরে ফেরা মার্কিন সেনাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও নানা খবর সে দেশের সংবাদমাধ্যমে মাঝেমধ্যেই প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি এমন খবরও দেখলাম যে আফগানিস্তানের রণাঙ্গনে আল-কায়েদা আর তালেবানদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্রিটিশ ও মার্কিন সেনারা নাস্তানাবুদ হওয়ার অনেক কারণের একটি হচ্ছে তাদের ব্যবহূত আগ্নেয়াস্ত্রের কারিগরি কিছু দিক। তালেবান ও আল-কায়েদা যোদ্ধাদের ব্যবহূত আগ্নেয়াস্ত্রের সঙ্গে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর সেনাদের ব্যবহূত আগ্নেয়াস্ত্রের কারিগরি পার্থক্য, আফগানিস্তানের ধুলাবালুময় পরিবেশে সেগুলোর সুবিধা-অসুবিধাগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণের খবর শুধু বিশেষায়িত সামরিক জার্নালে বা ওয়েবসাইটে নয়, গণসংবাদমাধ্যমে খোঁজ করলেই পাওয়া যায়। সুতরাং কী খবর প্রকাশ করা যাবে আর কী যাবে না—এটা কোনো নীতিমালা বা বিধিনিষেধ আরোপ করে নিশ্চিত করার দিন আর নেই।
এ রকম যুগে আমাদের দেশে সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের জন্য একটি পৃথক নীতিমালার প্রয়োজন কেন দেখা দিল বা আদৌ কোনো প্রয়োজন দেখা দিয়েছে কি না—এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সেদিনের ওই ভাষণে নীতিমালা প্রণয়নের ঘোষণা দেওয়ার আগে-পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন। প্রথম আলোয় বাসস, ইউএনবি ও আইএসপিআরের বরাত দিয়ে লেখা হয়েছে, ‘দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সেনাবাহিনী সম্পর্কে প্রকাশিত বিভিন্ন খবরের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, নেতিবাচক প্রচার সেনাসদস্যদের মনোবলে আঘাত করে। তিনি এসব প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থে সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে সেনাসদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান।’ দৈনিক নয়া দিগন্তে লেখা হয়: “সেনাবাহিনী নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল যেসব প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে সে সম্পর্কে আমি অবগত আছি। সেনাবাহিনী সংক্রান্ত যেকোনো নেতিবাচক মন্তব্য বা আলোচনা সেনাসদস্যদের মনোবলের ওপর আঘাত করে। এ ধরনের অপপ্রচারে আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না।’” আমার দেশও প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ উক্তি উদ্ধৃত করে একই খবর পরিবেশন করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে ‘সম্প্রতি সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে পত্রপত্রিকা ও বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল যেসব প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে’ বলে জানানো হলো, সেগুলো কী? কোন কোন পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল কী সব প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে বা চালাচ্ছে? ‘প্রচার-প্রচারণা’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? যা ঘটে না, যা সত্য নয়, তা তথ্য নয়, সেটা খবর হতে পারে না। কোনো সংবাদপত্র কি এ রকম কিছু ছেপেছে? কোনো টেলিভিশন চ্যানেল কি এ রকম কিছু প্রচার করেছে? করে থাকলে সরকারের পক্ষ থেকে কি সেসব ভিত্তিহীন প্রচারের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে? সংবাদমাধ্যম ইচ্ছামতো ভিত্তিহীন খবর (যা ভিত্তিহীন তাকে খবর বলা যায় না, সেটা গুজব, আর সে রকম কিছু নিয়ে আলোচনাকে বলা হয় জল্পনা-কল্পনা) এবং সে রকম কিছুর ভিত্তিতে কোনো প্রচারণা চালাতে পারে না। কেউ তেমন কিছু করলে তার আইনি প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে; প্রেস কাউন্সিল আছে, আদালত আছে। শুধু সেনাবাহিনী বা প্রতিরক্ষা বিভাগ/গোয়েন্দা সংস্থা সম্পর্কে নয়, কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বিষয় নিয়েই অসত্য, অবাস্তব, ভিত্তিহীন কিছুই প্রচার করার অধিকার কারোর নেই। তাই সেনাবাহিনী বা প্রতিরক্ষা বিষয়ে আলাদা সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালার প্রয়োজন থাকার কথা নয়।
এমন নয় যে সংবাদমাধ্যমে ভিত্তিহীন বা আংশিক ভিত্তি আছে এমন অর্ধসত্য, গুজব, জল্পনা-কল্পনা প্রকাশিত/প্রচারিত হচ্ছে না। অনেক হচ্ছে, ব্যক্তি সম্পর্কে, প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা সম্পর্কেও। এগুলো হচ্ছে প্রধানত নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্যের অভাবে এবং অংশত কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের অসাধুতায়। কোনো বিষয়ে ভিত্তিহীন প্রচারণা, গুজব, জল্পনা-কল্পনা বা সরকারের ভাষায় ‘নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা’ বন্ধ করার সর্বোত্তম উপায় ওই বিষয়ে সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা, গোপন করা নয়, কোনো কিছু এড়িয়ে যাওয়া নয়। আর ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে কুত্সামূলক ভিত্তিহীন প্রচারণা বন্ধ করার উপায় প্রথমত এই পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের নিজেদের পেশার মান-মর্যাদা, দায়িত্বশীলতা, নৈতিকতার বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া। তথাকথিত হলুদ সাংবাদিকতা রোধের লক্ষ্যে সংবাদমাধ্যমের কর্মী, ব্যবস্থাপক ও মালিক-প্রকাশকদের মধ্যে আলোচনা-পরামর্শ ও বোঝাপড়া একান্ত প্রয়োজন। তারপর আছে আইন প্রয়োগে তত্পর হওয়া, আইন প্রয়োগব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করা। মিডিয়ার বিরুদ্ধে কিছু বলা বা করা করা যাবে না, তাহলে হইচই শুরু হয়ে যাবে যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে—এই মানসিকতা ঠিক নয়। সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকেরা আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
প্রধানমন্ত্রীর ওই ভাষণের খবরগুলো থেকে পরিষ্কার নয় ‘সেনাবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা বিষয় সম্পর্কিত একটি সুস্পষ্ট গণমাধ্যম নীতিমালা’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে। সেটা কি একটি নির্দেশনা-জাতীয় কিছু হবে এবং তা কি গণমাধ্যমকে মেনে চলতে হবে? নাকি গণমাধ্যম বা সংবাদমাধ্যমকে সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে কী কী জানানো হবে, কী কী জানানো হবে না—এ সম্পর্কিত একটি নির্দেশিকা, যেটা প্রযোজ্য হবে সরকারের আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বা আইএসপিআরের জন্য? গণমাধ্যমকে মেনে চলতে হবে—এমন নীতিমালা, শুধু সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা বিভাগ সম্পর্কে—নিষ্প্রোয়জনীয়। সংবাদমাধ্যমের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এমন অন্তত পাঁচটি আইন ও বিধিবিধান বলবত্ আছে। তথ্য অধিকার আইনের আওতায় যেসব বিষয়ে তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক, প্রতিরক্ষা বিভাগ ও বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে তার বাইরে রাখা হয়েছে। এর চেয়ে বড় সুরক্ষা আর কী হতে পারে। (যদিও এ নিয়ে মতভেদ আছে, কিন্তু সে ভিন্ন প্রসঙ্গ)।
আর উল্লিখিত গণমাধ্যম নীতিমালাটি যদি পালনীয় বা প্রযোজ্য হয় আইএসপিআরের জন্য, তাহলে সেটা নিয়ে আপত্তি তোলার কিছু থাকবে না। সশস্ত্র বাহিনী, প্রতিরক্ষা, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাবিষয়ক যেসব তথ্য জনগণকে জানানো প্রয়োজন বা জানালে ক্ষতি নেই বরং গুজব-জল্পনা-কল্পনার পথ রুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে, সরকার আইএসপিআরের মাধ্যমে তা সংবাদমাধ্যমকে জানাবে। অর্থাত্ সশস্ত্র বাহিনী ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে তথ্যপ্রদানের ক্ষেত্রে আইএসপিআরকে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বশীল তথ্যসূত্র হিসেবে আরও কার্যকর করাই হওয়া উচিত উল্লিখিত গণমাধ্যম নীতিমালার মূল লক্ষ্য। তবে এই সুবিবেচনাটা থাকা দরকার যে তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে চিরাচরিত রক্ষণশীল মনোভাব, গোপনীয়তা রক্ষার প্রবণতা যত কাটিয়ে ওঠা যায়, ততই মঙ্গল। সম্প্রতি সাংসদ ফজলে নূর তাপসের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা তদন্তের প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীতে কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা, তাদের আটক, জিজ্ঞাসাবাদ ইত্যাদি সম্পর্কে আইএসপিআর থেকে যে তথ্য ও বক্তব্য আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়া হয়েছে, তা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এর ফলে আরও জল্পনা-কল্পনার পথ রুদ্ধ হয়েছে। আইএসপিআরের সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠন করে একে আরও কার্যকর ও সময়োপযোগী করার যে কথা প্রধানমন্ত্রীর সেদিনের ভাষণে বলা হয়েছে, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পুনর্গঠন-প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই যদি এ প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে সেটাই হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। এবং তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে ওই নীতিমালাটি যত কম রক্ষণশীল হবে ততই উত্তম। সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বিভাগকে জনগণের থেকে দূরের অজানা দ্বীপের মতো করে রাখা উচিত নয়। সিভিল-মিলিটারি সম্পর্কোন্নয়নের জন্য সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণাকে স্বচ্ছ রাখা প্রয়োজন।
>>>মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments