সংখ্যালঘুর মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের পুরো সময়টা রাষ্ট্র পরিচালনা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে ধর্মকে ন্যক্কারজনকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যেকোনো রাজনৈতিক-সামাজিক সংকট উত্তরণে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করতে কারণে-অকারণে ‘ইসলাম বিপন্ন’—এই ধোঁয়া তোলা হয়েছে। সামরিক শাসন ও স্বৈরাচার বলবত্ রাখতে ইসলামের বিপন্নতার প্রচার ছিল প্রধান অবলম্বন। সামরিক ষড়যন্ত্র ও ক্ষমতাপ্রিয়তা পাকিস্তানকে কোথায় দাঁড় করেছে তা আজ আলোচনার অপেক্ষা রাখে না। ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার কারণেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোয় ১৯৫০, ১৯৬৪ ও ১৯৭১ সালে হিন্দুদের জায়গা-জমি ‘মালে গানিমাত্’ হয়ে যায়।
১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর হিন্দু নাগরিকের সম্পত্তি ‘শত্রু সম্পত্তি’ আইনের আওতায় আনা হয়। ১৯৭২-এ শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিল করার নৈতিক দায়িত্ব ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের, তারা তা করেনি। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা সরকারের কাছে হিন্দু সম্প্রদায় আরও উপেক্ষিত হয়েছে। জাল দলিল, ভুয়া কাগজপত্র ও অর্পিত সম্পত্তির নাম দিয়ে যেভাবে হিন্দু সম্পত্তি গত পাঁচ দশক দখল করা হয়েছে তাতে বোঝা গেছে দখলদারের একমাত্র রাজনীতি ক্ষমতার সঙ্গে থাকা। এ দেশে অর্পিত সম্পত্তির নাম ভাঙিয়ে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ সংখ্যাগুরু মুসলিম লাভবান হলেও ৯৯ শতাংশ মুসলিমকে সাম্প্রদায়িকতার বিভাজন দিয়ে হিন্দুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, দেশের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক অবিশ্বাসের পরিবেশ, যার পরিণতিতে সাতচল্লিশের পর থেকে প্রায় দেড় কোটি হিন্দু মাতৃভূমি ছেড়ে দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছে।
১৯৭৪-এর পর অর্পিত সম্পত্তিসংক্রান্ত যাবতীয় আইন বাতিল হওয়া সত্ত্বেও ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রপতি সায়েম, পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া ও জেলারেল এরশাদ অর্পিত সম্পত্তিসংক্রান্ত আদেশ বহাল রাখেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ‘শত্রু সম্পত্তি’ আইনের রূপান্তর ঘটিয়ে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ আইন বলবত্ রাখা হয়। স্বাধীন দেশের নাগরিকের ওপর ‘শত্রু সম্পত্তি’ আইন চালু রাখা থেকে প্রতীয়মান হয় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র তার সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রতি পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি।
অর্পিত সম্পত্তি আইন জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদ ও বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ: ২৭ অনুচ্ছেদ ২৮(১), অনুচ্ছেদ ২৯(১), অনুচ্ছেদ ২৯(২) নাগরিকের অধিকারকে লঙ্ঘন করে আসছে। সাজু হোসেন বনাম বাংলাদেশ মামলায় ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট তারিখে এক ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের (আপিল বিভাগ) বিচারপতি মো. রুহুল আমিন, বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন এবং বিচারপতি তোফাজ্জেল ইসলাম। ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ ১৯৬৯ সালের ১ নম্বর অধ্যাদেশ ২৩ মার্চ ১৯৭৪ তারিখে সংসদে বাতিলের পর এটি একটি মৃত আইন, অর্পিত সম্পত্তির নামে আইনি প্রয়োগের ভিত্তি নেই—মর্মে এই ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের (আপিল বিভাগ) ওই রায়ে বলা হয়, ‘২৩ মার্চ ১৯৭৪ তারিখে ১৯৬৯ সালের ১ নম্বর অধ্যাদেশ বাতিল হওয়ায় শত্রু সম্পত্তি আইন নিজেই মৃত, পরে এ আইনের ভিত্তিতে আবার অর্পিত সম্পত্তি কেস রুজু করা আর যায় না, যেহেতু আইনটি ইতিমধ্যে নিজেই মৃত। তদনুযায়ী ১৯৮০ সালের ভিপি কেস নম্বর ২১০-এ ভূমির কেস কোনো ক্রমেই অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করার কোনো ভিত্তি নেই।’ (৫৮ ডিএলআর-২০০৬ পৃ. ১৭৭-১৮৫)।
এই ঐতিহাসিক রায় ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট দেওয়া হলেও দুই বছর পর ডিএলআরের ২০০৬ সালে তা প্রকাশ পায়। অতএব ২৩ মার্চ ১৯৭৪ সালের পর জিয়া-এরশাদ-খালেদা-শেখ হাসিনা সরকারের আমলে তহসিলদারদের দিয়ে লুক্কায়িত অর্পিত সম্পত্তি উদ্ধার ও চাকরির তৌফা হিসেবে যেসব হিন্দু সম্পত্তি তালিকাভুক্ত বা কেস করা হয়েছে, তা অবৈধ। জেনারেল এরশাদের ১৯৮৪ সালে নিষেধাজ্ঞার পর নতুন কোনো সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণা করা নিষেধ ছিল কিন্তু সবকিছু অবজ্ঞা করে ১৯৮৯ সালে হাজার হাজার একর সম্পত্তি অর্পিত ঘোষণা করা হয়।
অতএব ২৩ মার্চ ১৯৭৪ সালের পর হিন্দুদের যেসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি অর্পিত হিসেবে সরকার তালিকাভুক্ত বা মামলা করেছে তা প্রকৃত উত্তরাধিকারী ও বৈধ মালিকদের কাছে ফেরত দেওয়া হোক। দেশত্যাগী বা দেশান্তরী বাঙালি যারা বাংলাদেশের নাগরিকত্বের আইনমতে বৈধ নাগরিক তাদের পৈতৃক সম্পত্তি অর্পিত হিসেবে সরকার তালিকাভুক্ত বা লিজভুক্ত। আমরা দাবি করছি তাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দিন। সম্পত্তি ফিরে পাওয়া তাদের সাংবিধানিক অধিকার। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে এটা করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব।
পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ দেশে সামরিক শাসনের উদ্ভব হয়। জেনারেল জিয়ার শাসনামলে বাহাত্তরের অসাম্প্রদায়িক সংবিধান সংশোধন করে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে নতুন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল গড়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় জেনারেল এরশাদের আমলে ১৯৮৮ সালে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ করা হয়, যার মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের অধিকার মারাত্মকভাবে খর্বিত হয়।
২০০১ সালের বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, সে ব্যাপারেও সন্তোষজনক তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় পূজা অনুষ্ঠানের সময় প্রতিমা ভাঙচুর, শ্লীলতাহানির ঘটনার খবরও পাওয়া যায়। অনেক জায়গায় সংখ্যালঘুদের বলপূর্বক উচ্ছেদের ঘটনাও ঘটেছে। এই প্রেক্ষাপটে আমরা কিছু দাবি রাখছি:
উচ্চ আদালতের রায় মোতাবেক ২৩ মার্চ ১৯৭৪ সালের পর হিন্দুদের যেসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি অর্পিত হিসেবে সরকার তালিকাভুক্ত বা মামলা করেছে তা প্রকৃত উত্তরাধিকারী ও বৈধ মালিকদের কাছে প্রত্যর্পণ করা হোক।
ভারতের সংখ্যালঘুদের আর্থসামাজিক অবস্থান পর্যালোচনার জন্য ‘বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচার কমিশন’ গঠন করে যে দৃষ্টান্ত রেখেছে তা অনুসরণ করে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের আর্থসামাজিক অবস্থান পর্যালোচনার জন্য একটি ‘মাইনরিটি কমিশন’ গঠন, ‘মাইনরিটিবিষয়ক মন্ত্রণালয়’ বা ‘মাইনরিটি ফাউন্ডেশন বা বোর্ড’ গঠন করা হোক।
হিন্দুর উত্তরাধিকার আইনের সংশোধন করে ভারতীয় হিন্দু আইনের আলোকে নারীর জন্য সম্পত্তিতে সম-অধিকার প্রদান করা জরুরি। অমুসলিম নাগরিকদের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা হোক। সংবিধানের পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনী বাতিল করা হোক— কারণ তা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিসম্পন্ন। ১৯৭২ সালে গণপরিষদ প্রণীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ রূপ প্রতিস্থাপন করা হোক।
লেখকেরা: মানবাধিকার কর্মী, সাবেক সচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর হিন্দু নাগরিকের সম্পত্তি ‘শত্রু সম্পত্তি’ আইনের আওতায় আনা হয়। ১৯৭২-এ শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিল করার নৈতিক দায়িত্ব ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের, তারা তা করেনি। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা সরকারের কাছে হিন্দু সম্প্রদায় আরও উপেক্ষিত হয়েছে। জাল দলিল, ভুয়া কাগজপত্র ও অর্পিত সম্পত্তির নাম দিয়ে যেভাবে হিন্দু সম্পত্তি গত পাঁচ দশক দখল করা হয়েছে তাতে বোঝা গেছে দখলদারের একমাত্র রাজনীতি ক্ষমতার সঙ্গে থাকা। এ দেশে অর্পিত সম্পত্তির নাম ভাঙিয়ে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ সংখ্যাগুরু মুসলিম লাভবান হলেও ৯৯ শতাংশ মুসলিমকে সাম্প্রদায়িকতার বিভাজন দিয়ে হিন্দুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, দেশের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক অবিশ্বাসের পরিবেশ, যার পরিণতিতে সাতচল্লিশের পর থেকে প্রায় দেড় কোটি হিন্দু মাতৃভূমি ছেড়ে দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছে।
১৯৭৪-এর পর অর্পিত সম্পত্তিসংক্রান্ত যাবতীয় আইন বাতিল হওয়া সত্ত্বেও ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রপতি সায়েম, পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া ও জেলারেল এরশাদ অর্পিত সম্পত্তিসংক্রান্ত আদেশ বহাল রাখেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ‘শত্রু সম্পত্তি’ আইনের রূপান্তর ঘটিয়ে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ আইন বলবত্ রাখা হয়। স্বাধীন দেশের নাগরিকের ওপর ‘শত্রু সম্পত্তি’ আইন চালু রাখা থেকে প্রতীয়মান হয় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র তার সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রতি পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি।
অর্পিত সম্পত্তি আইন জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদ ও বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ: ২৭ অনুচ্ছেদ ২৮(১), অনুচ্ছেদ ২৯(১), অনুচ্ছেদ ২৯(২) নাগরিকের অধিকারকে লঙ্ঘন করে আসছে। সাজু হোসেন বনাম বাংলাদেশ মামলায় ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট তারিখে এক ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের (আপিল বিভাগ) বিচারপতি মো. রুহুল আমিন, বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন এবং বিচারপতি তোফাজ্জেল ইসলাম। ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ ১৯৬৯ সালের ১ নম্বর অধ্যাদেশ ২৩ মার্চ ১৯৭৪ তারিখে সংসদে বাতিলের পর এটি একটি মৃত আইন, অর্পিত সম্পত্তির নামে আইনি প্রয়োগের ভিত্তি নেই—মর্মে এই ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের (আপিল বিভাগ) ওই রায়ে বলা হয়, ‘২৩ মার্চ ১৯৭৪ তারিখে ১৯৬৯ সালের ১ নম্বর অধ্যাদেশ বাতিল হওয়ায় শত্রু সম্পত্তি আইন নিজেই মৃত, পরে এ আইনের ভিত্তিতে আবার অর্পিত সম্পত্তি কেস রুজু করা আর যায় না, যেহেতু আইনটি ইতিমধ্যে নিজেই মৃত। তদনুযায়ী ১৯৮০ সালের ভিপি কেস নম্বর ২১০-এ ভূমির কেস কোনো ক্রমেই অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করার কোনো ভিত্তি নেই।’ (৫৮ ডিএলআর-২০০৬ পৃ. ১৭৭-১৮৫)।
এই ঐতিহাসিক রায় ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট দেওয়া হলেও দুই বছর পর ডিএলআরের ২০০৬ সালে তা প্রকাশ পায়। অতএব ২৩ মার্চ ১৯৭৪ সালের পর জিয়া-এরশাদ-খালেদা-শেখ হাসিনা সরকারের আমলে তহসিলদারদের দিয়ে লুক্কায়িত অর্পিত সম্পত্তি উদ্ধার ও চাকরির তৌফা হিসেবে যেসব হিন্দু সম্পত্তি তালিকাভুক্ত বা কেস করা হয়েছে, তা অবৈধ। জেনারেল এরশাদের ১৯৮৪ সালে নিষেধাজ্ঞার পর নতুন কোনো সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণা করা নিষেধ ছিল কিন্তু সবকিছু অবজ্ঞা করে ১৯৮৯ সালে হাজার হাজার একর সম্পত্তি অর্পিত ঘোষণা করা হয়।
অতএব ২৩ মার্চ ১৯৭৪ সালের পর হিন্দুদের যেসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি অর্পিত হিসেবে সরকার তালিকাভুক্ত বা মামলা করেছে তা প্রকৃত উত্তরাধিকারী ও বৈধ মালিকদের কাছে ফেরত দেওয়া হোক। দেশত্যাগী বা দেশান্তরী বাঙালি যারা বাংলাদেশের নাগরিকত্বের আইনমতে বৈধ নাগরিক তাদের পৈতৃক সম্পত্তি অর্পিত হিসেবে সরকার তালিকাভুক্ত বা লিজভুক্ত। আমরা দাবি করছি তাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দিন। সম্পত্তি ফিরে পাওয়া তাদের সাংবিধানিক অধিকার। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে এটা করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব।
পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ দেশে সামরিক শাসনের উদ্ভব হয়। জেনারেল জিয়ার শাসনামলে বাহাত্তরের অসাম্প্রদায়িক সংবিধান সংশোধন করে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে নতুন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল গড়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় জেনারেল এরশাদের আমলে ১৯৮৮ সালে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ করা হয়, যার মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের অধিকার মারাত্মকভাবে খর্বিত হয়।
২০০১ সালের বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, সে ব্যাপারেও সন্তোষজনক তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় পূজা অনুষ্ঠানের সময় প্রতিমা ভাঙচুর, শ্লীলতাহানির ঘটনার খবরও পাওয়া যায়। অনেক জায়গায় সংখ্যালঘুদের বলপূর্বক উচ্ছেদের ঘটনাও ঘটেছে। এই প্রেক্ষাপটে আমরা কিছু দাবি রাখছি:
উচ্চ আদালতের রায় মোতাবেক ২৩ মার্চ ১৯৭৪ সালের পর হিন্দুদের যেসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি অর্পিত হিসেবে সরকার তালিকাভুক্ত বা মামলা করেছে তা প্রকৃত উত্তরাধিকারী ও বৈধ মালিকদের কাছে প্রত্যর্পণ করা হোক।
ভারতের সংখ্যালঘুদের আর্থসামাজিক অবস্থান পর্যালোচনার জন্য ‘বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচার কমিশন’ গঠন করে যে দৃষ্টান্ত রেখেছে তা অনুসরণ করে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের আর্থসামাজিক অবস্থান পর্যালোচনার জন্য একটি ‘মাইনরিটি কমিশন’ গঠন, ‘মাইনরিটিবিষয়ক মন্ত্রণালয়’ বা ‘মাইনরিটি ফাউন্ডেশন বা বোর্ড’ গঠন করা হোক।
হিন্দুর উত্তরাধিকার আইনের সংশোধন করে ভারতীয় হিন্দু আইনের আলোকে নারীর জন্য সম্পত্তিতে সম-অধিকার প্রদান করা জরুরি। অমুসলিম নাগরিকদের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা হোক। সংবিধানের পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনী বাতিল করা হোক— কারণ তা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিসম্পন্ন। ১৯৭২ সালে গণপরিষদ প্রণীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ রূপ প্রতিস্থাপন করা হোক।
লেখকেরা: মানবাধিকার কর্মী, সাবেক সচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
No comments