মির্জাপুরের মৃতপ্রায় গোপলা -চারদিক by বিশ্বজ্যোতি চৌধুরী
বর্ষায় প্রমত্তা, শীত কিংবা হেমন্তে শান্ত সৌম্য গোপলা নদী মির্জাপুরের গর্ব। মির্জাপুর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার একটি খ্যাত ইউনিয়ন। মির্জাপুরবাসীর গর্বের গোপলাকে ঘিরেই একদিন গড়ে উঠেছিল উপজেলার পশ্চিম সীমান্তের প্রসিদ্ধ হাট সমশেরগঞ্জ বাজার। নদীকেন্দ্রিক এ হাটটি মৌলভীবাজার জেলার প্রাচীন হাটগুলোর অন্যতম।
গোপলার উত্পত্তি ভারতের ত্রিপুরায়। ত্রিপুরার কৈলাসহর সংলগ্ন কোনো এক পাহাড়ি ঝরনার ধারা থেকে। পাহাড়ি ঝরনার স্রোতধারাটি উপজেলার সিন্দুরখান সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে। লাইংলাছড়া, উদনাছড়া, বিলাসছড়া ইত্যাদি নামে রাজঘাট, কালীঘাট ও আশীদ্রোণ ইউনিয়ন পাড়ি দিয়েছে। ভূনবীর ইউনিয়নের মতিগঞ্জ গ্রামের কাছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিলাস সেতুর খানিকটা পশ্চিমে গিয়ে গোপলা নাম ধারণ করে বয়ে গেছে আরও পশ্চিমে হাইল হাওরের দিকে। হাইল হাওরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে উপজেলার একেবারে পশ্চিমের শেষ সীমানা সুহিলপুর গ্রাম ছুঁয়ে বয়ে গেছে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জের দিকে। সুহিলপুর গ্রামের কাছে এ নদীটি বিভাজন করে দিয়েছে শ্রীমঙ্গল উপজেলার সীমান্ত। এপার শ্রীমঙ্গল, ওপার মৌলভীবাজার।
মাছ ধান পান—মির্জাপুরের প্রাণ। মির্জাপুর ইউনিয়নের অধিবাসীদের জীবন-জীবিকা এই তিনের ওপর নির্ভরশীল। পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি ঘরেই আছে ছোট ছোট হাঁসের খামার। এ খামারগুলো পরিবারের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ আরও একটু মজবুত করতে সাহায্য করছে। এই দেখে ভালো লাগল যে খামারগুলো দেখভাল করছেন পরিবারের নারীরা; বিশেষ করে, স্কুলপড়ুয়া মেয়েরা।
মির্জাপুরের অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে এই ধারণা পাওয়া গেল, এসবকিছুর পেছনেই রয়েছে গোপলার অবদান। কিন্তু এই গোপলা এখন আর সেই গোপলা নেই। গোপলা এখন মৃতপ্রায়। পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। বুকে পানি ধরে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। শিকার দূষণেরও। রাবার এবং চা-শিল্পের বর্জ্যে, লেবু ও আনারস বাগানে ব্যবহূত কীটনাশকের অবাঞ্ছিত দূষণে গোপলা তার অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। নদীতে এখন আর আগের মতো মাছ নেই। নদী পাড়ের মানুষের জীবনের গতি অনেকটাই পাল্টে গেছে। মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়তো জীবিকার তাগিদে থমকে যায়নি। তবে হোঁচট খেয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। এখন আর ভিনদেশি (অন্য জেলার) বজরা নৌকা এই নদীতে নোঙর করে না। বাণিজ্যে তাই লক্ষ্মীর বসতি নেই।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা সদর থেকে সুহিলপুর গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৩৮ কিলোমিটার। গ্রামটিতে মত্স্যজীবী সম্প্রদায়ের বসবাস। মাছের জন্য এ গ্রামটি একসময় বিখ্যাত ছিল। এখন এ গ্রামটি উপজেলায় দারিদ্র্যের জন্য খ্যাত।
উপজেলা সদর থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক হয়ে ভূনবীর চৌমোহনা। এরপর সবুজ মাঠের ওপর দিয়ে পিচঢালা কালো গ্রামীণ সরুপথ সেই গ্রামে গিয়ে মিশেছে। হেমন্তের সকাল। তবু প্রকৃতিতে শীতের আমেজ, শীতের আবাহন। শ্রীমঙ্গলে কিছুদিন হলো সন্ধ্যার পর থেকে কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। রাস্তার পাশে, মাঠের আলে দূর্বাদলের শীর্ষে, কাঁচা-পাকা ধানের ডগায় জমে আছে টলমলে শিশিরবিন্দু। ভোরের প্রথম সূর্যকিরণ পড়েছে তার ওপর। মৃদুমন্দ বাতাসে দোল খাচ্ছে কাঁচা-পাকা শিষের গুচ্ছ। পথের দুই পাশে যত দূর দৃষ্টি যায়, কী অপরূপই না লাগছে। কার না গাইতে ইচ্ছা হয়, ‘একি অপরূপ রূপে মা গো হেরিছ পল্লী জননী’।
প্রকৃতির এমন রূপে মুগ্ধ যে কারও কণ্ঠে গুনগুনিয়ে সুরের প্রকাশ পেতেই পারে। ঠিক এভাবে একসময় পৌঁছে গেলাম দারিদ্র্যখ্যাত সুহিলপুর গ্রামে।
নৌকা-বৈঠা আর জাল—এই তিন ছিল সুহিলপুরের প্রাণ। গ্রামের রুস্তম আলীর বয়স এখন সত্তরের কাছাকাছি। রুস্তম আলীর কৈশোর ও যৌবনের অনেকটা সময় কেটেছে গোপলার বুকে। কখনো ডিঙ্গি নৌকায়, কখনও বা বজরা নৌকায়।
রুস্তম আলী ছাড়া গোপলার আদ্যপান্ত কেউই বেশি বলতে পারে না। আরও একটা কারণে গোপলার সঙ্গে রুস্তমের প্রাণের সম্পর্ক রয়েছে। এই নদীর ঋণ তাঁকে শোধতে হয়েছে এক বছরের সোনামণিজাদু রহিমকে সমর্পণ করে। প্রমত্তা গোপলা এক বৈশাখে বাড়িঘরসহ তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। গোপলার প্রমত্তা রূপ তাঁর চেয়ে অন্য কেউ ভালো বলতে পারে না।
সত্তর বছরের রুস্তম এখনো গোপলার বুকে ভেসে বেড়ান জীবন-জীবিকার তাগিদে। রহিমের স্মৃতি হাতড়েও হয়তো বা। তাঁর মতো করে এত কাছাকাছি থেকে এই নদীকে নিবিড়ভাবে গ্রামের অন্য কারও দেখার সুযোগ হয়নি। হয়তো বা অন্য কারও এমন ক্ষমতাও নেই। গোপলা তাঁর কাছে যেমন বেদনার অন্তহীন যন্ত্রণা, আবার সুখেরও ঠিকানা। কেননা, এই গোপলাই তাঁকে আহার জুগিয়েছে। প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে জয়ের মন্ত্রে দীক্ষিত করেছে। বাঁচতে শিখিয়েছে।
তাই তো গোপলার বুকে পালতোলা নৌকার গলুইয়ে বসে মাছ শিকারের স্মৃতি তিনি এখনো রোমন্থন করেন।
রুস্তম আলী স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে যা কিছু তর্পণ করেন, সবই গল্পের মতো শোনায়। বড় বড় কই মাছ, মাগুর, শিং, কালোবাউস, বোয়াল, রুই, কাতল, মৃগেল আরও কতশত মাছের নাম। ভিনদেশি বণিকদের বড় বড় ময়ূরপঙ্খি বজরার বহর। কত না ব্যবসা-বাণিজ্য।
রুস্তমের কাছে গোপলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যগাথা শুনে যখন শ্রীমঙ্গল শহরে ফিরছিলাম, তখন কেবলই মনে হতে লাগল, গোপলার বর্তমান চেহারা দেখে যে কারোরই মনে হতে পারে এগুলো রুস্তমের বাড়িয়ে বলা, নিছকই গল্প। হায়রে গোপলা!
গোপলার উত্পত্তি ভারতের ত্রিপুরায়। ত্রিপুরার কৈলাসহর সংলগ্ন কোনো এক পাহাড়ি ঝরনার ধারা থেকে। পাহাড়ি ঝরনার স্রোতধারাটি উপজেলার সিন্দুরখান সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে। লাইংলাছড়া, উদনাছড়া, বিলাসছড়া ইত্যাদি নামে রাজঘাট, কালীঘাট ও আশীদ্রোণ ইউনিয়ন পাড়ি দিয়েছে। ভূনবীর ইউনিয়নের মতিগঞ্জ গ্রামের কাছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিলাস সেতুর খানিকটা পশ্চিমে গিয়ে গোপলা নাম ধারণ করে বয়ে গেছে আরও পশ্চিমে হাইল হাওরের দিকে। হাইল হাওরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে উপজেলার একেবারে পশ্চিমের শেষ সীমানা সুহিলপুর গ্রাম ছুঁয়ে বয়ে গেছে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জের দিকে। সুহিলপুর গ্রামের কাছে এ নদীটি বিভাজন করে দিয়েছে শ্রীমঙ্গল উপজেলার সীমান্ত। এপার শ্রীমঙ্গল, ওপার মৌলভীবাজার।
মাছ ধান পান—মির্জাপুরের প্রাণ। মির্জাপুর ইউনিয়নের অধিবাসীদের জীবন-জীবিকা এই তিনের ওপর নির্ভরশীল। পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি ঘরেই আছে ছোট ছোট হাঁসের খামার। এ খামারগুলো পরিবারের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ আরও একটু মজবুত করতে সাহায্য করছে। এই দেখে ভালো লাগল যে খামারগুলো দেখভাল করছেন পরিবারের নারীরা; বিশেষ করে, স্কুলপড়ুয়া মেয়েরা।
মির্জাপুরের অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে এই ধারণা পাওয়া গেল, এসবকিছুর পেছনেই রয়েছে গোপলার অবদান। কিন্তু এই গোপলা এখন আর সেই গোপলা নেই। গোপলা এখন মৃতপ্রায়। পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। বুকে পানি ধরে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। শিকার দূষণেরও। রাবার এবং চা-শিল্পের বর্জ্যে, লেবু ও আনারস বাগানে ব্যবহূত কীটনাশকের অবাঞ্ছিত দূষণে গোপলা তার অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। নদীতে এখন আর আগের মতো মাছ নেই। নদী পাড়ের মানুষের জীবনের গতি অনেকটাই পাল্টে গেছে। মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়তো জীবিকার তাগিদে থমকে যায়নি। তবে হোঁচট খেয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। এখন আর ভিনদেশি (অন্য জেলার) বজরা নৌকা এই নদীতে নোঙর করে না। বাণিজ্যে তাই লক্ষ্মীর বসতি নেই।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা সদর থেকে সুহিলপুর গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৩৮ কিলোমিটার। গ্রামটিতে মত্স্যজীবী সম্প্রদায়ের বসবাস। মাছের জন্য এ গ্রামটি একসময় বিখ্যাত ছিল। এখন এ গ্রামটি উপজেলায় দারিদ্র্যের জন্য খ্যাত।
উপজেলা সদর থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক হয়ে ভূনবীর চৌমোহনা। এরপর সবুজ মাঠের ওপর দিয়ে পিচঢালা কালো গ্রামীণ সরুপথ সেই গ্রামে গিয়ে মিশেছে। হেমন্তের সকাল। তবু প্রকৃতিতে শীতের আমেজ, শীতের আবাহন। শ্রীমঙ্গলে কিছুদিন হলো সন্ধ্যার পর থেকে কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। রাস্তার পাশে, মাঠের আলে দূর্বাদলের শীর্ষে, কাঁচা-পাকা ধানের ডগায় জমে আছে টলমলে শিশিরবিন্দু। ভোরের প্রথম সূর্যকিরণ পড়েছে তার ওপর। মৃদুমন্দ বাতাসে দোল খাচ্ছে কাঁচা-পাকা শিষের গুচ্ছ। পথের দুই পাশে যত দূর দৃষ্টি যায়, কী অপরূপই না লাগছে। কার না গাইতে ইচ্ছা হয়, ‘একি অপরূপ রূপে মা গো হেরিছ পল্লী জননী’।
প্রকৃতির এমন রূপে মুগ্ধ যে কারও কণ্ঠে গুনগুনিয়ে সুরের প্রকাশ পেতেই পারে। ঠিক এভাবে একসময় পৌঁছে গেলাম দারিদ্র্যখ্যাত সুহিলপুর গ্রামে।
নৌকা-বৈঠা আর জাল—এই তিন ছিল সুহিলপুরের প্রাণ। গ্রামের রুস্তম আলীর বয়স এখন সত্তরের কাছাকাছি। রুস্তম আলীর কৈশোর ও যৌবনের অনেকটা সময় কেটেছে গোপলার বুকে। কখনো ডিঙ্গি নৌকায়, কখনও বা বজরা নৌকায়।
রুস্তম আলী ছাড়া গোপলার আদ্যপান্ত কেউই বেশি বলতে পারে না। আরও একটা কারণে গোপলার সঙ্গে রুস্তমের প্রাণের সম্পর্ক রয়েছে। এই নদীর ঋণ তাঁকে শোধতে হয়েছে এক বছরের সোনামণিজাদু রহিমকে সমর্পণ করে। প্রমত্তা গোপলা এক বৈশাখে বাড়িঘরসহ তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। গোপলার প্রমত্তা রূপ তাঁর চেয়ে অন্য কেউ ভালো বলতে পারে না।
সত্তর বছরের রুস্তম এখনো গোপলার বুকে ভেসে বেড়ান জীবন-জীবিকার তাগিদে। রহিমের স্মৃতি হাতড়েও হয়তো বা। তাঁর মতো করে এত কাছাকাছি থেকে এই নদীকে নিবিড়ভাবে গ্রামের অন্য কারও দেখার সুযোগ হয়নি। হয়তো বা অন্য কারও এমন ক্ষমতাও নেই। গোপলা তাঁর কাছে যেমন বেদনার অন্তহীন যন্ত্রণা, আবার সুখেরও ঠিকানা। কেননা, এই গোপলাই তাঁকে আহার জুগিয়েছে। প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে জয়ের মন্ত্রে দীক্ষিত করেছে। বাঁচতে শিখিয়েছে।
তাই তো গোপলার বুকে পালতোলা নৌকার গলুইয়ে বসে মাছ শিকারের স্মৃতি তিনি এখনো রোমন্থন করেন।
রুস্তম আলী স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে যা কিছু তর্পণ করেন, সবই গল্পের মতো শোনায়। বড় বড় কই মাছ, মাগুর, শিং, কালোবাউস, বোয়াল, রুই, কাতল, মৃগেল আরও কতশত মাছের নাম। ভিনদেশি বণিকদের বড় বড় ময়ূরপঙ্খি বজরার বহর। কত না ব্যবসা-বাণিজ্য।
রুস্তমের কাছে গোপলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যগাথা শুনে যখন শ্রীমঙ্গল শহরে ফিরছিলাম, তখন কেবলই মনে হতে লাগল, গোপলার বর্তমান চেহারা দেখে যে কারোরই মনে হতে পারে এগুলো রুস্তমের বাড়িয়ে বলা, নিছকই গল্প। হায়রে গোপলা!
No comments