উত্তরটা আপাকেই দিতে হবে by শামীমুল হক

প্রিয়, হাসু আপা, কেমন আছেন? এর উত্তর আপনাকেই দিতে হবে এমন নয়। দেশ-বিদেশের সবাই জানেন। বাংলাদেশের রাজা হয়ে এখন অন্য দেশের দয়ায় দিন কাটাচ্ছেন- এটাকে ভালো থাকা বলা যায় না। তারপরও আপনি সব সময়ই ব্যতিক্রম। এই যে অন্য দেশে বসে নিজ দেশের নেতাকর্মীদের মাঝে মাঝে সবক দিচ্ছেন। এই সবক আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস করছেন। এতে কি বোঝাতে চাইছেন- মানুষ কিন্তু সবই বুঝে। ক্ষমতায় থাকতেও আপনি তা করেছেন। একাধিক প্রমাণ আছে দেশবাসীর কাছে। এ ছাড়া নিজের ঢোল নিজে পিটানোকে আপনি খুব পছন্দ করেন- এটা সবাই জানে। তাই তো গত প্রায় ষোল বছরে যত সভা-সমাবেশ করেছেন তাতে আপনি আপনার নিজের ঢোল পিটিয়েছেন বক্তব্যের অধিকাংশ সময়। তাতে কি লাভ হয়েছে? হ্যাঁ ষোল বছর একনাগাড়ে ক্ষমতায় থাকতে পেরেছেন। এতে পুলিশ প্রশাসন, সিভিল প্রশাসন আপনাকে সহায়তা করেছে। আর সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে আপনার আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে খতম করে। নিজ হাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা হত্যা করে একটি লাভ হয়েছে আপনার- তিনটি নির্বাচন করতে পেরেছেন নির্বিঘ্নে। নিজের নামের পাশে স্বৈরাচার বসাতে পেরেছেন। পৃথিবীর স্বৈরাচারদের ইতিহাসে নাম লেখাতে পারার গর্ব নিশ্চয় আপনি এখন করছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে পাত্তা না দিলে কি হবে? এমন মনোভাবই আপনাকে ধ্বংস করেছে। বিএনপিকে ঘরে ঢুকাইছি। জামায়াতকে নিঃশেষ করেছি। আর এমন পুচকে পোলাপান কী করবে? এদের ঠেঙ্গিয়ে সোজা করে দেবো। তাই তো ৬ সমন্বয়ককে আপনার ডিবি হারুন তুলে নিয়ে যায়। আন্দোলন কিছুটা নরমাল হতে না হতেই পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায় ব্লকেড দিয়ে গ্রেপ্তার অভিযান শুরু করে পুলিশ। একটুও ধৈর্য ধরতে পারলেন না। এত তাড়াতাড়ি শাস্তি দিতে হবে কেন? আন্দোলনটা শেষ হওয়ার পর করলেই তো হতো। আপনি আগে যা করেছেন। এক্ষেত্রে এটা করতে পারলেন না কেন? পুলিশের এই ব্লকেড গ্রেপ্তার অভিযানই আপনার জন্য কাল হয়। এরপর পুলিশের গুলি, আপনার পোষা গুণ্ডাদের গুলিতে একের পর এক হত্যা দেশবাসীকে ক্ষুব্ধ করে তুলে। এত মৃত্যু, এত লাশ মানুষ আর দেখতে চায়নি। ৫ই আগস্ট পর্যন্ত আপনার পুলিশ গুলি চালিয়েছে সাধারণ মানুষের ওপর। এর শত শত প্রমাণ থাকার পরও আপনি অন্য দেশ থেকে ফোনে এক নেতাকে বলছেন, ওরা কীভাবে পুলিশকে মেরেছে। কীভাবে মানুষের ভিড়ে মিশে গিয়ে মানুষকে মেরেছে। নিজে দোষ করে অন্যের উপর দোষ চাপানো আপনার জন্য নতুন কিছু নয়। ক্ষমতায় থাকাকালে দেখেছি, কোনো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই আপনি বলে উঠতেন এগুলো বিএনপি-জামায়াতের কাজ। কি করে বুঝতেন আপা? ওরা কি আপনার সঙ্গে শলাপরামর্শ করে এসব অঘটন ঘটাতো? যদি তা নাই হবে তাহলে এ কথার মানে কি? সত্যিই আপনি এক সেলুকাস। আপনার ষোল বছরের ইতিহাস পরবর্তী ষোল বছর লিখলেও শেষ হবে না। আপনার নেতাকর্মীরা এখন আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজেকে আওয়ামী লীগ পরিচয় দেয় না। ওদের কাছেও এখন আওয়ামী লীগ এক জমের নাম। কেউ কেউ দেশের বাইরে থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঁকিঝুঁকি দেয়। কিন্তু এ পর্যন্তই। যাকগে এসব বিষয় নিয়ে পড়ে লেখা যাবে। শুরুটা করেছিলাম নিজের ঢোল নিজে পিটানো নিয়ে। আগের লেখায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাড়াবাড়ির কথা লিখেছিলাম। আজ লিখতে চাই আপনার নামে কতো স্থাপনা রয়েছে তার কিঞ্চিৎ। আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী এটাই তো ইতিহাস। তারপর স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নাম আপনার নামে হতে হবে কেন? এতে কি আপনার মর্যাদা বেড়ে যায়। এক/এগারোর আগে আপনার দলের লোকেরা কীভাবে জিয়া বিমানবন্দর থেকে তার নামটি ভেঙেছে- সেটি দেখেননি। তারপরও আপনার শিক্ষা হয়নি। নাকি আপনি ভেবেছিলেন যে, সিস্টেম করে নিয়েছিলেন- সেই সিস্টেমে আজীবন আপনি ও আপনার বংশধরেরা ক্ষমতায় থাকবে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নামে মাত্র থাকবে। এর আড়ালে কায়েম হবে রাজতন্ত্র। সেটা করতে গিয়ে তৃতীয় বারের মাথায়ই তো ধরা খেয়েছেন। তাহলে এত কিছু কেন? গণতন্ত্রের মানসকন্যা থেকে স্বৈরাচারের মুকুট কেন লাগাতে গেলেন মাথায়। এ মুহূর্তে আপনার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা ও দপ্তরের  নামের দিকে চোখ বুলালে কি দেখা যায়?

দপ্তরগুলোর মধ্যে রয়েছে শেখ হাসিনা জাতীয় যুব কেন্দ্র। জামালপুরের মেলান্দহে রয়েছে শেখ হাসিনা পল্লী উন্নয়ন একাডেমি। রয়েছে নৌবাহিনী জাহাজ বিএনএস শেখ হাসিনা। ভবনের মধ্যে রয়েছে- ঢাকায় শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম, মানিকগঞ্জেও রয়েছে শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। জামালপুরে রয়েছে শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক পল্লী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে-  নেত্রকোনায় শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়। খুলনায় শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। কিশোরগঞ্জে শেখ হাসিনা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। শেখ হাসিনা কৃষি ইনস্টিটিউট, কৃষি অনুষদ, বশেমুরবিপ্রবি। হলের মধ্যে রয়েছে- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা হল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ হাসিনা হল, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ হাসিনা হল, বুটেক্সে রয়েছে শেখ হাসিনা হল, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে শেখ হাসিনা হল, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হল, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ হাসিনা হল,  যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ হাসিনা হল, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হল, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ হাসিনা হল। এ ছাড়া কলেজগুলোর মধ্যে রয়েছে- হবিগঞ্জে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, মেলান্দহ, জামালপুরে শেখ হাসিনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মাদারীপুরের ডাসারে সরকারি শেখ হাসিনা একাডেমি অ্যান্ড উইমেন্স কলেজ, গোপালগঞ্জে শেখ হাসিনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, ঝিনাইদহে শেখ হাসিনা পদ্মপুকুর ডিগ্রি কলেজ, পিরোজপুরে শেখ হাসিনা একাডেমি, পাবনার আতাইকুলায় শেখ হাসিনা উচ্চবিদ্যালয়। ইনস্টিটিউটগুলোর মধ্যে রয়েছে- জামালপুরের ইসলামপুরে শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল টেকনোলজি, ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। সড়কের মধ্যে রয়েছে- মাদারীপুর-শরীয়তপুর শেখ হাসিনা মহাসড়ক, চট্টগ্রামে শেখ হাসিনা রোড, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শেখ হাসিনা মহাসড়ক। সেতুর মধ্যে রয়েছে গংগাচড়া শেখ হাসিনা সেতু। সামরিক স্থাপনার মধ্যে রয়েছে পটুয়াখালীতে শেখ হাসিনা সেনানিবাস, কক্সবাজারে বানৌজা শেখ হাসিনা।

আচ্ছা, হাসু আপা, এত নামের কী দরকার। যেখানে প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশের ইতিহাসে নাম লেখিয়েছেন। দেশের জন্য কাজ করেছেন। কিন্তু বারবার প্রধানমন্ত্রী হতে হবে কেন? এ প্রশ্নটা করতাম না। কারণ আপনি নিজেই নিজের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। শতাধিক দিন হরতাল করে যে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি দেশে আনলেন সেটা কলমের এক খোঁচায় বাদ দিয়ে দিলেন। আবার এতে ব্যবহার করলেন আদালতকে। আপনার এ উদ্দেশ্য ছিল একেবারে নিজের স্বার্থে। যার পরিণতিতে আপনি হয়ে উঠেছিলেন স্বৈরশাসক। মনে পড়ে আপা, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিরোধী দলকে নিয়ে আপনি বৈঠকে বসেছিলেন। সেই বৈঠকে বলেছিলেন- আমি বঙ্গবন্ধুর মেয়ে, আমাকে একবার বিশ্বাস করে দেখুন। আপনার এ কথায় বিশ্বাস করে বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে গেল। নির্বাচনী প্রচারণাকালীন সময়েই বুঝা গেছে কেমন নির্বাচন হবে। বিরোধী দলের প্রার্থীদের কোনো পোস্টার লাগাতে দেয়া হয়নি। কেউ সাহস করে প্রচারণায় বেরুলে তার ওপর হামলা হয়েছে। মামলা হয়েছে। কেউ কোনো দিন চিন্তা করেনি আগের রাতেই ব্যালট বাক্স পূরণ হয়ে যাবে। দিনের বেলা শুধু লোক দেখানো নির্বাচন। যদিও দিনের বেলায় ৫ শতাংশের বেশি মানুষ ভোট দিতে যায়নি। রাতের ভোটে আপনি পাস। এরপর জোর গলায় বলে বেড়িয়েছেন জনগণ আওয়ামী লীগকে চায়। এ কারণেই তারা আওয়ামী লীগকে বারবার ভোট দেয়। আপা আপাগো, দেশের মানুষ যা দেখে তার উল্টোটা আপনি বলে বেড়ান সভা-সমাবেশে। তা শুনে মানুষ হাসে। ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে আপনার একটি সাক্ষাৎকার। যেখানে আপনাকে বলতে শোনা যায়- আমি প্রধানমন্ত্রী হলে সপ্তাহে একদিন টিভিতে দেখতে পাবেন। আপনার এ কথা যে কতোটুকু মেনেছেন তা জাতি দেখেছে। এভাবেই আপনি নিজের দেয়া কথা বেমালুম ভুলে যান। তবে কেন? আপা, এর উত্তরটা আপনার কাছে চাই। দয়া করে বলবেন কি? 

উত্তরটা আপাকেই দিতে হবে


No comments

Powered by Blogger.