গল্প- অপূর্ব এক গোধূলিবেলা by ইমদাদুল হক মিলন
একটা গানের কথা মনে পড়ছে, মায়া। কার গাওয়া? আরতি মুখোপাধ্যায়?
অনেক দূরের ওই যে আকাশ নীল হলো
আজ তোমার সাথে আমার আঁখির মিল হলো …
তোমার সঙ্গে আমার আঁখির মিল হয়েছিল কবে, মায়া?
ওই যে বিকালবেলা তুমি আমাকে পুকুরঘাটে ডেকে আনলে, তার আগে বললে, বাচ্চুকে পছন্দ করে বকুল, শুনে আমি কিন্তু খুব অবাক হইনি। আমি তো বোকা নই। বুদ্ধিসুদ্ধি কিছুটা আছে। লেখাপড়া করেছি। শিক্ষিত বাবার ছেলে। আমি কি খেয়াল করিনি স্বর্ণগ্রামের বাড়িতে, দীননাথ সেন রোডের বাড়িতে বাচ্চু এলেই তার চোখ এদিক-ওদিক ঘুরতো। কাকে খুঁজতো সেই চোখ সেটুকু বোঝার ক্ষমতা কি আমার ছিল না?
ছিল।
আমি বুঝতাম।
আমি সবই বুঝতাম।
বকুলের চঞ্চলতাও আমি বুঝতাম। বাচ্চুকে দেখলেই বোনটির মুখটা কেমন উজ্জ্বল হয়। চোখদুটো আনন্দে নাচে। হাসির শব্দও যেন বদলে যায়। বাচ্চুর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য একটু যেন জোরেই কথা বলে, একটু যেন বেশিই হাসে।
এই বয়সী ছেলেমেয়েদের কেন এমন হয়, আমি কি বুঝি না!
তবে সম্পর্ক ওদের তেমন গভীর হতে পারেনি। ওই ভালো লাগা পর্যন্তই। দুজন দুজনকে ভালোবাসে, দুজন দুজনকে চায় – সেসব মুখে কেউ কাউকে বলতে পেরেছে কিনা, বা চিঠি লেখালেখি হয়েছে কিনা জানি না।
আহা রে, আহা।
বাচ্চু জানেই না, তার বন্ধুর বোনটি, তার পছন্দের মেয়েটি, যাকে নিয়ে সে হয়তো স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল, দেশ স্বাধীন হবে, যুদ্ধ শেষ করে ফিরে এসে সে বকুলের সামনে দাঁড়াবে, হয়তো সব সংকোচ ঝেড়ে ফেলে বলবে, তোমাকে আমি চাই।
বকুল হয়তো সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিল।
বাচ্চু এখন বিলোনিয়ার ওদিকটায় যুদ্ধ করছে। জানেও না তার স্বপ্ন কীভাবে চুরমার হয়ে গেছে, ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার বোনটি হয়তো ভোরবেলার ওই সময়টায় স্বপ্ন দেখছিল তার মনের কোণে লুকিয়ে থাকা মানুষটির। হয়তো সেই মানুষটির মুখ তখন স্বপ্নের ভেতরে ছিল বকুলের চোখ জুড়ে।
আহা রে, আহা?
বাচ্চু আর আমি ছেলেবেলার বন্ধু। একই বয়সের। তাও বাচ্চুর আগে আমার সবকিছু হয়ে গিয়েছিল। খালাতো বোনের সঙ্গে প্রেম। ধুমধাম করে বিয়ে। গভীর ভালোবাসায় ডুবে সন্তানের পিতা হওয়া। সবকিছু, সবকিছুই তাড়াতাড়ি হলো। এক বন্ধু বাবা হতে চললো আরেক বন্ধু হয়তো তখনো তার ভালো লাগার মানুষটিকে, মনের মানুষটিকে বলতেই পারেনি, তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে চাই। এসো, আমার হাত ধরো!
বকুল কি নীল কাগজে গোলাপ পাপড়ি ছড়ানো চিঠি লিখতে পেরেছিল বাচ্চুকে? তুমি যেভাবে আমাকে লিখেছিলে? যেভাবে আমাকে লিখতে?
আমি লিখেছি।
আমিও তোমাকে অনেক চিঠি লিখেছি।
একই বাড়িতে থেকেও চিঠি লেখালেখি? অদ্ভুত না!
তুমি বলতে, চিঠি পড়ার আনন্দ অতুলনীয়। আমি যখন তোমাদের বাড়িতে না থাকি, তোমার চোখের সামনে না থাকি, তখন দোতলার খাটে শুয়ে শুয়ে তুমি আমার চিঠি পড়ো। একই চিঠি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বহুবার পড়ো। প্রথমে তোমার গ্রামোফোন, পরে চেঞ্জার, সেখানে গান বাজছে, লতা মুঙ্গেশকরের গান –
প্রেম একবার এসেছিল নীরবে
আমার এ দুয়ারও প্রামেত্ম
সে তো হায়, মৃদু পায় …
আমাদের প্রেম কি নীরবে এসেছিল, মায়া?
না। নীরবে আসেনি। মোটামুটি জানান দিয়েই এসেছিল। বাচ্চু আর বকুলের কথা বলতে বলতে তুমি আমাকে নিয়ে গেলে পুকুরঘাটে।
মনে আছে?
সেই অবিস্মরণীয় বিকালবেলাটির কথা তোমার মনে আছে?
তার আগে প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে আমরা একটু হাসি-আনন্দ করলাম, মজা করলাম।
এই যে চাঁদের এক টুকরো মোহন আলো এসে এখন তোমার মুখে পড়েছে, সেই বিকালে, গোধূলিবেলায় তোমার মুখে এসে পড়েছিল অসামান্য এক টুকরো আলো। ওই আলোকেই কি ‘কনে দেখা আলো’ বলে?
কনে দেখা নাকি প্রেমিকা দেখা আলো?
গভীর ভালোবাসায় মগ্ন হয়ে থাকা কোনো মুখ দেখা আলো!
কী নাম সেই আলোর?
আল্লাহপাক মানুষের পবিত্রতম মুহূর্তের জন্য কি তৈরি করেছেন ওই আলো। ঠিক ওই মুহূর্তেই কি তিনি তাঁর ওই মহান আলোটুকু পাঠান কারো জন্য? একজনের মুখে সেই আলো পড়ে, আরেকজন আলোয় ভাসা মুখখানি দেখে বুঝে যায়, এই মুহূর্তে এ-জীবন অন্যরকম হয়ে গেল। তার জন্য যে-মানুষটি নির্বাচন করা হয়েছে, এতকাল মনের রহস্যময় অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা মানুষটি এই মাত্র তার সামনে উদ্ভাসিত হয়েছে। এই তো এক মানুষ খুঁজে পেয়েছে আরেক মানুষকে। যার আসার কথা ছিল, এই তো সে এসেছে। স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা। আর রাজকন্যার কাছে তার স্বপ্নে দেখা রাজপুত্র।
তুমি এমন করে আমার দিকে তাকালে, এমন করে তাকিয়ে থাকলে, তোমার চোখে পলক পড়ে না, তোমার চোখের তারা একটুও কাঁপে না, নাকি কাঁপে, সেই মহান আলোয় তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমিও গেছি বিহবল হয়ে। আমিও তাকিয়ে আছি তোমার মতো করেই। গোধূলিবেলার আলোয় মগ্ন দুটি মানুষ, অনেক দূরের আকাশ সেদিন নীল, গভীর নীল। হাওয়ায় সবুজ পাতার গন্ধ, নাকি বিকালবেলায় ফুটে ওঠা কোনো ফুলের গন্ধ, গন্ধ নাকি সুবাস, পুকুরজলে আলো-ছায়ার ঝিলিমিলি খেলা। এক ঘোরলাগা প্রকৃতি। লিচুগাছগুলোর ওদিকটায় ডাকছিল দিনশেষের পাখি। দুজন মানুষ, দুজনে মগ্ন হয়ে বসে আছে মুখোমুখি।
আমি বুঝে গেলাম, আমি বুঝে গেলাম মায়া, আমার শরীর-মন বলে দিলো, তুমি আমার, আমার!
সন্ধ্যা হয়ে এলো। ফেরার সময় তুমি শুধু একটা কথা বললে, আমাকে আর তুই করে বলবে না।
পরদিন নীল কাগজে গোলাপ পাপড়ি-ছড়ানো চিঠি। সে ছিল এক অদ্ভুত চিঠি। শুধু একটি শব্দ লেখা। ভালোবাসি।
পুরো পৃষ্ঠায় শুধু ওই একটি শব্দ।
একশ একবার লেখা। ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি …
এক অনন্ত ভালোবাসায় আমরা ডুবে গেলাম।
তোমাদের বাড়ির কাজের বুয়া চিঠিটা এনে দিয়েছিল। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি। রাতের বেলা। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘুমাতে যাবো, তখন। বললাম, কী?
তা তো জানি না। আফায় দিছে।
ঠিক আছে, তুমি যাও।
বুয়া চলে যাওয়ার পর খুললাম চিঠি। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম। সারারাত কত স্বপ্ন তোমাকে নিয়ে। শুধু তোমার মুখটাই চোখ জুড়ে সারারাত। আমার হৃদয় থেকে উৎসারিত হয় রবীন্দ্রনাথের গান –
ভালোবাসি, ভালোবাসি –
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি
আমার জলে-স্থলে, আকাশে-বাতাসে, গাছের পাতায় পাতায়, আলো অন্ধকারে সর্বত্র তখন শুধু ওই একটি মাত্র শব্দ, ভালোবাসি, ভালোবাসি।
পাখির ডাকে, জোনাকির আলোয়, ভ্রমর গুঞ্জনে শুধু ওই একটিই শব্দ, ভালোবাসি, ভালোবাসি।
ঘুমে জাগরণে, স্বপ্নে স্বপ্নে শুধু ওই একটিই শব্দ, ভালোবাসি, ভালোবাসি।
আমার বেঁচে থাকায়, আমার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে ওই একটিই শব্দ, ভালোবাসি, ভালোবাসি।
আমরা বদলে গেলাম। ওই এক গোধূলিবেলা আমাদের বদলে দিলো। আমার জীবন বদলে দিলো, স্বপ্ন কল্পনা, অতীত হয়ে বর্তমানে আসা, বর্তমানে থেকে যাত্রা ভবিষ্যতে, এক মায়াবী যাত্রা শুরু হলো আমাদের। এক মায়াবী ভ্রমণ। একই বাড়ির মধ্যে থেকে, এই ঘর আর ওই ঘরের দূরত্ব, শুরু হলো আমাদের মানসভ্রমণ।
আমিও তোমাকে চিঠি লিখলাম। এক পৃষ্ঠায় বড় করে একটি মাত্র শব্দ ‘ভালোবাসি’।
বুয়াই পৌঁছে দিলো তোমাকে।
আমি বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি, তুমি আমার মুখোমুখি পড়ে গেলে। চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে, মুখের অদ্ভুত সুন্দর এক ভঙ্গি করে শুধু একটাই শব্দ বললে, কিপ্টা।
কেন বলেছিলে?
কয়েকদিন পর প্রশ্নের জবাব দিলে। আমি একশ একবার লিখেছি আর তুমি শুধু একবার।
ওই একবারই অনেক বড়।
ছাই বড়।
মনে আছে, মায়া?
তোমার এসব মনে আছে?
এত কিছুর মধ্যে থেকেও আমার তখন দিনগুলো কাটতে চায় না, রাতগুলো কাটতে চায় না। দিনের বেলা ইউনিভার্সিটি, ছাত্ররাজনীতি, স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকি। চারদিকে বন্ধুবান্ধব, রাজনৈতিক কর্মী, নেতারা। কত কাজ। ভোরবেলা বেরিয়ে ফিরি রাত করে। সবকিছুর মধ্যে থেকেও তোমার কথা ভেবে হঠাৎ হঠাৎ আনমনা হই। মনে হয় এক দৌড়ে চলে আসি বাড়িতে, তোমাকে একপলক দেখে যাই। দুয়েকদিন তোমার কলেজের ওখানে চলে গেছি। আমাকে দেখলেই তোমার চোখদুটো যে কী উজ্জ্বল হতো!
প্রেম, আমার প্রেম।
ভালোবাসা, আমার ভালোবাসা।
তারপর আমরা দুজন এমন বদলালাম, এমন হলাম একজন আরেকজনের জন্য, বাইরে আমার মন টেকে না। বন্ধুবান্ধব লেখাপড়া রাজনীতি, কিচ্ছু ভালো লাগে না। আমার সারাক্ষণ থাকতে ইচ্ছা করে তোমাদের বাড়িতে। কোনো না কোনোভাবে দেখতে ইচ্ছা করে তোমাকে। রাতে ঘুম আসে না। স্বপ্ন দেখি শুধু তোমাকে। ভাবি শুধু তোমার কথা। স্বপ্ন জাগরণ যা-ই বলো, সর্বত্র তুমি। তুমি।
তোমার অবস্থাও দেখছি তাই।
কোনো না কোনোভাবে আমার কাছাকাছি আসা। আমার দিকে তাকিয়ে থাকা, আমাকে একপলক দেখা। আর দুজন দুজনার দিকে তাকালেই কোথাও যেন বেজে ওঠে এক মোহন বাঁশি, হাওয়া যেন একটুখানি উতলা হয়, সুবাসিত হয়, আলো যেন একটু বেশি প্রখর হয়, আকাশ যেন একটু বেশি নীল, ‘অনেকদূরের ওই যে আকাশ নীল হলো, আজ তোমার সাথে আমার আঁখির মিল হলো’। গাছের পাতা যেন হয়ে ওঠে একটু বেশি সবুজ, ঘাসে যেন গ্রীষ্মকালেও পড়ে থাকে হালকা শিশির, যেন বা বেশি সতেজ হয় পায়ের তলার ঘাস। পুকুরজলে যেন হাওয়া ছাড়াই ঢেউ ওঠে। জলতরঙ্গের মতো টুংটাং শব্দ হয় কোথায়। সন্ধ্যাবেলাই যেন চাঁদ উঠে যায় পুব আকাশে। বিশাল চাঁদ। প্রখর জ্যোৎস্নায় ঝিমঝিম করে চারদিক। অন্ধকার নেই, কোথাও অন্ধকার নেই। তবু জোনাকপোকাগুলো জ্বলতে থাকে। রাতপাখি ডেকে যায় এদিক-ওদিক। আর ডাকে এক দুরন্ত কোকিল। তোমার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়, ঠিক তখুনি যেন জেগে ওঠে ঘুমন্ত কোকিল। তখুনি যেন শুরু করে ডাক।
কেন এমন হচ্ছিল?
কেন বলো তো?
প্রকৃতি যেন দুজন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের অন্তর আলোকিত করছে, ভাসিয়ে নিচ্ছে ভালোবাসার তীব্র স্রোতে।
দিনের বেলা চঞ্চল পায়ে মুহূর্তের জন্য তুমি এলে আমার ঘরে। নাকি আমি গেলাম তোমার ঘরে। একটুখানির জন্য তোমাকে দেখা। তুমি একদিন আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে …’
আমার সবদিকে তখন তোমার চোখ। আমার নাশতা খাওয়া, গোসল ঘুম সব লক্ষ করছো তুমি। আমার কখন এক কাপ চা লাগতে পারে, তুমি যেন টের পাচ্ছো। ঠিক এক কাপ চা এনে দিলে আমাকে। খালার চোখ এড়িয়ে সিগ্রেট খেতে যাই লিচুতলার দিকে, ঠিক তুমি খেয়াল করছো।
একদিন বললে, যে-জিনিস লুকিয়ে খেতে হয় তা খাওয়ার দরকার কী?
আমি হাসলাম।
শুনেছি সিগ্রেটের শেষটান নাকি প্রেমিকাকে চুমু খাওয়ার চেয়েও আনন্দের।
সঙ্গে সঙ্গে হাতের সিগ্রেট ফেলে দিলাম। শেষটান আমি দেবো না, চুমু খেতে দাও।
তুমি এমন লজ্জা পেলে, দৌড়ে চলে গেলে উঠোনের দিকে।
সেই রাতে ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা।
মায়া, কোথাও কি একটা পাখি ডাকলো?
ঘুমভাঙা পাখি?
কোনো গাছের ডালে, পাতার আড়ালে বসে একটুখানি কি ডাকলো?
আমি যেন শুনতে পেলাম!
গত ভোর থেকে, পাকিস্তানি … গুলো আর তাদের এদেশীয় চাকরবাকরগুলো, … গুলো যখন হত্যা করলো আমার
বাবাকে-মাকে, বোনকে, স্ত্রীকে, পৃথিবীর আলো দেখার অপেক্ষায় থাকা আমার সন্তানকে, পারুল কদম বারেকের মা কোথায় গেল, বল্টু কুকুরটা, মিনি বিড়ালটা, আমাদের কবুতরগুলো …। সন্ধ্যারাতের দিকে একবার যেন কাছে কোনো গাছের ডালে, নাকি দালানের কোনো আড়ালে থেকে একবার যেন, একবার যেন মৃদু একটুখানি শব্দ শুনেছিলাম কবুতরের। নাকি সেটা ছিল আমার মনের ভুল? বিভ্রম! আসলে কবুতর ডাকেনি। আমার মনে হয়েছিল ডাকছে।
হায়রে আমার মন!
হায়রে আমার দিশেহারা তছনছ হয়ে যাওয়া অন্তর!
এরকম দৃশ্য দেখার পর আমি যে বেঁচে আছি, এখনো শ্বাস নিচ্ছি, উঠোনে কবর খুঁড়ে বাবা মা বোনকে কবর দিয়েছি প্রকৃত ইসলামি নিয়মে, তিন কবরের কাজ শেষ করে, মায়া, মায়া, তোমার কবর খোঁড়ার অর্ধেক কাজ শেষ করে ক্লান্ত বিধ্বস্ত দেহমনে তোমার পাশে বসেছি একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য, তোমাকে একটু আদর করার জন্য, একটু কথা বলা তোমার সঙ্গে, তোমার গালে-মুখে একটুখানি হাত বুলানো, অনেকদিন পর তোমাকে একটুখানি ছুঁয়ে দেখা, এ কেমন করে সম্ভব হচ্ছে মায়া? কেমন করে সম্ভব হচ্ছে?
শেষ বিকালে বাড়ি ঢুকে, ক্লান্ত বিপর্যস্ত শরীর, তার ওপর এরকম দৃশ্য, আমার সব শেষ, তারপরও আমি বেঁচে আছি কেমন করে?
আমার তো দম বন্ধ হয়ে মরে যাওয়ার কথা!
আমার মাথা তো পুরো খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা!
বাবা মা বোন, ল-ভ- তুমি আর আমার সন্তান, আমার তো হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। হার্ট ফেইল করে আমার তো লুটিয়ে পড়ার কথা তোমার পাশে! আমার তো উঠে দাঁড়াবার কথা না! আমি এসব করেছি কী করে?
আমার হাত উঠে যায় মাথার কাছে। সেখানে বাঁধা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এই পতাকা আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এই পতাকা আমাকে প্রকৃত যোদ্ধার শক্তি দিয়েছে। যখনই আমি একদম ভেঙে পড়ছিলাম, শরীর মনের শক্তি হারিয়ে লুটিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম তোমাদের পাশে, তখনই আমার হাত উঠে গেছে মাথায়। স্পর্শ করেছি আমার পতাকা। মুহূর্তে শরীরে ফিরে এসেছে শক্তি, মন ঝেড়ে ফেলেছে সব আবেগ।
শেষ করতে হবে।
কাজটা আমাকে শেষ করতে হবে।
ফিরে যেতে হবে যুদ্ধক্ষেত্রে।
রাত পোহাবার কত দেরি?
কিসের শব্দ বলো তো? বাড়ির চারদিকে বর্ষার পানি। কচুরিপানা ঝোপজঙ্গল। বড় মাছ ঘাই দিলো? বোয়াল কিংবা গজার। নাকি শোল?
এই মাছগুলো তক্কে তক্কে থাকে। পাড়ের কাছে এসে ওুতপেতে থাকে। ইঁদুর কিংবা ব্যাঙ পেলেই ‘খাবলা’ দিয়ে ধরে।
তেমন কোনো মাছ ঘাই দিলো?
নাকি ইঁদুর কিংবা ব্যাঙ ধরল?
আকাশে অতিধীরে চলা চাঁদ, হাওয়া নেই, গাছপালা নিঃসাড়, সাদা মেঘ ভেসে যায় চাঁদের তলা দিয়ে। ও মেঘ, তুমি কোথায় যাও? কোন অচিন দেশে?
কীটপতঙ্গ ডাকছে। ঝিঁঝি ডাকছে। এই শব্দ আসলে শব্দ না। এই শব্দ আসলে চূড়ান্ত নৈঃশব্দ্য। চূড়ান্ত নৈঃশব্দ্যে এক যোদ্ধা তার কাজ শেষ করার অপেক্ষায়।
অনেক দূরের ওই যে আকাশ নীল হলো
আজ তোমার সাথে আমার আঁখির মিল হলো …
তোমার সঙ্গে আমার আঁখির মিল হয়েছিল কবে, মায়া?
ওই যে বিকালবেলা তুমি আমাকে পুকুরঘাটে ডেকে আনলে, তার আগে বললে, বাচ্চুকে পছন্দ করে বকুল, শুনে আমি কিন্তু খুব অবাক হইনি। আমি তো বোকা নই। বুদ্ধিসুদ্ধি কিছুটা আছে। লেখাপড়া করেছি। শিক্ষিত বাবার ছেলে। আমি কি খেয়াল করিনি স্বর্ণগ্রামের বাড়িতে, দীননাথ সেন রোডের বাড়িতে বাচ্চু এলেই তার চোখ এদিক-ওদিক ঘুরতো। কাকে খুঁজতো সেই চোখ সেটুকু বোঝার ক্ষমতা কি আমার ছিল না?
ছিল।
আমি বুঝতাম।
আমি সবই বুঝতাম।
বকুলের চঞ্চলতাও আমি বুঝতাম। বাচ্চুকে দেখলেই বোনটির মুখটা কেমন উজ্জ্বল হয়। চোখদুটো আনন্দে নাচে। হাসির শব্দও যেন বদলে যায়। বাচ্চুর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য একটু যেন জোরেই কথা বলে, একটু যেন বেশিই হাসে।
এই বয়সী ছেলেমেয়েদের কেন এমন হয়, আমি কি বুঝি না!
তবে সম্পর্ক ওদের তেমন গভীর হতে পারেনি। ওই ভালো লাগা পর্যন্তই। দুজন দুজনকে ভালোবাসে, দুজন দুজনকে চায় – সেসব মুখে কেউ কাউকে বলতে পেরেছে কিনা, বা চিঠি লেখালেখি হয়েছে কিনা জানি না।
আহা রে, আহা।
বাচ্চু জানেই না, তার বন্ধুর বোনটি, তার পছন্দের মেয়েটি, যাকে নিয়ে সে হয়তো স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল, দেশ স্বাধীন হবে, যুদ্ধ শেষ করে ফিরে এসে সে বকুলের সামনে দাঁড়াবে, হয়তো সব সংকোচ ঝেড়ে ফেলে বলবে, তোমাকে আমি চাই।
বকুল হয়তো সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিল।
বাচ্চু এখন বিলোনিয়ার ওদিকটায় যুদ্ধ করছে। জানেও না তার স্বপ্ন কীভাবে চুরমার হয়ে গেছে, ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার বোনটি হয়তো ভোরবেলার ওই সময়টায় স্বপ্ন দেখছিল তার মনের কোণে লুকিয়ে থাকা মানুষটির। হয়তো সেই মানুষটির মুখ তখন স্বপ্নের ভেতরে ছিল বকুলের চোখ জুড়ে।
আহা রে, আহা?
বাচ্চু আর আমি ছেলেবেলার বন্ধু। একই বয়সের। তাও বাচ্চুর আগে আমার সবকিছু হয়ে গিয়েছিল। খালাতো বোনের সঙ্গে প্রেম। ধুমধাম করে বিয়ে। গভীর ভালোবাসায় ডুবে সন্তানের পিতা হওয়া। সবকিছু, সবকিছুই তাড়াতাড়ি হলো। এক বন্ধু বাবা হতে চললো আরেক বন্ধু হয়তো তখনো তার ভালো লাগার মানুষটিকে, মনের মানুষটিকে বলতেই পারেনি, তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে চাই। এসো, আমার হাত ধরো!
বকুল কি নীল কাগজে গোলাপ পাপড়ি ছড়ানো চিঠি লিখতে পেরেছিল বাচ্চুকে? তুমি যেভাবে আমাকে লিখেছিলে? যেভাবে আমাকে লিখতে?
আমি লিখেছি।
আমিও তোমাকে অনেক চিঠি লিখেছি।
একই বাড়িতে থেকেও চিঠি লেখালেখি? অদ্ভুত না!
তুমি বলতে, চিঠি পড়ার আনন্দ অতুলনীয়। আমি যখন তোমাদের বাড়িতে না থাকি, তোমার চোখের সামনে না থাকি, তখন দোতলার খাটে শুয়ে শুয়ে তুমি আমার চিঠি পড়ো। একই চিঠি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বহুবার পড়ো। প্রথমে তোমার গ্রামোফোন, পরে চেঞ্জার, সেখানে গান বাজছে, লতা মুঙ্গেশকরের গান –
প্রেম একবার এসেছিল নীরবে
আমার এ দুয়ারও প্রামেত্ম
সে তো হায়, মৃদু পায় …
আমাদের প্রেম কি নীরবে এসেছিল, মায়া?
না। নীরবে আসেনি। মোটামুটি জানান দিয়েই এসেছিল। বাচ্চু আর বকুলের কথা বলতে বলতে তুমি আমাকে নিয়ে গেলে পুকুরঘাটে।
মনে আছে?
সেই অবিস্মরণীয় বিকালবেলাটির কথা তোমার মনে আছে?
তার আগে প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে আমরা একটু হাসি-আনন্দ করলাম, মজা করলাম।
এই যে চাঁদের এক টুকরো মোহন আলো এসে এখন তোমার মুখে পড়েছে, সেই বিকালে, গোধূলিবেলায় তোমার মুখে এসে পড়েছিল অসামান্য এক টুকরো আলো। ওই আলোকেই কি ‘কনে দেখা আলো’ বলে?
কনে দেখা নাকি প্রেমিকা দেখা আলো?
গভীর ভালোবাসায় মগ্ন হয়ে থাকা কোনো মুখ দেখা আলো!
কী নাম সেই আলোর?
আল্লাহপাক মানুষের পবিত্রতম মুহূর্তের জন্য কি তৈরি করেছেন ওই আলো। ঠিক ওই মুহূর্তেই কি তিনি তাঁর ওই মহান আলোটুকু পাঠান কারো জন্য? একজনের মুখে সেই আলো পড়ে, আরেকজন আলোয় ভাসা মুখখানি দেখে বুঝে যায়, এই মুহূর্তে এ-জীবন অন্যরকম হয়ে গেল। তার জন্য যে-মানুষটি নির্বাচন করা হয়েছে, এতকাল মনের রহস্যময় অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা মানুষটি এই মাত্র তার সামনে উদ্ভাসিত হয়েছে। এই তো এক মানুষ খুঁজে পেয়েছে আরেক মানুষকে। যার আসার কথা ছিল, এই তো সে এসেছে। স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা। আর রাজকন্যার কাছে তার স্বপ্নে দেখা রাজপুত্র।
তুমি এমন করে আমার দিকে তাকালে, এমন করে তাকিয়ে থাকলে, তোমার চোখে পলক পড়ে না, তোমার চোখের তারা একটুও কাঁপে না, নাকি কাঁপে, সেই মহান আলোয় তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমিও গেছি বিহবল হয়ে। আমিও তাকিয়ে আছি তোমার মতো করেই। গোধূলিবেলার আলোয় মগ্ন দুটি মানুষ, অনেক দূরের আকাশ সেদিন নীল, গভীর নীল। হাওয়ায় সবুজ পাতার গন্ধ, নাকি বিকালবেলায় ফুটে ওঠা কোনো ফুলের গন্ধ, গন্ধ নাকি সুবাস, পুকুরজলে আলো-ছায়ার ঝিলিমিলি খেলা। এক ঘোরলাগা প্রকৃতি। লিচুগাছগুলোর ওদিকটায় ডাকছিল দিনশেষের পাখি। দুজন মানুষ, দুজনে মগ্ন হয়ে বসে আছে মুখোমুখি।
আমি বুঝে গেলাম, আমি বুঝে গেলাম মায়া, আমার শরীর-মন বলে দিলো, তুমি আমার, আমার!
সন্ধ্যা হয়ে এলো। ফেরার সময় তুমি শুধু একটা কথা বললে, আমাকে আর তুই করে বলবে না।
পরদিন নীল কাগজে গোলাপ পাপড়ি-ছড়ানো চিঠি। সে ছিল এক অদ্ভুত চিঠি। শুধু একটি শব্দ লেখা। ভালোবাসি।
পুরো পৃষ্ঠায় শুধু ওই একটি শব্দ।
একশ একবার লেখা। ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি …
এক অনন্ত ভালোবাসায় আমরা ডুবে গেলাম।
তোমাদের বাড়ির কাজের বুয়া চিঠিটা এনে দিয়েছিল। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি। রাতের বেলা। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘুমাতে যাবো, তখন। বললাম, কী?
তা তো জানি না। আফায় দিছে।
ঠিক আছে, তুমি যাও।
বুয়া চলে যাওয়ার পর খুললাম চিঠি। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম। সারারাত কত স্বপ্ন তোমাকে নিয়ে। শুধু তোমার মুখটাই চোখ জুড়ে সারারাত। আমার হৃদয় থেকে উৎসারিত হয় রবীন্দ্রনাথের গান –
ভালোবাসি, ভালোবাসি –
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি
আমার জলে-স্থলে, আকাশে-বাতাসে, গাছের পাতায় পাতায়, আলো অন্ধকারে সর্বত্র তখন শুধু ওই একটি মাত্র শব্দ, ভালোবাসি, ভালোবাসি।
পাখির ডাকে, জোনাকির আলোয়, ভ্রমর গুঞ্জনে শুধু ওই একটিই শব্দ, ভালোবাসি, ভালোবাসি।
ঘুমে জাগরণে, স্বপ্নে স্বপ্নে শুধু ওই একটিই শব্দ, ভালোবাসি, ভালোবাসি।
আমার বেঁচে থাকায়, আমার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে ওই একটিই শব্দ, ভালোবাসি, ভালোবাসি।
আমরা বদলে গেলাম। ওই এক গোধূলিবেলা আমাদের বদলে দিলো। আমার জীবন বদলে দিলো, স্বপ্ন কল্পনা, অতীত হয়ে বর্তমানে আসা, বর্তমানে থেকে যাত্রা ভবিষ্যতে, এক মায়াবী যাত্রা শুরু হলো আমাদের। এক মায়াবী ভ্রমণ। একই বাড়ির মধ্যে থেকে, এই ঘর আর ওই ঘরের দূরত্ব, শুরু হলো আমাদের মানসভ্রমণ।
আমিও তোমাকে চিঠি লিখলাম। এক পৃষ্ঠায় বড় করে একটি মাত্র শব্দ ‘ভালোবাসি’।
বুয়াই পৌঁছে দিলো তোমাকে।
আমি বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি, তুমি আমার মুখোমুখি পড়ে গেলে। চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে, মুখের অদ্ভুত সুন্দর এক ভঙ্গি করে শুধু একটাই শব্দ বললে, কিপ্টা।
কেন বলেছিলে?
কয়েকদিন পর প্রশ্নের জবাব দিলে। আমি একশ একবার লিখেছি আর তুমি শুধু একবার।
ওই একবারই অনেক বড়।
ছাই বড়।
মনে আছে, মায়া?
তোমার এসব মনে আছে?
এত কিছুর মধ্যে থেকেও আমার তখন দিনগুলো কাটতে চায় না, রাতগুলো কাটতে চায় না। দিনের বেলা ইউনিভার্সিটি, ছাত্ররাজনীতি, স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকি। চারদিকে বন্ধুবান্ধব, রাজনৈতিক কর্মী, নেতারা। কত কাজ। ভোরবেলা বেরিয়ে ফিরি রাত করে। সবকিছুর মধ্যে থেকেও তোমার কথা ভেবে হঠাৎ হঠাৎ আনমনা হই। মনে হয় এক দৌড়ে চলে আসি বাড়িতে, তোমাকে একপলক দেখে যাই। দুয়েকদিন তোমার কলেজের ওখানে চলে গেছি। আমাকে দেখলেই তোমার চোখদুটো যে কী উজ্জ্বল হতো!
প্রেম, আমার প্রেম।
ভালোবাসা, আমার ভালোবাসা।
তারপর আমরা দুজন এমন বদলালাম, এমন হলাম একজন আরেকজনের জন্য, বাইরে আমার মন টেকে না। বন্ধুবান্ধব লেখাপড়া রাজনীতি, কিচ্ছু ভালো লাগে না। আমার সারাক্ষণ থাকতে ইচ্ছা করে তোমাদের বাড়িতে। কোনো না কোনোভাবে দেখতে ইচ্ছা করে তোমাকে। রাতে ঘুম আসে না। স্বপ্ন দেখি শুধু তোমাকে। ভাবি শুধু তোমার কথা। স্বপ্ন জাগরণ যা-ই বলো, সর্বত্র তুমি। তুমি।
তোমার অবস্থাও দেখছি তাই।
কোনো না কোনোভাবে আমার কাছাকাছি আসা। আমার দিকে তাকিয়ে থাকা, আমাকে একপলক দেখা। আর দুজন দুজনার দিকে তাকালেই কোথাও যেন বেজে ওঠে এক মোহন বাঁশি, হাওয়া যেন একটুখানি উতলা হয়, সুবাসিত হয়, আলো যেন একটু বেশি প্রখর হয়, আকাশ যেন একটু বেশি নীল, ‘অনেকদূরের ওই যে আকাশ নীল হলো, আজ তোমার সাথে আমার আঁখির মিল হলো’। গাছের পাতা যেন হয়ে ওঠে একটু বেশি সবুজ, ঘাসে যেন গ্রীষ্মকালেও পড়ে থাকে হালকা শিশির, যেন বা বেশি সতেজ হয় পায়ের তলার ঘাস। পুকুরজলে যেন হাওয়া ছাড়াই ঢেউ ওঠে। জলতরঙ্গের মতো টুংটাং শব্দ হয় কোথায়। সন্ধ্যাবেলাই যেন চাঁদ উঠে যায় পুব আকাশে। বিশাল চাঁদ। প্রখর জ্যোৎস্নায় ঝিমঝিম করে চারদিক। অন্ধকার নেই, কোথাও অন্ধকার নেই। তবু জোনাকপোকাগুলো জ্বলতে থাকে। রাতপাখি ডেকে যায় এদিক-ওদিক। আর ডাকে এক দুরন্ত কোকিল। তোমার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়, ঠিক তখুনি যেন জেগে ওঠে ঘুমন্ত কোকিল। তখুনি যেন শুরু করে ডাক।
কেন এমন হচ্ছিল?
কেন বলো তো?
প্রকৃতি যেন দুজন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের অন্তর আলোকিত করছে, ভাসিয়ে নিচ্ছে ভালোবাসার তীব্র স্রোতে।
দিনের বেলা চঞ্চল পায়ে মুহূর্তের জন্য তুমি এলে আমার ঘরে। নাকি আমি গেলাম তোমার ঘরে। একটুখানির জন্য তোমাকে দেখা। তুমি একদিন আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে …’
আমার সবদিকে তখন তোমার চোখ। আমার নাশতা খাওয়া, গোসল ঘুম সব লক্ষ করছো তুমি। আমার কখন এক কাপ চা লাগতে পারে, তুমি যেন টের পাচ্ছো। ঠিক এক কাপ চা এনে দিলে আমাকে। খালার চোখ এড়িয়ে সিগ্রেট খেতে যাই লিচুতলার দিকে, ঠিক তুমি খেয়াল করছো।
একদিন বললে, যে-জিনিস লুকিয়ে খেতে হয় তা খাওয়ার দরকার কী?
আমি হাসলাম।
শুনেছি সিগ্রেটের শেষটান নাকি প্রেমিকাকে চুমু খাওয়ার চেয়েও আনন্দের।
সঙ্গে সঙ্গে হাতের সিগ্রেট ফেলে দিলাম। শেষটান আমি দেবো না, চুমু খেতে দাও।
তুমি এমন লজ্জা পেলে, দৌড়ে চলে গেলে উঠোনের দিকে।
সেই রাতে ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা।
মায়া, কোথাও কি একটা পাখি ডাকলো?
ঘুমভাঙা পাখি?
কোনো গাছের ডালে, পাতার আড়ালে বসে একটুখানি কি ডাকলো?
আমি যেন শুনতে পেলাম!
গত ভোর থেকে, পাকিস্তানি … গুলো আর তাদের এদেশীয় চাকরবাকরগুলো, … গুলো যখন হত্যা করলো আমার
বাবাকে-মাকে, বোনকে, স্ত্রীকে, পৃথিবীর আলো দেখার অপেক্ষায় থাকা আমার সন্তানকে, পারুল কদম বারেকের মা কোথায় গেল, বল্টু কুকুরটা, মিনি বিড়ালটা, আমাদের কবুতরগুলো …। সন্ধ্যারাতের দিকে একবার যেন কাছে কোনো গাছের ডালে, নাকি দালানের কোনো আড়ালে থেকে একবার যেন, একবার যেন মৃদু একটুখানি শব্দ শুনেছিলাম কবুতরের। নাকি সেটা ছিল আমার মনের ভুল? বিভ্রম! আসলে কবুতর ডাকেনি। আমার মনে হয়েছিল ডাকছে।
হায়রে আমার মন!
হায়রে আমার দিশেহারা তছনছ হয়ে যাওয়া অন্তর!
এরকম দৃশ্য দেখার পর আমি যে বেঁচে আছি, এখনো শ্বাস নিচ্ছি, উঠোনে কবর খুঁড়ে বাবা মা বোনকে কবর দিয়েছি প্রকৃত ইসলামি নিয়মে, তিন কবরের কাজ শেষ করে, মায়া, মায়া, তোমার কবর খোঁড়ার অর্ধেক কাজ শেষ করে ক্লান্ত বিধ্বস্ত দেহমনে তোমার পাশে বসেছি একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য, তোমাকে একটু আদর করার জন্য, একটু কথা বলা তোমার সঙ্গে, তোমার গালে-মুখে একটুখানি হাত বুলানো, অনেকদিন পর তোমাকে একটুখানি ছুঁয়ে দেখা, এ কেমন করে সম্ভব হচ্ছে মায়া? কেমন করে সম্ভব হচ্ছে?
শেষ বিকালে বাড়ি ঢুকে, ক্লান্ত বিপর্যস্ত শরীর, তার ওপর এরকম দৃশ্য, আমার সব শেষ, তারপরও আমি বেঁচে আছি কেমন করে?
আমার তো দম বন্ধ হয়ে মরে যাওয়ার কথা!
আমার মাথা তো পুরো খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা!
বাবা মা বোন, ল-ভ- তুমি আর আমার সন্তান, আমার তো হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। হার্ট ফেইল করে আমার তো লুটিয়ে পড়ার কথা তোমার পাশে! আমার তো উঠে দাঁড়াবার কথা না! আমি এসব করেছি কী করে?
আমার হাত উঠে যায় মাথার কাছে। সেখানে বাঁধা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এই পতাকা আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এই পতাকা আমাকে প্রকৃত যোদ্ধার শক্তি দিয়েছে। যখনই আমি একদম ভেঙে পড়ছিলাম, শরীর মনের শক্তি হারিয়ে লুটিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম তোমাদের পাশে, তখনই আমার হাত উঠে গেছে মাথায়। স্পর্শ করেছি আমার পতাকা। মুহূর্তে শরীরে ফিরে এসেছে শক্তি, মন ঝেড়ে ফেলেছে সব আবেগ।
শেষ করতে হবে।
কাজটা আমাকে শেষ করতে হবে।
ফিরে যেতে হবে যুদ্ধক্ষেত্রে।
রাত পোহাবার কত দেরি?
কিসের শব্দ বলো তো? বাড়ির চারদিকে বর্ষার পানি। কচুরিপানা ঝোপজঙ্গল। বড় মাছ ঘাই দিলো? বোয়াল কিংবা গজার। নাকি শোল?
এই মাছগুলো তক্কে তক্কে থাকে। পাড়ের কাছে এসে ওুতপেতে থাকে। ইঁদুর কিংবা ব্যাঙ পেলেই ‘খাবলা’ দিয়ে ধরে।
তেমন কোনো মাছ ঘাই দিলো?
নাকি ইঁদুর কিংবা ব্যাঙ ধরল?
আকাশে অতিধীরে চলা চাঁদ, হাওয়া নেই, গাছপালা নিঃসাড়, সাদা মেঘ ভেসে যায় চাঁদের তলা দিয়ে। ও মেঘ, তুমি কোথায় যাও? কোন অচিন দেশে?
কীটপতঙ্গ ডাকছে। ঝিঁঝি ডাকছে। এই শব্দ আসলে শব্দ না। এই শব্দ আসলে চূড়ান্ত নৈঃশব্দ্য। চূড়ান্ত নৈঃশব্দ্যে এক যোদ্ধা তার কাজ শেষ করার অপেক্ষায়।
No comments