চার কাস্টমস কর্মকর্তার অঢেল সম্পদের খোঁজ by মারুফ কিবরিয়া

চার জনই কাস্টমস কর্মকর্তা। অভিযোগ ছিল ৪ জন মিলে তৈরি করেছেন ঘুষের সিন্ডিকেট। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ঘুষ নিয়ে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। রাজধানীর ফয়দাবাদ এলাকায় চারজন মিলে নির্মাণ করেছেন সাত তলা বাড়ি। এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবেও একেকজন বিপুল সম্পদের মালিক। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানেও মিলেছে তাদের সম্পদের তথ্য। অভিযুক্ত কাস্টমস কর্মকর্তারা হলেন- চট্টগ্রাম কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ছাইফুল ইসলাম, এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনারেট ঢাকার রাজস্ব কর্মকর্তা তৈয়বুর রহমান, ভুঁইয়া মফিজুর রহমান (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) এবং মানিকগঞ্জের (১)  এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনারেট কার্যালয়ের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আবদুস সামাদ।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর প্রকাশিত সংবাদের প্রেক্ষিতে চার কাস্টমস কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে সংস্থাটি। সম্প্রতি অনুসন্ধান শেষও হয়েছে। তবে এই চার কাস্টমস কর্মকর্তার স্ত্রীদের নামেই বেশি সম্পদ পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ছাইফুল ইসলামের পরিবার বসবাস করছে উত্তরার ১১ নং সেক্টরে। উত্তরার ৬ নং সেক্টরে বসবাস করছে তৈয়বুর রহমানের পরিবার। আর ভুঁইয়া মফিজুর রহমান দক্ষিণ খানের মোল্লার টেক ও আব্দুস সামাদ একই এলাকার ফায়দাবাদ ট্রান্সমিটার এলাকায়। ঢাকার দক্ষিণখান এলাকার ফয়দাবাদ মৌজায় চার কাঠা জমির উপর যৌথ মালিকানায় সাত তলা বাড়ি নির্মাণ করেছে এই চার কর্মকর্তা। নথি অনুযায়ী চার কাঠার মধ্যে আড়াই কাঠা জমির মালিক তৈয়বুর রহমানের স্ত্রী উম্মে তুরিন। সূত্রমতে,  ছয় কোটি টাকা মূল্যের এই বাড়ি তোলা হয়েছে ।
এ ছাড়া মসজিদ রোডের পাঁচ কাঠা জমি কিনে গড়ে তুলেছেন গরুর খামার। ২০টি গরুর এই খামারের বাজার মূল্য ২ কোটি বিশ লাখ টাকা। শুধু তাই নয়, আব্দুর রউফ মসজিদ সংলগ্ন আরেকটি ১৫ কাঠা জমি রয়েছে এই চার কর্মকর্তার যৌথ মালিকানায়। এই প্লটের বাজার মূল্য সাড়ে সাত কোটি টাকা। এই জমির পাশে লাল মসজিদ সংলগ্ন দশ কাঠা জমি রয়েছে তাদের নামেই।
দুদক সূত্রে জানা যায়, উত্তরায় অন্তত পাঁচটি ফ্ল্যাট রয়েছে ওই চার কর্মকর্তার। তৈয়বুর রহমানের স্ত্রী উম্মে তুরিন আইনজীবী হিসেবে পরিচয় দিলেও তিনি একজন গৃহিণী। তিনিই মূলত দেখাশোনা করেন চার কর্মকর্তার ঘুষের টাকার সাম্রাজ্য। উত্তরার  ৬ নং সেক্টরে বসবাসরত উম্মে তুরিন তার পরিবারের সদস্যদের নামে দক্ষিণখানের ফয়দাবাদ পুলিশ ফাঁড়ি এলাকায় আরও চারটি ফ্ল্যাট ক্রয় করে ভাড়া দিয়েছেন। ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের পাশে রয়েছে দোকানঘর।
দুদকে জমা পড়া অভিযোগ অনুসারে তৈয়বুর রহমান বর্ডার শুল্ক শাখায় চাকরিরত অবস্থায় আটক করেছিলেন ৩০০টি স্বর্ণের বার। এরমধ্যে একশ’ স্বর্ণের বার সরকারি কোষাগারে জমা পড়লেও, বাকি দুইশ’ স্বর্ণের বার হাপিশ করেন তৎকালীন শুল্ক অফিসার তৈয়বুর রহমান।
এই অভিযুক্ত চারজন প্রত্যেকেই ৯ম-১০ম গ্রেডের কর্মকর্তা। নিজেদের উপার্জন করা অবৈধ টাকা বিনিয়োগ করেই ধাপে ধাপে পদোন্নতি বাগিয়ে প্রত্যেকে এখন রাজস্ব কর্মকর্তা। এর মধ্যে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা থেকে মফিজুর রহমান অবসরে গেছেন। বাকি তিনজন বর্তমানে কাস্টমসে কর্মরত রয়েছেন।
অনুসন্ধানকালে অভিযুক্ত ছাইফুল ইসলাম, তৈয়বুর রহমান, ভুঁইয়া মফিজুর রহমান এবং আবদুস সামাদ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে অর্জিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ সংক্রান্ত তথ্য জানার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা রেজিস্ট্রার, ঢাকা/গাজীপুর/কক্সবাজার/চট্টগ্রাম/বি. বাড়িয়া/মানিকগঞ্জ, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা, ঢাকা উত্তর/দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, সহকারী পরিচালক, বিআরটিএ, ঢাকা সার্কেল-১/ঢাকা সার্কেল-২/ঢাকা সার্কেল-৩, সচিব, রাজউক, ঢাকা, চেয়ারম্যান, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, সংশ্লিষ্ট সহকারী কমিশনার (ভূমি), পোস্ট মাস্টার জেনারেল, কেন্দ্রীয় সার্কেল, ডাক ভবন, ঢাকা, মহাপরিচালক, জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরো, চেয়ারম্যান, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, সচিব, সিডিবিএল, রেজিস্ট্রার, জয়েন্ট স্টক অ্যান্ড যৌথ ফার্মসমূহের অধিদপ্তর, রিহ্যাব এবং সকল তফসিলি ব্যাংকসহ বিভিন্ন দপ্তরে পত্র প্রেরণ করা হয়।
এসব জায়গা থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কাস্টমস কর্মকর্তা তৈয়বুর রহমানের নামে দক্ষিণখানে সাত তলা বাড়িতে চারটি ফ্ল্যাট ছাড়াও বাড্ডায় এক কাঠার এক চতুর্থাংশ জমির তথ্য পাওয়া যায়। এই জমির দাম ৭ লাখ ৪২ হাজার টাকা। এ ছাড়া মানিকগঞ্জেও রয়েছে ৪ লাখ টাকা মূল্যের জমি। যার উপর তিন তলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন তিনি। এ ছাড়া একটি ফ্ল্যাটও রয়েছে তার নামে। এর মূল্য ২০ লাখ টাকার বেশি। অনুসন্ধানে তৈয়বুর-এর মোট  এক কোটি টাকার বেশি পরিমাণ স্থাবর সম্পদ পেয়েছে দুদক। যা তার আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ বলেও উল্লেখ করেছে অনুসন্ধান প্রতিবেদনে। এ ছাড়া তৈয়বুর রহমানের স্ত্রী উম্মে তুরিন রুমীর নামেও সাড়ে ৩৩ লাখ টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধান সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত কাস্টমস কর্মকর্তা ছাইফুল ইসলামেরও ঢাকা ও ময়মনসিংহে কয়েক কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। এতে বলা হয়, তৈয়বুর রহমানের মতোই ছাইফুল রাজধানীর বাড্ডায় সাত লাখ টাকা মূল্যের একটি জমি কিনেছেন। এ ছাড়া দক্ষিণ খানে যৌথ মালিকানায় কেনা জমিতে নির্মিত সাত তলা ভবনে চারটি ফ্ল্যাট পেয়েছেন তিনি। এ ছাড়া ময়মনসিংহের ত্রিশালে নিজ গ্রামের বাড়িতে চার তলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন বলেও জানানো হয় দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে। অন্যদিকে ছাইফুল ইসলামের স্ত্রী শাহনাজ বেগমের নামে ময়মনসিংহের ত্রিশালে ৫৬ শতাংশ জমির তথ্য পাওয়া গেছে। যার দলিল মূল্য সাড়ে আট লাখ টাকা হলেও বাজার মূল্য অর্ধকোটি টাকার মতো।
এদিকে অবসরপ্রাপ্ত কাস্টমস কর্মকর্তা ভুঁইয়া মফিজুর রহমানের বিষয়ে অনুসন্ধানকালে জানা যায়, রাজধানীর বাড্ডায় তার নামে একটি জমি রয়েছে। যার মূল্য সম্পদ বিবরণীতে সাড়ে সাত লাখ টাকা। তবে বাজার মূল্য আরও বেশি। এ ছাড়া আগারগাঁও, তুরাগে একাধিক ফ্ল্যাট পাওয়া গেছে অনুসন্ধানে। এসব ফ্ল্যাটের বাজার মূল্য কোটি টাকারও বেশি বলে জানান দুদক কর্মকর্তারা। মফিজুর রহমানের স্ত্রী দিলশাদ জাহান লাকীর নামে এক হাজার বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাটের তথ্য পায় দুদক। এসব ফ্ল্যাটের প্রদর্শিত মূল্য ৫০ লাখ ৬৭ হাজার হলেও বাজার মূল্য কোটি টাকার বেশি বলে জানিয়েছে অনুসন্ধান সংশ্লিষ্টরা।
অভিযোগের বিষয়ে মফিজুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা হয়েছে। দুদক অনুসন্ধান করুক কোনো সমস্যা নেই। আমি আগে হোটেলের ব্যবসা করতাম। সেখান থেকে কিছু টাকা আয় করেছি। তারপর চাকরি করেছি। চারজন মিলে একটা বাড়ি করা কি অসম্ভব বলেন? আমরা যখন জমিটি কিনেছি তখন মূল্য ছিল ৩০ লাখ টাকা। তখন রড- সিমেন্টের দামও কম ছিল। একদল লোক অযথাই হয়রানি করার জন্য অভিযোগ দিয়েছে। আমি দুদককে সব তথ্য দিয়েছি। আর ঘুষের সিন্ডিকেট বলা হচ্ছে। আমরা তো কখনো একসঙ্গে কাজও করিনি।
এদিকে অভিযুক্ত আরেক কাস্টমস কর্মকর্তা মো. আব্দুস ছামাদের বিষয়ে অনুসন্ধানে দুদক জানতে পারে, ফয়দাবাদের সাততলা বাড়ির ওপর চারটি ফ্ল্যাট ছাড়াও গাজীপুর, টাঙ্গাইল মিলিয়ে তার দেড় কোটি টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদ রয়েছে। এছাড়া ফয়দাবাদে ১৫ লাখ টাকা মূল্যের একটি টিনশেড বাড়ি রয়েছে তার। তবে বাজার মূল্য অনুযায়ী কোটি টাকার কাছাকাছি বলে দাবি করেছেন দুদকের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া আব্দুস ছামাদের স্ত্রী মালেকা পারভীনের নামেও ঢাকার বাড্ডা, দক্ষিণ খান, গাজীপুর, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন স্থানে মোট ৯০ লাখ ৯৭ হাজার টাকা মূল্যের সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। দলিলে ৯০ লাখ ৯৭ হাজার টাকা হলেও বাজার মূল্য কয়েক কোটি টাকা বলে মনে করছেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা।
দুদকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, চার জনের নামেই জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের তথ্য আমরা পেয়েছি। প্রতিবেদনের সব কাজ গুছানো হয়ে গেছে। নতুন কমিশন গঠন হলেই এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.