স্টেডিয়াম নয়, আমরা হাসপাতাল চাই: মরক্কোয় তরুণদের প্রতিবাদ
ডিজিটাল প্রজন্মের আন্দোলন: জেন জি ২১২
‘জেন জি ২১২’ তরুণদের একটি সংগঠন। এই নামের সংখ্যাটি মরক্কোর আন্তর্জাতিক টেলিফোন কোড নির্দেশ করে- ডিসকর্ড, টিকটক জেস ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মে আন্দোলনের সমন্বয় করছে। তারা অনুপ্রাণিত হয়েছে নেপালের সাম্প্রতিক আন্দোলন থেকে। সেখানে তরুণরা সরকারকে তীব্রভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। মরক্কোর তরুণরাও একইভাবে চায় সরকার যেন হাসপাতাল ও শিক্ষা নিয়ে সেই একই তৎপরতা দেখায়, যেভাবে তারা বিশ্বকাপ আয়োজনে দেখাচ্ছে।
স্বাস্থ্য আগে, বিশ্বকাপ পরে
২০২৫ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর ১০টি শহরে বিক্ষোভ দিয়ে শুরু হওয়া এই আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। স্লোগান ওঠে- ‘নো ওয়ার্ল্ড কাপ, হেল্থ কামস ফার্স্ট!’ অর্থাৎ কোনো বিশ্বকাপ নয়, আগে স্বাস্থ্যসেবা। অন্য স্লোগানে বলা হয়- ‘উই ওয়ান্ট হসপিটালস, নট ফুটবল স্টেডিয়াম!’ অর্থাৎ ফুটবল স্টেডিয়াম নয়, আমরা চাই হাসপাতাল। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের প্রতিক্রিয়া ছিল কঠোর। নির্বিচারে গ্রেপ্তার শুরু করে তারা। কিছু জায়গায় সংঘর্ষে রূপ নেয় পরিস্থিতি। তিনজন বিক্ষোভকারী নিহত হন। প্রধানমন্ত্রী আজিজ আখানুশ বৃহস্পতিবার বলেন, তিনি আলোচনায় রাজি। কিন্তু নেতাহীন তরুণ আন্দোলনটি ঘোষণা দিয়েছে- ‘বাস্তব পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত থামবো না।’
তরুণদের দাবির তালিকা
তরুণরা সামাজিকমাধ্যমে প্রকাশ করেছে তাদের আট দফা দাবি। সেগুলো হলো- সবার জন্য বিনামূল্যে ও মানসম্মত শিক্ষা, সবার জন্য সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা, মর্যাদাপূর্ণ ও সাশ্রয়ী আবাসন, উন্নত গণপরিবহন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও নিত্যপণ্যে ভর্তুকি, বেতন ও পেনশন বৃদ্ধি, তরুণদের কর্মসংস্থান ও বেকারত্ব হ্রাস ও ফরাসির পরিবর্তে ইংরেজিকে দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ।
আন্দোলনের সূচনা: হাসপাতালের করুণ মৃত্যু
এই আন্দোলনে আগুন জ্বেলে দেয় আগাদির শহরের একটি সরকারি হাসপাতালে আট নারীর মৃত্যু। সেপ্টেম্বরে কয়েকদিনের ব্যবধানে তারা সবাই প্রসূতি ওয়ার্ডে প্রাণ হারান। অভিযোগ আছে, যথাযথ চিকিৎসা, সরঞ্জাম ও ডাক্তার থাকলে এই মৃত্যু এড়ানো যেত। ২০২৩ সালে প্রতি ১০ হাজার নাগরিকের জন্য সেখানে মাত্র ৭.৮ জন চিকিৎসক ছিলেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ন্যূনতম সুপারিশ ২৩ জনের অনেক নিচে এই সংখ্যা।
আমরা যুক্তিসঙ্গত দাবি করছি
বেলহাসান বলেন, আমরা কোনো বিলাসী দাবি করছি না। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা মৌলিক অধিকার- এগুলোই আগে আসা উচিত। তিনি জানান, পুলিশের দিকে তাকাতেও ভয় হচ্ছিল, যেন চোখাচোখি না হয়। আমি জানতাম বিপদ হতে পারে। তবু রাস্তায় গিয়েছি। এই অভিযানে বুধবার পর্যন্ত ৪০৯ জনকে গ্রেপ্তার, ২৬০ জন পুলিশ ও ২০ জন বিক্ষোভকারী আহত এবং ৬০টি যানবাহন পোড়ানো হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানান।
তরুণ হাকিমের অভিজ্ঞতা
২৩ বছর বয়সী হাকিম (ছদ্মনাম) কাসাব্লাঙ্কায় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অংশ নিতে গেলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি বলেন, সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। আমার পিতা স্ট্রোকে আক্রান্ত। আমাদের কিছু সঞ্চয় না থাকলে তিনি বাঁচতেন না। আমি এমন দেশে কী লাভ পাচ্ছি, যে দেশ না বাবা-মায়ের চিকিৎসা দিতে পারে, না আমাকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারে?
মানবাধিকার সংস্থার সমালোচনা
দেশের মানবাধিকার সংগঠন ও বিরোধীরা পুলিশের দমননীতির তীব্র সমালোচনা করেছে। অনেকে ১৯৮১ সালের ‘রুটি দাঙ্গা’র স্মৃতি টেনে এনেছেন তারা। সেই আন্দোলনে শতাধিক মানুষ নিহত হন খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ করতে গিয়ে। এরপর ২০১১ সালে আরব বসন্তের ঢেউয়ে মরক্কোতেও তরুণরা রাস্তায় নামেন। সংবিধান সংস্কার হয় এবং প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাহী ক্ষমতা দেয়া হয়, যদিও রাজা মোহাম্মদ ষষ্ঠ এখনও রাষ্ট্র, সেনাবাহিনী ও ধর্মীয় প্রধান।
আমাদের নেতা নেই, তবু আমরা এক
বেলহাসান বলেন, আমরা কোনো রাজনৈতিক দল না। আমাদের কোনো নেতা নেই। হয়তো এই কারণেই সরকার আমাদের উপেক্ষা করছে। কারণ আমরা ঐতিহ্যবাহী পথ অনুসরণ করিনি। তবুও সহিংসতার কিছু ঘটনা আন্দোলনকারীরাই নিন্দা করেছে। অনেকেই দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নিজেরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করেছে এবং শান্তিপূর্ণ সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে।
আমরা ফুটবল ভালোবাসি, কিন্তু...
বেলহাসান বলেন, অবশ্যই আমরা বিশ্বকাপ আয়োজনে উচ্ছ্বসিত। ফুটবল আমাদের রক্তে মিশে আছে। কিন্তু আমাদের ভিত্তিটা অনুপস্থিত। হ্যাঁ, স্টেডিয়াম বানান, কিন্তু সেই সঙ্গে হাসপাতাল ও স্কুলও বানান। আগে মানুষকে বাঁচান, তারপর উৎসব করুন।

No comments