একনজরে গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি

রক্ত, লাশ আর ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে জীবন হারানো অসংখ্য মানুষের আরেক নাম যেন গাজা উপত্যকা। প্রায় ৪৬০ দিনে ইসরাইল নৃশংসভাবে হামলা চালিয়ে গাজাকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে। তাদের গণহত্যার শিকারে পরিণত হয়েছেন কমপক্ষে ৪৬ হাজার ৮৯৯ জন ফিলিস্তিনি। কিন্তু ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে কতো মানুষ মারা গেছেন- তার কোনো হিসাব রাখেনি কেউ। ফলে গাজাকে ‘নির্জন দ্বীপে পরিণত’ করার যে হুমকি দিয়েছিলেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু- তাতে অনেকাংশেই সফল হয়েছেন তিনি। গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো এমনকি সাধারণ মানুষের বসতিকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন। রক্ষা পায়নি স্কুল, হাসপাতাল, জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্র। এর ফলে গাজায় কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণ না করা পর্যন্ত বলা সম্ভব নয়। এত মানুষের লাশের উপর দিয়ে যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে- তা অনেক আগেই আসা উচিত ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে এই যুদ্ধে ইসরাইলের নৈতিক পরাজয় হয়েছে। কারণ, তাকে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গাজায় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যার দায়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও হামাসের এক নেতার নামে। কীভাবে ঘটেছে এই গণহত্যা একনজরে তা দেখে নেয়া যাক- ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর হামাসের কয়েক শত কর্মী ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে অপ্রত্যাশিত ও আকস্মিক হামলা করে। সীমান্ত অতিক্রম করে, আকাশপথে পার্শ্ববর্তী জনপদ, পুলিশ স্টেশন এবং সেনাঘাঁটিতে তারা আক্রমণ চালায়। এতে নিহত হয় প্রায় ১২০০ মানুষ। তারা মার্কিনিসহ জিম্মি করে ২৫১ জনকে। তাদেরকে নিয়ে যায় গাজায়।

এ ছাড়া ইসরাইলে কয়েক হাজার রকেট নিক্ষেপ করে হামাস। ইসরাইলের সেনাবাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে আকাশপথে ও স্থলপথে গাজায় হামলা চালিয়ে এর জবাব দেয়। ২৭শে অক্টোবর গাজায় স্থল আগ্রাসন চালায় ইসরাইল। গাজার ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তারা। ২১শে নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মিশরের মধ্যস্থতায় একটি চুক্তি হয়। তার অধীনে ইসরাইল তার জেলে থাকা ফিলিস্তিনের কমপক্ষে ২৪০ জন বন্দিকে মুক্তি দেয়। এর বিনিময়ে ১০৫ জিম্মিকে মুক্তি দেয় হামাস। চালু হয় এক সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি। কিন্তু তা টিকে থাকেনি। এর জন্য হামাস ও ইসরাইল একে অন্যকে দায়ী করে। ২৮শে ডিসেম্বর নতুন একটি যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি মুক্তির শাটল কূটনীতি শুরু হয়। ২০২৪ সালের ৩১শে মে ইসরাইলি জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে তিন দফার যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব দেয় ইসরাইল। তা জোর দিয়ে তুলে ধরেন যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সেই প্রস্তাবই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে এবং আট মাস পরে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে উভয়পক্ষ সম্মত হয়। ১০ই জুন যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনাকে সমর্থন করে একটি রেজ্যুলুশন পাস করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। ৩১শে জুলাই ইরানের রাজধানী তেহরানে হামাসের রাজনৈতিক নেতা ও প্রধান সমঝোতাকারী ইসমাইল হানিয়েকে ইসরাইল হত্যা করার পর আলোচনা স্থগিত হয়ে যায়। এর দু’সপ্তাহ পরে হামাসের অনুপস্থিতিতে আলোচনা শুরু করে তেহরান। ১৭ই অক্টোবর ইসরাইলি সেনারা গাজার দক্ষিণে হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যা করে। একে যুদ্ধ সমাপ্তির সূচনা বলে অভিহিত করেন নেতানিয়াহু। ৯ই নভেম্বর কয়েক মাস ধরে আলোচনায় যখন কোনো ফল আসছিল না তখন সমঝোতা প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেদের চেষ্টা স্থগিত করে কাতার।

তারা বলে, যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে হলে ইসরাইল এবং হামাস উভয়কেই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে। অচলাবস্থার জন্য এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দায়ী করে। ২০শে নভেম্বর অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান সংবলিত একটি খসড়া প্রস্তাবে ভোট দেয় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। তবে এতে যুদ্ধবিরতির সঙ্গে জিম্মি মুক্তির কোনো যোগসূত্র রাখা হয়নি। ২৭শে নভেম্বর যোদ্ধাগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ’র সঙ্গে ১৩ মাসের যুদ্ধ বন্ধে লেবাননের সঙ্গে রাজি হয় ইসরাইল। এর ফলে গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পর্কে আশা জেগে ওঠে। জো বাইডেন বলেন, তিনি আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আরও একবার চেষ্টা করবেন। ২রা ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ২০শে জানুয়ারি তিনি হোয়াইট হাউসে ফেরার আগে যদি গাজার জিম্মিদের মুক্তি দেয়া না হয়, তাহলে তার জন্য কঠিন মূল্য দিতে হবে।

 ১৭ই ডিসেম্বর ফিলিস্তিনের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, যুদ্ধবিরতি নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। তা সুচিন্তিত ও চূড়ান্ত দশায় আছে। একই সময়ে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ বলেন- যেকোনো সময়ের চেয়ে একটি চুক্তি খুব কাছাকাছি রয়েছে। ২০২৫ সালের ১৩ই জানুয়ারি হোয়াইট হাউসের শেষ সপ্তাহে সমঝোতা প্রক্রিয়া নিয়ে নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন জো বাইডেন। তার আগে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেন, খুব কাছাকাছি রয়েছে চুক্তি। তিনি আশা করেন ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগেই তা কার্যকর হবে। ১৫ই জানুয়ারি কাতারের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইসরাইল ও হামাস গাজায় যুদ্ধবিরতি, জিম্মি মুক্তির বিষয়ে একমত হয়েছে। তা কার্যকর হবে ১৯শে জানুয়ারি। ১৭ই জানুয়ারি ইসরাইলি মন্ত্রিপরিষদ চুক্তি অনুমোদন করে। তার আগে মন্ত্রিপরিষদ কয়েক ঘণ্টা ধরে দীর্ঘ আলোচনা করে। উগ্র ডানপন্থি দু’জন মন্ত্রী এই চুক্তির বিরোধিতা করেন। ১৯শে জানুয়ারি স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে আটটায় চুক্তি কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও তা বেশ বিলম্বে স্থানীয় সময় সকাল ১১টা ১৫ মিনিটে কার্যকর হয়।

mzamin


No comments

Powered by Blogger.