নাটকীয়তার পর গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর

নানা নাটকীয়তার পর গাজায় কার্যকর হয়েছে বহুল কাক্সিক্ষত যুদ্ধবিরতি চুক্তি। তিন জিম্মির একটি তালিকা  ইসরাইলের কাছে হস্তান্তরের পর এ বিষয়ে অগ্রসর হয়েছে উভয় পক্ষ। স্থানীয় সময় রোববার বেলা সোয়া ১১টার দিকে চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয়। এ খবর দিয়েছে অনলাইন আল জাজিরা। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর প্রকাশ করা এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গাজা থেকে তিন জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। এ ছাড়া আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আরও চার নারীকে মুক্তির কথাও জানিয়েছে সংগঠনটি। এদিকে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পরে রোববার বেলা সাড়ে ১১টার মধ্যে ইসরাইল হামলা চালিয়েছে। এতে  আরও ১৯ জন নিহত এবং ৩৬ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন গাজার সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল। এদের মধ্যে রাফা শহরে একজন, খান ইউনূসে ৬ জন এবং গাজার উত্তরাঞ্চলে বাকিরা নিহত হয়েছেন বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন ওই মুখপাত্র। যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকরের প্রথম দিনে মুক্তি দেয়া তিনজন ইসরাইলি বন্দির নাম প্রকাশ করেছে গাজার নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাস। এক টেলিগ্রাম পোস্টে হামাসের একজন মুখপাত্র এই তথ্য জানিয়েছেন। গাজায় স্থানীয় সময় রোববার সকাল সাড়ে ৮টায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জিম্মিদের নাম প্রকাশে দেরি হওয়ায় তা বিলম্ব হয়। ওদিকে এই যুদ্ধের কারণে গাজায় কয়েক লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তারা ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন তাঁবুতে, অস্থায়ী ক্যাম্পে। তাদের অনেকে যা কিছু সম্বল আছে, তা নিয়ে ঘরে ফেরার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ঘরবাড়ি কোথায় ছিল, সেই ঠিকানাটাও চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ, হামলায় যেভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা, তাতে মানচিত্রই যেন বদলে গেছে।

অনেকে সেই ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন। তাদেরকে সান্ত্বনা দেয়ার মানুষ নেই। সবারই এক অবস্থা। পুরো পরিবার বা পরিবারের কাউকে হারাননি এই যুদ্ধে এমন পরিবার খুব কমই আছে। যারা ফিরছেন তাদের চোখে-মুখে হতাশা। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। ফেরত আসা মানুষের মধ্যে আবেগ, কান্না মিলেমিশে একাকার। এই মাটি, এই ধ্বংসস্তূপ তাদের স্বজন, সব হারানোর সাক্ষ্য বহন করছে। হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৪৭ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরাইল। তার মধ্যে আছেন কয়েক ডজন সাংবাদিক, মিডিয়াকর্মী। তারা ইসরাইলের গণহত্যাকে প্রামাণ্য হিসেবে ধারণ করতে গিয়ে তার মূল্য দিয়েছেন। গাজায় আল জাজিরার ব্যুরো চিফ ওয়ায়েল দাহদু তার স্ত্রী, সন্তান এবং নাতি-পুতিদের হারিয়েছেন। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর তিনি বলেন, ঠিক এ সময়ে আমার মনের মধ্যে ঝড় চলছে। আমার হৃদয় কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমার বেশ কিছু সহকর্মীকে হারিয়েছি। আমরা একসঙ্গে অনাহার এবং হুমকি মোকাবিলা করেছি। এখন সেই কষ্ট আমাকে মুষড়ে দিচ্ছে। এই যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতায় বড় ভূমিকা পালন করেছে কাতার। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল আনসারী বলেছেন, ২০২৩ সালের নভেম্বরে আমরা একই রকম পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। কিন্তু এবার শেষ মুহূর্তে বন্দি ও জিম্মি- যাদেরকে মুক্তি দেয়া হবে তাদের নাম পাওয়া নিয়ে বিঘ্ন ঘটে। এ জন্য শেষ মুহূর্তে চুক্তি কার্যকরে বিলম্ব হয়। তা সত্ত্বেও চুক্তি কার্যকর হয়েছে। জিম্মি এবং বন্দি বিনিময় হয়েছে দুইপক্ষের মধ্যে। তিনি আরও বলেন, যুদ্ধবিরতি বজায় রাখা এবং চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখনো প্রচুর লজিস্টিক জটিলতা আছে। মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সেগুলো সম্পন্ন করতে হবে। তিনি বলেছেন, গাজার ভেতরে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং চলাচল করা সহজ হবে না। এ জন্য কিছু সময় প্রয়োজন হবে। আমরা এ সমস্যা সমাধানে সক্ষম হবো। সবেমাত্র চুক্তি কার্যকর করা হয়েছে। গাজায় ত্রাণ প্রবেশ শুরু করেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ডব্লিউএফপি বলেছে, তাদের ত্রাণবাহী ট্রাক গাজা সীমান্ত অতিক্রম শুরু করেছে চুক্তি কার্যকরের পরপরই। দক্ষিণে কারেম আবু সালেম এবং উত্তরে জিকিমে আরেকটি সীমান্ত দিয়ে এসব ট্রাক প্রবেশ করেছে। প্রথম ট্রাকগুলোতে আছে আটা এবং তাৎক্ষণিকভাবে খাওয়া যাবে এমন খাদ্য। বিপর্যস্ত মানুষ এসব খাবার সঙ্গে সঙ্গে খেতে পারবেন। মিশর, জর্ডান এবং ইসরাইলের রুট ব্যবহার করে তারা নিয়মিতভাবে খাদ্য সরবরাহ দেবে।

ইসরাইলের জেলে অন্যায়ভাবে আটকে রাখা হয়েছে হাজারো ফিলিস্তিনিকে। প্রথম দফায় কুখ্যাত অফার কারাগারে আটক ৯৫ জনসহ যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম দফায় মুক্তি পাওয়ার কথা কয়েক শত ফিলিস্তিনি বন্দির। দখলীকৃত পশ্চিম তীরের জেনিন শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছেন মরিয়ম ওয়াইস নামে এক মা। তার তিন ছেলে ইসরাইলের কারাগারে বন্দি। তিনি আশায় বুক বেঁধে আছেন, তার ছেলেরা মুক্তি পাবে। চুক্তি কার্যকরের প্রথমদিনে তার কমপক্ষে এক ছেলেকে তিনি ঘরে নিয়ে যেতে পারবেন- এমন আশায় প্রার্থনা করছিলেন। অন্য দুই ছেলেকে পরে মুক্তি দেয়ার কথা। শেষের দু’জন ইসরাইলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছিলেন। মরিয়ম বলেন, আমার ছেলে মুক্তি পাবে শোনার পর আমি বিস্মিত হয়েছি। আমার শরীর কাঁপতে শুরু করে। হঠাৎ করে অসুস্থ বোধ হচ্ছিল। আমার চারপাশে যারা আছেন তারা জানতে চাইলেন- আমার কি হয়েছে? জবাবে বললাম- জানি না। মনে হচ্ছে আমি খুব খুশি। জানি না আমার কেমন অনুভূতি হচ্ছে। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.