আওয়ামী লীগ: নতুন কমিটি নিয়ে প্রশ্ন by আসিফ নজরুল
আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি গঠন নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। এ বিষয়ে আলোচনার জন্য সেদিন রাতেই একটি টিভি চ্যানেলে আমার সঙ্গে উপস্থিত হন একজন নেতৃস্থানীয় সাংবাদিক। টিভি ক্যামেরার সামনে বসার আগে বরাবরের মতো আমাদের মধ্যে খোলামেলা কথাবার্তা হলো কিছুক্ষণ। সেখানে তিনি বারবার আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি নিয়ে তাঁর অস্বস্তি ও দুর্ভাবনার কথা বলতে থাকেন। শেখ হাসিনা বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছেন, আরেকটু সহনশীল ও কৌশলী হতে পারতেন তিনি— তাঁর বক্তব্য ছিল এ রকম। টিভি ক্যামেরার সামনে তিনি কি হুবহু এসব বলবেন? আমি নিশ্চিত ছিলাম তিনি তা বলবেন না। তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ বলে তাঁর পক্ষে প্রকাশ্যে এসব বলা হয়তো সম্ভবও নয়। আমার ধারণা সত্য হলো। টিভি অনুষ্ঠানে তিনি বরং প্রশংসা করলেন নতুন কমিটি গঠনে শেখ হাসিনার ভূমিকার। অনুষ্ঠানে এমনও বললেন যে এই কমিটি আসলে তিনি গঠন করেছেন দলের কাউন্সিলরদের মতামত অনুসারে।
অনুষ্ঠান শেষ হলে তিনি ফিরে যান বাস্তবতায়। আবারও বলেন, প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতাদের ঢালাওভাবে বাতিল করে দেওয়া ঠিক হয়নি, নেত্রী বেশি চাপ নিয়ে ফেললেন। নেত্রী কি রাজনৈতিকভাবে বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছেন না? আমার প্রশ্নে তিনি সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়েন।
২.
আমি যে প্রবীণ সাংবাদিকের কথা বললাম তিনি কোনো ব্যতিক্রমী মানুষ নন। তাঁর মতো আওয়ামী লীগের বহু শুভাকাঙ্ক্ষী প্রকাশ্যে না হলেও কমিটি গঠন প্রক্রিয়া এবং এতে যেভাবে সংস্কারপন্থী বলে পরিচিত সব স্তরের নেতাদের ছেঁটে ফেলা হয়েছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট নন বলে আমার ধারণা। মনে মনে ভিন্নমত পোষণ করলেও আওয়ামী লীগে (এবং অন্যান্য দলেও) দলপ্রধানের ইচ্ছায় অন্য কথা বলা হয়, ইতিহাস থেকেও এ ধারণার পক্ষে প্রমাণ হাজির করা সম্ভব। আমাদের সবার মনে থাকার কথা ২০০৩ সালে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের আওয়ামী লীগ ত্রিবার্ষিক নির্বাচনী কাউন্সিল নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে তুমুল আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল। এর মূল কারণ, এই কাউন্সিলে কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে দলের সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যন্য পদে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। এটি বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য এ এইচ এস কে সাদেককে প্রধান করে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আবদুর রাজ্জাক, ওবায়দুল কাদের, প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফসহ কয়েকজন নেতা এবং আওয়ামী লীগ-পন্থী হিসেবে পরিচিত অনেক পত্রিকা নির্বাচনের মাধ্যমে দলের নেতা নির্ধারণ দলে জবাবদিহি ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিরাট ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিল।
কাউন্সিলের দিন এর কিছুই হয়নি। দলের সভানেত্রীর মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন দলের সাধারণ সম্পাদক। সাধারণ সম্পাদক পদে আব্দুল জলিলের নাম প্রস্তাব করেন আবদুর রাজ্জাক, এ পদে যাঁর নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। প্রস্তাবটি সমর্থন করেন আর কেউ নন, স্বয়ং ওবায়দুল কাদের, যিনিও এই পদে আগ্রহী ছিলেন বলে কয়েক দিন আগেও পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল। অথচ কাউন্সিল শেষে তাঁরা সবাই এভাবে নেতা নির্বাচনে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। কেউ কেউ আওয়ামী লীগের ভেতর গণতন্ত্রের চর্চা নেই, এ অভিযোগ তীব্রভাবে খণ্ডনও করেছিলেন।
এক-এগারোর পর আমরা এঁদের অনেককে আওয়ামী লীগে আরও গণতন্ত্র চর্চা এবং দলের ভেতর যৌথ নেতৃত্বকাঠামো প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, এ ধরনের কথা বলতে শুনেছি। এটি প্রমাণ করে, ২০০৩-এর কাউন্সিল এবং এরপর দল যেভাবে পরিচালিত হয়েছে, তা নিয়ে এঁদের ভেতর ক্ষোভ বা আপত্তি ছিল। তা-ই যদি সত্যি হয় তাহলে আরও নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এবারের কাউন্সিলে বাদ পড়া নেতারা তো বটেই, আরও অনেকেই দলের ভেতর গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে না, এ ধরনের মনোভাব পোষণ করতে পারেন।
আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। হয়তো আওয়ামী লীগের কাউন্সিলরদের সবাই নেতা নির্বাচনের জন্য শেখ হাসিনা এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন, আন্তরিকভাবে এটি চেয়েছেন। হয়তো তাঁদের কেউই নিজের স্বাধীন ইচ্ছা ও মতামত প্রয়োগ করে কোনো নেতা নির্বাচন করতে চাননি। হয়তো পুরো দলের একজনও কার্যনির্বাহী সংসদের কোনো পদে নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহ বোধ করেননি। সত্যি যদি এ রকম হয়ে থাকে, তাহলে তো ৬০ বছরের পুরোনো একটি গণতান্ত্রিক দলের জন্য তা আরও বিপজ্জনক। দলের ভেতর গণতন্ত্রচর্চায় অনাগ্রহী এই দল তাহলে দেশকে কী গণতন্ত্র উপহার দেবে? বিএনপি বা জাতীয় পার্টির মতো তুলনায় আরও অগণতান্ত্রিক দলগুলোর জন্য গণতন্ত্র চর্চার কী প্রণোদনা সৃষ্টি করবে আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিল?
৩.
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী, সম্পাদকমণ্ডলী ও সাংগঠনিক সম্পাদকমণ্ডলী থেকে প্রায় দেড় ডজন নেতা বাদ পড়েছেন। এঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় একটিই অভিযোগ উচ্চারিত হয়েছে, সেটি হচ্ছে এক-এগারোপরবর্তী সময়ে এঁরা আওয়ামী লীগের ভেতর সংস্কার এবং দলে নিয়মিত কাউন্সিল ও যৌথ নেতৃত্বকাঠামো প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কেউ কেউ সে সময় অন্তরিন্ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়েই এ ধরনের সংস্কার করা যেতে পারে, আকারে-ইঙ্গিতে এমন কথা বলেছেন।
আওয়ামী লীগের বহু নেতা-কর্মী এতে মনঃক্ষুণ্ন ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ক্ষুব্ধ তাঁদের হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে আওয়ামী লীগে সংস্কার প্রয়োজন, আর শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়েই এই সংস্কার করা যেতে পারে, দুটো বক্তব্য এক নয়। সংস্কার প্রয়োজন, শুধু এই কথা যাঁরা বলেছেন, তাঁদের মধ্যেও যে অধিকাংশ এবার দলের নেতৃত্ব থেকে বাদ পড়েছেন, উদ্বেগের বড় কারণ এটি। এই ঘটনার পর দলনেত্রী কোনোভাবে অখুশি হতে পারেন, এমন কোনো বক্তব্য প্রদান করার সাহস আর কেউ দেখাবেন বলে মনে হয় না। এতে দলের ভেতর বহুমতের চর্চা রুদ্ধ হবে, দলের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে, দলের নেত্রী উপযুক্ত পরামর্শ থেকে বঞ্চিত হবেন। দলের ভেতর ক্ষমতার অতিকেন্দ্রিকতা সৃষ্টি হবে, এক নেত্রীর ওপর প্রত্যাশা ও নির্ভরতার অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হবে, সরকার পরিচালনায়ও এর প্রভাব পড়বে।
অতীতে আওয়ামী লীগের ভেতর ভিন্নমত চর্চা করতে গিয়ে নেতৃত্ব বা দল থেকে ড. কামাল হোসেন, কাদের সিদ্দিকী ও ড. সেলিমের মতো নেতারা বাদ পড়েছেন। এবারের কাউন্সিলে দলের নীতিনির্ধারণী কাঠামো থেকে একসঙ্গে বাদ পড়লেন এমন বেশ কয়েকজন নেতা, যাঁদের স্বাধীনতাসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং আওয়ামী লীগের বিকাশে বিশাল অবদান ছিল। বাদ পড়লেন মধ্যম সারির অনেক নেতা, যাঁরা তৃণমূল পর্যায় থেকে দলের নেতৃত্বে আসীন হয়েছিলেন। অন্যদিকে একসঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় পদে আসীন হয়েছেন এমন বহু নেতা, যাঁরা সারা জীবন শুধু স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতি করেছেন। একদিক থেকে এটি প্রশংসনীয়, কিন্তু এমন নেতাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে এটি ঝুঁকিপূর্ণও। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবেও যিনি কখনো ছিলেন না, তিনি দলের কোনো একটি সম্পাদক (এমনকি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের) পদ যখন পেয়ে যান, তা কাউন্সিলরদের ইচ্ছায় হয় কীভাবে? এটি যদি একজন নেত্রীর ইচ্ছায় হয়ে থাকে, তাহলে তিনি সেই নেত্রীর প্রতি শুধু দায়বদ্ধ থাকবেন, দলের প্রতি নয়। নেত্রী ও দলের স্বার্থ সব সময় এক হওয়া অসম্ভব।
আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্বে আরও সমস্যা রয়েছে। এখানে বহুসংখ্যক মন্ত্রীর উপস্থিতি দল ও সরকারের স্বাতন্ত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে সব বিভাগ ও জেলার প্রতিনিধিত্ব হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। সবচেয়ে বড় যা সমস্যা, দলের যে প্রবীণ পাঁচ নেতাকে সভাপতিমণ্ডলী থেকে উপদেষ্টামণ্ডলীর মতো আলংকারিক ও ক্ষমতাহীন জায়গায় সরিয়ে দেওয়া হলো, তাঁদের কারও কারও দলের বিভিন্ন পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। তাঁদের সমর্থকদের অসন্তুষ্টি ভবিষ্যতে দলের জন্য নানা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। কৌশলগতভাবে হলেও এঁদের অন্তত দু-একজনকে মন্ত্রিসভা বা প্রেসিডিয়ামে রেখে সেই ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যেত।
৪.
আওয়ামী লীগে গণতন্ত্র কতটুকু ও কীভাবে চর্চিত হচ্ছে, তা নিয়ে দেশের মানুষের উত্কণ্ঠার কারণ রয়েছে। আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে পুরোনো ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। এক-এগারোর আগেও দলের সভানেত্রীসহ অনেক নেতা বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্র চর্চার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। এবারের নির্বাচনে দলের স্লোগান ছিল দিনবদলের। সেই অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন শুধু সভানেত্রীর প্রতি চরম অনুগতদের নেতৃত্বের আসীনে বসিয়ে সম্ভব কি না, তা ভাবার বিষয়। দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বরং কাউন্সিলরদের নেতা নির্বাচনের জন্য গোপন ব্যালট বাক্সে ভোটাভুটি করার আন্তরিক নির্দেশ দিয়ে এবং তা বাস্তবায়ন করে সত্যিকার দিনবদলের সূচনা করতে পারতেন। অন্য দলগুলোর জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্তও স্থাপিত হতো এতে।
ভালো নজির স্থাপনের অবকাশ এখনো আছে তাঁর। দলের নতুন নেতাদের স্বাধীনভাবে বক্তব্য পেশ করার, এমনকি প্রয়োজনে দলীয় ফোরামে তাঁর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার অনুপ্রেরণা প্রদান করে দলকে আরও গতিশীল ও প্রাণবন্ত করতে পারেন তিনি। আমরা তাঁর কাছে এবং অন্যান্য দলপ্রধানের কাছে তা-ই আশা করব।
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা কাউন্সিলরদের ভোটে নির্বাচিত হলে এবং স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ পেলে এ দেশে হয়তো এক-এগারো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। ভারতে দলের ভেতর গণতন্ত্রচর্চার যথেষ্ট সুযোগ আছে বলে সেখানে গণতন্ত্র হোঁচট খায় না। পাকিস্তানে তা নেই বলে গণতন্ত্র বারবার মুখ থুবড়ে পড়ে।
আমরা চাই না আমাদের গণতন্ত্র আর কখনো মুখ থুবড়ে পড়ুক। দলের ভেতর গণতন্ত্র চর্চা না হলে উদ্বিগ্ন হই সে কারণে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অনুষ্ঠান শেষ হলে তিনি ফিরে যান বাস্তবতায়। আবারও বলেন, প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতাদের ঢালাওভাবে বাতিল করে দেওয়া ঠিক হয়নি, নেত্রী বেশি চাপ নিয়ে ফেললেন। নেত্রী কি রাজনৈতিকভাবে বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছেন না? আমার প্রশ্নে তিনি সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়েন।
২.
আমি যে প্রবীণ সাংবাদিকের কথা বললাম তিনি কোনো ব্যতিক্রমী মানুষ নন। তাঁর মতো আওয়ামী লীগের বহু শুভাকাঙ্ক্ষী প্রকাশ্যে না হলেও কমিটি গঠন প্রক্রিয়া এবং এতে যেভাবে সংস্কারপন্থী বলে পরিচিত সব স্তরের নেতাদের ছেঁটে ফেলা হয়েছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট নন বলে আমার ধারণা। মনে মনে ভিন্নমত পোষণ করলেও আওয়ামী লীগে (এবং অন্যান্য দলেও) দলপ্রধানের ইচ্ছায় অন্য কথা বলা হয়, ইতিহাস থেকেও এ ধারণার পক্ষে প্রমাণ হাজির করা সম্ভব। আমাদের সবার মনে থাকার কথা ২০০৩ সালে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের আওয়ামী লীগ ত্রিবার্ষিক নির্বাচনী কাউন্সিল নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে তুমুল আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল। এর মূল কারণ, এই কাউন্সিলে কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে দলের সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যন্য পদে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। এটি বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য এ এইচ এস কে সাদেককে প্রধান করে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আবদুর রাজ্জাক, ওবায়দুল কাদের, প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফসহ কয়েকজন নেতা এবং আওয়ামী লীগ-পন্থী হিসেবে পরিচিত অনেক পত্রিকা নির্বাচনের মাধ্যমে দলের নেতা নির্ধারণ দলে জবাবদিহি ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিরাট ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিল।
কাউন্সিলের দিন এর কিছুই হয়নি। দলের সভানেত্রীর মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন দলের সাধারণ সম্পাদক। সাধারণ সম্পাদক পদে আব্দুল জলিলের নাম প্রস্তাব করেন আবদুর রাজ্জাক, এ পদে যাঁর নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। প্রস্তাবটি সমর্থন করেন আর কেউ নন, স্বয়ং ওবায়দুল কাদের, যিনিও এই পদে আগ্রহী ছিলেন বলে কয়েক দিন আগেও পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল। অথচ কাউন্সিল শেষে তাঁরা সবাই এভাবে নেতা নির্বাচনে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। কেউ কেউ আওয়ামী লীগের ভেতর গণতন্ত্রের চর্চা নেই, এ অভিযোগ তীব্রভাবে খণ্ডনও করেছিলেন।
এক-এগারোর পর আমরা এঁদের অনেককে আওয়ামী লীগে আরও গণতন্ত্র চর্চা এবং দলের ভেতর যৌথ নেতৃত্বকাঠামো প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, এ ধরনের কথা বলতে শুনেছি। এটি প্রমাণ করে, ২০০৩-এর কাউন্সিল এবং এরপর দল যেভাবে পরিচালিত হয়েছে, তা নিয়ে এঁদের ভেতর ক্ষোভ বা আপত্তি ছিল। তা-ই যদি সত্যি হয় তাহলে আরও নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এবারের কাউন্সিলে বাদ পড়া নেতারা তো বটেই, আরও অনেকেই দলের ভেতর গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে না, এ ধরনের মনোভাব পোষণ করতে পারেন।
আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। হয়তো আওয়ামী লীগের কাউন্সিলরদের সবাই নেতা নির্বাচনের জন্য শেখ হাসিনা এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন, আন্তরিকভাবে এটি চেয়েছেন। হয়তো তাঁদের কেউই নিজের স্বাধীন ইচ্ছা ও মতামত প্রয়োগ করে কোনো নেতা নির্বাচন করতে চাননি। হয়তো পুরো দলের একজনও কার্যনির্বাহী সংসদের কোনো পদে নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহ বোধ করেননি। সত্যি যদি এ রকম হয়ে থাকে, তাহলে তো ৬০ বছরের পুরোনো একটি গণতান্ত্রিক দলের জন্য তা আরও বিপজ্জনক। দলের ভেতর গণতন্ত্রচর্চায় অনাগ্রহী এই দল তাহলে দেশকে কী গণতন্ত্র উপহার দেবে? বিএনপি বা জাতীয় পার্টির মতো তুলনায় আরও অগণতান্ত্রিক দলগুলোর জন্য গণতন্ত্র চর্চার কী প্রণোদনা সৃষ্টি করবে আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিল?
৩.
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী, সম্পাদকমণ্ডলী ও সাংগঠনিক সম্পাদকমণ্ডলী থেকে প্রায় দেড় ডজন নেতা বাদ পড়েছেন। এঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় একটিই অভিযোগ উচ্চারিত হয়েছে, সেটি হচ্ছে এক-এগারোপরবর্তী সময়ে এঁরা আওয়ামী লীগের ভেতর সংস্কার এবং দলে নিয়মিত কাউন্সিল ও যৌথ নেতৃত্বকাঠামো প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কেউ কেউ সে সময় অন্তরিন্ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়েই এ ধরনের সংস্কার করা যেতে পারে, আকারে-ইঙ্গিতে এমন কথা বলেছেন।
আওয়ামী লীগের বহু নেতা-কর্মী এতে মনঃক্ষুণ্ন ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ক্ষুব্ধ তাঁদের হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে আওয়ামী লীগে সংস্কার প্রয়োজন, আর শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়েই এই সংস্কার করা যেতে পারে, দুটো বক্তব্য এক নয়। সংস্কার প্রয়োজন, শুধু এই কথা যাঁরা বলেছেন, তাঁদের মধ্যেও যে অধিকাংশ এবার দলের নেতৃত্ব থেকে বাদ পড়েছেন, উদ্বেগের বড় কারণ এটি। এই ঘটনার পর দলনেত্রী কোনোভাবে অখুশি হতে পারেন, এমন কোনো বক্তব্য প্রদান করার সাহস আর কেউ দেখাবেন বলে মনে হয় না। এতে দলের ভেতর বহুমতের চর্চা রুদ্ধ হবে, দলের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে, দলের নেত্রী উপযুক্ত পরামর্শ থেকে বঞ্চিত হবেন। দলের ভেতর ক্ষমতার অতিকেন্দ্রিকতা সৃষ্টি হবে, এক নেত্রীর ওপর প্রত্যাশা ও নির্ভরতার অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হবে, সরকার পরিচালনায়ও এর প্রভাব পড়বে।
অতীতে আওয়ামী লীগের ভেতর ভিন্নমত চর্চা করতে গিয়ে নেতৃত্ব বা দল থেকে ড. কামাল হোসেন, কাদের সিদ্দিকী ও ড. সেলিমের মতো নেতারা বাদ পড়েছেন। এবারের কাউন্সিলে দলের নীতিনির্ধারণী কাঠামো থেকে একসঙ্গে বাদ পড়লেন এমন বেশ কয়েকজন নেতা, যাঁদের স্বাধীনতাসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং আওয়ামী লীগের বিকাশে বিশাল অবদান ছিল। বাদ পড়লেন মধ্যম সারির অনেক নেতা, যাঁরা তৃণমূল পর্যায় থেকে দলের নেতৃত্বে আসীন হয়েছিলেন। অন্যদিকে একসঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় পদে আসীন হয়েছেন এমন বহু নেতা, যাঁরা সারা জীবন শুধু স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতি করেছেন। একদিক থেকে এটি প্রশংসনীয়, কিন্তু এমন নেতাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে এটি ঝুঁকিপূর্ণও। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবেও যিনি কখনো ছিলেন না, তিনি দলের কোনো একটি সম্পাদক (এমনকি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের) পদ যখন পেয়ে যান, তা কাউন্সিলরদের ইচ্ছায় হয় কীভাবে? এটি যদি একজন নেত্রীর ইচ্ছায় হয়ে থাকে, তাহলে তিনি সেই নেত্রীর প্রতি শুধু দায়বদ্ধ থাকবেন, দলের প্রতি নয়। নেত্রী ও দলের স্বার্থ সব সময় এক হওয়া অসম্ভব।
আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্বে আরও সমস্যা রয়েছে। এখানে বহুসংখ্যক মন্ত্রীর উপস্থিতি দল ও সরকারের স্বাতন্ত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে সব বিভাগ ও জেলার প্রতিনিধিত্ব হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। সবচেয়ে বড় যা সমস্যা, দলের যে প্রবীণ পাঁচ নেতাকে সভাপতিমণ্ডলী থেকে উপদেষ্টামণ্ডলীর মতো আলংকারিক ও ক্ষমতাহীন জায়গায় সরিয়ে দেওয়া হলো, তাঁদের কারও কারও দলের বিভিন্ন পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। তাঁদের সমর্থকদের অসন্তুষ্টি ভবিষ্যতে দলের জন্য নানা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। কৌশলগতভাবে হলেও এঁদের অন্তত দু-একজনকে মন্ত্রিসভা বা প্রেসিডিয়ামে রেখে সেই ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যেত।
৪.
আওয়ামী লীগে গণতন্ত্র কতটুকু ও কীভাবে চর্চিত হচ্ছে, তা নিয়ে দেশের মানুষের উত্কণ্ঠার কারণ রয়েছে। আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে পুরোনো ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। এক-এগারোর আগেও দলের সভানেত্রীসহ অনেক নেতা বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্র চর্চার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। এবারের নির্বাচনে দলের স্লোগান ছিল দিনবদলের। সেই অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন শুধু সভানেত্রীর প্রতি চরম অনুগতদের নেতৃত্বের আসীনে বসিয়ে সম্ভব কি না, তা ভাবার বিষয়। দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বরং কাউন্সিলরদের নেতা নির্বাচনের জন্য গোপন ব্যালট বাক্সে ভোটাভুটি করার আন্তরিক নির্দেশ দিয়ে এবং তা বাস্তবায়ন করে সত্যিকার দিনবদলের সূচনা করতে পারতেন। অন্য দলগুলোর জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্তও স্থাপিত হতো এতে।
ভালো নজির স্থাপনের অবকাশ এখনো আছে তাঁর। দলের নতুন নেতাদের স্বাধীনভাবে বক্তব্য পেশ করার, এমনকি প্রয়োজনে দলীয় ফোরামে তাঁর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার অনুপ্রেরণা প্রদান করে দলকে আরও গতিশীল ও প্রাণবন্ত করতে পারেন তিনি। আমরা তাঁর কাছে এবং অন্যান্য দলপ্রধানের কাছে তা-ই আশা করব।
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা কাউন্সিলরদের ভোটে নির্বাচিত হলে এবং স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ পেলে এ দেশে হয়তো এক-এগারো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। ভারতে দলের ভেতর গণতন্ত্রচর্চার যথেষ্ট সুযোগ আছে বলে সেখানে গণতন্ত্র হোঁচট খায় না। পাকিস্তানে তা নেই বলে গণতন্ত্র বারবার মুখ থুবড়ে পড়ে।
আমরা চাই না আমাদের গণতন্ত্র আর কখনো মুখ থুবড়ে পড়ুক। দলের ভেতর গণতন্ত্র চর্চা না হলে উদ্বিগ্ন হই সে কারণে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments