জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার -সাক্ষাৎকারে এহছানুল হক মিলন by পিয়াস সরকার

সর্বাত্মক চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী সরকার ভালো করতে পারছে না। সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ না করার কারণে তারা দিনে দিনে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও এডুকেশন রিফর্ম ইনিশিয়েটিভ (ইআরআই) চেয়ারম্যান ড. আন ম এহছানুল হক মিলন। তিনি বলেন, অনেকেই বলছেন, বিএনপি’র লোকেরা চাঁদাবাজি করছে। বিএনপি  তো তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বহিষ্কার করছে। বিএনপি যদি বহিষ্কার করতে পারে, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকার কেন সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না? তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, সরকার কী কোনো সিন্ডিকেটের নির্দেশে নির্দেশিত?

এহছানুল হক মিলন মানবজমিনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যদি সকল বিপ্লবের সঙ্গে সহযোগিতা করা দল থেকে লোক নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করতো তাহলে খুব ভালো হতো। ১/১১ সরকার ব্যর্থ হওয়ার একমাত্র কারণ ছিল তাদের এডভাইজারি কাউন্সিল ছিল পুরোপুরি নন-পলিটিক্যাল। লংটার্ম গভর্নমেন্ট যদি নন-পলিটিক্যাল হয় তাহলে ব্যর্থতা ছাড়া সফলতা আসা সম্ভব নয়। যে ভুলটা স্বাধীনতার পর পর করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ভেবেছিলেন, তার দল স্বাধীনতায় অবদান রেখেছে তার দলই ক্ষমতায় থাকবে। ১৯৭২ ও ২০০৭ সালে ব্যর্থ হয়েছি, এবার যদি ব্যর্থ হই তাহলে ভাগ্যবিধাতা আমাদের উপর ব্যাপক মনোক্ষুণ্ন্ন হবেন। তবে আমাদের আশার জায়গা হচ্ছে দায়িত্ব নিয়েছেন একজন একাডেমিশিয়ান, বিশ্ববরেণ্য নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী বলেন, এত অল্প সময়ের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের ভুল নির্ধারণ করা যাবে না। অন্তর্বর্তী সরকারে যারা দায়িত্ব পেয়েছেন তারা যার যার সেক্টরে সফল। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসেছেন ছাত্র-জনতার মতামতের ভিত্তিতে। কিন্তু অন্যরা ইউনূসের মতামতের ভিত্তিতে এসেছেন কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। একজনকে পোস্টিং দেয়া হচ্ছে, এরপর সরিয়ে নেয়া হচ্ছে এসব একটা সমন্বয়হীনতার অভাব। যে যাকে চেনে, জানে, কাছের লোক তাকে টেনে নিয়ে আসছে। এখানে ব্যক্তিগত প্রভাব চলছে। যাচাই-বাছাইয়ের কোনো পদ্ধতি নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে, উপদেষ্টারা নিজেদের অতিরিক্ত উৎপাদনশীল মনে করায় কাজগুলোর গতি স্থবির হয়ে যাচ্ছে। ড. ইউনূসের নির্দেশনা আরও কঠিন হওয়া উচিত। এই সরকার যাদের নিয়োগ দিচ্ছেন তারা অনেকেই বিগত সরকারের ভিকটিম না। উপদেষ্টাদের অনেকেই বিগত সরকারের আমলে ভালোভাবেই ছিলেন। এজন্য তারা নিরুত্তাপভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এভাবে করলে হবে না। এটা বিল্পবী সরকার। তাদের বিল্পবী হয়ে র‌্যাপিড চেঞ্জ আনতে হবে।

তিনি বলেন, সংস্কার কমিটিগুলোকে সমস্যাগুলো জানতে হবে। এরপর দেখতে হবে সমাধান কোন পথে হবে। এরপর দেখতে হবে আইনত কী কী সমস্যা রয়েছে। সংস্কার করলেই হবে না সেগুলোর আইনগত কাঠামো তৈরি করতে হবে। নির্বাচন কমিশন সংস্কারের জন্য একটি কমিটি করা হয়েছে। আমি মনে করি প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল একটি কমিটি গঠন করতে পারে। তারা সংস্কার প্রস্তাব জমা দিক। ৪৮টি দলের মধ্যে একটি দল পলায়নরত বাকি ৪৭টি দল তাদের সংস্কার প্রস্তাব দিক। এগুলো জনগণের মধ্যে ছেড়ে দেয়া উচিত। জনগণের মতামতও মিলবে তাতে। এরপর সংস্কার কমিটি এগুলো বিবেচনা করে সংস্কার প্রস্তাব করতে পারে। তবে নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই ক্ষমতা দিতে হবে যাতে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে যাতে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হয়। আপাত দৃষ্টিতে বর্তমান সরকার কোনো সুফল বয়ে আনতে পারছে না। তারা প্রতিনিয়ত পিছনের দিকে যাচ্ছে। প্রধান সমস্যা এখন দ্রব্যমূল্য। বাস ভাড়া এক টাকা কমে নাই। এখনতো প্রশ্ন আসতে পারে- কেন আমি আমার সন্তানকে হারালাম? কোথায় পরিবর্তন? এর কারণ অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত না। যেহেতু তারা জানে না কোথায় কোথায় দুর্নীতি। তাই এই সরকার বেশিদিন চালাতে পারবে না। তারা এখন আমলাদের উপর নির্ভরশীল। আমলারাতো আগের সরকারের সময় ছিল। কিন্তু শুধু রদবদল করা হয়েছে। আদালতে রাজনীতি বিহীন বিচারক নিতে পারতেন। এই সরকারতো বলে নাই রাজনৈতিক মদতপুষ্ট আইন সমিতি, ডাক্তারদের সংগঠন, শিক্ষকদের সংগঠন নিষিদ্ধ হবে। উভয় জায়গা রাজনীতিকরণ রয়েছে। আগে যে প্রক্রিয়া ছিল সেটাই রয়েছে। তাহলে পরিবর্তন আশা করা যায় না। যারা আসনে বসেছেন তারা শুধু নিরপেক্ষ থাকলেই তো হবে না। ২০ জন সদস্য দিয়ে ৪৪টি মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন। বিগত সরকার এক মন্ত্রণালয় একাধিক মন্ত্রীও দিয়েছিল। শুধু তাই নয় তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই, জনসম্পৃক্ততা নেই।

সরকার নির্বাচনের সময় আইন করে মিথ্যা কথা বলতে বাধ্য করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০০৮ সালের কথা বলি সরকার নিয়ম চাপিয়ে দিলো ২৫ লাখ টাকা দিয়ে নির্বাচন করতে হবে। এই টাকা দিয়ে কখনই নির্বাচন করা সম্ভব নয়। নির্বাচনের সময় হলফনামা দিয়ে মিথ্যা বলতে হচ্ছে ২৫ লাখ টাকা খরচ করেছি। সংসদে যাওয়ার আগেই মিথ্যা কথা বলতে বাধ্য করা হচ্ছে। উপদেষ্টারা কী কী কাজ করবেন সেই রোডম্যাপটাও দিচ্ছেন না। ২৩ জন জাজ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আমি বলছি না খারাপ নিয়োগ হয়েছে। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়া কী ছিল সেটাতো বললেন না।
তিনি বলেন, জনগণের সর্বোচ্চ ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন ড. ইউনূস। শুধু আমরা ব্যালটে সিল দেইনি। শিশু আর পাগল ছাড়া সকলই ড. ইউনূসকে ভোট দিয়েছেন। যারা নির্বাচনের জন্য ৩ মাস বা ৬ মাসের কথা বলছেন তাদের সঙ্গে আমি একমত নই। উনি ক্ষমতায় থাকার জন্য লোভ করবেন সেটা আমি বিশ্বাস করি না। ড. ইউনূস জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন। এখন তার জনপ্রিয়তা সমান্তরালে যাচ্ছে। যখন তার জনপ্রিয়তা নিচের দিকে নামতে থাকবে তার আগেই নির্বাচন দিয়ে সরে যাওয়া উচিত।
জামায়াতের বিষয়ে তিনি বলেন, জামায়ত একটি সুশৃঙ্খল দল। অতীতে তারা কেয়ারটেকারের জন্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে আন্দোলন করছিলেন। এরপর তারা অনেক ভুগেছে, আত্মাহুতিও হয়েছে। এখন তারা সাংগঠনিক কাজগুলো অত্যন্ত ভালোভাবেই করছে। কিন্তু অনেক জায়গায় দেখা যাচ্ছে এলাকাভিত্তিক অনেক নিরপেক্ষ এবং আওয়ামী লীগের সমর্থকদেরও দলে ভেরাচ্ছে। বিএনপি’র দলীয় কোন্দলের কারণেও জামায়াত এগিয়ে যাচ্ছে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারেক রহমানের (বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) সঙ্গে আমার সম্প্রতি কথা হয়েছে। ম্যাডামের (সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া) স্বাস্থ্যগত বিষয়টি দেখতে হচ্ছে। তাকে লন্ডনে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। লন্ডনে নেয়ার পরপরই তারেক রহমানের দেশে আসার বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করবেন। এরমধ্যে আইনগত দিকগুলোও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি তুলে তিনি বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস এমন লোক নিয়েছেন যে, তারা বলছেন- ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা যাবে না।’ আমি তাদের প্রশ্ন করতে চাই- কী কী অন্যায় করলে একটা দলকে নিষিদ্ধ করা যায়? সেটা আগে বলুন। আর তার কোনটা আওয়ামী লীগ করে নাই তখন বোঝা যাবে। তারা পুলিশ লীগ বানিয়েছে, ডিজিএফআই’কে ব্যবহার করেছে, সেনাবাহিনীর অংশ বিশেষ, বিজিবিকে নষ্ট করেছে। তারা দলকে মাফিয়া গ্রুপ তৈরি করেছে। দলকে নিষিদ্ধ করা না হলে যত মামলা হয়েছে এগুলোতে তাদের নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে।

mzamin


No comments

Powered by Blogger.