এনামুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ মামলা দিয়েও কাজ হয় না by প্রতীক ওমর

ওসমানের পাড়া দাখিল মাদ্রাসা। গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার ওসমানের পাড়া গ্রাম। মাদ্রাসার সুপার এনামুল হক। সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের মতো মারাত্মক অপরাধের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। স্বাক্ষর জাল করে মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি গঠন করা, এক শিক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশনে অন্য শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করানো। নিয়োগ বাণিজ্যে কোটি টাকা পকেটস্থ করার লিখিত অভিযোগ, থানা এবং আদালতে একাধিক মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগের সত্যতা মিললে জেল হাজতেও যেতে হয়েছে এনামুলকে। বরখাস্ত হলে বেতন- ভাতা বন্ধ করে বোর্ড। এত কিছুর পরেও শুধুমাত্র উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সখ্য থাকার কারণে বহাল তবিয়তে মাতব্বরি করছেন প্রতিষ্ঠানের প্রধানের চেয়ারে বসেই। সম্প্রতি তার বেতন-ভাতা চালুর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন সাঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইছাহাক আলী। যদিও তিনি বলেছেন মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অনুমতিক্রমে তার বেতন ছাড় দেয়া হয়েছে।

রোববার সরজমিন ওসমানের পাড়া মাদ্রাসায় গিয়ে দেখা যায় পুরো প্রতিষ্ঠানে মাত্র একজন শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত। কোনো শ্রেণিতে ২ জন, কোনোটাতে ১ জন আবার কোনো শ্রেণিতে একজনও শিক্ষার্থী নেই। স্থানীয়রা জানায় এভাবেই অব্যবস্থাপনার মধ্যদিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে মাদ্রাসাটি। প্রশাসনের লোকজন মাঝেমধ্যে এসে সুপারের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে চলে যান। অনিয়মের কোনো তদন্ত বা বিচার কখনোই হয় না।
পরিদর্শনকালে দেখা মেলে ওই মাদ্রাসার সাবেক সভাপতি আরিফ মোহাম্মদ দুলালের। তার কাছে মাদ্রাসা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ধারাবাহিক দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরেন। সাবেক একজন বিচারপতি মরহুম ফজলুর রহমান তার গ্রামে ১৯৯৫ সালে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকেই  এনামুল হক সুপার পদে আছেন। দুর্নীতি করে প্রথম বরখাস্ত হন ২০০০ সালে। এরপর দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একই অপরাধে বহুবার বরখাস্ত হয়েছেন। এরপর  তার বিরুদ্ধে থানা এবং আদালতে একাধিক মামলা চলমান আছে। চার্জ গঠন হয়েছে একটি মামলাতে।
দুলাল আরও জানান, মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সাবেক বিচারপতি ফজলুর রহমান মারা যাওয়ার পর এনামুল কৌশলে দাতা সদস্য আরও ৩ জনকে মৃত দেখিয়ে একটি ভুয়া কমিটি গঠন করেন। তৎকালীন সভাপতি এডভোকেট শফিকুল ইসলামের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে এনামুল তার বড় ভাই ওসমান গনিকে সভাপতি বানান। পরে ওই কমিটি নিয়ে নানাধরনের কথা ওঠে। অবশেষে সেই কমিটি জাল প্রমাণিত হয়। এমনকি পরে অবৈধ ওই কমিটির ৬ জন সদস্য বাদী হয়ে এনামুলের বিরুদ্ধে মামলাও করেন। একজন অভিভাবক সদস্য সাবিনা ওই মামলার মূলবাদী। ওই মামলায় তারা উল্লেখ করেন কমিটিতে তাদের না জানিয়ে নাম দেয়া হয়েছে। তারা কোনো রেজ্যুলেশনে স্বাক্ষর করেননি। পরে থানা মামলাটি তদন্ত করে এনামুলের অপরাধের প্রমাণ পায়। পরে বোর্ড ওই কমিটি অবৈধ উল্লেখ করে বাতিল করে দেয়।
পরে মাদ্রাসা চালানোর জন্য আরিফ মোহাম্মদ দুলালকে সভাপতি করে নতুন কমিটি হয়। ওই কমিটি বৈঠক করে দুর্নীতির অপরাধে এনামুলকে আবারো বরখাস্ত করে। তখন ভারপ্রাপ্ত সুপার হিসেবে আবুল কালাম আজাদকে দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে ওই ভারপ্রাপ্ত সুপারকেও এলামুল বাহিনী মারপিট করেছে এবং প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে এবং তার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়েছে। এসব অভিযোগের আলোকে আবুল কালাম আজাদ একটি মামলা করেন। মামলার নম্বর ১১৭/২৩। মামলাটি চলমান রয়েছে।
এ ছাড়াও এনামুল বিভিন্ন সময়ে দপ্তরি, মালী, নৈশপ্রহরী এবং কম্পিউটার শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যে এককভাবে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির পাশাপাশি মহিমাগঞ্জ বন্দরে ব্যয়বহুল একটি ৩ তলা বাড়িও করেছেন এনামুল।
কয়েক বছর আগে তৌহিদা নামের একজন দাখিল পরীক্ষার্থীকে দিয়ে অন্য একজন শিক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশনের আলোকে ছবি পাল্টিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করায়। দু’টি পরীক্ষা দেয়ার পর ওই শিক্ষার্থী বুঝতে পারে সে নিজের জন্য নয় অন্যের জন্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করিয়েছে সুপার। পরে সে আর পরীক্ষা দেয়নি। বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার জন্য স্থানীয়ভাবে মিটমাট করেন চতুর ওই সুপার। তৌহিদার নিকট আত্মীয় মজনু মিয়া বিষয়টি বর্ণনা করেছেন।
এনামুলের এসব দুর্নীতি কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন ওই মাদ্রাসার এবতেদায়ী শাখার শিক্ষক আমিনুল ইসলাম। তিনি মানবজমিনকে বলেন, সুপার এনামুল একটি কমিটি করে। ওই কমিটিতে আমাকে শিক্ষক প্রতিনিধি দেখানো হয়। কিন্তু আমি কিছুই জানি না। পরে ধরা পড়ার পর জানা গেল ওই কমিটি করা হয়েছিল জাল জালিয়াতির মাধ্যমে। তিনি আরও বলেন, ওই সুপার একান্ত নিজের ইচ্ছায় নিজের মতো করে বিভিন্ন সময় নিয়োগ দিয়ে বাণিজ্য করেছেন। তিনি স্বীকার করেন ওই মাদ্রাসায় এবতেদায়ী শাখায় শিক্ষার্থী নেই বললেই চলে।
কথা হয় সুপার এনামুলের সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, শত্রুপক্ষ আমার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। আমি এসব অপরাধের সঙ্গে কখনোই জড়িত ছিলাম না। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। বোর্ড তদন্ত করে আমাকে বেতন-ভাতা প্রদান করছে।
বিষয়গুলো নিয়ে সাঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, এনামুল সুপারের বেতন চালু হয়েছে বোর্ডের পরিপত্রের আলোকে। এখানে আমার কোনো হাত ছিল না। বোর্ড যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে আমি সেই আলোকে কাজ করেছি। শিক্ষার্থী কমের বিষয়টি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ দেয় নি। আপনার মাধ্যমে জানলাম, আমি খোঁজ নিবো। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.